//
//

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার আনুমানিক বিস্তৃতি হল ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এই যুগের ভারতীয় আর্যভাষার মূল নিদর্শন পাওয়া যায় হিন্দুদের প্রাচীনতম ধর্মগ্রন্থ ‘বেদ’-এ। বেদ চারটি— ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রত্যেক বেদের আবার চারটি অংশ— সংহিতা (মূলমন্ত্রভাগ), ব্রাহ্মণ (যজ্ঞানুষ্ঠানের গদ্যাত্মক বিধিবিধান ও কিছু ব্যাখ্যা তথা কিছু আখ্যান-উপাখ্যান), উপনিষদ (গদ্য ও পদ্যে রচিত মূল আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তত্ত্ব) এবং আরণ্যক (গৃঢ়তর দার্শনিক তত্ত্ব ও কিছু আখ্যান-উপাখ্যান)। এগুলির মধ্যে ঋগ্বেদের সংহিতা অংশটি প্রাচীনতম। এই ঋক্‌-সংহিতাই হল প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার সবচেয়ে প্রামাণিক দলিল। বৈদিক যুগের ভারতীয় আর্যভাষাই হল প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার অবিমিশ্র অবিকৃত নিদর্শন।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

(ক) ঋ, ৯, এ, ঐ প্রভৃতি স্বরধ্বনি এবং শ, ষ, স প্রভৃতি ব্যঞ্জনধ্বনি বেদের পরবর্তী যুগে পরিবর্তিত হয়েছে বা লোপ পেয়েছে, কিন্তু বৈদিক ভাষায় ঋ, ঋ, ৯, এ, ঐ সহ সমস্ত স্বরধ্বনি এবং শ, ষ, স সহ সমস্ত ব্যঞ্জনধ্বনিই প্রচলিত ছিল।

(খ) স্বরাঘাতের (pitch accent) স্থান পরিবর্তনের ফলে শব্দের অন্তর্গত স্বরধ্বনির বিশেষ ক্রম অনুসারে গুণগত পরিবর্তন (Ablaut qualitative change) হত। স্বরধ্বনির এই পরিবর্তনের তিনটি ক্রম (grade) ছিল— গুণ (strong normal grade), বৃদ্ধি (lengthened grade) এবং সম্প্রসারণ (weak / reduced grade)। স্বরধ্বনি অবিকৃত থাকলে তাকে গুণ (strong / nomal grade) বলে। যেমন— ‘স্বপ’ ধাতু থেকে জাত ‘স্বপ্ন’ শব্দে ‘অ’ স্বরধ্বনিটি অবিকৃত আছে। স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়ে গেলে তাকে বৃদ্ধি (lengthened grade) বলে। যেমন ‘স্বপ’ ধাতু থেকে জাত ‘স্বাপ’ শব্দে ‘অ’  স্বরধ্বনি দীর্ঘ হয়ে ‘আ’ হয়েছে। স্বরধ্বনি যখন ক্ষীণ (reduced) হয়ে লোপ পেয়ে যায় এবং তার ফলে শব্দের অন্তর্গত ঋ, র, ব ধ্বনির স্থানে যথাক্রমে র, ই, উ আসে, তখন এই পরিবর্তনকে সম্প্রসারণ (reduced grade) বলে। যেমন— ‘স্বপ’ ধাতু থেকে জাত ‘সুপ্ত’ শব্দে ‘স্বপ’ ধাতুর ‘অ’ ধ্বনিটি লোপ পেয়েছে এবং তার ফলে ‘ব’ ধ্বনিটি পরিবর্তিত হয়ে ‘সুপ্ত’ শব্দে ‘উ’ ধ্বনি হয়ে গেছে।

(গ) সন্নিহিত দু’টি ধ্বনির মধ্যে যেখানে সন্ধি সম্ভব সেখানে সন্ধি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই অপরিহার্য ছিল।

(ঘ) বৈদিক ভাষায় শব্দের অন্তর্গত বিশেষ ধ্বনির উপরে স্বরতন্ত্রীর কম্পনজাত সুরের তীব্রতা বাড়িয়ে জোর দেবার রীতি প্রচলিত ছিল। একে স্বরাঘাত (pitch accent) বলা হত। বৈদিকে স্বর তিন প্রকার ছিল— উদাত্ত (high/acute), অনুদাত্ত (low/grave) এবং স্বরিত (circumplex)। একই শব্দে একটি অক্ষর থেকে অন্য অক্ষরে স্বরাঘাতের স্থান-পরিবর্তনের ফলে শব্দের অর্থই পরিবর্তিত হয়ে যেত। যেমন— র্অপস = কার্য (বিশেষ্য), অর্পস = সক্রিয় (বিশেষণ), রাজপুত্র = রাজা যার পুত্র (অর্থাৎ রাজার পিতাকে বোঝাচ্ছে) বস্ত্রীহি সমাস, রাজপুর্ত্র = রাজার পুত্র (পুত্রকে বোঝাচ্ছে) ষষ্ঠী তৎপুরুষ সমাস।

(ঙ) বিভিন্ন যুক্তব্যঞ্জনের স্বচ্ছন্দ ব্যবহার প্রচলিত ছিল। যেমন ক্র, ক্ল, ক্ত, ক্তৃ, ক্ষা, র্ম ইত্যাদি। কিন্তু পরবর্তী কালে মধ্য ভারতীয় আর্যে অনেক যুক্তব্যঞ্জন সমীভূত হয়েছে এবং আরো পরে নব্য-ভারতীয় আর্যে একক ব্যঞ্জনে পরিণত হয়ে গেছে। যেমন— ভক্ত > ভত্ত > ভাত, ধর্ম > ধম্ম > ধাম।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা থেকে জাত গ্রীক, লাতিন, গথিক প্রভৃতি ভাষার তুলনায় প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি অনেক বেশি রক্ষিত আছে।

(ক) মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার তিনটি বচন (একবচন, দ্বিবচন, বচন) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় প্রচলিত ছিল। মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষায় দ্বিবচন অবশ্য শুধু প্রকৃতি-নির্দিষ্ট জোড়া-জোড়া প্রাণীর (যেমন-পিতা-মাতা ইত্যাদি) ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল। এই বৈশিষ্ট্য বৈদিক ভাষায় এবং হোমরের গ্রীকেও লক্ষ করা যায়। পরবর্তী কালে ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে যে কোনো দুটি জিনিস বোঝাতে দ্বিবচনের প্রচলন হয়। বচনভেদে ধাতুরূপ ও শব্দরূপের পার্থক্য হত।

(খ) মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মতো প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষাতেও আটটি কারক ছিল কর্তৃকারক (Nominative), কর্ম কারক (Accusative), করণ কারক (Instrumental), সম্প্রদান কারক (Dative), অপাদান কারক (Ablative), সম্বন্ধপদ (Genitive), অধিকরণ কারক (Locative) এবং সম্বোধন পদ (Vocative)। লক্ষণীয় যে সংস্কৃতে সম্বন্ধ পদ ও সম্বোধন পদকে ঠিক কারকের মধ্যে ধরা হয়নি, কারণ এই দুটির সঙ্গে বাক্যের ক্রিয়ার সোজাসুজি সম্পর্ক ছিল না; সংস্কৃত মতে ক্রিয়ার সঙ্গে বাক্যের বিভিন্ন পদের যে সম্পর্ক থাকে শুধু তাকেই কারক বলা হত (ক্রিয়ান্বয়ি কারকম্)। প্রাচীন ভারতীয় আর্যে বিভিন্ন কারকের পৃথক বিভক্তিচিহ্ন ছিল এবং বিভক্তিযোগে বিভিন্ন কারকে বিশেষ্য, সর্বনাম ও বিশেষণের পৃথক্‌ রূপ হত (দু’একটি ক্ষেত্রে অবশ্য ব্যতিক্রম ছিল)। মূল শব্দের অন্ত্য ধ্বনি পৃথক হলেও শব্দরূপ পৃথক হত।

(গ) মূল ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার মতো প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষায় তিন প্রকার লিঙ্গ ছিল—পুংলিঙ্গ (Masculine), স্ত্রীলিঙ্গ (Feminine) এবং ক্লীবলিঙ্গ (Neuter)। এই লিঙ্গ-ভেদ প্রকৃতিনির্দিষ্ট (Natural) লিঙ্গ-ভেদ অনুসারে ছিল না, অর্থাৎ শব্দের অর্থের উপরে লিঙ্গ নির্ভর করত না, এই লিঙ্গ-ভেদ ছিল ব্যাকরণগত (Grammatical Gender), অর্থাৎ বিশেষ বিশেষ শব্দের লিঙ্গ ব্যাকরণে নির্দিষ্ট থাকত। যেমন ‘লতা’ শব্দ প্রাকৃতিক বিচারে ক্লীবলিঙ্গ, কিন্তু প্রাচীন ভারতীয় আর্য সংস্কৃতে এটি স্ত্রীলিঙ্গ বাচক শব্দ বলে ব্যাকরণে নির্দিষ্ট ছিল। লিঙ্গভেদ অনুসারে শব্দরূপ পৃথক্‌ হত, কিন্তু ক্রিয়ারূপ পৃথক্‌ হত না।

(ঘ) শব্দরূপের (Declension) চেয়ে ক্রিয়ারূপে (Conjugation) বৈচিত্র্য প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় অনেক বেশি ছিল। দুইবাচ্যে (কর্তৃবাচ্য = active voice ও কর্ম-ভাববাচ্য = middle voice) ক্রিয়ার রূপ হত পৃথক্‌ পৃথক্‌। •

(ঙ) ক্রিয়ারূপ দুই পদে বিভক্ত ছিল অর্থাৎ ক্রিয়াবিভক্তির দু’রকম রূপ ছিল—পরস্মৈপদ ও আত্মনেপদ। ধাতুও তিন ভাগে বিভক্ত ছিল—পরস্মৈপদী, আত্মনেপদী ও উভয়পদী। কর্তৃবাচ্যে পরস্মৈপদী ধাতুর সঙ্গে পরস্মৈপদের বিভক্তি, আত্মনেপদী ধাতুর সঙ্গে আত্মনেপদের বিভক্তি আর উভয়পদী ধাতুর সঙ্গে ক্ষেত্রবিশেষে পরস্মৈপদের বিভক্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে আত্মনেপদের বিভক্তি যোগ হত। নিজের জন্যে কোনো কাজ করলে আত্মনেপদের বিভক্তি এবং পরের জন্যে কোনো কাজ করলে পরস্মৈপদের বিভক্তি যোগ হত। কর্ম ভাববাচ্যে আত্মনেপদের বিভক্তি যোগ হত।

(চ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে তিন পুরুষে (উত্তম পুরুষ, মধ্যম পুরুষ ও প্রথম পুরুষ) ক্রিয়ার রূপ পৃথক্‌ হত। প্রত্যেক পুরুষের আবার তিন বচনে (একবচন, দ্বিবচন, বহুবচন) ক্রিয়ারূপের পার্থক্য হত।

(ছ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষায় (বৈদিক) ক্রিয়ার পাঁচ কাল (Tense) প্রচলিত ছিল। এগুলি হল— লটু (Present), ল (Imperfect), পৃঢ় (Future), লিটু (Perfect), লুণ্ডু (Aorist)। এগুলির মধ্যে তিনটি (ল, লুঙ ও লিট) ছিল অতীতকালেরই প্রকারভেদ।

(জ) বৈদিকে ক্রিয়ার পাঁচটি ভাব (Mood) ছিল— অভিপ্রায় (লেট) (Subjunctive), নিবন্ধ (Injunctive), নির্দেশক: (Indicative), সম্ভাবক (বিধিলিঙ) (Optative), অনুজ্ঞা (লোট), (Imperative)। ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে প্রথম দুটি ছিল না।

(ঝ) উত্তরকালের ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে প্র, পরা, অপ, সম, অনু, অব, নি, দুর, অভি, বি, অধি, সু, উৎ, অতি, নি, প্রতি, পরি, অপি, উপ, আ—এই কুড়িটি উপসর্গ ছিল, এগুলি ধাতুর পূর্বে যুক্ত হত এবং ক্রিয়ার অর্থ পরিবর্তিত করত। যেমন— প্র + হার = প্রহার, উপ + হার = উপহার, বি + হার = বিহার। কিন্তু পূর্ববর্তী বৈদিক যুগে এই ধরনের উপসর্গ শুধু ক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত আকারেই ব্যবহৃত হত না, স্বাধীন পদ রূপে স্বতন্ত্রভাবেও ব্যবহৃত হত।

(ঞ) প্রত্যয়-যোগে প্রচুর নতুন শব্দ গঠনে প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা অদ্বিতীয়। প্রত্যয় দু’রকমের ছিল— কৃৎপ্রত্যয় ও তদ্ধিত প্রত্যয়। ধাতুর সঙ্গে যে প্রত্যয় যোগ করা হত তাকে বলা হত কৃৎপ্রত্যয়। যেমন বৃৎ + শান (মান) = বর্তমান, মন্ + উ = মনু। আর শব্দের সঙ্গে যে প্রত্যয় যোগ হত তাকে বলা হত তদ্ধিত প্রত্যয়। যেমন— মনু + অণ = মানব।

(ট) বৈদিক ভাষায় ধাতুর সঙ্গে শত্, শান প্রভৃতি প্রত্যয় যোগ করে বহু বিচিত্র ক্রিয়াজাত বিশেষণ (Present Participle) সৃষ্টি করা হত। যেমন vহু + শতৃ = নহবৎ, কৃ + শানচ = ক্রিয়মাণ।

(ঠ) বৈদিকে ধাতুর সঙ্গে ত্ব, ব্যয় ইত্যাদি প্রত্যয় যোগ করে বহু অসমাপিকা ক্রিয়া (Gerund) রচনা করা হত। যেমন— পা + ত্বা = পীত্ব, ॥ দৃশ + ত্বায় = দৃষ্টায় ইত্যাদি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!