বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলাদেশের ছোটগল্প
বাংলাদেশের ছোটগল্পের ইতিহাস সময়ের স্বল্পতার মধ্যে সমৃদ্ধির পর্যায়ে গ্রসর হচ্ছে। কয়েকজন প্রতিশ্রুতিশীল ছোটগল্পকারের আবির্ভাবের ফলে এখানকার গল্পে উৎকর্ষের পরিচয় প্রকাশমান। তাই এই লেখকের লেখনী উপন্যাস ও ছোটগল্প— এই উভয় শাখাতেই কৃতিত্বের পরিচয় দান করে। এখানকার যেসব ঔপন্যাসিক উপন্যাস রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাঁদের প্রায় সবাই গল্প রচনাতেও বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছেন। কথাসাহিত্যের এই উভয় শাখা লেখকদের কাছে সমাদৃত বলে এখানকার উপন্যাসের মতই ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য ও সম্ভাবনা পরিদৃষ্ট হচ্ছে।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থার যে দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে তার প্রেক্ষিতে সাহিত্যসৃষ্টিতেও এসেছে নতুনত্ব-বিষয় নির্বাচন ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় সে নতুনত্ব প্রতিনিয়ত স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের ছোটগল্প তারই সার্থক পরিচয় বহন করছে। বাংলাদেশের ছোটগল্পে প্রবীণ গল্পকারগণ অবিভক্ত বাংলার ছোটগল্পের ঐতিহ্যের অনুসারী ছিলেন। তাঁদের গল্পের মধ্যে স্বতন্ত্র চরিত্রের বৈশিষ্ট্য প্রথমেই প্রকাশ পায়নি, ধীরে ধীরে তা নিজস্ব অবয়ব গ্রহণ করেছে। তবে বাংলাদেশের ছোটগল্পে সমাজচিত্র প্রাধান্য পেয়েছে এবং সমাজ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতিফলনও ছোটগল্পে রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
আবুল মনসুর আহমদ
আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৭৯) উপন্যাসের ক্ষেত্রে যেমন ওটগল্পের ক্ষেত্রেও তেমনি প্রবীণ হিসেবে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। তাঁর কৃতিত্ব ব্যঙ্গবিদ্রুপাত্মক গল্পরচনাকারী হিসেবে। ‘আয়না’, ‘ফুড কনফারেন্স’, ‘আসমানী পর্দা’, ‘গালিভারের সফরনামা’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ এবং তা সবই ব্যঙ্গরচনায় সমৃদ্ধ। ব্যঙ্গবিদ্রুপের তীব্রতায় তাঁর গল্পগুলো অনন্য বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। সমকালীন সমাজ-জীবনে বিরাজমান অন্যায়-অনাচারের প্রতি সুতীব্র ব্যঙ্গ প্রকাশ করার জন্য তাঁর গল্পগুলো বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ বলে বিবেচনার যোগ্য।
মাহবুব-আলু-উল-আলম
কথাশিল্পী মাহবুব-উল-আলমের (১৮৯৮-১৯৮১) গল্পগ্রন্থের নাম ‘তাজিয়া’, ‘পঞ্চঅন্ন’। ‘গোফ সন্দেশ’ তাঁর ব্যঙ্গরচনা।
আবুল ফজল
আবুল ফজল (১৯০৩-৮৩) গল্পরচনায় বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করেছেন। ‘মাটির পৃথিবী’, ‘আয়না’, ‘মৃতের আত্মহত্যা’, ‘নির্বাচিত গল্প’ ও ‘শ্রেষ্ঠগল্প’ নামে তাঁর গল্পসংকলন গ্রন্থ রয়েছে। সমাজচিত্র হিসেবে তাঁর গল্পগুলো প্রশংসিত। প্রেমের বিচিত্র প্রকাশও তাঁর গল্পে দেখা যায়। সমকালীন জীবনের বিভিন্ন দিক তাঁর ছোটগল্পে প্রতিফলিত হয়েছে।
আবু জাফর শামসুদ্দিন
আবু জাফর শামসুদ্দিন (১৯৯১-৮৮) কিছু গল্প রচনা করেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর নাম—‘জীবন’, ‘শেষ রাত্রির তারা’, ‘এক জোড়া প্যান্ট ও অন্যান্য’, ‘রাজেন ঠাকুরের তীর্থ যাত্রা’, ‘স্বনির্বাচিত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠগল্প’, ‘লেংড়ী’ ইত্যাদি। তাঁর গল্পে সমাজচেতনার পরিচয় পাওয়া যায়।
মবিনউদ্দিন আহমদ
মবিনউদ্দিন আহমদ (১৯১২-৭৮) বিচিত্র বিষয়াবলম্বনে গল্প রচনা করেছেন। ‘ভাঙ্গা বন্দর’, ‘হোসেন বাড়ীর বৌ’ তাঁর গল্পগ্রন্থ। মুসলমান সমাজ জীবনের কথা তাঁর গল্পে রূপায়িত হয়েছে। আঙ্গিক বা কলানৈপুণ্যের দিক থেকে অভিনবত্ব না থাকলেও সহজ সরল ভাষায় গল্পরস সৃষ্টির বৈশিষ্ট্য এখানে লক্ষণীয়। সমাজসচেতনতা ও বাস্তব জীবনবোধ তাঁর রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল।
