প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার
৬ নং বিডন স্ট্রিট, কলকাতা
উদ্বোধন: ১ জানুয়ারি, ১৮৮১
স্থায়িত্বকাল: ১ জানুয়ারি, ১৮৮১ – ডিসেম্বর, ১৮৮৫
প্রতিষ্ঠাতা: প্রতাপচাঁদ জহুরি
প্রথম নাটক: হামীর (সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার)
বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে যে ন্যাশনাল থিয়েটারের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার সেটি নয়। বাগবাজারের যুবকেরা উদ্যোগী হয়ে ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করে এদেশে সাধারণ রঙ্গালয়-এর সূত্রপাত করেছিল। ধনীর শখ-শৌখিনতা থেকে বাংলা মঞ্চকে মুক্ত করে সর্বসাধারণের সামনে রঙ্গালয়ে অভিনয় শুরু করেছিল। টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা থাকলেও সেটি কিন্তু পুরোপুরি পেশাদার থিয়েটার ছিল না। বাণিজ্যিক থিয়েটার তো নয়ই। প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটার পুরোপুরি পেশাদারি থিয়েটার এবং বাণিজ্যিক থিয়েটার। বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে দুই ন্যাশনাল থিয়েটারের মৌল চরিত্রগত ফারাকটুকু মনে রেখেই আলোচনা করতে হবে।
অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের ফাঁসে আটকে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার শেষ পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। মালিক ভুবনমোহন নিয়োগী তাঁর গ্রেট ন্যাশনালকে লীজ দিলেন গিরিশচন্দ্রকে। গিরিশ পালটে নাম রাখলেন ন্যাশনাল থিয়েটার। তারপরে ক্রমে হাতবদল হতে হতে, বেশ কয়েকজন স্বত্বাধিকারীকে সর্বস্বান্ত করে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়ি শেষ পর্যন্ত নিলামে উঠল। দ্বারকানাথ দেব, কেদার চৌধুরী, গোপীচাঁদ শেঠি, কালিদাস মিত্র প্রমুখ অনেক চেষ্টা করেও গ্রেট ন্যাশনালকে চালু রাখতে পারলেন না।
গ্রেট ন্যাশনাল নিলামে উঠলে প্রতাপচাঁদ ২৫ হাজার টাকায় কিনে নিলেন। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে। অবাঙালি ব্যবসাদার প্রতাপাচাঁদ জহুরি গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়িতে চালু করলেন ন্যাশনাল থিয়েটার। এই প্রথম একজন পাকাপোক্ত ব্যবসায়ি বাংলা রঙ্গালয়ের মালিক হলেন। তার আগে বেঙ্গল থিয়েটারের শরৎচন্দ্র ঘোষ কিংবা গ্রেট ন্যাশনালের ভুবনমোহন নিয়োগী—পুরোপুরি ব্যবসাদার ছিলেন না। বা বলা যেতে পারে, একেবারে পাকাপোক্ত ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে রঙ্গমঞ্চের মালিকানা ও পরিচালনার দায়িত্ব নেননি। প্রথমে ছিল নাটক অভিনয় করা এবং অভিনয়ের উন্মাদনা ভোগ করা। তারপরে শখ শৌখিনতা এবং সবশেষে আর্থিক লেনদেনের ব্যবসা। যদিও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শেষেরটি গৌণ হয়ে পড়েছিল।
কিন্তু প্রতাপচাঁদ ঝানু ব্যবসায়ী। তাঁর অন্যত্র জহরতের দোকান এবং অন্য নানাধরনের ব্যবসা ছিল। সে দেখেছিল, অন্যান্য ব্যবসায়ের মতো বাংলা থিয়েটারেও ভালো ব্যবসা করা যায়। টাকা লগ্নি করা এবং ঠিকমত পরিচালনার মাধ্যমে সেই লগ্নীকৃত টাকা ফেরৎ আনা—মূলধন বিনিয়োগের মাধ্যমে বেশি করে মুনাফা লোটাব্যবসায়ের এই সাধারণ সূত্র তিনি থিয়েটারে প্রয়োগ করলেন। তিনি দেখেছিলেন, লোকে থিয়েটার দেখে পয়সা দিয়ে। তাদের উৎসাহিত করে থিয়েটারে বেশি বেশি আনতে পারলে টিকিট বিক্রি বেশি হবে। ফলে লগ্নীকৃত মূলধন সহজেই বহুগুণ হয়ে ফিরে আসবে।
