//
//

বাংলাদেশের কবি সৈয়দ আলী আহসানের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

সৈয়দ আলী আহসান

চল্লিশের দশকের সবচেয়ে দ্বিধান্বিত কবি সৈয়দ আলী আহসান (১৯২২-২০০২)। কাব্যজীবনে কোনো নির্দিষ্ট আদর্শকে সামনে রেখে তিনি কাব্য রচনা করতে পারেননি। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাঁর কাব্যের গতিপথকে বারবার পরিবর্তন করেছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলি হল—চাহার দরবেশ (১৯৪৫), অনেক আকাশ (১৯৫৯), একক সন্ধ্যায় বসন্ত (১৯৬৪), সহসা সচকিত (১৯৬৫), উচ্চারণ (১৯৬৮), আমার প্রতিদিনের শব্দ (১৯৭৩) প্রভৃতি। ‘চাহার দরবেশ’ কাব্যের কবিতাগুলি মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। পাকিস্তান আন্দোলনের ভাবাবেগ এই কাব্যের কবিতাগুলির মূল উপজীব্য। পরবর্তীকালে পাকিস্তান আন্দোলনের ফলাফল তাঁকে হতাশ করায় তিনি পূর্বের আদর্শ থেকে সরে আসেন। পরবর্তী কাব্য ‘অনেক আকাশ’-এ সমাজ নয় বরং কবির ব্যক্তিগত জীবনভাবনা কাব্যরূপ পেয়েছে। কবি যেন আপন আত্মার স্বরূপ সন্ধানে নিমগ্ন ছিলেন। নিজেকে খুঁজে পাওয়ার আনন্দে নিজের চিন্তা ও অনুভবকে তিনি অকাতরে সম্প্রসারিত করে সৃষ্টি সাধনায় মেতে উঠতে চেয়েছেন। প্রেম, নিসর্গ, নারীর মধ্যে তিনি জীবনের নতুন স্বাদ অন্বেষণ করেছেন—

যখন তোমার উপর আমার দেহভার

অবনমিত হয়

তুমি শিহরিত হও আমাকে দেখে

তুমি একান্ত আমার

যেমন চক্ষু একান্তভাবে মুখ মণ্ডলের

তুমি মৃত্যুর পর নেমে যাবে

আমার গান থাকবে তোমার কণ্ঠে

এই মৃত্যুর স্বাদ পাওয়ার জন্য কবি জীবনের অনাবিল, অকৃত্রিম, অনাবৃত যে জৈবিক আবেগ, ইন্দ্রিয়ঘন অনুভূতি সেই আদিম রূপকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। এজন্য চর্যাপদের অনুষঙ্গ ব্যবহার করেছেন কবি। জীবনের আদিম বাসনাকে অনুভব করার জন্য কবি শবরী বালিকার শরণাপন্ন হয়েছেন—

      বন্ধুর পার্বত্য দিন— শবরী বালিকা

          কল্কলে ঢেকেছে কটি— হৃদয় নিটোল

          নয়নে আশ্চর্য মেঘ— মেঘ নয়, সূর্যের সায়র

          দিবসের পাণ্ডুতাপে সে আমার কোমল মৃত্তিকা।

          পুষ্পফল জীবনের— দেহের দাহন

          ভূমিকম্প দাবানল— অপাঙ্গে সংহার

          হৃদয়ে দেহের শোভা স্নায়ু বিগলিত

          পদ্মার প্লাবনে যেন বিচলিত তটভূমি সেই।

স্মৃতিময় অনুভব আর রোমান্টিক কল্পনার মেলবন্ধনে কবি এক নতুন ভুবন নির্মাণ করলেন। যেখানে আত্মার স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে কবি অতীতের আদিমঘন জীবনে প্রবেশ করে সৃষ্টির স্বাদ গ্রহণ করে তৃপ্তি পেতে চেয়েছেন। তাই সমালোচক রফিকুল ইসলাম বলেছেন— ‘‘অনেক আকাশে’ সৈয়দ আলী আহসান জীবনের যে নতুন স্বাদ অন্বেষণ করেছেন যে অভিজ্ঞতার আশ্রয় পেতে চেয়েছেন সে স্বাদ রক্তিম আবেগের, ইন্দ্রিয়ঘন অনুভূতির এক উতপ্ত চেতনার।’’

‘একক সন্ধ্যায় বসন্ত’ কাব্যের প্রধান উপজীব্য প্রেম ও প্রকৃতি। প্রকৃতির সংস্পর্শে প্রেমের বস্তুনিষ্ট রূপ হৃদয়ে, চেতনায়, অনুভূতিতে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রেমের পথ ধরেই কবি প্রকৃতিতে বিলীন হতে চেয়েছেন—

অতলান্ত সমুদ্রের পূর্ণ-প্রাণ আগ্রহে একাকী—

যখন সন্ধান করি মূর্ছাহিত আমার হৃদয়

তখন তোমার চিন্তা সঙ্গীহীন পাখীর ডানায়

সমুদ্রের জলে ভিজে অকস্মাৎ আমারে জাগালো।

কবির প্রকৃতি চেতনা বিবর্তিত হয়ে স্বদেশ চেতনায় রূপান্তরিত হয়েছে। জীবনানন্দ যেমন বাংলার প্রকৃতিতেই বিশ্বের স্বরূপ আবিষ্কার করেছিলেন, সৈয়দ আলী আহসানও আন্তর্জাতিকতার মোহ ত্যাগ করে ফিরে এসেছেন পূর্ব-বাংলার মাটিতে। সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে চেয়েছেন জন্মভূমির ঘ্রাণ। বাংলার অসীম ঐশ্বর্য, অপরূপ সৌন্দর্য বিচিত্র মহিমা নিয়ে তাঁর কাব্যে উঠে এসেছে। প্রকৃতির নিসর্গের মধ্যে কবি আবিষ্কার করেছেন আপন মাতৃভূমিকে—