শওকত ওসমান
শওকত ওসমান (১৯১৯-৯৮) ঔপন্যাসিক হিসেবে যেমন কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও তেমনি কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থগুলোর নাম—‘জুনু আপা ও অন্যান্য গল্প’, ‘সাবেক কাহিনী’, ‘পিজরাপোল’, ‘ওটেন সাহেবের বাংলো’, ‘ডিগবাজী’, ‘প্রস্তর ফলক’, ‘উপলক্ষ’, ‘নেত্রপথ’, ‘জন্ম যদি তব বঙ্গে’, ‘এবং তিন মির্জা’, ‘ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘উভশৃঙ্গ’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘মনিব ও তাহার কুকুর’, ‘বিগত কালের গল্প’ ইত্যাদি। শওকত ওসমান নিরীক্ষামুখীন শিল্পী বলে তাঁর রচনায় বিচিত্র স্বাদ ও আঙ্গিকের গল্প পাওয়া যায়। খুব ছোট আকারের গল্প তিনি রচনা করেছেন। এক্ষেত্রে তাঁর গল্প নকশাজাতীয়। অল্প কথায় গভীর ব্যঞ্জনাসৃষ্টিতে তাঁর বিশেষ দক্ষতা বিদ্যমান। সংক্ষিপ্ত অবয়বে গল্প রচনা করে যে বাগভঙ্গিমায় আকর্ষণীয়তা সৃষ্টি করেছেন তাতে পাঠকের সমাদর লাভ করা সম্ভব হয়েছে। সমাজজীবনের বিচিত্র মানুষের পরিচয়—জীবনের দারিদ্র্য, সংগ্রাম, ধর্মের বাহ্যিক রীতিনীতি, মত আচার—তাঁর গল্পে রূপ লাভ করেছে। লেখকের সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টির পরিচয় গল্পে প্রকাশমান। অনেক ক্ষেত্রে তিনি সমাজ সমালোচকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর রচনা গতানুগতিকতার ব্যতিক্রম। সমকালীন জীবনের চিত্র তাঁর গল্পে খুব সার্থকভাবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। গল্পের বিষয় নির্বাচনে তাঁর পর্যবেক্ষণশীলতা, গল্পের রূপায়ণে আকর্ষণীয় ও সাবলীল ভাষার ব্যবহার, চরিত্রচিত্রণে দক্ষতা—সবকিছু মিলিয়ে তার গল্প যথার্থ সার্থকতার দাবিদার।
আবু রুশদ
আবু রুশদ (১৯১৯) স্বল্প সংখ্যক গল্পের রচয়িতা হলেও তাঁর রচনায় বিশিষ্টতা রয়েছে। ‘প্রথম যৌবন’, ‘শাড়ী বাড়ী গাড়ী’, ‘রাজধানীতে ঝড়’, ‘স্বনির্বাচিত গল্প’, ‘মহেন্দ্র মিষ্টান্ন ভাণ্ডার’, ‘ডোবা হল দীঘি’, ‘দিন অমলিন’, ‘বিয়োগ ব্যথা’ তাঁর গল্প গ্রন্থ। তাঁর গল্পে শহুরে আবহাওয়া এবং আধুনিক সমাজের চিত্রই বেশি ফুটেছে। সমকালীন জীবনের বিচিত্র রূপ তাঁর গল্পে বিধৃত হয়েছে। গল্পকারের যথার্থ অনুসন্ধিৎসা তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে। চরিত্র চিত্রণে, গল্প বর্ণনায় ও ভাষা ব্যবহারে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর বিদ্যমান।
মিরজা আবদুল হাই
মিজা আবদুল হাই (১৯১৯-৮৪) গল্প রচনায় কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। ‘ছায়া প্রচ্ছায়া’ ও ‘বিস্ফোরণ’ তাঁর গল্পগ্রন্থ। রচনায় প্রাচুর্যের অভাব থাকলেও তিনি স্বাতন্ত্রে বিশিষ্ট ছিলেন। ছোটগল্পকার হিসেবেই ছিল তাঁর যথার্থ প্রতিষ্ঠা। সমকালীন বাস্তব জীবনের আলেখ্য তাঁর ছোটগল্পে দক্ষতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির ফলে তিনি সমাজ জীবন ও পরিবেশকে তাঁর গল্পে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর (১৯২২-৭১) নাম বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তিনি বৈচিত্র্যপূর্ণ সাহিত্যসৃষ্টি করেছেন। তবে তাঁর গল্পের সংখ্যা বেশি নয়। তাঁর ‘নয়নচারা’ ও ‘দুই তীর ও অন্যান্য গল্প’ নামে দুটি গল্পসংকলন প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু এই স্বল্পসংখ্যক গল্পেই তাঁর বিশিষ্ট প্রতিভার নির্দশন বিদ্যমান। তাঁর অধিকাংশ গল্পে গ্রামাঞ্চলের অনাচার-কুসংস্কারের যথাযথ চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ তাঁর উপন্যাসের মত গল্পেও লক্ষণীয়। বিষয়বস্তু নির্বাচনের জন্য তিনি সমাজজীবনের বিভিন্ন দিকে পদচারণা করছেন। সেখানকার নানা অসংগতি তাঁর গল্পে বিকৃত হয়েছে। সুন্দর ও আকর্ষণীয় প্রকাশভঙ্গির জন্য তাঁর গল্পের বিশেষ আবেদন বিদ্যমান। শুধু বাংলাদেশের সাহিত্যের ক্ষেত্রে যে তাঁর গল্প ব্যতিক্রমধর্মী তা নয়, বরং এদিক থেকে সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যে তার অবদান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচতার ছোটগল্পে প্রতিফলিত হয়েছে গভীর জীবনবোধ, অন্তর্লোকের রহস্য অনুসন্ধানেও তিনি ছিলেন তৎপর, ব্যক্তিজীবন ও সমাজ-সমস্যার পটে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার, মূল্যবোধের বিপর্যয় এবং মানসিক স্বলনপতনের আলেখ্য তাঁর রচনায় উজ্জ্বল ভাবে রূপ লাভ করেছে।
সরদার জয়েনউদদীন
সরদার জয়েনউদ্দীন (১৯২৩-৮৬) ‘নয়ানঢুলি’, ‘বীর কণ্ঠীর বিয়ে’, ‘খরস্রোতা’, ‘অষ্টপ্রহর’, ‘বেলা ব্যানার্জির প্রেম’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। দরিদ্র গ্রামীণ সমাজজীবনের নানা সমস্যা দর্পণের ন্যায় স্বচ্ছভাবে পাঠকের চোখের সামনে উপস্থিত করার ক্ষমতা তাঁর অনস্বীকার্য। গ্রামের মানুষের দুঃখদুর্দশা তাঁর হৃদয়ে সহানুভূতির সঞ্চার করেছিল। তাই তাঁর গল্পে সেই মনের পরিচয় মেলে। তাঁর রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে সমকালীন সমাজের সংকট, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়, আবার গ্রামীণ জীবনের চিত্রাঙ্কনেও তিনি কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছেন। সামাজিক শোষণের কথাও তিনি উপেক্ষা করেননি। গ্রামবাংলার শোষিত ও বঞ্চিত মানুষের মননশীল আলেখ্য হিসেবে তাঁর গল্পগুলোকে বিবেচনা করা চলে।
আবু ইসহাক
আবু ইসহাক (১৯২৬-২০০৩) প্রধানত ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান, কিন্তু ছোটগল্পের ক্ষেত্রেও তাঁর কৃতিত্ব রয়েছে। ‘মহাপতঙ্গ’ ও ‘হারেম’ তাঁর গল্পগ্রন্থ। তিনি বাস্তবধর্মী লেখক এবং তাঁর বক্তব্য সহজ সরলভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
আবদুশ শাকুর
আবদুশ শাকুর (১৯৪১-২০১২) ‘ক্ষীয়মান’, ‘সরসগল্প’, ‘নৈসর্গিক সম্পর্ক’, ‘গোলাপ-ধোলাই’, ‘ধস’, ‘এপিটাফ’, ‘বিচলিত প্রার্থনা’ প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ প্রকাশ করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর গল্পে সমকালীন জীবনের বৈশিষ্ট্যের প্রতিফলন লক্ষণীয়। তাঁর গল্পের প্রকাশভঙ্গি তথা ভাষার ক্ষেত্রে স্বকীয়তা রয়েছে। শব্দের অভিনব ব্যবহারে, ভাবের ব্যঞ্জনাসৃষ্টিতে আবদুশ শাকুরের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে।
আতোয়ার রহমান
আতোয়ার রহমান (১৯২৭-২০০২) শিশুদের জন্যই বেশি লিখে থাকেন। তবে গল্প রচনায়ও তাঁর কৃতিত্ব ফুটে উঠেছে। ‘হলদে লতা’, ‘বলয়’ তাঁর উল্লেখযোগ্য গল্পগ্রন্থ। বিভিন্ন বিষয়ের অনুবাদে তিনি দক্ষতা দেখিয়েছেন। বিদেশী গল্প অনুবাদের নমুনা হিসেবে তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘পঞ্চমুখী’, ‘স্বৰ্গনরক’, ‘নির্বাচিত গল্প’ ইত্যাদি।
রাজিয়া মাহবুব
রাজিয়া মাহবুব (১৯২৮) বৈচিত্র্যধর্মী সাহিত্যসাধনায় মহিলাদের মধ্যে বিশিষ্ট। তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম ‘খাপছাড়া’, ‘কুয়াশার নদী’ ও ‘অমূর্ত আকাঙ্ক্ষা’, ‘অরণ্যে নক্ষত্রের আলো’।
মিন্নাত আলী
রসরচনা লিখে মিন্নাত আলী (১৯২৬-২০০৮) খ্যাতি লাভ করেছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম ‘আমার প্রথম প্রেম’, ‘মফঃস্বল সংবাদ’, ‘যাদুঘর’, ‘চেনা ও জানা’, ‘আমি দালাল বলছি’ ইত্যাদি।
ইসহাক চাখারী
ইসহাক চাখারী (১৯২২) রচিত গল্পগ্রন্থের নাম ‘জানালা’। স্বল্প সংখ্যক গল্প রচনা করলেও তাঁর গল্পগুলো বিশিষ্টতার দাবি রাখে।
শামসুদ্দিন আবুল কালাম
