প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি উদাহরণসহ আলোচনা কর।
প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
বাংলা ভাষার প্রাচীন যুগের বিস্তৃতিকাল হল আনুমানিক ৯০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই সময়সীমার মধ্যে ১২০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত যে কালপর্ব সেই পর্বের মধ্যে রচিত বলে নিঃসংশয়ে গ্রহণ করা যেতে পারে এমন কোনো বাংলা রচনার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সেই জন্য ১২০০ খ্রিঃ থেকে ১৩৫০ খ্রিঃ পর্যন্ত বিস্তৃত পর্বটিকে অনুর্বর পর্ব (barren period) বলা হয়। এই পর্বের ভাষার নিদর্শন পাওয়া যায়নি বলে এর বৈশিষ্ট্যও আমরা জানতে পারি না; তাই এই পর্বটিকে অন্ধকার যুগও বলা যায়। এইজন্যে এই পর্বটিকে বাদ দিয়েই অনেকে বলে থাকেন প্রাচীন যুগের বিস্তারকাল হল ৯০০ খ্রিঃ থেকে ১২০০ খ্রিঃ পর্যন্ত।
ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার বিষম ব্যঞ্জনের মিলনে গঠিত যুক্ত ব্যঞ্জনগুলি মধ্যভারতীয় আর্যভাষায় সমীভূত হয়ে সমব্যঞ্জনে গঠিত যুগব্যঞ্জনে পরিণত হয়েছিল (পর্বত > পব্বত, জন্ম > জম্ম)। প্রাচীন বাংলায় এই যুগ্ম ব্যঞ্জনের মধ্যে একটি লুপ্ত হল (যেমন— পব্বত > পর্বত, জম্ম > জম) এবং এই লোপের ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি দীর্ঘ হল (যেমন— পবত = প্+ অ + ব্ + অ + ত + অ > পাবত = প্ + আ + ব + অ + ত্ + অ, জম = জ + অ + ম্ + অ > জাম = জ + আ + ম্ + অ)।
(খ) নাসিক্য ব্যঞ্জন অনেক ক্ষেত্রে লোপ পেল এবং তার ফলে পূর্ববর্তী স্বরধ্বনি অনুনাসিক হয়ে গেল। যেমন— শব্দেন > সাঁদে।
(গ) পাশাপাশি অবস্থিত একাধিক স্বরধ্বনি বজায় ছিল, অর্থাৎ দুটি মিলে একটি স্বরে পরিণত হয় নি। যেমন— উদাস > উআস। কিন্তু পদের অন্তে অবস্থিত একাধিক স্বর যৌগিক স্বররূপে উচ্চারিত হত এবং ক্রমে দুটি মিলে একক স্বরে পরিণত হল। যেমন— ভণতি > ভণই ( = ভ্ + অ + ণ্ + অ + ই > ভ্ + অ + ণ্ + অই)।
(ঘ) পাশাপাশি অবস্থিত দুই স্বরধ্বনির মাঝখানে প্রায়ই য়-ধ্বনি শ্রুতিধ্বনি (glide) রূপে এসে যেত। যেমন— নিকটে > *নিঅড্ডী (ন্ + ই + অ + ড্ + ড্ + ঈ) > নিয়ড্ডী ( ন্+ ই + য়্ + অ + ড্ + ড্ + ঈ) নিয়ডি।
(ঙ) স্বরমধ্যবর্তী একক মহাপ্রাণ ধ্বনি প্রায়ই হ-কারে পরিণত হত। যেমন— মহাসুখ (ম্ + অ + হ্ + আ + স্ + উ + খ্ + অ) > মহাসুহ (ম্ + অ + হ্ + অ + স্ + উ + হ্ + অ, কথন (ক + অ + থ্ + অ + ন্ + অ) > কহন (ক্ + অ + হ্ + অ + ন্ + অ)।
(চ) ‘শ’ স্থানে ‘স’-এর ব্যাপক ব্যবহার দেখা যায়। যেমন— এড়িএউ ছান্দক বান্ধ করণক পাটের আস (< আশা), সুনুপাখ (শুন্যতাপাখা) ভিড়ি লাহু রে পাস (পাশ) (ছন্দের পটুতার আশা. ছাড়া হোক, শূন্যতা পাখা পাশে ভিড়ে ধর)।
রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য
(ক) কর্তৃকারকে শূন্য বিভক্তি (বিভক্তিহীনতা) প্রাচীন বাংলায় লক্ষ করা যায়। যেমন— চঞ্চল চীএ পইঠো কাল (চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবিষ্ট হল)। কখনো কখনো অনির্দিষ্ট কর্তায় ‘এ’-বিভক্তির প্রয়োগও দেখা যায়। যেমন— রুখের তেলি কুম্ভীরে খাঅ (গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়)।
(খ) কোনো কোনো ক্রিয়ার দুটি করে কর্ম থাকে— মুখ্য কর্ম ও গৌণ কর্ম। ক্রিয়াটির প্রসঙ্গে কী প্রশ্নের যে উত্তর পাওয়া যায় তা মুখ্য কর্ম এবং ‘কাকে’ প্রশ্নের যে উত্তর পাওয়া যায় তা গৌণ কর্ম। সাধারণত মুখ্য কর্ম অপ্রাণীবাচক কর্ম ও গৌণ কর্মই প্রাণীবাচক কর্ম হয়ে থাকে। প্রাচীন বাংলা থেকেই গৌণকর্ম ও সম্প্রদান কারকের রূপ একই রকম হতে থাকে। বাংলায় প্রায়ই গৌণ কর্মে ও সম্প্রদান কারকে কে, রে বিভক্তি বা শূন্য বিভক্তি পাওয়া যায়। যেমন-লুই ভণই গুরু পুচ্ছিঅ জান (লুই বলে-গুরুকে জিজ্ঞাসা করে জেনে নাও)। এখানে ‘গুরু’-তে শূন্য বিভক্তি। মুখ্য কর্মে শূন্য বিভক্তি দেখা যায়; যেমন— সসুরা নিদ গেল বহুড়ী জাগঅ। কানেট চোরে নিল কা গই মাগম।। (শ্বশুর ঘুমিয়ে পড়ল, বউ জেগে আছে, কানের দুল চোরে নিয়ে গেল, কোথায় গিয়ে চাওয়া যায়) (কানেট = শূন্য বিভক্তি)।
(গ) করণ কারকের বহু প্রচলিত বিভক্তি ছিল -এঁ (< এন)। যেমন— মতিএঁ ঠাকুরক পরিণিবিত্তা, (মতি = ঐ বিভক্তি), করণ ও অধিকরণ কারক প্রায়ই একাকার হয়ে গেছে। ফলে অধিকরণেও প্রায়ই একই বিভক্তি চোখে পড়ে। যেমন—ঘরে।
(ঘ) অধিকরণের আরো বিভক্তি ছিল— ই, এ, হি, তেঁ, ত। যেমন— নিঅড়ি বোহি মা জাহুরে লাঙ্ক। চঞ্চল চীএ পইঠো কাল (চঞ্চল চিত্তে কাল প্রবিষ্ট হল)।
(ঙ) অধিকরণের বিভক্তিগুলির মধ্যে ‘এ’ বিভক্তির প্রয়োগ ছিল ব্যাপক। এত ব্যাপক যে অন্যান্য কারকের অর্থ প্রকাশ করার জন্যেও এই বিভক্তির তির্যক, ব্যবহার ছিল। যেমন কর্তৃকারকের অর্থে— কানেট চোরে নিল কা গই মাগম (কানের দুল চোরে নিল, কোথায় গিয়ে চাওয়া যায়?); অপাদানের অর্থে— জামে কাম কি কামে জাম (জন্ম থেকে কর্ম হয়, নাকি কর্ম থেকে জন্ম হয়?)।
(চ) সম্বন্ধ পদের বিভক্তি ছিল— এর, র, ক। যেমন— রুখের তেন্তলি কুম্ভীরে খাঅ (গাছের তেঁতুল কুমীরে খায়), মোহোর বিগোআ কহণ ন জাই (আমাদের মিলনসুখের কথা বলা যায় না)।
(ছ) তির্যক বিভক্তি ছাড়া অপাদানের নিজস্ব বিভক্তি ছিল। যেমন— রঅণহুঁ (< রত্নাৎ = রত্ন থেকে)।
(জ) বিভক্তির অর্থ প্রকাশ করার জন্য যেসব শব্দ বিভক্তির বদলে ব্যবহৃত হয়, অথচ যেগুলি বিভক্তির মতো মূল শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায় না সেগুলিকে অনুসর্গ বলে। এই রকম অনুসর্গের ব্যবহার প্রাচীন বাংলাতেই সূচিত হয়েছিল। যেমন— নিমিত্তার্থে চতুর্থ বিভক্তির স্থানে ‘অন্তরে’— তোহোর অন্তরে মোএ ঘলিলি হাড়েরি মালী (তোর জন্যে আমি হাড়ের মালা নিলাম)।
(ঝ) ভবিষ্যৎ কালের ক্রিয়ারূপ গঠিত হত ‘ইব’ যোগ করে। যেমন— মই ভাইব (আমি ভাববো)।
Leave a Reply