রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ের ভূমিকা আলোচনা কর।
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়
কলকাতার বহুবাজার অঞ্চলে বাজার অবৈতনিক নাট্যসমাজ স্থাপিত হয়। প্রধান উদ্যোগী ছিলেন বলদেব ধর ও চুনিলাল বসু। এরা দুজনেই ভালো অভিনেতা ছিলেন এবং এর আগে পাথুরিয়াঘাটায় যতীন্দ্রমোহনের বঙ্গনাট্যালয়ে অভিনয় করেছেন। চুনিলাল প্রধানত স্ত্রী চরিত্রের অভিনয়ে দক্ষ ছিলেন। তাদের উৎসাহ ও প্রেরণায় এবং অঞ্চলের যুবকবৃন্দের চেষ্টায় প্রথমে অস্থায়ীভাবে একটি মঞ্চ তৈরি হয়। ২৫ নং বাঞ্ছারাম অর্জুরের গলিতে গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়িতে নির্মিত এই রঙ্গমঞ্চের প্রধান উপদেষ্টা ছিলেন মধ্যস্থ পত্রিকার সম্পাদক ও নাট্যকার মনোনোহন বসু। এই নাট্যশালার জন্য তিনি ‘রামাভিষেক’ নাটক রচনা করে দেন। নাটকটি দিয়েই বহুবাজার নাট্যসমাজের নাট্যাভিনয় শুরু হয়, ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩ অক্টোবর।
এই রঙ্গশালাটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে নির্মাণ করা হয়েছিল। দৃশ্যপটগুলি নাটকের প্রয়োজন মতো তৈরি করা হয়েছিল। পোষাক পরিচ্ছদ ও সাজসজ্জা সুরুচিসম্পন্ন ও যথাযথ হয়েছিল। অভিনয়ও খুব উচ্চমানের হয়েছিল। তবে নারীচরিত্রগুলির অভিনয় এবং সঙ্গীত ভালো হয়নি বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন। ‘রামাভিষেক’ নাটকের চরিত্রলিপি—
দশরথ—অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, রাম—উমাচরণ ঘোষ, লক্ষ্মণ—বলদেব ধর, বিদূষক—মতিলাল বসু, কৌশল্যা—চুনিলাল বসু, সুমিত্রা—চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সীতা—আশুতোষ চক্রবর্তী, মন্থরা—ক্ষেত্রমোহন দে।
পাশ্চাত্য ট্রাজেডি রীতিতে ‘রামাভিষেক’ নাটক বিয়োগান্তক হওয়াতে দেশীয় মিলনান্তক প্রথায় অভ্যস্ত অনেক দর্শকের কাছে নাটকটি সুখপ্রদ হয়নি। মনে রাখতে হবে, মধুসূদনের ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকটিও ট্রাজেডি হওয়াতে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর তাঁর বাড়ির অমঙ্গল চিন্তায়, মায়ের আপত্তিতে, নাটকটির অভিনয় করতে পারেননি।
প্রথম প্রতিষ্ঠার পাঁচ বছর পরে অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের চেষ্টায় ও অর্থে ২৫ নং মতিলাল লেনে বাজার নাট্যসমাজের স্থায়ী নাট্যশালা তৈরি হয়। গোবিন্দচন্দ্র সরকারের বাড়ি থেকে উঠে এসে এই নতুন নির্মিত স্থায়ীমঞ্চের নাম রাখা হয় বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়। এলাহাবাদ নিবাসী নীলকমল মিত্র এবং অপর কয়েকজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই নাট্যশালার স্বত্বাধিকারী ছিলেন। পরিচালকমণ্ডলীর সম্পাদক ছিলেন প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নতুন নির্মিত স্থায়ী রঙ্গমঞ্চে প্রথম অভিনীত হয় মনোমমাহন বসুর ‘সতী’ নাটক; ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দের ১৭ জানুয়ারি (৩ কিংবা ১০ জানুয়ারিও হতে পারে বলে কেউ কেউ জানিয়েছেন।) শনিবার। রঙ্গমঞ্চটি সুন্দর ছিল, দৃশ্যপট খুবই সুচারুভাবে অঙ্কিত হয়েছিল এবং অভিনয়ও খুবই সুন্দর হয়েছিল। ঐকতান বাদন এবং নৃত্যগীত মনোমুগ্ধকর হয়েছিল। তাতে আঁকা দৃশ্যপটের সঙ্গে এখানে ‘প্রথম’ হিসেবে বসবার আসন ব্যবহৃত হয়। এখানে প্রতি শনিবার ‘সতী’ নাটক-এর অভিনয় হতে থাকে। শেষ অভিনয় হয় ১৮৭৪-এর ৪ এপ্রিল। সতী নাটকের চরিত্রলিপি—
শিব ও দক্ষ—চুনিলাল বসু, নারদ—প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নগরপাল—বলদেব ধর, সতী—আশুতোষ চক্রবর্তী, অশ্বিনীচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সনকা ও নটী—নন্দ ঘোষ।