কিন্তু উৎপাদন ব্যবস্থাটিকে শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে, আগের অনেক মালিকের মতোই তাঁকেও লোকসান দিয়ে ব্যবসা চালাতে হবে। তাই একটি নিয়মবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের মতো তিনি থিয়েটারের প্রত্যেকটি ব্যক্তিকে শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখলেন। কর্মচারীদের নির্দিষ্ট বেতন, হাজিরা খাতা, আয়-ব্যয়ের হিসেব—সবই পেশাদারিভাবে চালু করলেন। এই নিয়মের আওতা থেকে কারো রেহাই ছিল না, সে অভিনেতা-অভিনেত্রী, ম্যানেজার, নাট্যকার কিংবা দারোয়ান, যেই হোক না কেন।
এই থেকেই বাংলা থিয়েটারে পাকাপাকিভাবে পেশাদারি থিয়েটার বা ব্যবসায়িক থিয়েটার তার প্রথাসিদ্ধ পথ খুঁজে পেলো। মালিকানাধীন এবং মুনাফাভিত্তিক পরিচালনার মধ্যে দিয়ে বাংলা রঙ্গালয়ের নতুন যুগ শুরু হয়ে গেল। পূর্ববর্তী সাধারণ রঙ্গালয়গুলির মধ্যে এই পেশাদারিত্ব কিংবা বাণিজ্যিক মওবৃত্তি এত প্রখরভাবে ছিল না। প্রতাপাচাঁদ বাংলা থিয়েটারে সেটিই যথাযথভাবে চালু করলেন।
ব্যবসা পরিচালনার নিয়মনীতি এবং শৃঙ্খলা থিয়েটারে প্রয়োগ করা হলো। রঙ্গালয়ের ভিতর ও বাইরে এই প্রথম নিয়মশৃঙ্খলা প্রবর্তিত হলো। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের মতো থিয়েটারও একটি প্রতিষ্ঠান—এর ভালোমন্দ, লাভ-লোকসান সবই নির্ভর করে তার সুষ্ঠ ও যথাযথ পেশাদারি প্রথা, মনোভাব ও প্রয়োগের ওপর।
এইরকম একটি থিয়েটার-প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য একজন যোগ্য ম্যানেজারের দরকার। তিনি জানলেন, সেই সময়ে থিয়েটারে গিরিশচন্দ্র সেই যোগ্যতম ব্যক্তি। গিরিশ তখন পার্কার কোম্পানীতে ১৫০ টাকার চাকুরি করেন। তাঁকে ১০০ টাকা বেতন দিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারের ম্যানেজার করে আনা হলো। সঙ্গে বাড়তি বোনাস। গিরিশ চাকুরি ছেড়ে এই প্রথম থিয়েটারকে তাঁর জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করলেন। বাংলা নাটকে ‘এমেচারিস’ গিরিশ এই প্রথম পুরোপুরি ‘প্রোফেশনাল’ হলেন।
প্রতাপচাঁদ ও গিরিশচন্দ্রের যোগাযোগের ফলে পেশাদার বাংলা থিয়েটারের ভিত্তিটি মজবুত হলো। এই দুজনে মিলে পেশাদার থিয়েটার পরিচালনার যে সব নিয়মনীতি চালু করলেন, পরবর্তী বহুদিন সেই ধারাই বাংলা থিয়েটারে চলে এসেছে। বাধাবন্ধহীন উচ্ছৃঙ্খলতায় বাংলা থিয়েটার যখন ভেসে যেতে বসেছিল, যাকে অভিনেত্রী বিনোদিনী বলেছেন ‘অশুভ গ্রহ’, সেই সময়ে এই দুজনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দৃঢ়বদ্ধ নিয়মনীতি প্রায় একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনার মতো করে বাংলা থিয়েটারকে রক্ষা করেছিল।
প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটারে যোগ দিয়ে গিরিশ তাঁর পুরনো ন্যাশনাল থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জড়ো করলেন। ধর্মদাস সুর, মহেন্দ্রলাল বসু, অমৃতলাল বসু, মতিলাল সুর, অমৃতলাল মুখোপাধ্যায়, সঙ্গীতাচার্য রামতারণ সান্যাল, অমৃতলাল মিত্র, ক্ষেত্ৰমণি, কাদম্বিনী, লক্ষ্মীমণি, নারায়ণী, বিনোদিনী, বনবিহারিণী সবাইকে এনে অভিনয়ের দলটিকে গড়ে তুললেন।
১৮৮১ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি মহাসমারোহে প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটারের উদ্বোধন হলো সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের লেখা নাটক ‘হামীর’ দিয়ে। মাইকেল টড-এর রাজস্থানবিষয়ক ইতিহাসের গ্রন্থ থেকে বিষয় নিয়ে নাটকটি লেখা। গিরিশ এতে নিজের লেখা চারটি গান যুক্ত করেন। অভিনয়ে ছিলেন: হামীর—গিরিশচন্দ্র, নায়িকা লীলা—বিনোদিনী। এই নাটকটি তেমন সাড়া ফেলতে পারলো না। তেমন দর্শক আগমনও হলো না। প্রতাপচাঁদ চিন্তিত হয়ে ভালো নাটকের জন্য বিজ্ঞাপন দিলেন। থিয়েটারের হ্যান্ডবিলের নিচে ভালো নাটকের জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হতে থাকল। ভালো নাটকের খোঁজ চলল, ভালো নাটক হাতের কাছে নেই, অথচ রঙ্গমঞ্চও বিনা নাটকে বসে থাকতে পারে না, অভিনেতা-অভিনেত্রী থেকে থিয়েটারের সবাইকে মাইনে দিতে হবে—তাই তাদের বসিয়ে রাখা যায় না, তাতে আর্থিক ক্ষতি। তখন একান্ত দায়ে পড়ে ম্যানেজার গিরিশ নাটক রচনা শুরু করলেন। এর আগে আগমনী, অকালবোধন, দোললীলা নামে গীতিনাট্যগুলি লিখেছিলেন, কিন্তু সেগুলি অকিঞ্চিৎকর। পুরো নাটক গিরিশ এর আগে লেখেননি। অন্যের নাটক সম্পাদনা করেছেন, ভালো ভালো নাটক পড়েছেন, অভিনয় করেছেন, ভালো অভিনয় দেখেছেন, কিন্তু নাট্যকার হওয়ার জন্যে কখনোই সেভাবে কলম ধরেননি। এবারে ধরতে হল। গিরিশ তাঁর কারণ বলতে গিয়ে বলেছেন, তিনি নাটক রচনা আরম্ভ করেছিলেন‘‘দায়ে পড়ে’—out of sheer necessity. যখন মাইকেল, বঙ্কিম, প্রায় সব dramatized করা শেষ হলো, স্টেজে আর কোনও অভিনয়োপযোগী নাটক মিললো না, তখন বাধ্য হয়েই নাটক রচনা করতে হলো।
বাংলা থিয়েটারে নাট্যকার হিসেবে গিরিশের আবির্ভাব হলো। একেবারে মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত থেকে, মঞ্চের উপযোগী করে নাটক রচনা করলেন। ইংরেজিতে এইরকম নাটক রচনাকারদের প্লে-রাইট (Play Wright) বলে।
গিরিশ লিখলেন মোহিনী প্রতিমা ও মায়াতরু। অভিনীত হল নাটক দুটি—১৮৮১-এর ২২ জানুয়ারিতে মায়াতরু এবং ৯ এপ্রিলে মোহিনী প্রতিমা। মায়াতরুও গীতিনাট্য। এটি অনেকেরই প্রশংসা পায়। বঙ্কিমচন্দ্র এই নাট্য-উপস্থাপনা দেখে খুশি হয়ে প্রশংসা করেছিলেন। মোহিনী প্রতিমা প্রেমের উচ্চভাব ও আদর্শে রচিত বলে সাধারণ স্তরের দর্শকের আনুকূল্য পায়নি। যদিও পত্র-পত্রিকা খুবই প্রশংসা করেছিল।
এবারে আরব্য উপন্যাস থেকে কাহিনী নিয়ে লিখলেন ‘আলাদীন’, ৯ এপ্রিল অভিনীত হলো। এই নাটকে গিরিশ কুহকীর ভূমিকায় অভিনয়ে এবং রামতারণ সান্যাল আলাদীনের ভূমিকায় নাচে গানে মাতিয়ে দিলেন।
সেই সময়ে অন্য মঞ্চে ঐতিহাসিক নাটকের জনপ্রিয়তা লক্ষ করে গিরিশ তাড়াতাড়ি লিখে ফেললেন ‘আনন্দরহো’ নামে ইতিহাসের বিষয় নিয়ে রোমান্সধর্মী নাটক। পূর্ণাঙ্গ নাটক হিসেবে ‘আনন্দরহো’ গিরিশের প্রথম রচনা। অভিনীত হলো ২১ মে, ১৮৮১। এই নাটকে বেতালের ভূমিকায় অভিনয়ে গিরিশ নতুন ভাবনার সঞ্চার করেছিলেন। বেতালের মধ্যে গুরুতন্ত্রসাধনা ও ইচ্ছাশক্তির (will force) ভাব রয়েছে। সুখদুঃখের সমভাব, সদানন্দ, নিঃস্বার্থ ও পরোপকারী চরিত্র বেতালের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। পরবর্তী নাটক শ্রীবৎস চিন্তায় ‘বাতুল’, ভ্রান্তিতে ‘রঙ্গলাল’, ছত্রপতি শিবাজীতে ‘গঙ্গাজী’, অশোকে ‘আকাল’—এই একই ভাবনায় রচিত হয়েছিল।
