প্রবন্ধের সংজ্ঞা, উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য লেখ।
প্রবন্ধ: সংজ্ঞা, উদ্ভব ও বৈশিষ্ট্য
‘প্রবন্ধ’ বা ‘Essay’ এক বিশেষ ধরনের গদ্যরচনা, Saintsbury-র শব্দবন্ধে ‘Work of prose art.’ যার একটি সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেওয়া কঠিন। শব্দার্থগতভাবে ‘প্রবন্ধ’ হল এমন এক রচনা যার আছে প্রকৃষ্ট বন্ধন। সে বন্ধন ভাবের, ভাষার, রূপের বন্ধন। শশীভূষণ দাশগুপ্তের বিচারে কোনো অংশ বা উপাদান যখন কোনো একটা প্রকৃষ্ট বন্ধনের ভিতর দিয়া পরস্পর অন্বিত হইয়াছে এবং একটি সমগ্রতা লাভ করিয়াছে, তখনই তাহাকে প্রবন্ধ আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে। ষোড়শ শতকে ফরাসি লেখক Michel de Montaigne তাঁর Essais (1580) গ্রন্থের শিরোনামে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন ‘essai’ বা ‘attempt’, অর্থাৎ ‘প্রয়াস’, এই মূলগত অর্থে। Montaigne-এর নির্দেশিত অর্থে ও রূপরীতিতে ‘প্রবন্ধ’কে প্রথম ইংরেজি ভাষায় প্রচলন করেন ফ্রান্সিস বেকন তার তিনটি সংস্করণে প্রকাশিত ‘Essays’ (1597, 1612, 1625)-এ। Montaigne ও বেকনেরও বহু পূর্বে প্রাচীনকালে গ্রিস ও রোমে প্রবন্ধধর্মী গদ্যরচনার চর্চা করেছিলেন থিওফ্রাসটাস, প্রতার্ক, সিসেরো এবং সেনেকা। প্রাচীন প্রয়োগে ‘প্রবন্ধ’ শব্দটির অর্থ ছিল ‘উপায় বা ব্যবস্থা’। সংস্কৃত ভাষায় প্রবন্ধ তথা প্রকৃষ্টরূপে বন্ধন বলতে বোঝাতো ছন্দের বন্ধন, বিষয়ের রূপ-বন্ধন, সর্গ/পর্ব অধ্যায়দির বন্ধন, রচনাক্রমের পারম্পর্য ইত্যাদি এবং সাহিত্যের সকল শাখাতেই প্রবন্ধের চলন ছিল।
‘প্রবন্ধ’ কী বা কেমন রচনা? মোটের ওপর যে-কোন বিষয় নিয়ে লেখা নাতিদীর্ঘ সাহিত্যিক গদ্যরচনাকেই প্রবন্ধ বলা হয়ে থাকে। যদিও এ-বিষয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। ড. স্যামুয়েল জনসন তাঁর অভিধান (১৭৫৫)-এ ‘প্রবন্ধ’ বলতে এক জাতীয় শিথিল ও অনিয়মিত রচনার কথা বলেছিলেন—‘a loose sally of the mind, an irregular, indigested piece, not a regular and orderly performance.’ অক্সফোর্ড ইংরেজি অভিধানে প্রদত্ত সংজ্ঞায় প্রবন্ধের নাতিদীর্ঘ রূপ, বিষয়ের অনির্দিষ্টতা ও জনসন-নির্দেশিত শৃঙ্খলা ও গঠন-শৈথিল্যের কথা বলা হয়েছে—‘‘A composition of moderate length on any particular subject or branch of a subject, originally implying want of finish, ‘an irregular, indigested piece’, but now said of a composition more or less elaborate in style, though limited in range.’’ ড. জনসনের সংজ্ঞাকে মূলত না-বাচক বলে মনে করেছেন Hugh Walker; তাঁর মতে, প্রবন্ধের স্বভাবই হলো কিছুটা অনিশ্চিত অসম্পূর্ণতা—‘‘Something tentative, so that there is a justification for the conception of imcompleteness and want of system.’’ হাডসন তার মন্তব্যে প্রবন্ধের স্বল্প পরিসর গঠন ও সমগ্রতার অভাবের প্রতি দৃষ্টিপাত করেছেন— ‘‘The essay, then, may be regarded roughly as composition on any topic, the chief negative features of which are comparative brevity and the comparative want of exhaustiveness.’’
প্রবন্ধকে সংজ্ঞায়িত করার এই কঠিন ও তর্কসাপেক্ষ প্রচেষ্টা থেকে সরে গিয়ে আমরা বরং তার রূপ-রীতির বৈশিষ্ট্যগুলিকে বোঝবার চেষ্টা করি। যে-কোন বিষয় নিয়েই প্রবন্ধ রচিত হতে পারে যদি সেই বিষয়টি লেখকের ভাবনা-অভিজ্ঞতা-মন-মননের প্রত্যয় দ্বারা যথাযথভাবে চিহ্নিত এবং তার রসবোধে জারিত হয়। গুরুগম্ভীর কিংবা হালকা পরিহাসমণ্ডিত, গভীর ভাবোদ্দীপক কিংবা নিছক বস্তুগত কোনো বিষয়, কোনো সর্বজনীন প্রসঙ্গ বা সমস্যা কিংবা ব্যক্তিগত অভিনিবেশ, যে-কোনো কিছুই প্রবন্ধের বিষয় হয়ে উঠতে পারে লেখকের ব্যক্তিত্বের পরশপাথরের ছোঁয়ায়। অর্থাৎ মূল বিষয়বস্তু যাই হোক না কেন। প্রবন্ধকারের সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাষাশৈলী তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়ে থাকে। সাধারণভাবে প্রবন্ধ ক্ষুদ্রায়তন গদ্যরচনা, তবে সবক্ষেত্রেই আয়তনের স্বল্পতা প্রবন্ধের শর্ত হিসেবে গণ্য হতে পারে না। হিউমের ‘A Treatise of Human Nature’ কে যদি প্রবন্ধ না বলি, তাহলে লকের ‘An Essay Concerning Human Understanding’-কে কী বলব? প্লেটোর ‘Dialogues’, সিসেরোর ‘De Sencetate’, ড্রাইডেনের সমালোচনামূলক ‘Essay on Dramatic Poesy’, বঙ্কিমচন্দ্রের কৃষ্ণচরিত্র, কমলাকান্তের দপ্তর, রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন গ্রন্থভুক্ত ধর্মসম্বন্ধীয় বক্তৃতাবলী—এ সবই যদি ‘প্রবন্ধ’ বলে মনে করা হয় তাহলে তো তার আয়তন, বিষয় ও রূপবন্ধের বিভিন্নতা স্বীকার করতেই হয়। স্মৃতিচারণামূলক রচনা, যথা রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি, পত্রাবলী, ছিন্নপত্র; ব্যঙ্গরসাত্মক রচনা, যথা বিদ্যাসাগরের ব্রজবিলাস, সবই তো নানা রূপে লেখা নানা স্বাদের প্রবন্ধ। সাধারণভাবে বাংলা ও ইংরেজি সহ সকল ভাষাতেই গদ্যের উদ্ভব ও ব্যবহারের সময় থেকেই প্রবন্ধের আত্মপ্রকাশ। ইংরেজি ভাষায় নবম শতক ও তার পরবর্তীকালে অনুবাদকার ও ধর্মযাজকদের হাতে এবং বাংলায় শ্রীরামপুর মিশন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের পাদ্রি তথা পণ্ডিতদের হাতে প্রবন্ধের জন্ম। এলিজাবেথের যুগে ফ্রানসিস বেকন ও উনিশ শতকের প্রারম্ভিক পর্বে রামমোহন রায় যথাক্রমে ইংরেজি ও বাংলা প্রবন্ধশিল্পের সার্থক রূপকার।
প্রবন্ধের বৈশিষ্ট্য
গদ্যের উন্মেষ ও বিবর্তনের ইতিহাসে প্রবন্ধের অনুশীলন পর্যালোচনা করলে একেবারে শুরু থেকেই এই শিল্পরূপের কয়েকটি লক্ষণ চিহ্নিত করা যেতে পারে—
- গদ্যই প্রবন্ধশিল্পের স্বাভাবিক মাধ্যম, যদিও পদ্যে প্রবন্ধ রচিত হয়েছে;
- যুক্তি-তর্ক-বিচার-বিশ্লেষণ ইত্যাদির আশ্রয়ে প্রবন্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য তত্ত্ব ও তথ্যের উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার;
- যৌক্তিক পারম্পর্য তথা বিশ্লেষণী ঋজুতার সঙ্গে কল্পনা ও আবেগের প্রয়োগ;
- বিষয় ও উপস্থাপন রীতির বৈচিত্র্য।
প্রবন্ধের শ্রেণিবিভাগ
প্রবন্ধকে দুইভাগে ভাগ করা যায়—
১. বস্তুনিষ্ঠ, তন্ময় বা আনুষ্ঠানিক প্রবন্ধ (Formal Essay)
২. ব্যক্তিনিষ্ঠ, মন্ময় বা ভাবপ্রধান প্রবন্ধ (Personal Essay)।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply