//
//

বক্রোক্তিবাদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা কর।

বক্রোক্তিবাদ

সাধারণ অর্থে বক্রোক্তি বলতে ‘বাঁকা কথা’কে বাোঝানো হয়ে থাকে। সংস্কৃত ও বাংলা অলংকার গ্রন্থে ‘বক্রোক্তি’কে শব্দালংকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই অলংকারটি আবার দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত। কাকু ও শ্লেষ। উচ্চারণ বা কণ্ঠস্বরের ভঙ্গির ওপর নির্ভর করে কাকু বক্রোক্তি অলংকার হয় এবং শ্লেষ বক্রোক্তিতে বাহ্য অর্থ ছাড়াও অন্য একটি অর্থ থাকে। সংস্কৃত আলংঙ্কারিক মম্মট ও রুদ্রট বক্রোক্তিকে শব্দালংকার হিসাবেই গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ভামহ, দণ্ডী ও বামন শব্দালংকার থেকে বক্রোক্তিকে পৃথক করে নিয়েছিলেন। বক্রোক্তিবাদের সর্বময় প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল কুন্তকের হাতে; কিন্তু তার আলোচনা পূর্বসূরীদের আলোচনার ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে।

দণ্ডী ‘বক্রোক্তি’ কথাটির দ্বারা স্বভাবোক্তি থেকে যাবতীয় অলংকারের পার্থক্য নির্ণয় করেছিলেন। তিনি সব অলংকারকেই বক্রোক্তি বলতে চেয়েছেন। দণ্ডী ‘স্বভাবোক্তি’কে প্রথম কাব্যালঙ্কার বা ‘আদ্যা অলংকৃতিঃ’ বলে চিহ্নিত করেন। তিনি পৃথক পৃথকভাবে একাধিক অলংকারের আলোচনা করলেও উপমা, রূপক, উৎপ্রেক্ষা, অবয়ব, অনন্বয়, সসংদেহকে পৃথক অলংকারের মর্যাদা দিতে রাজি ছিলেন না। তাঁর কাছে ‘শ্লেষ’ হল সমস্ত অলংকারের চমৎকারিত্ব বিধায়ক। দণ্ডী বাঙ্ময় কাব্যকে দুটি ভাগে বিভক্ত করেছিলেন— স্বভাবোক্তি ও বক্রোক্তি। তিনি মনে করতেন বক্রোক্তির সৌন্দর্য নির্ভর করে শ্লেষের ওপর।

আচার্য ভামহও প্রচলিত অর্থে ‘বক্রোক্তি’ কথাটিকে গ্রহণ করেননি। তিনি শব্দার্থের মিলনকে সাহিত্য বললেও সেই মিলনের বক্রতার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। অর্থাৎ শব্দার্থময় সাহিত্যে শব্দ ও অর্থের যে মিলন ঘটে তা হয় বক্র। তিনি ব’ বলতে আরও কিছুকে বুঝেছিলেন। সাধারণভাবে শব্দার্থ থেকে যা বোঝা যায় বক্ৰমিলনে তার থেকে আর একটু বেশি বোঝানোই কবিদের উদ্দেশ্য থাকে। একমাত্র বক্রোক্তিই পারে সেই আরও কিছুর ইঙ্গিত দিতে। ভামহ মনে করতেন, অলঙ্কার মাত্রই বক্রোক্তি। নাটক, মহাকাব্য, কথা, আখ্যায়িকা সর্বত্রই বক্রোক্তি থাকা বাঞ্ছনীয়।

তিনি বক্রোক্তিকে ‘লোকাতিক্রান্ত গোচরং বচঃ বলেছিলেন। ‘লোকাতিক্রান্ত’ বলতে তিনি দৈনন্দিন ভাষা থেকে পৃথক অন্যজাতের ভাষাকে বুঝিয়েছিলেন। তিনি সব অলংকারের মধ্যেই একটি অতিশয়োক্তির ভাব লক্ষ করে বক্রোক্তিকে অতিশয়োক্তির সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন— “সৈষা সর্বৈব বক্রোক্তি।” আর “সৈষা’ বলতে অতিশয়োক্তিকে বুঝিয়েছিলেন। অথাৎ ভামহের মতে সব অলংকারই এক হিসাবে অতিশয়োক্তি ও বক্রোক্তি। সুতরাং ভামহের বক্রোক্তি বিষয়ক আলোচনায় দুটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রথমতঃ তিনি বক্রোক্তিকে মম্মট বা রুদ্রটের মত নিছক শব্দালংকার হিসাবে মেনে নেননি এবং দ্বিতীয়তঃ বক্রোক্তির মধ্যে তিনি লোকোত্তর বিষয়ের ইঙ্গিত করেছিলেন।

আচার্য বামনও বক্রোক্তিকে শব্দালংকার বলতে চাননি। তিনি বক্রোক্তিকে লক্ষণার দ্বারা রচিত ভিত্তি অলংকার বলে চিহ্নিত করেছিলেন এবং এই অর্থালঙ্কারে সাদৃশ্যের সাহায্যে লক্ষণার ভিত্তি রচিত হয় বলে মনে করেছিলেন।

কুন্তক তাঁর ‘বক্রোক্তিজীবিত’ গ্রন্থে যে বক্রোক্তিতত্ত্ব খাড়া করেছেন তার অনেকটাই ভামহের তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। কুন্তক শব্দ ও অর্থের মিলিত রূপকে সাহিত্য বলে গণ্য করলেও নিছক শব্দার্থের মিলনকে সাহিত্য বলেননি। শব্দ ও অর্থের মিলন যখন আত্মাদজনক হয়ে ওঠে তখনই তা সাহিত্য পদবাচ্য হয়। কাব্য ও সাহিত্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে কুন্তক বলেছিলেন—

শব্দার্থেী সহিত বক্রকবিব্যাপারশালিনি।

বন্ধে ব্যবস্থিতৌ কাব্যং তদ্বিদাহ্লাদারিণি।।

অর্থাৎ মিলিত শব্দার্থ কাব্যরসিকদের আহ্লাদজনক বক্রতাময় কবি ব্যাপারপূর্ণ রচনাবন্ধে বিন্যস্ত হলেই কাব্য হয়ে থাকে। তিনি অন্যত্র বলেছেন, এই কাব্য রসিকজনের “অদ্ভুতামোদ চমৎকার’ বিধান করে। শব্দ হল বাচক এবং অর্থ তার বাচ্য। এদের মিলিত সত্তাকেই কাব্য বলে। কেবল শব্দও কাব্য নয়, আবার কেবল অর্থও কাব্য নয়। উভয়ের যুগপৎ মিলনেই কাব্য হয়। কুন্তক বলেছিলেন যে, প্রতিভার দারিদ্র্যের জন্য যারা কেবলমাত্র শব্দমাধুর্য সৃষ্টি করতে চান তারা কাব্যের যথার্থ সম্পদ প্রকাশ করতে পারেন না।

আবার কেবলমাত্র অর্থ-চাতুর্যের দ্বারা শুষ্ক তর্কের গাঁথুনি গাঁথলেও কাব্য হয় না। প্রতিভার দ্বারা প্রথমে বর্ণনীয় বস্তুটি কবিচিত্তে মণিখণ্ডের ন্যায় প্রতিভাত হয়। অস্ফুটভাবে যা মনের মধ্যে প্রতিভাত হয় তা যদি বক্রবাক্যের দ্বারা প্রকাশিত হয় তা উজ্জ্বল হীরের মালার ন্যায় শোভা পায় ও অভিজ্ঞ ব্যক্তির আনন্দ উৎপাদন করে এবং তখনই তা কাব্যত্ব লাভ করে। কুন্তক বলেছিলেন যে, একই কথা ভঙ্গিগত বিভিন্নতার কারণে অর্থাৎ বিভিন্নভাবে প্রকাশিত হওয়ার জন্য কাব্যসম্পদের পার্থক্য রচনা করে।

অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, কুন্তক শব্দ ও অর্থের মিলিতসত্তার চমৎকারিত্বের মধ্যে যে কাব্যত্ব অন্বেষণ করেছেন তার প্রকৃত অর্থ কী? শব্দ ও অর্থ তো সর্বদা মিলিতই থাকে। বাচ্য ও বাচক, অর্থ ও শব্দের কোনোখানেই তো মিলিতসত্তার অভাব নেই। তবে এদের মিলনে কাব্য হয় একথা বলার অর্থ কী? এর উত্তরে কুন্তক বলেছেন যে কাব্য হতে গেলে শব্দার্থের মিলিতসত্তার একটি বিশিষ্টতা আবশ্যক। যাকে শব্দার্থের ‘সাম্যসুভগ’ অবস্থান বলা চলে। এই মিলন হবে ন্যূনতা এবং বাহুল্যবর্জিত মনোহারী মিলন।

অর্থাৎ শব্দ ও অর্থ কেউ কারও চেয়ে ছোট বা নিকৃষ্ট হবে না, আবার বড় বা উৎকৃষ্টও হবে না। তারা হবে পরস্পর স্পর্ধিত রমণীয়—পরস্পরকে স্পর্ধা করে সমানভাবে বড় হয়ে উঠে পরস্পরের সংযোগে তারা রমনীয় হয়ে উঠবে। এই পরস্পর স্পর্ধা প্রতিযোগিতামূলক হলেও শত্রুভাবাপন্ন নয়, মিত্রভাবাপন্ন। অথাৎ উভয়ের মধ্যে থাকবে একটা সৌভ্রাতৃত্বের বন্ধন। একে অনেকটা তুলনা করা যেতে পারে মাঠের দুটি বড় তালগাছের সঙ্গে। উদ্ভিদবিদরা বলেন যে মানুষের মত গাছের মধ্যেও বড় হওয়ার প্রতিযোগিতা চলে।

এর ফলে পাশাপাশি অবস্থিত দুটো বড় গাছ উভয়ে উভয়কে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতার নামে, কিন্তু সেই প্রতিযোগিতার মধ্যে কোনো অসুস্থতা থাকে না। একটা গাছ আর একটা গাছকে ঠেলে ফেলে দিয়ে কখনই বড় হয় না। অনুরূপভাবে শব্দ ও অর্থও পরস্পরকে স্পর্ধা করে বড় হয়ে উঠলেও তাদের মধ্যে থাকে সৌভ্রাতৃত্ব। এই সৌভ্রাতৃত্বের ফলেই কাব্য রমণীয় হয়ে ওঠে। শব্দ ও অর্থের সম্বন্ধের বিশিষ্টতা অর্থাৎ সৌকুমার্য ও সূক্ষ্মতা না থাকলে কাব্য হয় না। কাব্যশিল্পের জন্যে চাই একদিকে পরস্পর অর্থের সামঞ্জস্যে ক্রমবিকাশ এবং অন্যদিকে সেই অর্থের সামঞ্জস্যে শব্দের মিলন।

অর্থাৎ কাব্য রচনার সময় দেখা দরকার শব্দগুলি অর্থের আনুকূল্য করেছে কিনা বা শব্দগুলির বিন্যাসে অর্থধারা কলুষিত হয়েছে কিনা। পরস্পর প্রতিস্পর্ধীভাবগুলি কিভাবে একটি অখণ্ড অর্থসম্পদ ফুটিয়ে তুলে যথার্থ কাব্য হয়ে ওঠে তার প্রমাণ দিয়েছেন অধ্যাপক সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত ‘মালতীমাধব’ এর একটি শ্লোক উদ্ধার করে। কোনও কাপালিক কোনও সুন্দরী নায়িকাকে বধ করতে উদ্যত হলে কোও ব্যক্তি নায়িকার অসাধারণ লাবণ্য বর্ণনা করতে গিয়ে বলছেন—

অসারং সংসারং পরিমুষিতরত্নং ত্রিভুবনং

নিরালোকং লোকং মরণশরণং বান্ধবজনং।

অদর্পং কন্দর্পং জননয়ননির্মাণমফলং 

জগজ্জীর্নারণ্যং কথমসি বিধাতুং ব্যবসিতঃ।।

এই শ্লোকে নায়িকা নিহত হলে সংসারের কি ক্ষতি হবে তা বর্ণনা করতে গিয়ে কবি চিত্তে এক একটি কথা মনে হয়েছে এবং পরক্ষণেই মনে হয়েছে ঐটুকুই যেন যথেষ্ট নয়। এই অভাববোধ থেকে তার মনের মধ্যে আবার নতুন ভাবের উদয় হয়েছে এবং পরস্পর স্পর্ধিত ভাবগুলি কাব্যের অখণ্ড অর্থসম্পদ গড়ে তুলেছে।

প্রথমে কবির মনে হয়েছে, নায়িকা নিহত হলে সংসার অসার হবে, কিন্তু এতে কবির মনোবেদনা সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয়নি জেনেই তিনি আবার বলছেন, সমস্ত ত্রিভুবনের একমাত্র রত্ন অপহৃত হবে, পৃথিবীর আলো নিভে যাবে, মানুষের চক্ষুনির্মাণের প্রয়োজনীয়তা দূর হবে, জগৎ শুষ্ক অরণ্য হবে। এমনি করে এক একটি ভাবের পাঁপড়ি পরস্পর প্রতিযোগিতায় ফুটে উঠে একটি সমগ্র ভাবকমল ফুটিয়ে তুলেছে। কিন্তু যদি কবি এখানে একটি ভাবের দ্বারা চমৎকারিত্ব ফোটাতে চাইতেন তবে তা এতো সুন্দর হত না। এখানে অনেকগুলি পরস্পর প্রতিস্পর্ধী ভাব বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে বড় হয়ে উঠেছে বলেই কাব্যটি রমণীয় হয়েছে।

কুন্তক বক্রোক্তি বিষয়ে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন সেখানে বাইরের জগৎ বা বস্তু জগৎ উপেক্ষিত হয়নি। কাব্য রচনার সময় এই জগৎ কবিচিত্তে ঠাই পায় এবং তার অন্তরে গভীর আলোড়ন জাগায়। এই আলোড়নের ফলে বাহ্যজগৎটি কবির মনে আর পূর্বাবস্থায় থাকে না। তা তাঁর অন্তলোর্কে ভাবময় অলৌকিক রূপ পরিগ্রহ করে। এমতাবস্থায় অন্তরের পরিষ্পদনে বা আলোড়নে কবি এমন সমস্ত শব্দ নির্বাচন করেন যা ভাবময় বস্তুটির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। অর্থাৎ কবির মনের মধ্যে বাইরের বিষয়বস্তুজাত যে নবীন ভাবময় দেহখানি ফুটে ওঠে তাই যেন স্বমহিমায় শব্দরূপে অবতীর্ণ হয়।

অলৌকিক ব্যাপার-মাহাত্ম্যে জাগতিক বস্তু যেমন কবিচিত্তে ভাবময় হয় তেমনি যথোপযুক্ত শব্দ নির্বাচন, সঞ্চয়ন ও বিন্যাস সেই অলৌকিক ব্যাপারেরই ফল। কাব্যসৃষ্টির প্রক্রিয়াটি হল প্রথমতঃ বাহ্যজগতের ভাবরূপ পরিগ্রহ এবং দ্বিতীয়তঃ পরিগৃহীত ভাবরূপটিকে যথাযথ শব্দরূপে পরিবর্তন। যে, কোনো সার্থক সাহিত্যই এই ভাবরূপ ও শব্দরূপের যথাযথ মিলন।

এবারে একটু সহজ ভাবে কুন্তকের বক্তব্যকে বোঝা যেতে পারে। আমরা দেখেছি, বস্তুজগতের সঙ্গে ভাবময় জগতের একটা পার্থক্য আছে। তেমনি লোকমুখে ব্যবহৃত সাধারণ লৌকিক শব্দের সঙ্গে কবির অলৌকিক জগৎ অথাৎ কাব্য বা সাহিত্যে ব্যবহৃত শব্দেরও পার্থক্য আছে। ভাব যে রূপে, যে ভাবে কবির মনের মধ্যে ফুটে ওঠে ঠিক তার উপযোগী শব্দও তার মনে জন্ম নেয়।

