//
//

প্রতীকবাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।

প্রতীকবাদ (Symbolism)

উনিশ শতকের শেষের দিকে ফরাসি কবিতায় যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তাকে সাহিত্যে আধুনিকতার ব্রতযাত্রায় একটি প্রধান মাইল-ফলক বলা যেতেই পারে। জড়বাদী বিজ্ঞান ও বাস্তববাদী সাহিত্যাদর্শের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেই এই ‘সিম্বলিস্ট’ কবিগোষ্ঠী প্রতীক ও অভিভাবের মাধ্যমে বস্তগতের আপাত গ্রাহ্যতার বাইরে রয়েছে যে ভাবলোক তাকে আভাসিত করতে চাইলেন। কল্পনা, আবেগ, রহস্যময়তার ইঙ্গিত ইত্যাদির সাহায্যে গূঢ়তলশায়ী ভাবনা ও উপলব্ধিকে ফুটিয়ে তুলতে, বাস্তবতন্ত্রী ও যথাস্থিতবাদী চিন্তাধারণা যখন সাহিত্যকে চেপে ধরেছে তখন পরাভূত বিস্ময়বোধের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে, প্রতীকবাদীরা এসেছিলেন কবিতা তথা সৃজনীসাহিত্যের নতুন আঙ্গিক ও আদর্শ নিয়ে।

যদিও মালার্মে ছিলেন প্রতীকবাদী আন্দোলনের ঋত্ত্বিক, যদিও বোদলেয়ারের ‘Correspondenses’ ও মার্কিন কবি-লেখক এডগার আ্যালান পোর রচনায় প্রতীকবাদী শুদ্ধতার সংকেত ছিল, তবু ‘সিম্বলিজম’ শব্দটি নতুন অর্থব্যঞ্জনায় প্রথম ব্যবহার করেছিলেন Jean Mores, ১৮৮৬-র সেপ্টেম্বরে ‘Le Figaro’ পত্রিকায়। বাস্তববাদের বিরুদ্ধে কবির অন্তর্ময়তার স্বরূপ প্রকাশের একটি পদ্ধতির রূপরেখা দেন তিনি। ইতিপূর্বে ১৮৭০-এর দশকে প্রতীকী কবিতা তথা আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল পল ভের্লেনের ‘Romances sans Paroles’ এবং মালার্মের L’Apres-midi d’un Faune’ (1876) দিয়ে। অন্যান্য প্রতীকবাদী কবিদের মধ্যে ছিলেন লাফোর্গ, কর্বিয়ের ও র‍্যাঁবো। ঔপন্যাসিকদের মধ্যে ছিলেনJoris-Karls-Huysmans এবং Edouard Dujardin। আর ১৮৯০-এর দশকে নাটকে প্রতীকবাদের প্রয়োগ ঘটিয়েছিলেন বেলজিয়ান নাট্যকার মরিস মেটারলিঙ্ক। বিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বেও ‘সিম্বলিস্ট’, আন্দোলনের প্রভাব লক্ষ করা গিয়েছিল ইঙ্গ মার্কিন তথা ইওরোপীয় কবিতায় ও শিল্পচর্চায়। ফরাসি কবিতায় পল ভালেরি, জার্মানিতে রাইনের মারিয়া রিলকে, ইংরেজি কবিতার ক্ষেত্রে ইয়েট্‌স্‌ ও এলিয়ট ছাড়াও চিত্রকলা এবং সংগীতের ক্ষেত্রে প্রতীকবাদের লক্ষণীয় প্রভাব ছিল। বলা যেতে পারে যে আধুনিকতাবাদী কোনো কবি ও লেখকই ‘সিম্বলিজম’-এর তাৎপর্য এড়িয়ে যেতে পারেননি।

মালার্মে ও তার সতীর্থ প্রতীকবাদীরা মনে করতেন যে প্রতীয়মান সত্যের জগতই একমাত্র সত্য নয়, তার অন্তরালে রয়েছে এক পরিপূর্ণ, সর্বব্যাপ্ত আধ্যাত্মিক সত্তা যা বাচ্য বর্ণনায় পরিস্ফুট করা অসম্ভব, যাকে কেবলমাত্র শব্দ ও ধ্বনির প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত করা যেতে পারে। মালার্মে কবিতার চারিত্র্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বললেন—‘‘Poetry is the expression by means of human language restored to its essential rhythm of the mysterious sense of the aspects of existence; it endows our ‘sojourn with authenticity and constitutes the sole spiritual task.”—এ তো এক শুদ্ধতার অভিমুখে যাত্রা।

আভাসে-ইঙ্গিতে, প্রতীক ও অভিভাবে মনের সূক্ষ্ম ও নিগূঢ় অনুভূতি ও প্রেরণাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন প্রতীকবাদী কবিলেখকরা। কবির স্বপ্নময় দৃষ্টিতে বস্তুর বাস্তব রূপ যে বাস্তবাতীত তথা অতীন্দ্রিয় ব্যঞ্জনা পেয়ে থাকে তাকে প্রতীকের গূঢ়তায় প্রকাশ করাই ছিল ‘সিম্বলিস্ট’দের আকাঙ্ক্ষা। আর এ কাজে সচরাচর প্রচলিত ব্যবহারিক প্রয়োজনের ভাষা যে চলবে না তাও বুঝেছিলেন ‘সিম্বলিস্ট’রা। তারা মনে করেছিলেন যে, ইঙ্গিতময়তা আসে আদিম ভাষা থেকে, যে ভাষা অর্ধেক হারিয়ে গেছে আর তার বাকি অর্ধেক আছে জীবিত এবং যে ভাষা আধা অস্তিত্ব ও আধা অনস্তিত্বে সুপ্ত রয়েছে প্রতিটি মানবসত্তায়। স্বপ্ন আর সংগীতের সঙ্গে সেই ভাষার এক অনন্য সম্পর্ক।

মালার্মে বলেছিলেন চিত্রকর দেগাকে যে, ভাব দিয়ে কবিতা লেখা হয় না, লেখা হয় শব্দ দিয়ে। আর শব্দের আদিতে রয়েছে সংগীত। কবিতায় হারিয়ে যাওয়া সংগীতের পুনর্বাসন ঘটাতে হবে। প্রসঙ্গত বলা যায় যে মালার্সে-প্রবর্তিত প্রতীকবাদী কাব্যাদর্শের ওপর জার্মান সংগীতনির্মাতা Richard Wagnar-এর প্রভাব পড়েছিল। শব্দ বেছে, শব্দের পর শব্দ গেঁথে কবি উন্মোচিত করতে চান এক রহস্যময়তাকে, যা শেষ পর্যন্ত অনেকখানিই অনুদঘাটিত থেকে যায়। আর সে কারণে এক বিষাদ থাকে রহস্যময়তাকে জড়িয়ে। এই উন্মোচনের প্রয়াসে অনন্য যোগ করে সুরের দীপ্তিময়তা।

বোদলেয়ার ছিলেন প্রতীকবাদের প্রাণপুরুষ। একক অনুশীলনে তিনি বহ বিচিত্র প্রতীক ব্যবহার করেছিলেন তাঁর যুগ, জীবন ও আধ্যাত্মিক চেতনাকে ব্যক্ত করতে। বোদলেয়ার মনে করতেন যে জগতের নানা রূপের অন্তরালে রয়েছে এক পূর্ণ সত্তা যা একদিকে জড়জগতরূপে ব্যক্ত এবং অন্যদিকে আত্মিক জগতরূপে মানস-উপলব্ধির বিষয়। অর্থাৎ আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের অনুভূতি ও ইন্দ্রিয়াতীত উপলব্ধি একই উৎসজাত। জগৎ ও জীবনের সকল প্রকাশ এক অখণ্ড উৎসজাত এবং আপাত-বিরোধী বহু প্রতীকের মাধ্যমে তাদের ব্যক্ত করা যায়। আমাদের রং- রূপস্পর্শ-ঘ্রাণ ইত্যাদি ইন্দ্রিয়ানুভূতির পারস্পরিক পরিবর্তনও সম্ভব বলে মনে করতেন বোদলেয়ার। বোদলেয়ারের প্রতীকবাদের অনুসরণে এলেন র‍্যাবোবো, লাফোর্গ ও মালার্মে। তবে র‍্যাবো বোদলেয়ারের মতো ব্যক্তি-সত্তাকে একটি নির্দিষ্ট পর্দার মতো মনে করতেন না যার ওপর কেবল বহির্জগতের প্রতীকগুলি ছবি হয়ে ফুটে ওঠে। র‍্যাবোর মতে কবির মন সর্বতোভাবে অনুভব করবে জগতের অনিবার্য আত্মাকে এবং ব্যক্ত করবে স্পষ্ট বাচ্যার্থব্যঞ্জক প্রতীকের বদলে গৃঢ়ার্থব্যঞ্জক ও অতিপ্রাকৃতের ইঙ্গিতবাহী প্রতীকে। মালার্মের প্রতীক-ভাবনার কথা আগেই বলা হয়েছে। তিনি প্রতীককে দিতে চেয়েছিলেন সাংগীতিক দ্যোতনা। লাফোর্গ ছিলেন র‍্যাবোর অনুগামী। চিন্তাপ্রবাহকে তিনি ধরতে চাইলেন ছবিতে।

ফরাসি প্রতীকতন্ত্রী কবিদের প্রভাব লক্ষ করা যায় ইংরেজি ভাষার দুই কবি ইয়েটস্ ও এলিয়টের কবিতায়। সবপারদর্শী ইয়েটস্ তাঁর, প্রতীকগুলি সংগ্রহ করেছিলেন জাদুবিদ্যা, পুরাণ, থিওজফি, কিংবদন্তি ইত্যাদি থেকে। প্রথম দিকের ঐতিহ্যনির্ভর প্রতীকসমূহের তুলনায় তার উত্তরপর্বের একান্ত ব্যক্তিগত প্রতীকমালা অনেক বেশি দুরধিগম্য। এলিয়ট আবির্ভূত হয়েছিলেন এক সংকটাপন্ন, অবক্ষয়িত মহানাগরিক জীবনের ভাষ্যকার রূপে। নগরজীবনের ক্লেদ ও পঙ্কিলতা, তার অর্থহীন শূন্যতার অসংখ্য ছবি চিত্রকল্পের এক কুশলী বিন্যাসে ফুটে উঠেছে এলিয়টের কবিতায়। প্রতীকী নাট্যরচনায় শিরোমণি-ব্যক্তিত্ব মেটারলিঙ্ক, যার সর্বাপেক্ষা পরিচিত নাটক ‘Pelleas et Melisande’ (1892); এছাড়া উল্লেখযোগ্য পল ক্লদেল ও অ্যালফ্রেড জ্যারি।

চিত্রকলার ক্ষেত্রে ‘ইম্প্রেশনিস্ট’ শিল্পীদের যথাস্থিতবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধ প্রতীকবাদীরা রং ও রেখায় ব্যঞ্জিত করেছিলেন তাদের ভাবলোক। Gustave Moreau ও Pierre Puvis de Chavannes এই চিত্রকরদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ‘উত্তর-ইমপ্রেশনিজম’-এর দিকপাল শিল্পীদের মধ্যে ভান গখ্‌ ও পল গগ্যাঁ প্রতীকবাদের উদ্দেশ্য ও আঙ্গিকের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিলেন।

প্রতীকবাদীরা পৌঁছতে চেয়েছিলেন শব্দের শিকড়ে। প্রতীকের প্রয়োগে মনের গভীরে যে আদিম-মানুষটি রয়েছে তাকে উন্মোচিত করতে চেয়েছিলেন। তারা মনে করতেন যে, কবিদের থাকে এক Inner voice, প্রতীকের সাহায্যে তাকে তারা ব্যক্ত করেন কবিতায়। আপাতদৃষ্ট প্রপঞ্চ বা ‘ফেনোমেনা’র ঊর্ধ্বে রয়েছে যে রাহসিক ও পরম সৌন্দর্যলোক শব্দই হলো তাকে ধরবার অভিজ্ঞান। দৃশ্যমান জগতের ভাষায় অতীন্দ্রিয় অভিজ্ঞতাকে বোঝাতে প্রয়াসী ছিলেন সিম্বলিস্টরা। শব্দ মাত্রই ছিল তাই প্রতীক। যে শব্দ সাধারণ ব্যবহারের বাহন নয়, সে শব্দ এমন অনুষঙ্গ সৃষ্টি করে যা সংবেদনের ঊর্ধ্বে পরম বাস্তবতাকে উৎসারিত করে; মালার্মে বলেছিলেন যে “কবিতা কোনো সংবাদ বহন করে না, বরং ইঙ্গিত দেয়, জাগিয়ে তোলে; বস্তুপুঞ্জের অভিধা নয় গড়ে তোলে তাদের বাতাবরণ”। যাবতীয় নীতিবাদী প্রবণতা, ভাষার অলংকারবাহুল্য, কল্যাণবাদী যা কিছু, সবই ‘সিম্বলিস্ট’রা পরিত্যাগ করেছিলেন কবিতার পক্ষে অপ্রয়োজনীয় মনে করে।

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!