পূর্বরাগের কাকে বলে? এই পর্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবির কৃতিত্ব আলোচনা কর।

পূর্বরাগ

সংজ্ঞা

শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘উজ্জ্বলনীলমণি’ গ্রন্থে পূর্বরাগের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন—

রতির্যা সংগমাৎ পূর্বং দর্শনশ্রবণাদিজা

তয়োরুন্মীলতি প্রাজ্ঞৈ পূর্বরাগ স উচ্যতে।।

অর্থাৎ যে রতি প্রকৃত মিলনের আগে দর্শন ও শ্রবণাদির দ্বারা উৎপন্ন হয়ে নায়ক-নায়িকার হৃদয়কে উন্মীলিত করে তাকে পূর্বরাগ বলে।

শ্রেণিবিভাগ

পূর্বরাগ দুই ভাগে বিভক্ত— ১) দর্শনজাত, ২) শ্রবণজাত। দর্শনজাত পূর্বরাগ তিনভাবে ঘটতে পারে— প্রত্যক্ষ দর্শন, স্বপ্নে দর্শন এবং চিত্রে দর্শন। শ্রবণজাত অনুরাগ পাঁচভাবে হতে পারে— দূতিমুখে, বন্দীমুখে, সখীমুখে, সংগীতাদি থেকে এবং বংশীধ্বনি শ্রবণে।

পূর্বরাগ অবস্থার সঞ্চারীভাব হল— ব্যাধি, শঙ্কা, অসূয়া, শ্রম, ক্লম, নির্বেদ, ঔৎসুক্য, দৈন্য, চিন্তা, জাগরণ, বিষাদ, জড়তা, উন্মাদ, মোহ এবং মৃত্যু। কৃষ্ণবিষয়ক রতির সাদারণী, সমঞ্জসা এবং সমর্থার বিভাগ অনুসারে পূর্বরাগের তিনটি ভাগ— সাধারণ, সমঞ্জসা এবং প্রৌঢ়। এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ প্রৌঢ়—পূর্বরাগের প্রধান দশটি সঞ্চারীভাব— লালসা, উদ্বেগ, জাগরণ, তানব (কৃশতা), জড়িমা, বৈয়গ্র (ব্যগ্রতা), ব্যাধি, উন্মাদ, মোহ এবং মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে পূর্বরাগ ‘দশা’ রূপ লাভ করে।

পূর্বরাগের শ্রেষ্ঠ কবি চণ্ডীদাস

চণ্ডীদাস নিঃসন্দেহে শ্ৰীমতী রাধার পূর্বরাগ পর্যায়ের প্রধানতম কবি। কিন্তু অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর মতে, চণ্ডীদাসের রাধা পূর্বরাগ পর্যায়েই যোগিনীতে পরিণত হন। কৃষ্ণের জন্য তার ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা ভক্তের আবেগ ব্যাকুলতার কথাই মনে করিয়ে দেয়। চণ্ডীদাস সাধারণভাবে দেহনির্ভর প্রেমের কবি নন। সম্ভবত সেই কারণেই তার মিলন পর্যায়ের কোকো পদ নেই। কিন্তু তার পূর্বরাগের পদে রাধা কৃষ্ণের শরীর সান্নিধ্যের জন্যও আর্ত ব্যাকুল হয়ে পড়েন। পূর্বরাগ পর্যায়ে তাঁর শ্রেষ্ঠ পদগুলির মধ্যে অন্যতম হল, ‘সই কেবা শুনাইল শ্যাম নাম’ শীর্ষক পদটি। এই পদে পূর্বরাগ পর্যায়েই কৃষ্ণনাম জপ করতে করতে রাধার সর্বাঙ্গ অবশ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে তিনি এও ভাবেন যে, শ্যামের নামের প্রতাপেই যদি এই তাহলে কৃষ্ণের অঙ্গস্পর্শে রাধার কি হবে। কৃষ্ণকে দেখে রাধার পক্ষে যুবতীধর্ম রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে।

পদটির প্রথমার্ধে রাধার যে আত্মসমাহিত ভাব, পরবর্তী অংশের দেহচেতনা তাকে খণ্ডিত করেছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। কিন্তু নাম শ্রবণে পূর্বরাগের পর শ্রীরাধার নামজপ-বিহ্বলতা এবং পরবর্তী অংশে অঙ্গস্পর্শজনিত আনন্দের কল্পনা কোনও মতেই বিসদৃশ নয়। পদটি চৈতন্য-পূর্ববর্তী কালে রচিত কিনা এ নিয়ে যে সন্দেহ এবং পদটির ওপর শ্রীরূপ গোস্বামীর পদাবলীর একটি শ্লোকের প্রভাব সম্পর্কিত অনুমান মোটেই সঙ্গত নয়। এটিকে চৈতন্য-পূর্ব চণ্ডীদাসের পদ হিসেবে গ্রহণ করতে কোনও বাধাই নেই। পদটির শেষে রাধা বলেন, তিনি কৃষ্ণের কথা ভুলতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু তবুও ভুলতে পারছেন না। এখন তিনি কি করবেন, তার উপায় কি হবে? এই নিরূপায় যন্ত্রণাই চণ্ডীদাসের রাধার বৈশিষ্ট্য।

‘রাধার কি হৈল অন্তরে ব্যথা’ শীর্ষক পদটিতে চণ্ডীদাস যে রাধাকে এঁকেছেন তিনি সাধিকা যোগিনী। পূর্বরাগের আধারে এখানে যেন শ্রীরাধা আত্মনিবেদনের যোগসাধনাই করেছেন। এই রাধা কৃষ্ণকে হয়তো চকিতের জন্য দর্শন করেছেন, আর তাতেই সারা বিশ্বের সমস্ত শ্যামলসৌন্দর্য তার চোখে কৃষ্ণময় হয়ে গেছে। রাধা আহার ছেড়েছেন, নীলাম্বরীর পরিবর্তে তার পরিধেয় হয়েছে গৈরিক বস্তু। এইভাবে যোগিনী রূপধারিণী রাধা একদৃষ্টে মেঘের দিকে তাকিয়ে আছেন ধ্যাননিমগ্ন তন্ময়তায়। তার দুটি চোখের তারা পর্যন্ত স্থির। শ্যামল মেঘে কৃষ্ণের রূপদর্শনে রাধার এই বিমুগ্ধ আত্মবিস্মৃতি পূর্বরাগের তীব্র মিলন-অভীপ্সার উন্মাদনাকে বিন্দুমাত্র ফুটিয়ে তোলেনি। সাধিকার একাগ্রতাকেই পরিপূর্ণভাবে রূপায়িত করেছে।

রাধা তার বেণী উন্মোচিত করে কালো কুন্তলের দিকে তাকিয়ে দেখেন। আবার কখনো ময়ূর-ময়ূরীর কণ্ঠবর্ণ একদৃষ্টে নিরীক্ষণ করেন। এই অপরূপ পূর্বরাগ মানবীর বলে মনে হয় না। আবার কখনো মেঘের দিকে তাকিয়ে দুহাত তুলে রাধা হাসিমুখে কি যেন বলেন। অর্থাৎ মেঘকেই কৃষ্ণ ভেবে রাধা তার সঙ্গে কথা বলতে যান। এই চেষ্টাই বুঝিয়ে দিচ্ছে, কৃষ্ণের বর্ণসুষমার সঙ্গে সাদৃশ্যযুক্ত বলেই শুধু রাধা এই বস্তুগুলিকে দেখছেন না। এগুলিকেই তিনি কৃষ্ণ বলে মনে করছেন। তাই মেঘের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা। এই পদে চণ্ডীদাস যেন ভালবাসার আধ্যাত্মিক উৎকণ্ঠার একটি অবিস্মরণীয় ছবি এঁকেছেন। রাধা এখানে পরিণত হয়েছে যথার্থ সাধিকায়। যে কৃষ্ণ একবারের জন্য দেখা দিয়েছেন, কিন্তু ধরা দেননি, তাকে পাওয়ার জন্য একাগ্রচিত্তা যোগিনীর এই ধ্যানতন্ময়তা যেন কুমারসম্ভবের উমার চন্দ্রশেখর লাভের তপস্যা।

এই পদটির প্রেরণা অবশ্য চণ্ডীদাসের সম্পূর্ণ নিজস্ব নয়। কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়ে, সদুক্তিকর্ণামৃতে, সাহিত্যদর্পণে এবং পরবর্তীকালে শ্রীরূপের পদ্যাবলীতে উদ্ধৃত একটি শ্লোকের সঙ্গে পদটির ভাবসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। শ্লোকটিতে পূর্বরাগের নায়িকার যোগিনীরূপের পরিচয় আছে সত্য, কিন্তু চণ্ডীদাস তার পদে নবপ্রেমমুগ্ধা আত্মবিস্মৃতা রাধার আচরণের যে বর্ণনা দিয়েছেন, তা অনেক বেশি কাব্যগুণান্বিত। বিশেষ করে এক আত্মবিস্মৃতা মুগ্ধা নায়িকার কুন্তল আলুলায়িত করে তার মধ্যে প্রিয়রূপ দর্শনের তন্ময় বিহুলতা শিল্পীর তুলিতে আঁকা অমর চিত্রের মতোই আমাদের মর্মলোকে চিরকালের মতোই মুদ্রিত হয়ে যায়। চণ্ডীদাস শুধু মরমীয়া কবি নন, তিনি মহাকবিও বটে। তাই যে প্রেমের আবেগকে সর্বতোভাবে বাইরে প্রকাশ করতে না পারার অতৃপ্ত ব্যাকুলতায় প্রেমিক-প্রেমিকা উদ্ভান্ত হয়ে যায়, কবি তাকে ছবির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলেন। পূর্বোক্ত শ্লোকটিতে ভাব আছে, চিত্র নেই। চণ্ডীদাসের পদে ভাব ও চিত্র পার্বতী-পরমেশ্বরের মতো অদ্বয় সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে এই পদটিকে সাহিত্যে শ্রেষ্ঠ পূর্বরাগের পদ করে তুলেছে।

কিন্তু পূর্বরাগের পদে চণ্ডীদাস শুধু সাধিকা রাধার ধ্যান-তন্ময়তা আর নামজপ-বিহ্বলতাকেই ফুটিয়ে তোলেননি, সেই সঙ্গে রাধার ব্যাকুল উৎকণ্ঠা এবং কৃষ্ণকে দেখার জন্য, কৃষ্ণের সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য তার আবেগময় অস্থিরতার পরিচয়ও দিয়েছেন। ঘরের বাহিরে দণ্ডে শতবার শীর্ষক পদটিতে আমরা সেই রাধারই পরিচয় পাই। রাধা বারবার ঘরের বাইরে আসেন, তার মন অস্থির। নিঃশ্বাস দ্রুত। তিনি বারবার কদম্বকাননের দিকে দৃষ্টিপাত করেন। সখিরা ভেবেছে, রাধার ওপর হয়তো বা কোনও দেবতার ভর হয়েছে। তিনি তাই সবসময়ই চঞ্চলা। গুরুজনদেরও ভয় পাচ্ছেন না। তাঁর বসনাঞ্চল অসম্বৃত। অঙ্গের ভূষণও তিনি একবার পরেন, একবার খোলেন। তার এই অস্থিরতায় সখিরাও চিন্তিত।

তাদের মনে হচ্ছে রাধা যেন চাদে হাত বাড়াচ্ছেন, অর্থাৎ কোনও দুষ্প্রাপ্য বস্তু চাইছেন। চণ্ডীদাসের সাধিকা রাধার এই তীব্র অস্থিরতাই বুঝিয়ে দেয়, কৃষ্ণসান্নিধ্যলাভের জন্য তার ব্যাকুলতা কি অপরিমেয়। প্রিয়ের চোখে নিজেকে মনোহর করে তোলার সচেতনতাও এখানে রাধার মধ্যে লক্ষণীয়। তাঁর অসম্বৃত বসনাঞ্চলে, ভূষণ গ্রহণ বর্জনের পৌনঃপুনিকতায় সেই সচেতনতারই ইঙ্গিত দেয়। রাধার দেহ-মনের এই চাঞ্চল্য সখিদের কাছেও অভাবিত। তাই তারা যে কিছুটা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন, ‘হাত বাঢ়ালইল চাদে’-র প্রবাদ ব্যবহারে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

মনোজগতের কথা চণ্ডীদাসের কাব্যে বেশি করে উচ্চারিত হলেও, দেহও তাঁর কাব্যে পুরোপুরি বাদ পড়েনি। শরীর এবং মনের এমন স্বাভাবিক সমম্বয় উত্তরকালে এক জ্ঞানদাস ছাড়া অন্য কোনও পদকর্তার মধ্যে দেখা যায় না। পারিবারিক এবং সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে রাধা এখানে সম্পূর্ণ নির্বিকার এবং তাতেই শুভাকাঙ্ক্ষিণী সখিদের আশঙ্কা আরও বেড়েছে। এই পূর্বপশ্চাৎবিবেচনাহীন প্রেম পূর্বরাগ পর্যায়েরই। পরবর্তীকালে রাধার গভীর আত্মস্থ প্রেম মন থেকে সামাজিক পরিবেশকে মুছে ফেলতে পারেনি। কিন্তু এখানে পূর্বরাগের উন্মাদনাময় অস্থির চাঞ্চল্য, প্রেমের প্রথম আবেগের তীব্র আলোড়ন রাধাকে সব কিছুই ভুলিয়ে দিয়েছে। তাই চণ্ডীদাস এই পদে যথার্থই হয়ে উঠেছেন প্রেম মনস্তত্ত্বের সুনিপুণ রূপকার।

পূর্বরাগ পর্যায়ে শ্রীরাধার বিচিত্র প্রতিক্রিয়া কখনো কখনো রাধার নিজেরই মুখে উচ্চারিত হয়েছে। ‘কাহারে কহিব মনের মরম’ শীর্ষক পদটিতেই রাধা তার হৃদয়ের গভীর কৃষ্ণপ্রেমের প্রতিক্রিয়া ব্যাখ্যা করার দায়িত্ব নিজেই বহন করেছেন। চণ্ডীদাসের পদাবলীর সমস্ত পর্যায়েই ছড়িয়ে আছে কৃষ্ণপ্রেমের জন্য রাধা-হৃদয়ের ব্যাকুল আর্তি আর যন্ত্রণা। সামন্ত-সমাজের পটভূমিতে এক বাঙালি গৃহবধূর গণ্ডিবদ্ধ জীবনের নিরুপায় বন্দিত্বে, পরিবার-পরিজনের অরণ্যে একাকিনী রাধা কখনো প্রেমের বেদনায়, কখনো গৌরবে, আর কখনো বা নিজের দ্বিধান্দোলিত সত্তার ব্যাকুলতায় ব্যথাদীর্ণ। চণ্ডীদাসের সমগ্র পদাবলী যেন সেই রাধার হৃদয় নিংড়ানো অশ্রুবিন্দু দিয়ে গাঁথা মুজমালা, ধূসর গোধূলির ম্লান বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন।

পূর্বরাগের এই পদটিতেও সেই রাধারই প্রেমের বেদনা উচ্চারিত। কৃষ্ণপ্রেম রাধার জীবনের চরম আনন্দের ও পরম বেদনার। তার সেই বেদনাকে প্রকাশ করার মতো কাউকেই তিনি খুঁজে পান না। তার ভয় হয়, হৃদয়ের গভীরে নিহিত মর্মবেদনা হয়তো বা বাহিরেই প্রকাশ হয়ে যাচ্ছে। গুরুজনদের সামনে তিনি দাঁড়াতে পারেন না। কারণ কৃষ্ণকে না দেখতে পাওয়ার বেদনায় তার দুটি আঁখি সবসময়েই জলে ভরে থাকে। আবার কৃষ্ণকে দেখার আনন্দময় পূর্বস্মৃতিতে রাধা সব দিকেই কৃষ্ণকে দেখেন। সখির সঙ্গে যমুনায় তিনি জল আনতে যান। কিন্তু যমুনার কালো জলের ঔজ্জ্বল্য তাকে কৃষ্ণের কথা মনে করিয়ে দেয়। আবার এও হতে পারে যমুনার জলে অপেক্ষমান কৃষ্ণেরই ছায়া পড়েছে। তাই কৃষ্ণকে সেই প্রত্যক্ষ দেখার আনন্দ সম্পর্কে রাধা শুধু এই বলেন, সেই রূপকে তিনি কথায় প্রকাশ করতে পারবেন না— ‘‘সে কথা কহিবার নয়।’’ সব শেষে রাধা বলছেন— ‘‘কুলের ধরম রাখিতে নারিনু কহিলুঁ সবার আগে।’’

এই কথাটির ভিতর দিয়ে রাধা যেন নিজের দোষস্খালন করে নিরুপায়ত্বটুকুই বোঝাতে চাইছেন। চণ্ডীদাসের পদের নিরাভরণ সারল্য আর সেই সারল্য সুষমায় লাবণ্যময়ী রাধার পদটিকে অসাধারণ সৌন্দর্যময়ী করে তুলেছেন। বিদ্যাপতি, গোবিন্দদাস এমনকি জ্ঞানদাসের পূর্বরাগের পদেও প্রেমানুভবের যে আনন্দোচ্ছ্বল প্রবল তরঙ্গ চঞ্চলতা লক্ষ করা যায়, এখানে। তা অনুপস্থিত। অথচ শান্ত, নম্র ঘোষণায় রাধার গভীরতম প্রেমের স্তরপারম্পর্যও এখানে উন্মোচিত। এই বেদনা মাধুরী চণ্ডীদাসের একান্তই নিজস্ব। এখানেই তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!