বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের অবদান ব্যাখ্যা কর।
প্রসেনিয়াম থিয়েটার
প্রসেনিয়াম থিয়েটার পৃথিবীর সবদেশেই সবচেয়ে আদৃত ও বহুল ব্যবহৃত থিয়েটার। অনেক দেশেই তাদের নিজস্ব নাট্যাভিনয় পদ্ধতি ছিল ও আছে। কিন্তু খ্রিস্ট্র-পূর্ব কাল থেকে বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে মধ্য যুগের ইউরোপে প্রসেনিয়াম থিয়েটার নির্দিষ্ট রূপ পেতে থাকে। ইউরোপের দেশগুলি, বিশেষত ইংরেজ এবং ফরাসিরা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনের জন্য পৃথিবীর যেসব দেশে গিয়ে বসবাস শুরু করেছে, সেখানেই তাদের দেশের প্রসেনিয়াম থিয়েটার নিয়ে গেছে। সেইসব দেশের নিজস্ব নাট্যাভিনয় পদ্ধতি থাকা সত্ত্বেও সেখানে প্রসেনিয়াম থিয়েটার চালু হয়ে আদৃত হয়েছে।
বর্তমান পৃথিবীতে থিয়েটার পদ্ধতি নিয়ে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলেছে। তাতে প্রসেনিয়াম থিয়েটারের ঘেরাটোপ ভেঙে নাট্যাভিনয়কে কিভাবে কতোদূর প্রসারিত করা যায়, তার উদ্যোগ দেখা যায়। প্রসেনিয়াম ভেঙে, নানাভাবে ও নানা নামে নতুন নতুন থিয়েটার ব্যবস্থা হয়ে চলেছে। কিন্তু এখনো, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘প্রসেনিয়াম থিয়েটার’-ই চালু রয়েছে। থিয়েটার যারা করেন এবং থিয়েটার যারা দেখেন, উভয়পক্ষেই এখনো সমাদৃত হয়ে রয়েছে প্রসেনিয়াম থিয়েটার। নানাদেশের নানা পদ্ধতির বিচিত্র মিশেল প্রসেনিয়াম থিয়েটারকে আরো সমৃদ্ধ ও বিচিত্রমুখি হয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। কিন্তু তার নিজস্ব মডেল এখনো অপরিবর্তিত।
গ্রিক শব্দ Skene, গ্রিক রঙ্গমঞ্চের যে জায়গাটায় দেবতা ডায়নিসাসের আরাধনার পর নাটকের অভিন হত, তাকে বলতো Skene. এই Skene-এব সামনের দিকে গোলাকৃতি জায়গায় থাকতো Orchestra, তার সামনে বিশাল পাহাড়ের ঢালু জমিতে গ্যালারির মতো করে দর্শকাসন ছিল, প্রায় পনের-কুড়ি হাজার।
রোমান যুগে থিয়েটারে অভিনয়ের সুবিধার জন্য Skene-এর সামনে খানিকটা জায়গা বাড়িয়ে নিয়ে প্ল্যাটফর্ম মতো করা হয়েছিল। Orchestra ও Skene-এর মাঝখানে এই বাড়তি অংশটুকু জোড়া হলো। Skene-এর সামনে (Pro) এই অংশ জোড়ার ফলে এর নাম হয়ে গেল Proskenion, পরবর্তীকালে সামনের Orchestra-র গোলাকৃতি জায়গা তুলে দিয়ে অর্ধবৃত্তাকার ভাবে তার অংশটি Skene-এর সামনে জুড়ে দেওয়া হলো। ক্রমে সেই অংশটি Arch (ধনুক)-এর আকারে Skene-এর সামনের অংশে যুক্ত হয়ে গেল। তাই অনেকে একে Arch Proskenion বলে থাকে।