শামসুদ্দিন আবুল কালাম (১৯২৬-৯৭) রচিত ছোটগল্পের গ্রন্থগুলোর নাম—‘পথ জানা নেই’, ‘ঢেউ’, ‘দুই হৃদয়ের তীর’, ‘অনেক দিনের আশা’, ‘শাহের বানু’, ‘পুঁই ডালিমের কাব্য’, ‘মজা গাঙের গান’ ইত্যাদি। তাঁর গল্পগুলো বৈপ্লবিক সমাজচেতনায় সমৃদ্ধ। তাঁর অধিকাংশ গল্প গ্রামীণ পটভূমিতে রচিত এবং তাতে লেখকের বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রতিফলিত হয়েছে। প্রকৃতির প্রভাবও তাঁর গল্পে লক্ষ করা যায়। বাস্তবতা ও প্রকৃতির সান্নিধ্যের জন্য তাঁর গল্প পাঠকের কাছে সমাদৃত। এদেশের সামাজিক সমস্যার বিভিন্ন দিক তাঁর ছোটগল্পে সার্থকভাবে রূপায়িত হয়ে উঠেছে। নিপীড়িত জনগণের কথা বলার ওপরই তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
ড. আশরাফ সিদ্দিকী
ড. আশরাফ সিদ্দিকী (১৯২৭) ‘রাবেয়া আপা’ গল্পগ্রন্থ রচনা করে খ্যাতিলাভ করেছেন। কথাশিল্পী হিসেবে তাঁর বিশিষ্টতা আছে। তাঁর অন্যান্য গল্পগ্রন্থ হল—‘গলির ধারের ছেলেটি’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘শেষ নালিশ’ ইত্যাদি। শিশুতোষ গল্প রচনাতেও তাঁর বিশেষ দক্ষতা রয়েছে। শিশুদের জন্য তাঁর লেখা ‘সিংহের মামা ভোম্বল দাস’, ‘আমার দেশের রূপকাহিনী’, ‘বাণিজ্যতে যাব আমি’, ‘বাংলাদেশের রূপকথা’, ‘রূপকথার রাজ্যে’ ইত্যাদি।
হেলেনা খান
হেলেনা খান (১৯২৯) গল্প উপন্যাস রচনা করেছেন। ‘ফসলের মাঠ’, ‘বৃষ্টি যখন নামলো’, ‘একাত্তরের গল্প’, ‘কালের পুতুল’, ‘পাপড়ির রং বদলায়’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ছায়াকালো কালো’, ‘কারাগারের ভিতরে ও বাইরে’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থে তাঁর প্রতিভা ফুটে উঠেছে। শিশু-কিশোরদের জন্যও তাঁর গল্পগ্রন্থ রয়েছে।
নাজমুল আলম
নাজমুল আলম (১৯২৯) একজন বিশিষ্ট গল্পকার। তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘একটি অচল আনি’, ‘উপস্থিত সুধীমণ্ডলী’, ‘স্বনির্বাচিত গল্প’, ‘পাণ্ডুলিপি ও গহনার বাক্স’, ‘বুনোবৃষ্টি’, ‘নিজের বাড়ি’ ইত্যাদি।
আহমদ মীর
আহমদ মীর (১৯২৮-৭৯) ‘লালমোতিয়া’ গল্পগ্রন্থ রচনা করে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন।
ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ
সমাজসচেতন লেখক হিসেবে ড. আলাউদ্দিন আল আজাদের (১৯৩২-২০০৯) নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর গল্পগ্রন্থ—‘জেগে আছি’, ‘ধানকন্যা’, ‘মৃগনাভি’, ‘অন্ধকার সিড়ি’, ‘উজান তরঙ্গে’, ‘যখন সৈকত’, ‘আমার রক্ত স্বপ্ন আমার’, ‘জীবনজমিন’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘মনোনীত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ইত্যাদি। লেখকের প্রথম দিককার গল্পে শ্রেণিসংগ্রাম সম্পর্কিত বলিষ্ঠ বক্তব্য রূপায়িত হয়ে উঠেছিল বলে তিনি সহজেই খ্যাতিলাভ করতে পেরেছেন। সংগ্রামী মানুষের জীবনালেখ্য তাঁর গল্পে বিধৃত হয়েছে, জীবনমুখীনতা তাঁর বৈশিষ্ট্য। কোন কোন গল্পে সমাজজীবনের বাস্তব ও অন্তরঙ্গ পরিচয় প্রকাশ পেয়েছে। এসব ক্ষেত্রে লেখকের আন্তরিকতার অভাব নেই। কিছু সংখ্যক গল্পে লেখক ফ্রয়েডীয় রীতিবৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছেন। সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাঁর পদচারণা আছে। তবে ছোটগল্পে তাঁর অবদান বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচ্য। সমালোচকের মতে, বাংলা কথাশিল্পের বাস্তবতা-নিবিড় বিষয়-বৈচিত্র্যের বাইরে আলাউদ্দিন আল আজাদের শিল্পচেতনার যে অতিরিক্ত বিশেষত্ব ধরা পড়ে তার পরিচয় রয়েছে তাঁর ভাষার কাব্যময়তায়, বর্ণনার শিল্পিত মাধুর্যে ও বাক্যবিন্যাসের চমৎকারিত্বে, যার সমন্বয়ে অনায়াসে গড়ে ওঠে তাঁর রচনার অনন্য এক শিল্পশৈলী।
শহীদ সাবের
শহীদ সাবের (১৯৩০-৭১) রচিত গল্পগ্রন্থ ‘এক টুকরো মেঘ’ বিশিষ্টতার পরিচায়ক।
জহির রায়হান
জহির রায়হান (১৯৩৩-৭২) ‘সূর্যগ্রহণ’ নামে একটি গল্পসংকলন প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর আরও কিছু গল্প বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছড়ানো রয়েছে। উপন্যাসের মতই তাঁর গল্পে অপূর্ব মাধুর্য প্রকাশ পেয়েছে। ‘জহির রায়হান গল্পসমগ্র’ গ্রন্থে তাঁর রচিত অনেকগুলো গল্প সংগৃহীত হয়েছে। গল্পগুলোতে মধ্যবিত্ত সমাজবাদী মানবহৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতির পরিচয় বিধৃত। জহির রায়হান ছিলেন প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ধারক। তাঁর উপন্যাসের মত ছোটগল্পেও ফুটে উঠেছে দেশাত্মবোধ, সেই সঙ্গে মানবমনের বিচিত্র অনুভূতির স্বচ্ছন্দ প্রকাশ, বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করে প্রকাশ করার বিরল ক্ষমতা ছিল তাঁর। সেজন্য তিনি সহজ সরল ভাষা ও সংক্ষিপ্ত আকারের বাক্য ব্যবহার করেছেন। তাঁর ছোটগল্পের মধ্যে রসসৃষ্টির সহজ প্রমাণ বিদ্যমান।
মুর্তজা বশীর
মুর্তজা বশীর (১৯৩৩) গল্পকার হিসেবে :কাচের পাখির গান’ গ্রন্থে বৈশিষ্ট্যের পরিচয় দিয়েছেন।
সাইয়িদ আতিকুল্লাহ
সাইয়িদ আতিকুল্লাহ (১৯৩৩-৯৮) একজন বিশিষ্ট গল্পকার। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম ‘বুধবার রাতে’। কবি হিসেবে তিনি সমধিক খ্যাতিমান ছিলেন।
হাসানাত আবদুল হাই
হাসানাত আবদুল হাই (১৯৩৯) গল্পকার হিসেবে খ্যাতিমান। ‘একা এবং একসঙ্গে’, ‘যখন বসন্ত’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ তাঁর সংকলন। তাঁর ছোটগল্পে নগর জীবন ও গ্রামীণ জীবন চিত্রিত হয়েছে। আধুনিক চিন্তাধারার এই গল্পকার চলমান জীবনের বিচিত্র ঘটনা, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জীবনের নানা জটিলতা ইত্যাদি রূপায়ণে আধুনিক বাস্তববাদী শিল্প ধারণাকে অবলম্বন করেছেন।
কাজী ফজলুর রহমান
কাজী ফজলুর রহমান (১৯৩১) ছোটগল্প রচনায় সমকালীন জীবন ও মানবিক হৃদয়ানুভূতি প্রকাশে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থগুলোর নাম—‘দর্পণে প্রতিবিম্ব’, ‘যাত্রী’, ‘ষোলই ডিসেম্বর ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’।
আবদুল গাফার চৌধুরী
আবদুল গাফফার চৌধুরী (১৯৩৪) লব্ধপ্রতিষ্ঠ গল্পলেখক। ‘সম্রাটের ছবি’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’, ‘সুন্দর হে সুন্দর’ প্রভৃতি গ্রন্থে তাঁর গল্পগুলো সংকলিত হয়েছে। তিনি শিল্পরীতিতে ওমান্টিক। তাঁর গল্পে বাংলাদেশের সমাজ ও জীবন যেমন রূপায়িত হয়ে উঠেছে, তেমনি কল্পনা প্রবণতার পরিচয়ও তাতে বিদ্যমান ।
হেমায়েত হোসেন
হেমায়েত হোসেন (১৯৩৪-৭২) ‘অনিদ্র পলাশ’ নামক গল্পগ্রন্থ রচনা করে ছিলেন।
সৈয়দ শামসুল হক
সৈয়দ শামসুল হক (১৯৩৫) কবি ও ঔপন্যাসিক হিসেবে খ্যাতিমান হলেও গল্পরচনায় তাঁর বিশেষ দক্ষতা প্রকাশ পেয়েছে। ‘তাস’, ‘শীতবিকেল’, ‘রক্তগোলাপ’, ‘আনন্দের গত্যু’, ‘প্রাচীন বংশের নিঃস্তু সন্তান’, ‘এক সঙ্গে’, ‘বাংলার মুখ’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ ‘সৈয়দ শামসুল হকের প্রেমের গল্প’, ‘জলেশ্বরীর গল্পগুলো’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। রোমান্টিক মনোভাবের পরিচয় তাঁর গল্পে প্রকাশ পেয়েছে।
শহীদ আখন্দ
শহীদ আখন্দ (১৯৩৫) ‘জনতায় শির্জন’, ‘অনিবার্য বান্ধব’, ‘যখন পারিনা’ ‘শহীদ আখন্দের সরস গল্প’, ‘হালকা হাসির গল্প’ প্রভৃতি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। বাস্তবধর্মী সামাজিক আলেখ্য হিসেবে তাঁর গল্পগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পেয়েছে। কিশোর সাহিত্যে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য। অনুবাদেও তাঁর দক্ষতা রয়েছে। মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনের সুখদুঃখ আনন্দবেদনার চিত্র তাঁর গল্পে চমৎকারভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি মানবহৃদয়ের বিচিত্র অনুভূতিকে উজ্জ্বল ভাবে রূপায়িত করেছেন।
হুমায়ূন কাদির
হুমায়ুন কাদির (১৯৩৫-৭৭) কিছু গল্প রচনা করেছিলেন। তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম—‘এক গুচ্ছ গোলাপ ও কয়েকটি গল্প’, ‘আদিম অরণ্যে এক রাত্রি’, ‘শীলার জন্যে সাধ’ ইত্যাদি।
সুচরিত চৌধুরী
সুচরিত চৌধুরী (১৯৩০-৯৪) গল্পকার হিসেবে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর গ্রন্থের নাম ‘আকাশে অনেক ঘুড়ি’, ‘একদিন একরাত’, ‘সুচরিত চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘সুচরিত চৌধুরীর নির্বাচিত গল্প’, ‘নদী নির্জন নীল’, ‘সুরাইয়া চৌধুরীর শুধু গল্প’। তিনি চলন্তিকা রায়, শুধু চৌধুরী, সুরাইয়া চৌধুরী ছদ্মনামে গল্প কবিতা লিখতেন।
হাসান হাফিজুর রহমান
হাসান হাফিজুর রহমানের ১৯৩২-৮৩) গল্পগ্রন্থের নাম—‘আরো দুটি মৃত্যু’। শক্তিমান এই কথাশিল্পীর মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়েছে ‘হাসান হাফিজুর রহমানের অপ্রকাশিত গল্প।’
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর
বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর (১৯৩৬) তাঁর গল্পে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দক্ষতা দেখিয়েছেন। তাঁর গল্পগ্রন্থ—‘অবিচ্ছিন্ন’, ‘দূর দূরান্ত’, ‘বিশাল ক্রোধ’ ও ‘এক ধরনের যুদ্ধ’, ‘মুণ্ডহীন মহারাজ’, ‘সর্বনাশ চতুর্দিকে’, ‘গণতন্ত্রের প্রথম দিন ও অন্যান্য গল্প’।
আল মাহমুদ
আল মাহমুদ (১৯৩৬) কয়েকটি গল্পসংকলন প্রকাশ করেছেন। ‘পানকৌড়ির রক্ত’, ‘সৌরভের কাছে পরাজিত’, ‘গন্ধবণিক’, ‘আল মাহমুদের গল্প’, ‘প্রেমের গল্প’, ‘ময়ূরীর মুখ’, ‘গল্প সমগ্র’ তাঁর গল্পগ্রন্থের নাম।
শওকত আলী
শওকত আলী (১৯৩৬) ‘উন্মুল বাসনা’, ‘লেলিহান সাধ’, ‘শুন হে লখিন্দর’, ‘বাবা আপনে যান’ গল্পগ্রন্থে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। বক্তব্যের প্রতি অকৃত্রিম সহানুভূতি, গভীর অন্তদৃষ্টি, মওহর প্রকাশভঙ্গি তাঁর রচনার বৈশিষ্ট্য। মানব জীবনের সামগ্রিক বোধের প্রতি তাঁর আন্তরিকতা স্পষ্ট। সাহিত্যের প্রকরণ ও বিষয়বস্তুর প্রতি সচেতনতা তাঁর প্রবল। শিশুতোষ গল্প রচনায়ও তাঁর কৃতিত্ব রয়েছে। তাঁর রচনায় বাংলাদেশের আঞ্চলিক জীবন খুব সার্থকভাবে চিত্রিত হয়েছে। তিনি খেটে যাওয়া মানুষের চিত্রাঙ্কণে এক কৃতী শিল্পী।
হাসান আজিজুল হক
হাসান আজিজুল হক (১৯৩৬) গল্প রচনা করে বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর রচিত গল্পগুলো—‘সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য’, ‘আত্মজা ও একটি করবী গাছ’, ‘জীবন ঘষে আগুন’, ‘নামহীন গোত্রহীন’, ‘আমরা অপেক্ষা করছি’, ‘পাতালে হাসপাতালে’, ‘রোদে যাবো’, ‘মা-মেয়ের সংসার’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘রাঢ়বঙ্গের গল্প’, ‘হাসান আজিজুল হকের শ্রেষ্ঠ গল্প’ প্রভৃতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়েছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের জীবন তাঁর গল্পে অত্যন্ত সার্থকতা সহকারে রূপায়িত হয়ে উঠেছে।
নূরউল আলম
নূরউল আলম (১৯৩৭) ‘পুতুলের কান্না’, ‘প্রসাধন’, ‘উঁচু তলার নায়ক’ প্রভৃতি গল্পগ্রন্থে সমকালীন সমাজ-জীবনের কথা বলেছেন।
মকবুলা মনজুর
মকবুলা মনজুর (১৯৩৮) রচিত ছোটগল্প গ্রন্থগুলোর নাম—‘সায়াহ্ন যুথিকা’, ‘শকুনেরা সবখানে’, ‘নক্ষত্রের তলে’, ‘মকবুলা মনজুরের প্রেমের গল্প’, ‘একুশ ও মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, ‘দিন রজনী’ ইত্যাদি।
বশীর আল হেলাল
বশীর আল হেলালের (১৯৩৬) গল্পগ্রন্থের নাম—‘স্বপ্নের কুশীলব’, ‘প্রথম কৃষ্ণচূড়া’, ‘বিপরীত মানুষ’, ‘ক্ষুধার দেশের রাজা’ ইত্যাদি।
