//
//

বাংলা গদ্যের বিকাশে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অবদান আলোচনা কর।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

(১৮৩৮-১৮৯৪)

ঊনবিংশ শতাব্দীর এক বিশেষ লগ্নে ‘বঙ্গদর্শনে’র সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪) আবির্ভাব। বঙ্কিম প্রতিভা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারাকে সাঙ্গীকৃত করেছিল বলেই বাংলা সাহিত্যাঙ্গনে তার খ্যাতি যুগপৎ স্রষ্টা ও সম্পাদক রূপে। বঙ্গদর্শন পত্রিকাকে কেন্দ্র করে তার সাহিত্যিক প্রতিভার অফুরন্ত বিকাশ ঘটেছিল। ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকা সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— “পূর্বে কী ছিল এবং পরে কী পাইলাম। তাহা দুই কালের সন্ধিস্থলে দাঁড়াইয়া আমরা এক মুহূর্তেই অনুভব করিতে পারিলাম। কোথায় গেল সেই অন্ধকার, সেই একাকার, সেই সুপ্তি—কোথায় গেল সেই ‘বিজয়বসন্ত’, সেই ‘গোলেবকাওলি’, সেই বালকভুলানো কথা—কোথা হইতে আসিল এত আলোক, এত আশা, এত সঙ্গীত, এত বৈচিত্র্য। বঙ্গদর্শন যেন তখন আষাড়ের প্রথম বর্ষার মতো ‘সমাগতো রাজবদুন্নতধ্বনিঃ’। …কত কাব্য-নাটক-উপন্যাস; প্রবন্ধ, কত সমালোচনা, কত মাসিকপত্র, কত সংবাদপত্র, বঙ্গভূমিকে জাগ্রত প্রভাত কলরবে মুখরিত করিয়া তুলিল। বঙ্গভাষা সহসা বাল্যকাল হইতে যৌবনে উপনীত হইল।” রবীন্দ্রনাথের এই প্রশংসা থেকেই বোঝা যায় সম্পাদক বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব।

বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা প্রবন্ধ-সাহিত্যের একজন ধ্রুপদী শিল্পী। তিনি বিবিধ প্রসঙ্গ অবলম্বন করে প্রবন্ধ রচনা করেছে। বিজ্ঞান, সাহিত্য, সমাজতত্ত্ব, দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস কোন প্রধান বিষয়ই তাঁর আলোচনা-বহির্ভূত হয়নি। এই সকল প্রবন্ধের মধ্যে বঙ্কিমচন্দ্রের বহুদর্শী অভিজ্ঞতার ফলশ্রুতি, গভীর ধ্যান ও ধারণালব্ধ তীক্ষ বোধিদৃষ্টি এবং গবেষণা ও রসবোধের সম্যক পরিচয় লাভ করা যায়। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা সাহিত্যের একজন প্রজ্ঞাবান, শীর্ষস্থানীয় প্রবন্ধ লেখক। প্রবন্ধধর্মের সর্ববিধ লক্ষণই তাঁর রচনায় পরিস্ফূর্তি লাভ করেছে। বঙ্কিমচন্দ্র সুপণ্ডিত চিন্তাশীল মনীষী ব্যক্তি। তিনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য সাহিত্য গভীরভাবে অনুশীলন করেছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের পাণ্ডিত্য, চিন্তাশীলতা ও সাহিত্যিক মূল্যায়নে স্বকীয়তার স্বাক্ষর তাঁর প্রবন্ধের সর্বত্রই লক্ষ করা যায়।

প্রবন্ধ নিছক উচ্ছ্বাসধর্মী গদ্যরচনা নয়। বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে সুষ্ঠু ধারণা বা অনুশীলন না থাকলে প্রবন্ধকারের পক্ষে নিরপেক্ষ এবং তথ্যসমৃদ্ধ ও তত্ত্বগভীর দৃষ্টিলাভ করা সম্ভব হয় না। বঙ্কিমচন্দ্রের দৃষ্টি ছিল প্রসারিত এবং তা কখনও কোন সীমাবদ্ধ মতাদর্শের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়নি। প্রবন্ধের বিষয়-বৈচিত্র্য হেতু বঙ্কিমচন্দ্রকে বহুলক্ষেত্রে বিষয়গাপযোগী উপাদান আহরণে, গবেষণাকর্মে লিপ্ত থাকতে হয়েছিল এবং বিভিন্ন মূল্যবান উপাদান সংগ্রহকল্পে তাঁর একনিষ্ঠ উদ্যমেরও অভাব ছিল না। প্রামাণ্য তথ্য-সমাবেশে ও নিস্পৃহ যুক্তির সুতীক্ষ্ণতায় বঙ্কিমচন্দ্রের সকল বিষয়ক প্রবন্ধই সমুজ্জ্বল হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ প্রধানত বুদ্ধি নিষ্ঠ ও বিশ্লেষণধর্মী সাধারণত বুদ্ধি ও বিচার-প্রধান দুর্লভ সাহিত্য-স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়। কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধে সাহিত্যগুণের অসদ্ভাব ঘটেনি। জাতীয় সংস্কৃতি ও সমাজ-জীবন তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধেরই ভিত্তিভূমি।

১৮৭২ সালে বঙ্গদর্শনের সম্পাদক হয়ে তিনি নানা ধরনের প্রবন্ধ রচনার তাগিদ উপলব্ধি করলেন। তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থের সংখ্যাও অল্প নয়—‘লোকরহস্য’ (১৮৭৪), ‘বিজ্ঞানরহস্য’ (১৮৭৫), ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (১৮৭৫), ‘বিবিধ সমালোচনা’ (১৮৭৬), ‘সাম্য’ (১৮৭৯), ‘প্রবন্ধপুস্তক’ (১৮৭৯), ‘কৃষ্ণ চরিত্র’ (১৮৮৬), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (১ম ভাগ-১৮৮৭), ‘ধর্মতত্ত্ব’ (১৮৮৮), ‘বিবিধ প্রবন্ধ’ (২য় ভাগ, ১৮৯২), ‘শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা’ (প্রচারে ১২৯২ ও ১২৯৫ সালে প্রকাশিত)। এই তালিকা থেকে দেখা যাচ্ছে, প্রবন্ধেও বঙ্কিম প্রতিভা কত ব্যাপক ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। সাহিত্য, ইতিহাস, সমাজনীতি, ধর্মকথা, দর্শন, শিল্পতত্ত্ব, শাস্ত্রগ্রন্থ—এমন কোন বিষয় নেই যা নিয়ে তিনি আলোচনা করেননি। এই প্রবন্ধগুলিতে তাঁর যুক্তিআশ্রয়ী সিদ্ধান্ত, মননশীলতার পরিচয় এবং সাহিত্যগুণ পাওয়া যাবে প্রচুর পরিমাণে। নানা তত্ত্বকথা ও তথ্যকে তিনি প্রবন্ধের মধ্যে সন্নিবিষ্ট করেছিলেন, কিন্তু তার কোন আলোচনাই নীরস তথ্যবিবৃতি মাত্র হয়নি।

ধর্মতত্ত্বের প্রথমভাগে বঙ্কিমচন্দ্র বলেছিলেন— “সমাজই শিক্ষাদাতা, সমাজই গুরু’’। বঙ্কিমচন্দ্রের এই বিশেষ মানসিকতা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে যেমন গীতা, সাংখ্যদর্শন, চারবাক দর্শন সাহায্য করেছিল; তেমনি বেন্থাম, মিল ও স্পেনসারের দর্শন বঙ্কিমকে আকৃষ্ট করে। সুতরাং দর্শন ও ধর্মচিন্তায় বঙ্কিমের মধ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য দুই ধারারই মিল হয়েছিল। ‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘প্রচার’ পত্রিকায় তিনি অন্তত নয়-দশটি ধর্মবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা করেন। যেমন—মনুষ্যত্ব কী, ধর্ম ও সাহিত্য, চিত্তশুদ্ধি, গৌরদাস বাবাজীর ভিক্ষার ঝুলি ইত্যাদি। এইসব প্রবন্ধে বঙ্কিম গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি হল—(১) চিত্তশুদ্ধি প্রাধান্য কথা, (২) মনুষ্যত্ব হচ্ছে চারটি বৃত্তির আনুপাতিক সামঞ্জস্য, (৩) ধর্ম হচ্ছে ঈশ্বরে ভক্তি, মনুষ্যের প্রীতি ও হৃদয়ে শান্তি, (৪) পরহিতে রতি এবং পরের অহিতে বিরতি ধর্মের গোড়ার কথা। বঙ্কিম দুরূহ তত্ত্বমূলক এই সব সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় যেমন প্লেটনিক সংলাপের পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন, তেমনি নিছক বক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ‘ধর্মতত্ত্বে’ তথ্যের সঙ্গে সংলাপ মিশ্রিত হয়ে এমন একটি সহজ ও অনায়াস গতি গড়ে উঠেছে যা দুর্লভ রচনারীতির দৃষ্টান্ত।

‘বঙ্গদর্শন’ ও ‘প্রচার’ পত্রিকায় বঙ্কিমের ইতিহাস সচেতনতার প্রমাণ অন্তত দশটি প্রবন্ধ—‘ভারতকলঙ্ক’, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’, ‘বাঙ্গালীর বাহুবল’, বাঙ্গালার কলঙ্ক’ ইত্যাদি। দেশের অতীত ইতিহাস সম্পর্কে বঙ্কিমের আগ্রহ ধরা পড়েছে উক্ত প্রবন্ধগুলিতে। হিন্দুধর্ম ও শিবাজীর প্রতি শ্রদ্ধা যেমন কিছু লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য তেমনি কৃষিনির্ভর দেশের উন্নতিতে কৃষির সংস্কার যে প্রয়োজন তা তিনি বলেছিলেন। সমাজ ও অর্থনীতি সম্পর্কে বঙ্কিম অনেক উদার। যাঁরা এর সঙ্গে বিবেকানন্দের ‘বর্তমান ভারত’ এবং রবীন্দ্রনাথের ‘স্বদেশ ও সমাজ’ স্মরণ করবেন, তাঁরা অবশ্যই বঙ্কিমকে নব্যচিন্তার পথিকৃৎ বলে মানবেন।

সাহিত্য সমালোচনার জগতে বঙ্কিম পথিকৃৎ। তুলনামূলক সাহিত্যবিচার তিনি করেন এবং তিনি বলেছেন সাহিত্য দেশের অবস্থা ও জাতীয় চরিত্রের প্রতিবিম্বন। প্রাচীন ভারতীয় কবিদের তুলনামূলক বিচার বঙ্কিম প্রথম করেছেন ‘বিদ্যাপতি ও জয়দেব’ প্রবন্ধে। তিনি লিখেছেন—“জয়দেব ভোগ, বিদ্যাপতি আকাঙ্ক্ষা ও স্মৃতি। জয়দেব সুখ, বিদ্যাপতি দুঃখ। জয়দেব বসন্ত, বিদ্যাপতি বর্ষা।” প্রতিটি বাক্যে বিপরীতার্থক শব্দে প্রশংসনীয় বিন্যাস এবং একটি অনায়াস গতি বাক্যগুলিকে উন্নততর গদ্যরীতির নিদর্শন করে রেখেছে।

তাঁর ‘শকুন্তলা’, মিরন্দা ও দেসদিমোনা’ প্রবন্ধটি উত্তরকালে রবীন্দ্রনাথকে অত্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। বাংলা ভাষায় তুলনামূলক সমালোচনার প্রথম সাহিত্যিক প্রয়াস হিসাবে ‘শকুন্তলা, মিরন্দা ও দেসদিমোনা’ প্রবন্ধটি সমুল্লেখযোগ্য। লেখকের ভাষায়— ‘‘শকুন্তলা চিত্রকরের চিত্র, দেসদিমোনা ভাস্করের গঠিত সজীবপ্রায় গঠন। দেসদিমোনা আমাদিগের সম্মুখে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত এবং সম্পূর্ণ বিস্তারিত, শকুন্তলার হৃদয় কেবল ইঙ্গিতে ব্যক্ত।’’

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘লোকরহস্য’ গ্রন্থের রচনাগুলি বিশুদ্ধ প্রবন্ধের গোত্র অনুসারে গঠিত হয়নি। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ ও লঘু কৌতুকের একটি আস্তরণ নির্মাণ করে বঙ্কিমচন্দ্র এইসব রচনায় সমাজ ও স্বদেশ-চিন্তার পরিচয় প্রকাশ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ প্রাধান্য বিস্তার করলেও অন্তরস্থ ভাববস্তুর যথাযথ প্রকাশ তা দ্বারা ব্যাহত হয়নি। বাংলা প্রবন্ধের একটি অভিনব প্রকরণ অর্থাৎ রূপকাখ্যানধর্মী পন্থার ভিত্তিতেই ‘লোকরহস্যে’র রচনাগুলি বিচার্য। বাঙালির স্বভাবদোষকে ব্যঙ্গের কশাঘাতে জর্জরিত করে রহস্য সৃষ্টিই ‘লোকরহস্য’ গ্রন্থের একমাত্র উপজীব্য। রহস্য অর্থে বঙ্কিমচন্দ্র মূলত ব্যঙ্গ বা কৌতুক রসকেই লক্ষ করেছে। কৌতুক অর্থাৎ হিউমার-এর প্রবণতাই এখানে অধিক লক্ষণীয়। বিদ্রুপ বা স্যাটায়ার অর্থাৎ তীব্র কশাঘাতের মানসিকতা বঙ্কিমচন্দ্রে মাঝে মধ্যে পরিলক্ষিত হলেও এই সব রচনায় তা-ই প্রধান হয়ে উঠেনি। নির্মল হাস্যরসের ঔদার্যেই বিষয়গুলি রূপায়িত।

‘লোকরহস্যে’রই ব্যঙ্গাত্মক, শাণিত শ্লেষপূর্ণ মনোভাব বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এ আরও এক আশ্চর্য পদ্ধতিতে চিত্তাকর্ষকভাবে প্রকাশ পেয়েছে। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের সকল রচনাই কেবলমাত্র তরল ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মধ্যেই পরিসমাপ্তি লাভ করেনি—কৌতুকরসের আবরণে রূপকধর্মী উপাখ্যানসুলভ উপাখ্যানের মধ্য দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তৎকালীন দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, ধর্ম ও সাহিত্যেরও পর্যালোচনা করেছে। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র কর্তৃক তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা হিসাবে মর্যাদা লাভ করেছে। এ যে বঙ্কিম-প্রতিভার অন্যতম বিশিষ্ট সাহিত্যিক সৃষ্টি, তা অনস্বীকার্য। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর ভাব ও আঙ্গিক পরিকল্পনায় বঙ্কিমচন্দ্র পাশ্চাত্ত্য কোনও কোনও বিশিষ্ট লেখকের দ্বারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ডি-কুইন্সির  (De-Quiencey)র ‘The Confessions of an English Opium-Eater’ গ্রন্থখানির রচনা-প্রকরণের উল্লেখ করা যায়। ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুপম কল্পনাপ্রসূত চারটি চরিত্রের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। কমলাকান্ত স্বয়ং, ভীষ্মদেব খোসনবীশ, নসীরামবাবু ও প্রসন্ন গোয়ালিনী। কমলাকান্তই প্রধান চরিত্র এবং তারই চিন্তা-ভাবনা অন্যান্য চরিত্রগুলির সংলাপ সহযোগে প্রকাশ পেয়েছে।

বঙ্কিমচন্দ্র ছিলেন সমাজসচেতন শিল্পী। তাই সমকালীন সমাজের সামাজিক ত্রুটি বিচ্যুতি, বিভিন্ন বৈষম্য ও অসঙ্গতিকে তিনি সমালোচনা করেছেন। ঊনবিংশ শতকের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র সম্যকভাবে অবহিত ছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় এদেশের পুরাতন সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা তখনো ভেঙে পড়েনি। ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের ফলে তখন ভারতীয় অর্থনীতির শোচনীয় অবস্থা। সেই আর্থ-সামাজিক অবস্থার চিত্র ‘বিবিধ প্রবন্ধে’র ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ প্রবন্ধে, ‘সাম্য’ গ্রন্থে এবং ‘কমলাকান্তের দপ্তরে’র ‘বিড়াল’, ‘আমার মন’ ‘বড়বাজার’ প্রভৃতি প্রবন্ধে চিত্রিত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবনদর্শনের মূল কথা হল মানবকল্যাণ ও মানবপ্রীতি। এই প্রীতির সঙ্গে স্বদেশপ্রীতির কোন বিরোধ নেই। কেননা বঙ্কিমচন্দ্র দেখেছিলেন দেশের শোচনীয় অধঃপতন, বিভিন্ন সামাজিক শ্রেণির মধ্যে সম্প্রীতির অভাব, প্রতিবেশীতে-প্রতিবেশীতে সদ্ভাব ও অনুরাগের অভাব, সর্বোপরি পরাধীনতার সুগভীর ধিক্কার কমলাকান্তের মনে নিদারুণ তীব্রতায় ধ্বনিত হয়েছে।

বঙ্কিমের গদ্যরীতির উত্তরাধিকার লাভ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ‘পঞ্চভূত’ গ্রন্থে কমলাকান্তের মতো বিচিত্র সংসার ও জগৎ জীবনকে দেখেছে। বঙ্কিমচন্দ্র যেখানে ব্যঙ্গের চাবুক হাতে, কিছুটা গুরুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে সেখানে রবীন্দ্রনাথ নিরপেক্ষ ও নিরাসক্ত দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবনে উত্থিত ঢেউগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। এখানেই বঙ্কিমের সুযোগ্য উত্তরসূরি হলেন রবীন্দ্রনাথ। যিনি অনুকরণের মধ্যে নিজেকে আবদ্ধ না রেখে মৌলিক সৃষ্টিকর্মে অনুপ্রাণিত হয়েছেন।

প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্ব

  • প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র স্বয়ং একটি প্রতিষ্ঠান ও যুগের স্রষ্টা। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ গোষ্ঠী গদ্যকে করেছিলেন গালগল্পের বাহন, রামমোহন করলেন বিচার-বিতর্কের বাহন, বিদ্যাসাগর সেই প্রাণহীন গদ্যের কাঠামোয় প্রাণ সঞ্চার করে তাকে এক বিশিষ্ট রূপ দেন; কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বাংলা গদ্য পেল যৌবনমুক্তির এক স্বতঃস্ফূর্ত হিল্লোল। বাংলা গদ্যকে স্বচ্ছ পদচারণার গতি দান করে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা গদ্যের একটা আদর্শ গড়ে দিলেন।
  • শুধু তাই নয়, গদ্যের বিবর্তনশীলতাকে তিনি সম্মান জানিয়েছে বিভিন্ন রচনার মাধ্যমে। তাই তাঁর সাহিত্যিক জীবনের প্রারম্ভে ভাষার যে গতি-ভঙ্গি, শব্দবিন্যাস ও রীতিবৈশিষ্ট্য ছিল তা পরবর্তীকালে তার আত্মপ্রত্যয় ও রসরুচি ভেদে রূপান্তরিত হয়েছে।
  • শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রের মূল্যায়ন সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন— “গুটিপোকার বিচিত্রবর্ণ প্রজাপ্রতিতে রূপান্তরের ন্যায় বঙ্কিমের হাতে প্রবন্ধের এক নবজন্ম পরিগ্রহ ঘটিল। জ্ঞানপ্রধান প্রবন্ধ ভাবপ্রধান রসরচনার রূপ গ্রহণ করিল।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, পৃঃ-১২৪-১২৫)
  • মার্জিত পরিহাস রসিকতার পথিক হিসাবে প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্বের মূল্যায়ন করে সুকুমার সেন লিখেছেন— “বাঙ্গালা সাহিত্যে সুনির্মল কৌতুক রসধারার অবতারণা বঙ্কিমের একটি প্রধান কৃতিত্ব। নিরাবিল কৌতুকের অন্তঃপ্রবাহ তাঁরহার নভেলের ভাষায় অন্তরঙ্গতায় নিবিড়তা দিয়াছেন।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, পৃঃ-২৩৪)।
  • অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্রের ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে লিখেছেন— “তিনি ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের নব্য বাংলা ও বাঙালীর চেতনাকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। সমাজ, ধর্ম, মনন—সমস্ত কিছুকে নিজের কক্ষপথে টেনে এনেছিলেন। তার জন্য তিনি প্রবন্ধকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রবন্ধের সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালীকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁকে বাংলাদেশের তদানীন্তন বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি বলে অভিহিত হয়।” (বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত-১৩৭৮, পৃঃ-২৭২)।
  • প্রাবন্ধিক বঙ্কিমের প্রতিভার মূল্যায়ন সূত্রে অধীর দে লিখেছেন— “সংস্কৃত সাহিত্যের মহাকবি কালিদাসের ন্যায় বঙ্কিমচন্দ্রও একজন প্রয়োগনিপুণ শব্দশিল্পী ছিলেন। …সহৃদয় ভঙ্গি ও মাত্রাবোধের অপূর্ব সমন্বয়ে রচনারীতির সৌষ্ঠব ও সমুন্নতি সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্রের তীক্ষ্ণ সচেতন এক বিশিষ্ট অনুভূতির পরিচয় পাওয়া যায়। অসাধারণ প্রতিভার ঔজ্জ্বল্য ও গভীর আন্তরিকতার স্নিগ্ধ মধুর লালিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের সকল প্রবন্ধই ওজস্বী ও দীপ্তিময় হইয়াছে।” (আধুনিক বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ধারা, পৃঃ-১৭৩)।
  • রবীন্দ্রনাথ বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যকীর্তি সম্পর্কে ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ প্রবন্ধে বলেছেন— (ক) “একদিন আমাদের বঙ্গভাষা কেবল একতারা যন্ত্রের মতো এক তারে বাঁধা ছিল, কেবল সহজ সুরে ধর্ম সংকীর্তন করিবার উপযোগী ছিল; বঙ্কিম স্বহস্তে তাহাতে এক-একটি তার চড়াইয়া আজ তাহাকে বীণাযন্ত্রে পরিণত করিয়া তুলিয়াছেন।” (খ) “বঙ্কিম বঙ্গভাষার ক্ষমতা এবং বঙ্গ সাহিত্যের সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করিয়া দিয়াছে, তিনি ভগীরথের ন্যায় সাধনা করিয়া বঙ্গ সাহিত্যে ভাবমন্দাকিনীর অবতারণা করিয়াছে এবং সেই পুণ্যস্রোতস্পর্শে জড়ত্ব শাপমোচন করিয়া আমাদের প্রাচীন ভস্মরাশিকে সঞ্জীবিত করিয়া তুলিয়াছে ….ইহা একটি ঐতিহাসিক সত্য।” (গ) “রচনা এবং সমালোচনা এই উভয় কার্যের ভার বঙ্কিম একাকী গ্রহণ করাতে বঙ্গ-সাহিত্য এত সত্বর এমন দ্রুত পরিণতি লাভ করিতে সক্ষম হইয়াছিল।”

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!