ভাবোপযোগী শব্দ যদি স্ব-মহিমায় প্রকাশিত না হত তবে সাহিত্য সৃষ্টির প্রচেষ্টা অনেকাংশে ব্যাহত হত। শব্দ, ভাবের পরিপোষকতা না করলে সাহিত্য রচনার উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। যথার্থ ভাবরূপের সঙ্গে যথার্থ শব্দরূপের মিলনেই সাহিত্য গড়ে ওঠে। সার্থক কবির কাছে দুটি একই প্রযত্নে জন্ম নেয়। এদের জন্যে আলাদা আলাদা ভাবে পরিশ্রমের প্রয়োজন হয় না।

অর্থ প্রসঙ্গে কুত্তক বলেছেন যে, বাইরের জগৎ নানারকম ভাবধর্মের দ্বারা আমাদের মনের মধ্যে রচিত হতে পারে। কিন্তু যে ভাবধর্মের দ্বারা রচিত হলে অর্থাৎ যে বিশেষভাবরূপ পরিগ্রহ করলে তা সহৃদয়গণের আহ্বাদের কারণ হয় তাই কাব্যাকারে পরিণতি লাভ করে। অন্তরের আলোড়নজাত যে সমস্ত শব্দ কবি নির্বাচন করেন সেই শব্দগুলির অর্থই কবির অভিপ্রেত। এই জাতীয় শব্দ ও অর্থের মিলনে যে ভাব ধরা দেয় তা অলৌকিক। শব্দ ও অর্থের এই ধরনের মিলন, যা অন্যভাবে কাব্যের শৈল্পিক ধর্ম (Aesthetic quality) রূপে ব্যাখ্যাত হতে পারে তাকেই কুন্তক ‘বক্রতা’ রূপে অভিহিত করেছেন।

কুন্তক কোনো বস্তুর স্বভাবমাত্র বর্ণনাকে অলঙ্কার বলতে চাননি। কেননা তিনি মনে করতেন, যাই বর্ণনা করা হোক না কেন তার স্বভাবটা সেখানে থাকবেই। সেই স্বভাবের অতিরিক্ত কোনো ভাবধর্ম যুক্ত না হলে কোনো অলংকার সৃষ্টি হতে পারে না। এইজন্যে কুন্তক দণ্ডীর স্বভাবোক্তি অলংকারকে বর্জন করেন। অভিনবগুপ্ত অলংকার সম্বন্ধে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, যা রসের শোভাবৃদ্ধি না করে তা অলংকারই নয়। তার মতে অলংকার হ’ল রসের ‘শোভা-সম্পাদক ধর্ম’।

কুন্তক রসের সঙ্গে না হলেও বক্রতার সঙ্গে অন্বিত করে অলংকারের বিচার করেছেন। প্রচলিত অলংকারগুলির কোনো মূল্যই থাকে না যদি না সেগুলি বক্রতার সঙ্গে অন্বিত হয়ে কাব্যশোভা বৃদ্ধি করে। বক্রতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ হলেই প্রচলিত অলংকারগুলি যথার্থ স্থান লাভ করে; তখন তা বক্রোক্তিরই একটা স্তর হয়ে ওঠে। এইভাবে কুন্তক বক্রোক্তির মধ্যে প্রচলিত অলংকারগুলি অঙ্গীভূত করে নিয়েছিলেন।

কুন্তক রীতির আলোচনা করতে গিয়ে বামনের তিনটি এবং দণ্ডীর দেওয়া দুটি রীতিকে অস্বীকার করেছেন। তার মতে দেশ-বিশেষে কোনো রীতির নামকরণ করা হতে পারে। রীতির মধ্যে দিয়ে কবির স্বভাবটি যেহেতু ধরা পড়ে তাই তা দেশ-বিশেষের ধর্ম হতে পারে না। তিনি রীতির পরিবর্তে তিনটি ‘মার্গ’ এর কথা বলেছিলেন। এগুলি হল—সুকুমার, বিচিত্র ও মধ্যমমার্গ। এই মার্গগুলির মধ্যে কোনটা শ্রেষ্ঠ, বা কোটা নিকৃষ্ট এ প্রশ্ন অবান্তর। কবির স্বভাবজনিত কারণে লিখনপ্রণালীতেও অসংখ্য পার্থক্য থাকতে পারে। আমাদের শুধু দেখা কর্তব্য রচিত কাব্যটি রমণীয় হয়ে উঠেছে কিনা। তিনরীতির যে কোনো একটিতে সাহিত্য রচনা করেই অমর হওয়া সম্ভব।

গুণের আলোচনা করতে গিয়ে কুন্তক গুণকে দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন—সাধারণ ও অসাধারণ। সৌভাগ্য, ও ঔচিত্যকে তিনি বলেছেন সাধারণ গুণ এবং মাধুর্য, প্রসাদ, লাবণ্য ও আভিজাত্যকে বলেছেন অসাধারণ গুণ। যে কোনো উত্তমকাব্যে সৌভাগ্য ও ঔচিত্যগুণ থাকেই কিন্তু সুকুমার ও বিচিত্র মার্গের কাব্যে থাকে অসাধারণ গুণ। অসাধারণ গুণগুলি স্বভাব মার্গ অনুযায়ী ভিন্ন হয়। গুণের আলোচনা করতে গিয়ে কুন্তক অন্তত তিনটি গুণের কথা বলেছিলেন যা একেবারেই অভিনব। এগুলি হল লাবণ্য, আভিজাত্য ও সৌভাগ্য। কুন্তকের গুণের আলোচনাও তার বক্রোক্তির আলোচনার মতই মৌলিকতায় ভাস্বর।

কুন্তক বক্রোক্তির আলোচনা অত্যন্ত বিস্তৃতভাবে করেছিলেন। তিনি বক্রতার মধ্যে অলংকার, গুণ, রীতি এবং ধ্বনিকেও যুক্ত করে নিয়েছিলেন। আনন্দবর্ধন কবিপ্রতিভার সার্থকতা খুঁজে পেয়েছিলেন ব্যঞ্জনাময় ধ্বনির মধ্যে, আর কুন্তক পেয়েছিলেন বক্রোক্তির মধ্যে। বক্রোক্তিকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিতে গিয়ে কুন্তক তার ‘বক্রোক্তিজীবিত’ গ্রন্থে ধ্বনির স্বাধীন অস্তিত্বকেই অস্বীকার করেছিলেন— “The Vakroktijibit denies the independent existence of Dhavani…as the soul of the poetry and tries to include it under its all pervading Vakrokti.” (History of Sanskrit Poetics, P.V. Kane).

তিনি শব্দার্থের যে নিপুণ সূক্ষ্ম আলোচনার মাধ্যমে কাব্যব্যাপারকে অলৌকিক অভিধায় ভূষিত করেন সেই আলোচনার গভীরতা রীতিমত বিস্ময়কর। শব্দার্থের আলোচনার পাশাপাশি কুন্তক বাক্যগত, প্রকরণগত, প্রবন্ধগত সাহিত্যের কথাও বলেছিলেন। তিনি বক্রোক্তিকে যে ছয়টি শ্রেণীতে (বর্ণবিন্যাস-বক্রতা, পদপূর্বার্ধ-বক্রতা, পদপরাধ-বক্রতা, বাক্যবৈচিত্র্য বা বস্তু-বক্রতা, প্রকরণ-বক্রতা ও প্রবন্ধ-বক্রতা) বিভক্ত করেছিলেন সেগুলির মধ্যেই তার প্রমাণ আছে। এর থেকেই বোঝা যায় কুন্তকের বক্রোক্তি-বিষয়ক আলোচনার বৈচিত্র্য ও গভীরতা কতটা ছিল।

তথ্যসূত্র:

১. কাব্যতত্ত্ব সমীক্ষা: অচিন্ত্য বিশ্বাস

২. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত

৩. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত

৪. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!