//
//

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে পাথুরিয়াঘাটা নাট্যশালার অবদান আলোচনা কর।

পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়

বিদ্বজ্জন, ধনী ও নাট্য উৎসাহী মহারাজ যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের পাথুরিয়াঘাটার রাজবাড়িতে বঙ্গনাট্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে। যতীন্দ্রমোহনের খুল্লতাত প্রসন্নকুমার ঠাকুর ১৮৩১ খ্রিস্টাব্দে হিন্দু থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে বাঙালি ধনীর বাড়িতে নাট্যাভিনয়ের প্রচলন করেন। যতীন্দ্রমোহনও বাংলা নাটকের অভিনয়ের অন্যতম উদ্যোগী ছিলেন। বেলগাছিয়া নাট্যশালার তিনি পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বাঙালি ছাত্রদের ইংরেজি নাট্যাভিনয় থেকে সরিয়ে এনে তিনি ওরিয়েন্টাল থিয়েটারের অভিনেতাদের রামজয় বসাকের নাট্যশালায় এবং বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে নিয়ে আসেন বাংলা নাটক অভিনয়ের জন্য। তিনি নিজেও নাট্যরচনা ও নাট্যসঙ্গীত রচনায় পারদর্শী ছিলেন। ছোটখাট দু-একটি ভূমিকাতেও তিনি অভিনয় করেছিলেন।

বেলগাছিয়া নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তিনি নিজের পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গনাট্যালয় প্রতিষ্ঠার আগেই তাদের আদিবাড়িতে গোপীমোহন ঠাকুরের নাচঘরে তার ভাই শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সহযোগিতায় একটি ছোট রঙ্গমঞ্চ ছিল। সেখানে কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্রম্’ নাটকের বাংলা অনুবাদ ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে অভিনীত হয়েছিল। পরের বছর দ্বিতীয়বার অভিনয় হয়।

যতীন্দ্রমোহনের প্রতিষ্ঠিত বঙ্গনাট্যালয় বড় আকারের এবং স্থায়িত্বের দিক দিয়ে দীর্ঘকালীন ছিল। এখানে অনেকগুলি নাটকের অনেকদিন ধরে অভিনয় হয়েছিল। এখানে দর্শকাসন ছিল দুশোরও বেশি। দর্শকদের মধ্যে থাকতেন তাঁর বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন ও সম্ভ্রান্ত দেশী-বিদেশী অতিথিবর্গ।

পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ে প্রথম অভিনীত হয় ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’ নাটকাকারে, ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর। নাট্যরূপ দেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর স্বয়ং। সেই রাত্রে একই সঙ্গে অভিনীত হয় রামনারায়ণের প্রহসন ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’। ‘বিদ্যাসুন্দর’ ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ৬ জানুয়ারি, দ্বিতীয়বার অভিনয় হয়। বিদ্যাসুন্দরের দুটি অভিনয়েই রেওয়ার মহারাজা উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয় অভিনয়ের পর তিনি সন্তুষ্ট হয়ে প্রত্যেককে একটি করে শাল ও সকলকে একসঙ্গে তিন হাজার টাকা দেন।

বিদ্যাসুন্দর অভিনয়ের মঞ্চসজ্জা, দৃশ্যপট, গীতবাদ্য এবং অভিনয় খুবই চিত্তাকর্ষক হয়েছিল। অভিনয়ে বিশেষ করে, মদনমোহন বর্মণ (বিদ্যা), কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় (হীরা মালিনী), রাধাপ্রসাদ বসাক (রাজা বীরসিংহ), হরিমোহন কর্মকার (মন্ত্রী), গিরিশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (গঙ্গা ভাট) সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এঁরা ছাড়া অভিনয়ে ছিলেন—মহেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (সুন্দর), হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (ধূমকেতু), নারায়ণচন্দ্র বসাক (বিমলা), যদুনাথ ঘোষ ও হরকুমার গঙ্গোপাধ্যায় (সুলোচনা, চপলা), ব্রজদুর্লভ দত্ত (প্রহরী), অমরনাথ চট্টোপাধ্যায় (প্রতিহারী) প্রমুখ।

‘বিদ্যাসুন্দর’ এবং ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’—দুটির একসঙ্গে অভিনয় নয় দশবার হয়েছিল। ১৮৬৬-এর জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পাঁচবার অভিনয়ের খবর পাওয়া যায়।