‘আনন্দরহো’ সাড়ম্বরে অভিনীত হলেও, নাটকটি সমাদৃত হলো না। বোঝাই যাচ্ছে প্রথম নাটক লেখবার জন্য আসরে নেমে গিরিশ নানাদিক সন্ধান করছেন সাফল্যের জন্য। শুধু নাটক লিখলেই চলবে না, সেই নাটককে অভিনয় শিক্ষা দিয়ে মঞ্চস্থ করতে হবে, এবং দর্শক আনুকূল্য পেতে হবে। গিরিশের তাই বিভিন্ন দিকে অনুসন্ধান। কিন্তু তখনো বুঝতে পারছেন না—কোন ধরনের নাটক চলবে।
এবারে গিরিশ রচনা করলেন রাবণবধ। রামায়ণ অবলম্বন করে পৌরাণিক নাটক। প্রতাপচাঁদের থিয়েটারে অভিনীত হলো ৩১ জুলাই, ১৮৮১। রাতারাতি বিপুল জনপ্রিয়তা দেখা গেল এই নাটকের অভিনয়ে: রাম—গিরিশ, সীতা—বিনোদিনী, লক্ষ্মণ—মহেন্দ্রলাল বসু, রাবণ—অমৃতলাল মিত্র। •
‘রাবণবধ’ অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গেই ন্যাশনাল থিয়েটারের কপাল খুলে গেল। বাঙালি ধর্মাশ্রিত। ধর্মাশ্রয়ী জাতির মর্মাশ্রয়ী নাটক লিখতে গেলে যে পুরাণই ভরসা এবং সেই পুরাণের কাহিনীর মধ্যে যুগোপযোগী ভক্তিরসের ধর্মপ্লাবন বইয়ে দিতে হবে—গিরিশ তা অনুধাবন করলেন। বুঝতে পারলেন মালিক প্রতাপচাঁদও।
ম্যানেজার ও অভিনেতা হিসেবে এতদিন গিরিশ প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। ‘রাবণবধ’ থেকেই তিনি নাট্যকাররূপেও খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। এবারে ন্যাশনাল থিয়েটারে দর্শক সমাগম শুরু হলো। অভিনেত্রী বিনোদিনী তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন—‘‘রাবণবধ-এর পর হইতে থিয়েটারে লোকের স্থান সঙ্কুলান হইত না।’’
এই নাটকেই অভিনয়ের সুবিধের জন্য, বিশেষ করে অভিনেত্রীদের সুবিধের কথা মাথায় রেখেই গিরিশ অমিত্রাক্ষর ছন্দকে ভেঙে ‘ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দে’ সংলাপ লিখলেন। পরবর্তীকালে যা ‘গৈরিশ ছন্দ’ নামে প্রচলিত হয়ে খ্যাতিলাভ করেছে। এর আগে মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্যে’র নাট্যরূপ দিতে গিয়ে গিরিশ অমিত্রাক্ষর ছন্দকে ভেঙে সরল করে সংলাপ তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। রাজকৃষ্ণ রায়ের উৎসাহ তিনি পেয়েছিলেন। কেননা, রাজকৃষ্ণ রায় এর আগেই এই চেষ্টা করেছিলেন। প্রবহমানতা, উচ্চারণের সুবিধে এবং মুখস্থ করা সহজতর বলে অভিনেত্রীবৃন্দ সহজেই এই ছন্দকে গ্রহণ করে নিতে পারলেন। ঠাকুর বাড়ির ভারতী পত্রিকায় (মাঘ, ১২৮৮) গৈরিশ ছন্দের প্রশংসা করা হলো। অক্ষয়চন্দ্র সরকারও স্বীকার করলেন যে, এতদিনে নাটকের ভাষা সৃজিত হয়েছে।
দর্শক আনুকূল্যে উৎসাহিত গিরিশ এবার রামায়ণ ধরে ধরে কাহিনী নিয়ে নাটক লিখতে লাগলেন। তারপরে মহাভারত। এইভাবে বাঙালি-দর্শকের রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনীর প্রতি আগ্রহকে সম্বল করে তিনি ধর্মভাব নাটকগুলিতে ছড়িয়ে দিতে লাগলেন।