হঠাৎ নতুন প্রত্যাগত আমার কাছে

বন্য উচ্ছলতার সবুজের ঔদার্য

এখানে আমার পৃথিবী অনেক

রূপময়ী

এখানে নদীর মতো এক দেশ

শান্ত, স্ফীত, কল্লোলময়ী

বিচিত্ররূপিণী অনেক বর্ণের রেখাঙ্কন

এ-আমার পূর্ব-বাংলা

যার উপমা একটি শান্ত শীতল নদী।

পূর্ব-বাংলার রূপ কেবল শান্ত নদীর মতো কবির হৃদয়কে শীতলতা দান করে না, অন্ধকারে তমালের স্নিগ্ধ পল্লবের ঘনিষ্টতায় গড়ে তোলে প্রেমের প্রগাঢ় নিকুঞ্জ। সন্ধ্যার উন্মেষের মতো, সরোবরের অতলের মতো, কালো-কৃষ্ণ মেঘের মতো প্রশান্তি দান করে। কবির হদয়ে অনুরাগের আবির্ভাব ঘটে। প্রকৃতির সংস্পর্শেই ভেসে আসে বৈষ্ণব পদাবলীর বর্ষাভিসারের সুর—

আমার পূর্ব-বাংলা বর্ষার অন্ধকারের

অনুরাগ

হৃদয় ছুঁয়ে-যাওয়া

সিক্ত নীলাম্বরী

নিকুঞ্জের তমাল কনক-লতায় ঘেরা

কবরী এলো করে আকাশ দেখার

মুহূর্ত

অশেষ অনুভূতি নিয়ে

পুলকিত স্বচ্ছলতা

‘সহসা সচকিত’ গ্রন্থে কবি পুনরায় অন্তর্মুখী। প্রেমের অতুল্য অনুভব এক অনিঃশেষ মাদকতা নিয়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে। যে প্রেম সমগ্র সত্তাকে সচকিত করে, আনন্দ দান করে তারই আবেগময় উত্তাপ এই কাব্যটিকে ভাবে-ভাবনায় স্বতন্ত্র করে তুলেছে। আলোচ্য কাব্যের বত্রিশটি কবিতারই কবি নামকরণ করেননি। কেবল সংখ্যা দিয়েই একটা ধারাক্রম রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। কবির আবেগের একমুখীনতাই কবিতাগুলির মূল বিষয়। ভাবের অন্তর্নিহিত ঐক্যই কবিতাগুলির মধ্যে একটি আখ্যান গড়ে তুলেছে। প্রেমাবিষ্ট হৃদয়ের উদ্বেলতা, মিলনের আকাঙ্ক্ষা আমাদেরকে আকুল করে তোলে—

বিবশ সময়ের অনুষঙ্গের,

আশ্রিত তনু উদ্‌যাপনের

সে কী উন্মাদ সংগ্রাম নিয়ে

কাম্য বিলোপে কত অতুল।

যে আবেগকে কেন্দ্র করে কবির চেতনা আবর্তিত হয়েছে সেই আবেগের মধ্যেই কবি জীবনের সার্থকতা খুজে পেতে চেয়েছেন। উচ্চারণ কাব্যে কবির নিজস্ব জীবনদর্শন এবং জীবনজিজ্ঞাসা কাব্যরূপ পেয়েছে। এ কাব্যেও কোনো সামাজিক সংকটের চিত্র পাওয়া যায় না। অথচ কবিতা গুলি রচিত হয়েছে পঞ্চাশ-ষাটের উত্তাল সময়ে। তাহলে কবি কি সময়য়ের পরিবর্তে শিল্পকে প্রাধান্য দিতে চাইছেন। কালকে অতিক্রম করে হতে চাইছেন চিরকালীন? তা বোধহয় নয়। কবির বর্তমান সময়ের ধারাভাষ্য নয় বর্তমানের মধ্যে আপন ক্ষমতাকে অনুভব করেই আনন্দ পেতে চান—

আমার ক্ষমতা যতটুকু, তাই আমি আবিষ্কার করে

আনন্দিত হতে চাই। আমার দৃষ্টি যতটা দিক্‌বলয়

নিমার্ণ করে, তার অতিরিক্ত দেখবার ইচ্ছা আমার

নেই।….একটি নিষ্ঠুর দ্রুততায় বর্তমানে সময়ের যে

প্রবাহ সে সময়ের মধ্যে বসতি করে আমি যদি আমার

ক্ষমতাকে আবিষ্কার করতে না পারি তাহলে আমি পৃথিবীকে

কিছুই তো দিতে পারবো না।

আসলে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেকেই বারেবারে ভেঙেছেন, গড়েছেন। এভাবেই তিনি সময়কে অতিক্রম করতে চেয়েছেন। হতে চেয়েছেন কালান্তক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!