এখানে ‘বুঝলে কিনা’ নামে ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখা একটি প্রহসনের অভিনয় ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ ডিসেম্বর অভিনীত হয়। কলকাতায় দলপতিদের দলাদলি ও চক্রান্তের মুখোশ খুলে দেবার চেষ্টাতেই প্রহসনটি এই রঙ্গালয়ের জন্য লেখা হয়েছিল। এরও দৃশ্যপট, গীতবাদ্য এবং অভিনয় সকলকে পরিতৃপ্ত করেছিল। অভিনয় দেখতে উপস্থিত দলপতিদের মুখের ভাব ও মানসিক অবস্থা কীরকম হয়েছিল তার বর্ণনা পাওয়া যায় ‘বেঙ্গলী’ পত্রে (২২ ডিসেম্বর, ১৮৬৬)।

তারপর এখানে অভিনীত হয় রামনারায়ণের করা ভবভূতির সংস্কৃত নাটক ‘মালতীমাধব’-এর অনুবাদ—১৪ জানুয়ারি, ১৮৬৯। এই বছরেই ৫, ৬ এবং ১৯ ফেব্রুয়ারি ‘মালতীমাধব’ নাটকের পুনরভিনয় হয়। রামনারায়ণের আত্মকথা থেকে জানা যায় যে, ‘মালতীমাধব’ এই মঞ্চে দশ-এগার বার অভিনীত হয়েছিল।

তারপর অভিনীত হলো কালিদাসের ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’-এর বাংলা অনুবাদ। সঙ্গে রামনারায়ণের লেখা আরো দুটি প্রহসন—‘চক্ষুদান’ ও ‘উভয়সঙ্কট’—২৬শে ফেব্রুয়ারি, ১৮৭০।

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে এই রঙ্গালয়ে সাময়িকভাবে অভিনয় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৭২-এর ১৩ জানুয়ারি আবার অভিনয় শুরু হয় ‘রুক্মিণীহরণ’ ও ‘উভয়সঙ্কট’ দিয়ে। দুটিই রামনারায়ণের লেখা। রুক্মিণীহরণের অভিনয়ও বেশ কয়েকবার হয়েছিল।

এরপরে এখানে অভিনয় প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৭৩-এর ২৫ ফেব্রুয়ারি বড়লাট লর্ড নর্থব্রুক পাথুরিয়াঘাটা রাজবাড়ির অতিথি হলে তার সম্মানে ‘রুক্মিণীহরণ’ ও ‘উভয়সঙ্কট’ আবার অভিনয় করা হয়। প্রচুর গণ্যমান্য ইংরেজ পুরুষ ও মহিলা এবং দেশীয় সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গের সামনে এই নাটক দুটির অভিনয়ের সময় ইংরেজি সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হয়েছিল।

১৮৭৩-এ আবার নাট্যশালাটি বন্ধ হয়ে যায়। অনেকদিন পরে ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে পুনরায় চালু হলে শৌরীন্দ্রমোহনের লেখা ছোট দৃশ্যকাব্য ‘রসাবিষ্কারকবৃন্দ’ অভিনীত হয়।

যতীন্দ্রমোহনের প্রচেষ্টায় তাঁর বাড়ির বঙ্গনাট্যালয় শুধুমাত্র তাদের বাড়ির নাট্যালয় হয়ে ছিল না। সেকালের জ্ঞানীগুণী, রাজা-মহারাজা এবং শিক্ষিত বাঙালি এখানে নাট্যাভিনয় এবং নাটক অভিনয়ের সহযোগী ও দর্শক হিসেবে সদাসর্বদাই আসা-যাওয়া করেছেন। বাংলা থিয়েটার ও অভিনয়ের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ সাধারণ রঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার (১৮৭২) প্রাক্-মুহূর্তে যতীন্দ্রমোহনের এই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা লিখেছিল যে, পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয় রাজাদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হলেও, তাদের বদান্যতায় এটি একটি জাতীয় প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে।

এই রঙ্গমঞ্চে রামনারায়ণের একাধিক অনুবাদ, মৌলিক নাটক এবং প্রহসনের অভিনয় হয়েছিল। প্রহসন তিনখানি রচনা করে তিনি মহারাজার কাছে পুরস্কৃত হয়েছিলেন। সেই সময়ে প্রায় সব সখের নাট্যশালার সঙ্গেই রামনারায়ণের যোগাযোগ ছিল। তিনি এই নাট্যশালাগুলির জন্য অকাতরে অনুবাদ, মৌলিক পূর্ণাঙ্গ নাটক ও প্রহসন রচনা করে দিয়েছিলেন। পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ে রামনারায়ণের সবচেয়ে বেশি অনুবাদ, মৌলিক নাটক ও প্রহসনের অভিনয় হয়েছে। সে যুগের সবচেয়ে আদৃত নাট্যকার রামনারায়ণ যে ‘নাটুকে’ আখ্যা পেয়েছিলেন, তার মূলে পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ের অবদান স্বীকার্য।

স্টেজ-নির্মাণ, মঞ্চব্যবস্থা, দৃশ্যপট অঙ্কন, গীতবাদ্য ও অভিনয় সব দিকেই এই নাট্যালয় কুশলতা প্রদর্শন করেছে। কিন্তু নাটকের ক্ষেত্রে নতুন যুগের ভাবনায় অগ্রবর্তী হতে পারেনি। বাংলা নাটকের যে অবশ্যম্ভাবী নতুন পরিবর্তন ক্ৰমে ঘটে চলেছিল মধুসূদন দীনবন্ধুর হাতে এবং দু’এক বছরের মধ্যেই সাধারণ রঙ্গালয়ে নাটকের যে পটপরিবর্তন হতে চলেছে—তা ধরবার মানসিকতা বা অনুপ্রেরণা যতীন্দ্রমোহন বা তাঁর বঙ্গানাট্যালয়ে অভিনেয় নাটকগুলির মধ্যে ছিল না। সেখানে বিদ্যাসুন্দরের কাহিনী, পৌরাণিক কাহিনী কিংবা সংস্কৃত নাটকের অনুবাদ এবং সমাজ সমস্যামূলক ব্যঙ্গ বিদ্রুপের প্রহসনের বাইরে তারা যেতে পারেননি। তবুও বাংলা নাটক অভিনয়ের ধারাকে দীর্ঘকাল সঞ্জীবিত রেখে এবং উন্নতমানের মঞ্চব্যবস্থায় উন্নত ধরনের অভিনয় প্রদর্শন করে বঙ্গনাট্যালয় সখের নাট্যশালার ইতিহাসে উজ্জ্বল কৃতিত্ব রেখে গেছে।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ের অবদান

পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গনাট্যালয়ের কৃতিত্বগুলি সূত্রাকারে বলা যেতে পারে—

  • সখের নাট্যশালাগুলির মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী নাট্যমঞ্চ।
  • এই নাট্যশালাতেই একমাত্র নিয়মিত ও ধারাবাহিক নাট্যাভিনয় হয়েছে।
  • নাট্যকার রামনারায়ণের বেশির ভাগ নাটক ও অনুবাদ এই মঞ্চের জন্যই লেখা।
  • দেশীয় ঐকতানবাদনের বৈশিষ্ট্য; শৌরীন্দ্রমোহনের ‘কনসার্ট” সে সময়ে খুবই বিখ্যাত হয়েছিল।
  • ‘হিন্দু পেট্রিয়ট” পত্রিকা এই রঙ্গালয়কে জাতীয় নাট্যশালার মর্যাদা দিতে চেয়েছিল এর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও ধারাবাহিক অভিনয়ের জন্য।
  • যতীন্দ্রমোহনের আত্মীয় অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফি এই মঞ্চের অভিনয় ও রঙ্গমঞ্চ ব্যবস্থা দেখে নিজের নাট্যানুশীলনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করে ছিলেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। এই অর্ধেন্দুশেখর পরবর্তী ন্যাশনাল থিয়েটার ও সাধারণ বঙ্গালয় প্রতিষ্ঠার প্রধানতম ঋত্বিক।
  • নাটকের ক্ষেত্রে কোনো নতুনতর ভাবনা আনতে না পারলেও, এই মঞ্চের নাট্যোপস্থাপনার গুণে সব নাটকই চিত্তাকর্ষক হয়ে উঠেছিল।
  • এই রঙ্গালয়ের উদ্যোক্তা যতীন্দ্রমোহন শুধু এই থিয়েটারের জন্যই নয়, তখনকার উল্লেখযোগ্য প্রায় সব সখের নাট্যশালাগুলির সঙ্গেই উপদেষ্টা ও সাহায্যকারী হিসেবে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
  • এই রঙ্গালয় পাথুরিয়াঘাটার প্রাসাদ ছাড়িয়ে বহু মানুষকে আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!