‘রাবণবধে’র পর ‘সীতার বনবাস’ (১৭ সেপ্টেম্বর, ১৮৮১)। বনবাসিনী সীতার অশ্রুজল বাঙালি মহিলাদেরও থিয়েটারে নিয়ে আসতে শুরু করলো। এর আগে বাংলা রঙ্গালয়ে ভদ্রঘরের মহিলাবৃন্দ দর্শক হিসেবে ততো আসতেন না। থিয়েটারের পরিবেশও তখন তার উপযুক্ত ছিল না। তাছাড়া বারাঙ্গনা অভিনেত্রীসহ অভিনয়, থিয়েটারের দর্শকদের বেলেল্লাপনা ইত্যাদি কারণে শিক্ষিত ও রুচিসম্পন্ন মানুষেরা সহসা রঙ্গমঞ্চে যেতেন না, তেমনি ভদ্রমহিলারাও আসতেন না। গিরিশের ‘সীতার বনবাস’ এই নতুন দর্শকদের মঞ্চাভিমুখী করে তুলে বাংলা নাট্যশালায় একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটিয়ে তুললো। অহীন্দ্র চৌধুরী লিখেছেন—‘‘সীতার বনবাসই প্রথম বাংলার মা-জননীদের নাট্যশালায় অভিনয় দর্শনে আগমনের জন্য সমস্ত দ্বিধা-সংকোচের দ্বার উন্মুক্ত করে দিল।(নাট্য বিবর্ধনে গিরিশচন্দ্র)
এই ব্যাপারে প্রতাপচাঁদের ভূমিকাও নগণ্য নয়। তিনি দ্রুত মহিলাদের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে দিলেন। এবং দর্শকদের বেলেল্লাপনা বন্ধ করার জন্য কড়া হাতে ব্যবস্থা নিলেন। তিনি বুঝেছিলেন এই মহিলা দর্শকেরাই তাঁর ব্যবসায়ের ‘মা-লক্ষ্মী’। সীতার বনবাসের ভূমিকালিপি: রাম—গিরিশ, সীতা—কাদম্বিনী, লক্ষ্মণ—মহেন্দ্রলাল বসু, বাল্মীকি—অমৃতলাল মিত্র, লব—বিননাদিনী, কুশ—কুসুমকুমারী (খোড়া)। গিরিশের রাম চরিত্রের অভিনয় সকলকে মুগ্ধ করল। এবং লব-কুশের অভিনয় ও গান লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। সঙ্গীত রচয়িতা গিরিশেরও প্রতিষ্ঠা হলো।
গিরিশের নতুন নাটক রচনার অবসরে অভিনীত হল অমৃতলাল বসুর ‘তিল-তর্পণ’ (২১ সেপ্টেম্বর)। অমৃতলাল নিজে বাপ্পারাও-এর ভূমিকায় অনবদ্য অভিনয় করলেন। গিরিশ এতদিনে মহাভারত ধরেছেন, মহাভারত থেকে লিখলেন ‘অভিমন্যু বধ’। অভিনীত হল ২৬ নভেম্বর। যুধিষ্ঠির ও দুর্যোধন এই দুটি ভূমিকায় গিরিশ নিজে অভিনয় করলেন। শ্রীকৃষ্ণ ও দ্রোণাচার্য হলেন কেদার চৌধুরী, ভীম ও গর্গ হলেন অমৃত মিত্র, অর্জুন ও জয়দ্রথ মহেন্দ্রলাল বসু। অভিমন্যু চরিত্রে অমৃতলাল মুখখাপাধ্যায় এবং উত্তরা বিনোদিনী। গিরিশ নাটকটির ঘটনা বিন্যাস ও চরিত্র নির্মাণ এমনভাবে করলেন যাতে একই অভিনেতা একাধিক চরিত্রে অভিনয় করতে পারেন। ফলে নাটকটি অভিনয় করতে কম অভিনেতার প্রয়োজন। ব্যবসাদার প্রতাপচাঁদের সাহচর্যে নাট্যকার গিরিশচন্দ্র কি মিতব্যয়ি হয়ে পড়েছিলেন!
‘অভিমন্যুবধ’ জনসমাদর লাভ করতে পারলো না। প্রতাপচাঁদ নাট্যশিল্পের দিক দিয়ে নয়, তাঁর ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে লক্ষ করেছিলেন, ‘সীতার বনবাস’ নাটকটির সাফল্যের মূলে শুধু পুরাণ বা ধর্ম নয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল লব-কুশের গান। বিনোদিনী ও কুসুমকুমারী, এই দুজনের অভিনয় ও গান দর্শকদের মাতিয়ে দিয়েছিল। তাই ‘অভিমন্যুবধ’ ব্যর্থ হলে প্রতাপাচাঁদ গিরিশকে ডেকে বলেছিলেন—“বাবু, যব দুসরা কিতাব লিখগে তব ফির ওহি দুনো লেড়কা ছোড় দেও’—অর্থাৎ যে নাটকই লেখ না কেন, ঐ দুনো লেড়কা লব-কুশকে মঞ্চে এনে ছেড়ে দিতে হবে। নাটকে দর্শক আকর্ষণের মূল কেন্দ্রটি কোথায় ঝানু জহুরি প্রতাপচাঁদ ধরতে পেরেছিলেন। নাট্যশিল্প বোঝার প্রয়োজন তাঁর ছিল না।