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত
জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (১৯৩৯) গল্পকার হিসেবে খ্যাতিমান। তাঁর ‘দুর্বিনীত কাল’, ‘বহে না সুবাতাস’, ‘সিতাংশু তোর সমস্ত কথা’, ‘পুনরুদ্ধার’, ‘উড়িয়ে নিয়ে যা কাল মেঘ’, ‘ফিরে যাও জ্যোৎস্নায়’, ‘নির্বাচিত গল্প’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থে মধ্যবিত্ত সমাজের চিত্র রূপায়িত হয়েছে।
রিজিয়া রহমান
রিজিয়া রহমান (১৯৩৯) ‘অগ্নিস্বাক্ষর’ ও ‘নির্বাচিত গল্প’ গ্রন্থে বিচিত্র অভিজ্ঞতা ভিত্তিক গল্প স্থান দিয়েছেন।
রাহাত খান
রাহাত খান (১৯৪০) খ্যাতিমান গল্পকার। ‘অনিশ্চিত লোকালয়’, ‘অন্তহীন যাত্রা’, ‘ভালমন্দের টাকা’, ‘আপেল সংবাদ’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। তিনি ছোটদের জন্যও গল্প রচনা করেছেন। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা গল্পগ্রন্থগুলো হল—‘দিলুর গল্প’, ‘হবু রাজা গবু মন্ত্রী’, ‘হাজার বছর আগে’, ‘হাসিকান্নার চিকিৎসা?’ ইত্যাদি।
রশীদ হায়দার
রশীদ হায়দার (১৯৪২) কতিপয় গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। সেগুলোর নাম—‘নানকুর বোধি’, ‘অন্তরে ভিন্ন পুরুষ’, ‘তখন’, ‘আমার প্রেমের গল্প’, ‘পৌষ থেকে পৌষ’, ‘মেঘেদের ঘরবাড়ি’, ‘উত্তর কাল’, ‘পূর্বাপর’ ইত্যাদি।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস (১৯৪৩-৯৭) ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রে বিশেষ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম—‘অন্যঘরে অন্য স্বর’, ‘খোয়াড়ি’, ‘দুধভাতে উৎপাত’ ও ‘দোজখের ওম’।
বিপ্রদাস বড়ুয়া
বিপ্রদাস বড়ুয়া (১৯৪২) ‘নির্বাচিত প্রেমের গল্প’, ‘নদীর নাম গণতন্ত্র’, ‘স্বপ্ন মিছিল’, ‘বীরাঙ্গনার প্রেম’, ‘যুদ্ধজয়ের গল্প’, ‘স্বপ্নসমুদ্রে বনদেবীরা আছে’, ‘উল্কি একটি প্রেমের গল্প’, ‘গাঙচিল’, ‘সাদা কফিন’, ‘আকাশে প্রেমের বাদল’, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করি’, ‘স্বপ্নসুন্দরী’, ‘অলৌকিক চুম্বন’, ‘আমি একটি স্বপ্ন কিনেছিলাম’, ‘ফিরে তাকাতেই দেখি বঙ্গবন্ধু’ ইত্যাদি গ্রন্থে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।
আবদুল মান্নান সৈয়দ
আবদুল মান্নান সৈয়দ (১৯৪৩) সাহিত্য সৃষ্টিতে বৈচিত্র্য ও অভিনবত্ব দেখিয়েছেন। তাঁর গল্পের মধ্যেও সে ধরনের কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। ‘সত্যের মত বদমাশ’, ‘চলো যাই পরোক্ষে’, ‘মৃত্যুর অধিক লাল ক্ষুধা’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘উৎসব’, ‘নেকড়ে হায়েনা আর তিন পরী’ তাঁর গল্পগ্রন্থ।
সেলিনা হোসেন
সেলিনা হোসেন (১৯৪৭) ‘উৎস থেকে নিরন্তর’, ‘খোল করতাল’, ‘মানুষটি’, ‘জলবতী মেঘের বাতাস’, ‘পরজন্ম’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘মতিজানের মেয়েরা’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন।
নাজমা জেসমিন চৌধুরী
নাজমা জেসমিন চৌধুরীর (১৯৪০-৮৯) গল্পগ্রন্থের নাম—‘মেঘ কেটে গেলে’, ‘অন্য নায়ক’, ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ ইত্যাদি। তিনি কয়েকটি উপন্যাস গ্রন্থেরও রচয়িতা।
আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন
আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিন (১৯৩৪-) ‘চাবুক’, ‘ওম শান্তি’, ‘চিরকুট’, ‘নল খাগড়ার সাপ’, ‘কুম্ভকর্ণের দিবানিদ্রা’ ‘লাঁল গেঞ্জি কোকড়া চুল’, ‘আবুল খায়ের মুসলেহউদ্দিনের রম্যগল্প’ প্রভৃতি গ্রন্থ রচনা করে ছোটগল্পের শাখাকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রকাশিত ‘মনের রং নেই’, ‘নিষিদ্ধ শহর’, ‘নির্বাচিত প্রেমের গল্প’, ‘নির্বাচিত গল্প’, ‘নেপথ্য নাটক’, ‘আনন্দ ভুবন’, ‘মুক্তিযুদ্ধের গল্প’, ‘নীল ছবির নায়িকা’, ‘সোনার শরীর’, ‘কলেজ গার্ল’, ‘মনোনীত গল্প’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থেও প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে।
ইউসুফ শরীফ
ইউসুফ শরীফ (১৯৪৮) উপন্যাসের মত ছোটগল্প রচনার ক্ষেত্রেও স্বকীয়তার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম—‘মুহূর্তের বৃত্তান্ত ও যুদ্ধের পর’। সমকালীন জীবনের ছবি তাঁর গল্পে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
কায়েস আহমেদ
কায়েস আহমেদ (১৯৪৮-৯৩) ‘লাশ কাটা ঘর’, ‘দিনযাপন’, ‘অন্ধ তীরন্দাজ’, ‘নির্বাসিত একজন’ গল্পগ্রন্থের রচয়িতা।
হুমায়ূন আহমেদ
হুমায়ূন আহমেদ (১৯৪৮-২০১২) ‘আনন্দবেদনার কাব্য’, ‘নিশিকাব্য’, ‘শীত ও অন্যান্য গল্প’, ‘ছায়াসঙ্গী’, ‘নীলহাতী’, ‘এই আমি’, ‘আমার আপন আঁধার’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থের রচয়িতা। ‘এলেবেলে’ তাঁর রম্য গল্পগ্রন্থ। তিনি মানব জীবনের বিচিত্র রহস্য তাঁর ছোটগল্পে অনবদা ভঙ্গিতে রূপায়িত করে তুলেছেন। গল্পে আকস্মিকতার চমক সৃষ্টিতে যেমন তিনি দক্ষ, তেমনি সাধারণ বিষয়ের ওপর সাধারণত্ব আরোপ করার বিরল প্রতিভা তাঁর রয়েছে। তাঁর গল্পের আঙ্গিকগত বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে যেমন নতুনত্ব আছে, তেমনি নাটকীয়তাকে তিনি যথোপযুক্ত ভাবে কাজে লাগিয়েছেন। সহজ সরল উপস্থাপনা, অনাড়ম্বর ভাষা ও রসমধুর বর্ণনাভঙ্গি তার গল্পকে পাঠকের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
মঞ্জু সরকার
মঞ্জু সরকার (১৯৫৩) ‘অবিনাশী আয়োজন’, ‘মৃত্যুবাণ’, ‘উচ্ছেদ উচ্ছেদ খেলা’, ‘পুরাতন প্রেম ও অন্যান্য গল্প’, ‘আনন্দ যাত্রা’, ‘অপারেশন জয় বাংলা’ গ্রন্থের রচয়িতা।
ইমদাদুল হক মিলন
ইমদাদুল হক মিলন (১৯৫৫) ‘ফুলের বাগানে সাপ’, ‘প্রেমের গল্প’, ‘ভালোবাসার গল্প’, ‘নিরন্নের কাল’, ‘হে প্রেম’, ‘বালিকারা’, ‘হারী’, ‘তোমাকে ভালবাসি’, ‘তাহারা’, ‘মর্মবেদনা’, ‘প্রেমনদী’, ‘প্রেমিক প্রেমিকা’, ‘বারো রকম মানুষ’, যদি জানতে’, ‘প্রেম ভালোবাসা’, ‘ভালোবাসা’, ‘শ্রেষ্ঠ গল্প, বাছাই গল্প’, ‘নির্বাচিত প্রেমের গল্প’, ‘ভালোবাসার নির্বাচিত গল্প’ প্রভৃতি ছোটগল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর ছোটগল্পে নাগরিক জীবনের কথা যেমন বলা হয়েছে তেমনি গ্রামীণ মানুষের কথাও তিনি উপেক্ষা করেননি। তাঁর বর্ণনাভঙ্গি আকর্ষণীয় উপস্থাপনা রীতিও পাঠকের হৃদয়কে সহজভাবে নাড়া দেয়। একজন জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হিসেবে তিনি খ্যাতিলাভ করেছেন।
মঈনুল আহসান সাবের
মঈনুল আহসান সাবের (১৯৫৮) ‘ভিড়ের মানুষ’, ‘আগমন সংবাদ’, ‘প্রেম বিরহ’, ‘স্বপ্নযাত্রা’, ‘এরকমই’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ রচনা করে প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর গল্পে নগর জীবনের মানুষের কথা বলা হয়েছে। আকর্ষণীয় বর্ণনাভঙ্গি তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য।
ঝর্না রহমান
ঝর্না রহমান (১৯৬৯) ‘কালঠুঁটি চিল’, ‘অন্য এক অন্ধকার’, ‘জীবনের জল ও অনল’, ‘স্বর্ণ তরবারি’, ‘কৃষ্ণপক্ষের ঊষা’, ‘অগ্নিতা’ ইত্যাদি গল্পগ্রন্থ রচনা করেছেন।
বাংলাদেশে ছোটগল্পের ক্ষেত্রে বিশিষ্টতা দেখিয়েছেন এমন লেখকের সংখ্যা কম নয়। বর্তমানে এখানকার ছোটগল্পের ইতিহাস যথেষ্ট সম্প্রসারণশীল। পাশ্চাত্যের ছোটগল্পের অনেক অনুবাদ এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এখানকার গল্পকারগণ বাইরের উন্নত গল্পসম্ভারের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। তাই এখনকার গল্পে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার নিদর্শন বিদ্যমান। এর ফলে এখানকার ছোটগল্পের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে পারে।
Leave a Reply