এই থিয়েটার ইংলন্ডে এসে ইংরেজি ভাষায় ‘Skene’ হয়ে গেল ‘Scene’, গ্রিক ‘K’-এর বদলে ইংরেজি ‘C’। ইংরেজিতে নাম হলো তাই Proscenium, গ্রিক থেকে রোমান Proskenion ইংরেজিতে হলো Proscenium. এই ধরনের মঞ্চে যে থিয়েটার হয় তাকেই বলে Prosceniun Theatre. এখনো মঞ্চের পর্দার বাইরে সামনের Arch আকৃতির অংশটিকে ‘আর্চ প্রসেনিয়াম’ বলে।
অষ্টাদশ শতকে ইংলন্ডে যে রকম প্রসেনিয়াম থিয়েটার চালু ছিল, ইংরেজরা সেই থিয়েটারই ভারতবর্ষে তথা বাংলায় নিয়ে এলো। ঐ মডেলে থিয়েটার তৈরি হলো কলকাতায় ইংরেজদের আনুকূল্যে ও উৎসাহে। ততদিনে ইংলন্ডে প্রসেনিয়াম থিয়েটার ঘেরা প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আবদ্ধ হয়েছে। আর খোলা জায়গায় নেই। সেই প্রেক্ষাগৃহের একদিকে কিছুটা উঁচু জায়গায় প্রসেনিয়াম স্টেজ। এই মঞ্চের সামনে তৈরি হলো দর্শকাসন। এবং সবটা ঘিরে তৈরি হলো ‘থিয়েটার হল’ বা প্রেক্ষাগৃহ বা নাট্যশালা বা রঙ্গালয়।
মঞ্চের তিনদিক ঘেরা, সামনের দিক খোলা। সেখানে কার্টেন বা পর্দা। এই পর্দা সরে গেলে মঞ্চের ভেতর দেখা যায়। মঞ্চের দুধারে ‘উইংস’ অনেকগুলো। সেইগুলো দিয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রীরা মঞ্চে প্রবেশ-প্রস্থান করে। পেছনে পদায় দৃশ্য আঁকা থাকে, একে বলে দৃশ্যপট। সেই দৃশ্যপটের সামনে অভিনয় চলে। যে যুগে যেমন আলোর ব্যবস্থা সেইরকম উপকরণ দিয়ে মঞ্চকে আলোকিত করা হয়। প্রথমে হতো খোলা আকাশে প্রকাশ্য সূর্যের আলোতে দিনের বেলায়। পরে আলোক-প্রাপ্তির বিভিন্ন টেকনোলজি আবিষ্কার ও বিবর্তনের ফলে ঘেরা মঞ্চে আলোর ব্যবস্থা করা হতে থাকলো এবং রাতের বেলায়ও অভিনয় চালু হলো। মশাল, তেল বা গ্যাসের আলো থেকে বিদ্যুতের আলো মঞ্চে এসে গেল।
পেছনের দৃশ্যপট বা ‘আঁকা-সীন’ পদ্ধতি অনেকদিন ছিল। পরে পেছনের দৃশ্যপট তুলে দিয়ে কাটা-সীন, ঠ্যালা-সীন জোড়া হলো। ক্রমে এই আঁকা-সীন পরিত্যক্ত হলো। সেখানে প্রয়োজনীয় আসবাব-পত্র এবং কাঠের বা পিচবোর্ডের তৈরি দৃশ্যসজ্জা করা হলো। রিয়ালিস্টিক থিয়েটারের যুগে একেবারে হুবহু দৃশ্যসজ্জা করবার তাগিদে সব রকম ব্যবস্থা করা হলো। মায় খাট-আলমারি-সোফাসেট, ঘরের ভেতরের দেওয়াল বানানো হলো। আস্তে আস্তে দৃশ্যসজ্জার ভার কমে গিয়ে ‘সাজেসটিভ’ দৃশ্যসজ্জা দেখা গেল। দেওয়ালের একটি দিক, কিংবা শুধু একটি দরজার ফ্রেম, কিংবা একটি খড়ের চালা অথবা মন্দিরের সিঁড়ি। প্রাসাদের একটি থাম কিংবা পার্কের একটি রেলিং।
নট-নটীদের সাজপোষাক, আসা-যাওয়া, যন্ত্রানুষঙ্গ, সঙ্গীত, দৃশ্যসজ্জা এবং অভিনয়—সব নিয়ে নাট্যাভিনয় চালু হলো প্রসেনিয়াম থিয়েটারে নাট্যাভিনয়।
Leave a Reply