মহাভারত থেকে গিরিশ ফিরে এলেন রামায়ণে লব-কুশের সন্ধানে। তিনি লিখলেন ‘লক্ষ্মণবর্জন’। লক্ষ্মণবর্জন এবং ধীবর ও দৈত্য দুটি নাটক একসঙ্গে অভিনীত হল (৩১ ডিসেম্বর)। কিন্তু ব্যর্থ হলো সব প্রচেষ্টা। ১৮৮২-তে পরপর অভিনীত হল রামের বনবাস (১১ মার্চ), সীতার বিবাহ (১৫ এপ্রিল), সীতাহরণ (২২ জুলাই), মলিনামালা (১৬ সেপ্টেম্বর)। সবকটি নাটকই গিরিশের লেখা। ফাঁকে ফাঁকে পুরনো নাটক সীতার বনবাস, রাবণবধ এবং ভোটমঙ্গল (১৪ অক্টোবর) নামে হাল্কা প্রহসন অভিনীত হল। লর্ড রিপনের বড়লাট থাকাকালীন মিউনিসিপ্যালিটিতে ‘লোকাল সেলফ গভর্নমেন্ট’ চালু হওয়াতে যে ভোটপর্ব চলছিল, তা নিয়ে রঙ্গাত্মক প্রহসন ভোটমঙ্গল। এইসব অভিনয়ের মধ্যে সীতার বিবাহ এবং মলিনামালা গীতিনাট্য কিছুটা জনসমাদর লাভ করেছিল। অন্যগুলি ব্যর্থ হয়েছিল। সীতার বিবাহ অভিনয়ে মঞ্চাধ্যক্ষ ধর্মদাস সুর মঞ্চে আরেকটি রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে জনকের রাজসভার অভিনয় দেখিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
১৮৮২ সাল ভাল গেল না ন্যাশনাল থিয়েটারের; প্রতাপাচাঁদ ও গিরিশেরও খারাপ সময়। এর মধ্যে দিয়ে ১৮৮২ শেষ হও। ১৮৮৩-র গোড়াতেই (১৩ জানুয়ারি) ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’ অভিনীত হল। গিরিশের মহাভারতকেন্দ্রিক নাটকটি বিপুল জনসমাদর লাভ করলো। রাবণবধের জনপ্রিয়তাকেও ছাড়িয়ে গেল। কীচক ও দুর্যোধনের ভূমিকায় গিরিশের অভিনয় সবার প্রশংসা অর্জন করল। দ্রৌপদীবেশী বিনোদিনী, অর্জুনরূপী—মহেন্দ্র বসু, ভীম অমৃত মিত্র খুব আকর্ষণীয় অভিনয় করলেন। নাট্যগ্রন্থনে ও চরিত্র দ্বন্দ্বে এই নাটকটি গিরিশের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ নাটক—পাঠ্য এবং অভিনেয়, দুদিক দিয়েই।
‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাসে’র বিপুল জনসমাদর গিরিশকে নাট্যকার, অভিনেতা ও নাট্যপরিচালক হিসেবে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। ব্যবসায়িক থিয়েটারের ভাগ্যও খুলে যায়।
কিন্তু প্রতাপচাঁদের সঙ্গে গিরিশের মতার শুরু হয় এই সময় থেকেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীর মাইনে ও সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করেন গিরিশ। প্রতাপচাঁদ তা নাকচ করে দেন। তাছাড়া প্রতাপাচাঁদ নিয়মনীতির আরো কড়াকড়ি করতে চান। তা অনেকের পক্ষে বিশেষ করে গিরিশের পক্ষে ফাঁস বলে মনে হয়েছিল। অভিনেত্রীদের প্রতি প্রতাপচাঁদের দুর্ব্যবহার গিরিশকে ক্ষুব্ধ করেছিল। বিনোদিনী কয়েকদিন কামাই করলে তার মাইনে কাটারও চেষ্টা করেন প্রতাপচাঁদ। এমন কি, অনেকক্ষেত্রে প্রতাপাচাঁদ তার সীমা লঙ্ঘন করে গিরিশের ওপরও মাতব্বরি করতেন। গিরিশ ক্রমশ ক্রুদ্ধ হচ্ছিলেন। প্রতাপচাঁদের সঙ্গে মনোমালিন্যের এগুলি কারণ। তার ওপর প্রতাপচাঁদ ব্যবসায়ী হলেও কৃপণ ছিলেন। প্রচুর অর্থলাভ করলেও তিনি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের কোনো সুযোগ-সুবিধা বা মাইনে বাড়াতে চাননি। তার ওপরে তিনি বাঙালিদেরও খুবই অপছন্দ করতেন। গিরিশ অপমানিতও হন।
গিরিশের সঙ্গে প্রতাপচাঁদের মনোমালিন্য মতান্তরে পরিণত হয়। গিরিশ ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে দিলেন। তাঁর সঙ্গে বেশির ভাগ অভিনেতা-অভিনেত্রীও এই থিয়েটার ত্যাগ করেন। অমৃত মিত্র, অঘোরনাথ পাঠক, উপেন্দ্র মিত্র, বিনোদিনী, কাদম্বিনী, ক্ষেত্ৰমণি, নীলমাধব চক্রবর্তী প্রমুখ সকলেই সম্পর্ক ছিন্ন করেন। ন্যাশনাল থিয়েটারে গিরিশ ও তাঁর সহযোগীদের শেষ অভিনয় রাবণবধ, ১৮৮৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি।
গিরিশের সঙ্গে সদলে বেরিয়ে এসে এরা কিছুদিন ‘ক্যালকাটা স্টার কোম্পানী’ নামে একটি দল তৈরি করে বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে অভিনয় করেন। তারপরে গুর্মুখ রায়ের টাকায় বিনোদিনীর আনুকূল্যে ও সকলের উৎসাহ ও আগ্রহে বিডন স্ট্রিটে তৈরি হলো স্টার থিয়েটার, ২১ জুলাই, ১৮৮৩।
প্রতাপাচাঁদ এতে ক্ষুণ্ন হলেও অবদমিত হলেন না। তিনি ন্যাশনাল থিয়েটার অব্যাহত গতিতে চালিয়ে যেতে লাগলেন। কেদারনাথ চৌধুরীকে ম্যানেজার করে আনলেন। ১৮৮৩-তে ৭ মে, কেদার চৌধুরীর নাট্যরূপ দেওয়া ‘আনন্দমঠ’ অভিনীত হলো। এই সময়ে অর্ধেন্দুশেখর এখানে যোগ দেন। তাছাড়া গিরিশরা চলে গেলেও যে কয়েকজন তখনো এখানে ছিল তারা অভিনয় করতে থাকেন। মহেন্দ্র বসু, রামতারণ সান্যাল, অমৃত মিত্র, ধর্মদাস সুর, বনবিহারিণী (ভূনি) প্রমুখ কেদারনাথের অধ্যক্ষতায় আনন্দমঠে অভিনয় করলেন। মহাপুরুষরূপে অর্ধেন্দুশেখর এবং মহেন্দ্র চরিত্রে মহেন্দ্রলাল বসু উচ্চাঙ্গের অভিনয় করেন। তা সত্ত্বেও আনন্দমঠ সমাদৃত হলো না। পরবর্তী অভিনয় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বপ্নময়ী (১৫ সেপ্টেম্বর)। আগে লেখা ও অভিনীত হয়ে যাওয়া এই নাটকটি নিয়ে ন্যাশনাল ভাগ্য পরীক্ষা করল। আওরঙ্গজেবের রাজত্বকালে রাজা শোভা সিংহের বিদ্রোহ অবলম্বনে এই নাটকটি এক সময়ে বেঙ্গল থিয়েটারে সমাদৃত হয়েছিল। কিন্তু এখানে সাফল্যলাভ করলো না। তা সত্ত্বেও কিছু অভিনয় চললো। কেদার চৌধুরীর ছত্রভঙ্গ (দুর্যোধনের উরুভঙ্গ), রাজসূয় যজ্ঞ প্রভৃতি অভিনীত হল। কিন্তু কোনোদিক দিয়েই সুবিধে করা গেল না।
প্রতাপচাঁদ এবারে ন্যাশনাল থিয়েটার ছেড়ে দিলেন। ‘লেসি’ হয়ে থিয়েটারের ভার আবার গ্রহণ করলেন ভুবনমোহন নিয়োগী ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে, স্ত্রীর বকলমে। তিনিও কেদার চৌধুরীকে ম্যানেজার রাখলেন। কেদার চৌধুরী এবারে রবীন্দ্রনাথের ‘বৌঠাকুরানীর হাট’ উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় করলেন, ৩ জুলাই, ১৮৮৬। তার আগে অভিনেতা পণ্ডিত হরিভূষণ ভট্টাচার্যের ‘কুমারসম্ভব’ অভিনয় করেছিল। এই নাটকটি অভিনয় নৈপুণ্যে ও চমকপ্রদ দৃশ্যকৌশলে দর্শকদের তৃপ্ত করেছিল।
এরপরে প্রতাপচাঁদ ও ভুবনমোহনের মামলা শুরু হয়। ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়ি (সাবেক গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের বাড়ি) নিলামে ওঠে। হাতিবাগানের স্টার থিয়েটার আড়াই হাজার টাকায় এটি কিনে নেন এবং থিয়েটার বাড়িটি ভেঙ্গে ফেলা হয়। এইসব দরজা, জানলা, আসবাব প্রভৃতি নিয়ে সেগুলি তাদের নবনির্মিত স্টার থিয়েটারের কাজে লাগানো হয়। ন্যাশনাল তথা গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার নিশ্চিহ্ন হলো। পরে এই জমিতেই গড়ে ওঠে মিনার্ভা থিয়েটার।
প্রতাপচাঁদ জহুরির ন্যাশনাল থিয়েটার-এর ইতিহাস এইখানেই শেষ।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে প্রতাপচাঁদ জহুরির থিয়েটারের অবদান
বাংলা রঙ্গমঞ্চের ধারায় স্বল্পকালীন হলেও প্রতাপাচাঁদ তাঁর ন্যাশনাল থিয়েটারের মাধ্যমে অনেকগুলি নতুনতর কাজ করেছিলেন বা করতে উৎসাহিত করেছিলেন। এগুলি পরবর্তী বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য—
- প্রথম সার্থকভাবে থিয়েটারে পেশাদারিত্ব চালু করেন প্রতাপচাঁদ। মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত সব রকমের কর্মীর মাইনে ইত্যাদি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়। প্রত্যেকের কাজের গণ্ডিও নির্ধারিত হয়।
- নিয়মশৃঙ্খলার দ্বারা থিয়েটারের উচ্ছৃঙ্খল ও শখ-শৌখিনতাকে তিনি নিয়ন্ত্রিত করেন।
- এমেচারিস থেকে বাংলা থিয়েটারকে পুরোপুরি প্রোফেশনালরূপে গড়ে
- প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটারে পেশাদার হিসেবে গিরিশচন্দ্র যোগ দিয়েই থিয়েটার জীবনের শৃঙ্খলা উপলব্ধি করেন। যেটা তার পরবর্তী থিয়েটার জীবনের পাথেয় হয়ে ছিল।
- অভিনেতা ও ম্যানেজার গিরিশ প্রতাপচাঁদের ন্যাশনাল থিয়েটারে এসেই নাটক রচনা করতে বাধ্য হন। এইভাবে তাঁর নাট্যকার জীবনের শুরু হয়। প্রাথমিক নাট্যকার সত্তার সম্ভাব্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা এই থিয়েটারেই তিনি করে নিতে পেরেছিলেন। প্রতাপচাঁদের থিয়েটারে গিরিশ ছিলেন দু’বছর। দুমাস বাদে বাদেই নতুন নাটক নামাতে হতো বলে এই দু’বছরে গিরিশ নয়টি নাটক, ছয়খানি গীতিনাট্য লেখেন।
- বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়কে পুরোপুরি বাণিজ্যিক থিয়েটারে (Commercial Theatre) পরিণত করার দৃঢ় পদক্ষেপ এখান থেকেই শুরু হয়।
একথা ঠিক, প্রতাপচাঁদ ব্যবসা করতে গিয়ে ন্যাশনাল থিয়েটারকে দর্শকলক্ষ্মীর চাহিদার কাছে বিকিয়ে দিয়েছিলেন। তাই সস্তা নাচগানের নাটক, গীতিনাট্য, ধর্মাশ্রয়ী পৌরাণিক নাটকগুলিই এখানে অভিনীত হয়েছে। উচ্চভাবের অসাধারণ নাটক এখানে অভিনীত হয়নি। গিরিশও লিখতে পারেননি। তাছাড়া নানারকম নাট্যকৌশল ও কলাকৌশল প্রয়োগ করে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা এইখানেই শুরু হয়েছিল। ব্যবসায়ী প্রতাপচাঁদ থিয়েটারকে পুরোপুরি ব্যবসায়ের দিক দিয়েই দেখেছিলেন। নাট্যশিল্পের দিক দিয়ে দেখেননি। সে দায় বা দায়িত্ববোধও তাঁর ছিল না।
কিন্তু উচ্ছৃঙ্খল শিল্পী-জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে এবং গিরিশের শিল্পীসত্তাকে পেশাদারি নৈপুণ্যে জাগ্রত করে তিনি বাংলা থিয়েটারের যে উপকার করেছিলেন, তা বিস্মৃত হবার নয়। অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন প্রবর্তনের পরবর্তী বাংলা থিয়েটারের যে অশুভ গ্রহ চলছিল, প্রতাপচাঁদ তা থেকে থিয়েটারকে বাঁচাবার ব্যবসায়িক পথ দেখিয়েছিলেন।
প্রতিষ্ঠিত শিল্পী গিরিশ তাঁর সহযোগী শিল্পীদের নিয়ে ব্যবসায়ীর আষ্টেপৃষ্ঠের বন্ধন থেকে বেরিয়ে মুক্ত হাওয়ায় নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য গড়ে তুললেন স্টার থিয়েটার। প্রতাপচাঁদ থিয়েটার থেকে চলে গেলেন। কিন্তু রয়ে গেল তাঁর প্রবর্তিত পেশাদারি থিয়েটারের নিয়মরীতির ধারা।
Leave a Reply