‘সতী’ নাটকের পর অভিনয় হয় মনোমোহনেরই ‘হরিশ্চন্দ্র’ নাটক। ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে। এই নাটকেরও একাধিকবার অভিনয় হয়। হরিশ্চন্দ্রের ভূমিকালিপি—
হরিশ্চন্দ্র—চুনিলাল বসু, রোহিতাশ্ব—ননীলাল দাস, বিশ্বামিত্র—প্রতাপচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নগরপাল—বলদেব ধর, শৈব্যা—অবিনাশচন্দ্র ঘোষ, কমলা—বিহারীধর, মল্লিকা—নন্দ ঘোষ।
বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ে দেশীয় ও ইউরোপীয় বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকতেন। ‘সতী’ নাটকের অভিনয়ে ভিজিয়ানা গ্রামের মহারাজা, নাটোরের রাজা চন্দ্রনাথ রায়, পাকুড়ের রাজা উপস্থিত ছিলেন।
এই নাট্যালয় স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে প্রতি শনিবার নিয়মিত অভিনয়ের ব্যবস্থা করে। যদিও তা দীর্ঘদিন চালানো সম্ভব হয়নি। তবুও প্রতি শনিবার অভিনয় আয়োজন করার মধ্যেই একটি ধারাবাহিক অভিনয় প্রচেষ্টার উদ্যম লক্ষ করা যায়।
এই নাট্যশালার সঙ্গে মনোমোহন বসু উদ্যোক্তা, উৎসাহদাতা ও নাট্যকার হিসেবে যুক্ত ছিলেন। তাঁর লেখা সব নাটক এখানে অভিনীত হয়। মনোমোহন দেশীয় যাত্রার রীতিকে উন্নত করে এবং বিদেশী নাটকের রীতিকে মিশিয়ে নতুন নাটক রচনার চেষ্টা করেন। পুরাণাশ্রিত বিষয়কে নিয়ে পূর্বতন নাটগীতির সঙ্গে আধুনিক নাটকের রীতির যোগাযোগ ঘটালেন। এতে পুরনো যাত্রা পাচালির কারুণ্য ও ভক্তিভাব এবং কথকতার বাক্যবয়ন রইল নতুন ভঙ্গিতে। দেশীয় গানের সুর যোজিত হলো। ফলে তার নাটক পুরাতন ও নতুনের সন্ধিবন্ধন, আদি ও মধ্য যুগের সেতু সংযোগ।
ঠিক এই সময়ে নাটকাভিনয়ের যে জোয়ার নামে সেখানে মনোমোহনের এই নাটকগুলি খুবই সহায়তা করে। অর্থাভাবে মঞ্চবিহীন অবস্থাতেও গীতাভিনয়ের মতো এগুলি অভিনয় করা যায়। যাত্রা ও নাটকের সম্মিলন ঘটানোয় মনোমোহন এ যুগে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিলেন। আবার ‘সতী’ নাটক ট্রাজেডি হওয়াতে অনেকের অভিনয়ে আপত্তি ছিল। তাই তিনি ‘হর-পার্বতী মিলন’ নামে এক ‘ক্রোড়অঙ্ক’ লিখে ছাপিয়ে জানান, যারা বিয়োগান্তক নাটক অভিনয়ে অনিচ্ছুক তারা এই ক্রোড়অঙ্ক জুড়ে নিয়ে মিলনান্তক অভিনয় করতে পারেন। এই নাট্যরসহীন হাস্যকর প্রচেষ্টাও সে যুগে আদৃত হয়েছিল। পরবর্তী সাধারণ রঙ্গালয়ের যুগেও এইভাবে বিয়োগান্তক নাটককে ক্রোড়অঙ্ক জুড়ে মিলনান্তক করে তোলা হয়েছিল। বহু নাটকের শেষাংশে এই চিহ্ন এখনও দেখতে পাওয়া যায়।
ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রতিষ্ঠা (১৮৭২) ও উদ্যোগের পূর্ববর্তী বহুবাজার নাট্যসমাজ। বিত্তবান বাবুদের দৌলত ও দালান-কোঠা আশ্রিত বাংলা নাটককে এরাই প্রথম সাধারণের কাছে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। এদের বিত্ত ছিল না অন্যদের মতো, তবে চেষ্টা ও আন্তরিকতা ছিল বেশি। অবৈতনিক হলেও দক্ষতায় প্রায় পেশাদার। তবে এরা টিকিট বিক্রি করে নাট্য দর্শনের আয়োজন করেননি, তাদের দর্শক ছিল আমন্ত্রিত।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বহুবাজার বঙ্গনাট্যালয়ের অবদান
এই রঙ্গালয়ের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হলো—
এক. নিয়মিত (প্রতি শনিবার) অভিনয় করা।
দুই. একই নাটকের ধারাবাহিক অভিনয়।
তিন. দর্শকের প্রতি শিষ্টাচার।
চার. টিকিট-ব্যবস্থা না থাকলেও বিশেষ আমন্ত্রণ পত্র ছিল।
পাঁচ. প্রযোজনা সর্বাঙ্গসুন্দর করার পেশাদারি চেষ্টা।
ছয়. নাট্যনির্বাচন, অভিনয়, মঞ্চসজ্জা, ঐকতান, গান সুন্দর ছিল।
সাত. স্থায়ী মঞ্চ নির্মাণ।
আট. এই মঞ্চের জন্যই মনোমোহনের নাট্যরচনার সূত্রপাত ও নাট্যকার-সত্তার বিকাশ।
Leave a Reply