প্রহসনের সংজ্ঞা, স্বরূপ এবং একটি সার্থক প্রহসন আলোচনা কর।
ফার্স বা প্রহসন
প্রহসনকে কেউ কেউ নাটকের অন্যতম শ্রেণি বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন, কিন্তু অ্যাব্রাম্স্ যেহেতু তাকে কমেডিরই একটি বিভাগ বলে মনে করেন, আমরা সেই ভাবেই তাকে বিন্যস্ত করলাম। ফার্স বলতে বোঝায় অত্যন্ত লঘু কল্পনাসিদ্ধ, অতিরঞ্জিত এক ধরনের হাস্যোচ্ছল নাটক। সহজ সরল এই রকম কমেডিতে হাস্যময়তা অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত। আসলে, এখানে বুদ্ধির খেলা বিশেষ দেখা যায় না এবং বাগবৈদগ্ধ্য দেখাবার অবকাশও কম বলে একে একটু নাড়ু ধরনের কমেডি বলে মনে হতে পারে, নহলে অ্যাব্রাম্স্ এখানে ‘বেলি লাফস’ (অর্থাৎ কিনা কাতুকুতু দিয়ে হাসানোর ব্যাপার) আছে বলে মন্তব্য করতেন না। অপর এক ইংরেজ সমালোচক একে বলেছেন— “the type of drama stuffed with low humour and extravagant wit। সংস্কৃত আলংকারিক প্রহসন সম্বন্ধে বলেন—হাস্যোদ্দীপক কাব্যন্তু প্রহসনমিতি স্মৃতম্।
প্রহসনের বৈশিষ্ট্য
প্রহসনের বৈশিষ্ট্যগুলি হল—
- প্রহসনে স্কুল রঙ্গরস ও আতিশয্যযুক্ত দৈহিক অঙ্গভঙ্গি অনেক বেশি থাকে যা সর্বদাই দর্শককে কৌতুককর উত্তেজনা দিতে চায়।
- সমকালীন সমাজ, ধর্ম, রাজনীতি ইত্যাদির কুৎসিত ও কলঙ্কময় দিকগুলি খোলাখুলিভাবে প্রহসনে চিত্রিত হয়। ফলে প্রহসনের আখ্যানভাগ বহু আলোচিত ও বিতর্কিত বিষয়ের প্রত্যক্ষ ব্যঙ্গধর্মী উন্মোচনে তৎপর থাকে কমেডিতে তেমন দেখা যায় না।
- প্রহসনের চরিত্রেরা সর্বদাই টাইপ-ধর্মী, সমকালীন সমাজবাস্তবের অন্তর্গত বিশেষ বিশেষ শ্ৰেণী বা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করে তারা। চরিত্রেরা হয় সাধারণভাবে একমাত্রিক ও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কমেডির চরিত্রেরা তুলনায় অনেক বেশি গভীর, জটিল ও বহুমাত্রাযুক্ত।
- কমেডির মতো পূর্ণাঙ্গ বিস্তার প্রহসনে থাকে না। প্রহসন একটি বা দুটি অঙ্কে শেষ হলে যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তার বিন্যাস হয় নকশাধর্মী; টুকরো টুকরো চিত্রের মাধ্যমে প্রহসনের কাঠামো গড়ে ওঠে।
- নাট্য দ্বন্দ্ব প্রহসনের স্বল্প আয়তনে সেভাবে গড়ে উঠতে পারে না বলে চটুল ও চাতুর্যপূর্ণ পরিস্থিতির ওপরেই প্রহসন নির্ভর করে।
- প্রহসনের সংলাপ হয় হালকা, কিছুটা অমার্জিতও। বুদ্ধিদীপ্ত হিউমার কিংবা বাগবৈদগ্ধ্য প্রদর্শনের সুযোগ প্রহসনে থাকে না।
- পেট ফাটা হাসি বা ‘belly laughs’ প্রহসনকে আদ্যোপান্ত টই-টুম্বুর করে রাখে।
কোনও কোনও সমালোচক ফার্সকে অত্যন্ত পুরনো ধরনের কমেডি মনে করে রিস্টোফেসের ‘দি ফ্রগসকে’ও এর অন্তর্ভুক্ত করতে চান। কিন্তু মধ্যযুগের মিরা প্লে-র মধ্যে যে ফার্সের উপাদান ছিল একথা অস্বীকার করবার কোনো উপায় নেই—দৃষ্টান্ত, ওয়েকফিল্ডের প্লে-র অন্তর্গত ‘নোয়া’ এবং ‘সেকেন্ড শেফার্ডস প্লে’। শেক্সপীয়রের নাটককে প্রহসনের স্তরে নামানো ঠিক হবে না, তবে তাঁর ‘দি টেমিং অব দি শ্রু’ কিংবা ‘দি মেরি ওয়াইভস্ অব উইঞ্জর’-এ যেসব নক্-অ্যাবাউট’ দৃশ্যগুলি আছে, প্রকৃতিতে তারা প্রহসনই। এছাড়া ফরাসি নাটকের মধ্যে মলেয়েরের নাটক ‘লে মিসানথ্রোপ’, ইংরেজি নাটকের মধ্যে বিচার্ড শেরিডানের ‘দি স্কিমিং লেফটেন্যান্ট’, আমেরিকান নাটক হিসাবে ব্র্যান্ডন টমাসের ‘চার্লিজ আন্ট’, বাংলায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘অলীক বাবু’, দ্বিজেন্দ্রলালের ‘কল্কি অবতার’ বা অমতলাল বসুর ‘তাজ্জব ব্যাপার’কে প্রহসনের কিছু দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
একটি সার্থক বাংলা প্রহসন
মধুসূদন দত্ত প্রথম সার্থক ঐতিহাসিক নাটক এবং প্রকৃত অর্থে ট্র্যাজেডি যেমন আমাদের উপহার দিয়েছেন, প্রথম বাংলা প্রহসনদুটিও তাঁরই রচনা। আমরা সেই প্রহসনদুটির একটি, ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’কে আলোচনার জন্য গ্রহণ করতে পারি।
প্রথমে নাটকটির সারসংক্ষেপ একটু জেনে রাখা যাক। দুটি অঙ্কে এবং চারটি গর্ভাঙ্কে সম্পূর্ণ এই ছোট নাটকের মুখ্য চরিত্র গ্রামের জমিদার ভক্তপ্রসাদবাবু। এছাড়া আছে তার প্রধান সহচর ভৃত্য গদাধর, আছেন গ্রামের সজ্জন পণ্ডিত পঞ্চানন বাচস্পতি, আর আছে গ্রামের অতিদরিদ্র মুসলমান চাষী হাজিফ গাজি এবং তার স্ত্রী ফতেমা। ভক্তপ্ৰসাদ বাবুটি বাহ্যিক আচার-আচরণের যতই ভক্ত এবং ভক্তিভাবাপন্ন হন, আসলে তিনি একটি তুলসীবনের বাঘ। নিত্যনতুন নারীসম্ভোগ ছাড়া তিনি বাঁচতে পারেন না। একাজে তার প্রধান সাগরেদ গদাধর এ ব্যাপারে এতদিন প্রচুর কুকর্ম করেছে এবং গ্রাম্য নারী-সংগ্রাহক পুঁটিকে দিয়ে প্রভুর সব ইচ্ছাই পূর্ণ করেছে। এক্ষেত্রে অকাতরে অর্থব্যয় করতে ভক্তিপ্রসাদের কোনো আপত্তি নেই, কিন্তু সব্রাহ্মণের মাতৃদায়ে পাঁচটি টাকা দিতে তার বুক ফেটে যায়। গদাধরের প্ররোচনায় হাজিফের বউ ফতেমাকে উপভোগ করতে গিয়ে ভক্তপ্ৰসাদ কীরকম বিপদে পড়ে—আগে থেকে প্রস্তুত হাজিফ-ফতেমা-বাচস্পতির পরিকল্পনায় নাজেহাল হয়ে, প্রথমে ভূতের ভয়ে এবং তারপর লোকলজ্জার ভয়ে প্রচুর অর্থদণ্ড দিয়ে, তাকে কোনোরকমে মুক্তি পেতে হয়।
আমরা বলেছি, প্রহসন একরকমের লঘু কল্পনাসিদ্ধ রচনা! অতিরঞ্জন এর প্রধান কথা এবং সহ অতিরঞ্জন এই ছোট নাটকেও আছে ভয়াবহভাবে। বৃদ্ধবয়সে নারীসংসর্গের প্রলোভন তরুচির পরিচয় হলেও কোনো চরিত্রের মধ্যে প্রচ্ছন্নভাবে বা খানিকটা থাকতেও পারে, কিন্তু ভক্তপ্ৰসাদ যতবারই কথা বলেছেন ততবারই তিনি নিজের এই প্রবল আসক্তির কথাই বলেছেন, গদাধরও তাকে কেবল সংগৃহীত নারীদের কথাই মনে করিয়েছে, যেমন—
গদা—কত্তামশায়, আপনার সেই ইচ্ছেকে মনে পড়ে তো!
ভক্ত—কোন্ ইচ্ছে?
গদা—আজ্ঞে ঐ যে ভাজ্যিদের মেয়ে। আপনি যাকে—…
ভক্ত—হাঁ! হাঁ। ছুঁড়ীটে দেকতে ছিল ভাল বটে।
শুধু তাই নয়, সেদিন রাতে হানিফের বউকে তিনি পাবেন, এই রকম কথা পাকা হয়ে যাবার পরও পীতাম্বর তেলির বউ ভগী এবং তার মেয়ে পঞ্চীকে দেখে তার বাসনা সিক্ত হয়ে উঠেছে। কাছে ডেকে আলাপ করার পর তিনি বলেছেন—“ছুড়ীর নবযৌবনকাল উপস্থিত, তাতে আবার স্বামী থাকে বিদেশে। এতেও যদি কিছু না কতে পারি তবে আর কিসে পারবো।’’
বাগবৈদগ্ধ্য এসব নাটকে বিশেষ থাকেনা, এই নাটকেও নেই। তবে এক-একটি মেয়ের সর্বনাশ কামনা করেই সঙ্গে সঙ্গে ‘প্রভো, তোমারই ইচ্ছা’ কিংবা রাধে কৃষ্ণ! প্রভো তুমিই সত্য ইত্যাদি নাটক সংলাপ জমবার পক্ষে ভালো। সামান্য উঁচু দরের রসিকতা আছে কিছু উদ্ধৃতিচয়ন, যেমন—
মেদিনী হইল মাটি নিতম্ব দেখিয়া।
অদ্যাপি কাঁপিয়া উঠে থাকিয়া থাকিয়া।
কিংবা,
তুমি প্রাণ, তুমি ধন, তুমি মন, তুমি জন,
নিকটে যে ক্ষণ থাক সেই ক্ষণ ভাল লো।
যত জন আর আছে, তুচ্ছ করি তোমা কাছে।
ত্রিভুবনে তুমি ভাল আর সব কাল লো৷
তবে সবই ওই আদি রসসংক্রান্ত। সেই কারণেই এদের, সমালোচকদের ভাষায় বলা যায়, ‘extravagant wit’ অত্যন্ত লঘু হাস্যরসের ব্যাপার বলেই ভক্তপ্রসাদবাবুকে এই একটি ঘটনাতেই মূহ্যমান করে দেওয়া হয়েছে এবং চরিত্র তার পালটে গিয়েছে, এইরকম তিনি বলেছেন—এ জঘন্য কর্মটাই আজ অবধি দূর কল্যেম। এবারে যদি ভক্তপ্রসাদের চেতন না হয়, তবে তার পারা গর্দভ আর নাই।
অ্যাব্রামস এই ধরনের নাটককে বলেছেন—কাতাকুতু দিয়ে হাসানোর নাটক। বোধহয় তাই, নইলে প্রায় প্রথম থেকেই যেখানে বোঝা যায় ভক্তপ্রসাদের কুকীর্তি ধরা পড়ে যাবে সেখানেও আমরা আদ্যন্ত তা উপভোগ করি কেমন করে। বিশ্বাস্য, অবিশ্বাস্য সব ঘটনাই এই লঘু কল্পনার জগতে ভারহীন হয়ে যায়, নতুবা হাজিফ কেবলমাত্র ওষ্ট ও চিবুক ‘বস্ত্রাবৃত’ করে আসা সত্ত্বেও তাকে কেউ চিনতে না পেরে ভূত মনে করে অজ্ঞান হয়ে পড়বে, এটাও কখনই সম্ভব হতে পারে না।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদার | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply