//
//

বাংলাদেশের স্মৃতিকথা ও অন্যান্য রচনার বিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলাদেশের স্মৃতিকথা ও অন্যান্য রচনা

স্মৃতিকথা ও আত্মজীবনীর ধর্ম আলাদা কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্ক যে নেই তা বলা যাবে না। দুটোর পার্থক্য সূক্ষ্মতর। ধরণ আলাদা। বয়ন কৌশলের, প্রবণতাগত তফাৎ আছে। তবে ধরে নেওয়া যায়, লেখকের সবকিছুই ব্যক্তিগত, যা লেখেন তা আত্মস্মৃতি বা জীবনচরিত। সারা জীবনের ডায়েরীই তো লেখকের সবচেয়ে বড় সঞ্চয়। সুতরাং যা লেখা হয় সবই আত্মচরিত, স্মৃতিকথা। তবে আত্মস্মৃতিতে লেখক কি শুধু নিজের জীবনের কথাই বলেন? যাপিত জীবনে কতো কিছুরই তো মুখোমুখি হচ্ছেন লেখক, স্মৃতির নির্মিতি হয় তো সবকিছু মিলেই, পরাজয়-হতাশা-গ্লানি-মনস্তাপ-আত্মসমর্পণ কিংবা সব ছাপিয়ে শ্লাঘাবোধ সবই থাকে। আর সবকিছুরই ঝুলি ঐ স্মৃতিতে। রবীন্দ্রনাথের জীবনস্মৃতি মনোমুগ্ধকর সব কথা, শৈশবের-কৈশোরের। কারও স্মৃতিকথা হতাশার, অসহিষ্ণুতার, ক্ষুন্নবৃত্তিময় জীবনের। এককথায় স্মৃতিতে যা আছে গৌরব-অগৌরব, কষ্ট-সুখের, শ্লাঘার-যন্ত্রণার, মনস্তাপের-হতাশার সবকিছু। তবে কারও স্মৃতি সততই সুখেরও হতে পারে। স্মৃতিকথা auto-portrait, এতে লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট, অতীতকে লক্ষ্যগোচর করা, অতীত-দর্শন (retrospection)। এখানে বস্তুনিষ্ঠতার কিছু নেই। তাঁর স্মৃতিই সর্বার্থ, এবং একমাত্র অবলম্বন। অপরদিকে আত্মজীবনী নানা ধরনের। সাহিত্যিকের আত্মজীবনী অবশ্যই ভিন্ন। জীবনকে তিনি সাহিত্যভাষা প্রদান করেন। সেটা নিশ্চয়ই নিছক কোনো ডকুমেন্টশান হবে না! বাস্তব-অবাস্তব, সত্য-অসত্য-সম্ভাব্যতা মিলে যাপিত জীবনকে মুখোমুখি করেন, করেন পুনর্নির্মাণ। কল্পনার সত্যই সেখানে হয়ে ওঠে বড়। আত্মজীবনী বা আত্মচরিত (auto-biography) বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয়ে থাকে সময়ের পৃষ্ঠপোষকতায়, নির্ধারিত থাকে সাল-তারিখ। নির্ধারিত পথ ধরে চলে তা, তথ্য-উপাত্ত ধরেই সবকিছু ঘটে, সেখানে কিছু সম্ভাব্যতা বা কল্পনা তৈরি হলেও ঐ ছকের মধ্যেই তা গৃহীত। এককথায় বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে আত্মজীবনী বা জীবনচরিত বা চরিতকথা। এমনকি তা জীবন নিয়ে গবেষণার ব্যাপারও হতে পারে।

ভ্রমণসাহিত্য ভ্রামণিক অভিজ্ঞতা। মনে পড়ে সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে, অন্নদাশঙ্কর রায়ের পথে প্রবাসে কিংবা মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের বিলেতে সাড়ে সাত’শ দিন গ্রন্থের কথা। পথটাই, পথের অভিজ্ঞতাই ভ্রমণকারিদের মুখ্য। খুঁড়ে তোলেন যেন পথের স্থানিক সত্যকে, তার অতীতকে, প্রত্ন-অভিজ্ঞতাকে। বাংলাদেশের লেখক হাসনাত আবদুল হাই লিখেছেন আন্দালুসিয়া, স্পেনের একটি শহরের মনোমুগ্ধকর কাহিনি। ঐতিহাসিক স্থানে পৌছালে, মন আনচান করে ঐ ইতিহাসকে ফিরে পেতে, নায়াগ্রা ফলস এ পৌছালে বাস্তব ফিরতে চায় এর উৎসে; এরূপে কল্পনায় ভর করে তুলনা; এদেশ থেকে অন্যদেশ, নিজদেশ থেকে পরদেশ—এভাবে ভ্রমণ হয়ে ওঠে সাহিত্য, যোগায় প্রাণচাঞ্চল্যের রস, স্বীকৃতি দেয় জীবনের, প্রতিষ্ঠা দেয় জীবনবাদকে। এ পর্যায়ে আমাদের সাতচল্লিশ-উত্তর লেখকগণ নিম্নরূপ—

আ. ন. ম. বজলুর রশীদ

‘দ্বিতীয় পৃথিবীতে’, ‘পথ বেঁধে দিল’ (১৩৬৭), ‘দুই সাগরের দেশে’ স্মৃতিচারণমূলক রচনা। অনুভবের ছোঁয়ায় জীবনের বিচিত্র আয়োজনের অন্বেষণ-উপলব্ধি তার রচনা। কবির প্রতিবিম্ব রচিত হয়েছে এসব রচনায়। আবেগকে একটা মাত্রায় প্রয়োগ করেছেন, সংযত ও সংহত রচনাপ্রয়াস। পথের অভিজ্ঞতাকে অনুরাগের রংয়ে রাঙিয়েছেন আ.ন.ম. বজলুর রশীদ।

আজিজুর রহমান মল্লিক

‘আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ (১৯৯৫)-এ স্মৃতিকথায় রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেখকের অনুষঙ্গ। অত্যন্ত মৃদুভাষী উচ্চারণে অনন্য করে তুলেছেন তার অভিজ্ঞতা। আন্তরিক, পরিশ্রমী ও যত্নবান এ লেখক গ্রন্থটিতে কোনো পরিচ্ছেদ বিভাজন করেননি, তথ্য-উপাত্তসমেত অবারিত বলে গেছেন ঘটনাপ্রবাহ। তীক্ষ মনন-প্রলুব্ধ রচনা।

আকবরউদ্দীন

আকবরউদ্দীনের অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে লিখেছেন ‘পথের দিশারী’, ‘শহীদ লিয়াকত’, ‘কায়দে আযম’। এটি স্মৃতিচারণাধর্মী কিন্তু সদ্য পাকিস্তানের রাজনৈতিক আবেগ ও ব্যক্তিত্বরাই এতে উঠে আসেন। কায়েদে আজম স্মৃতিচেতনায় অনিবার্যতা পান, মুসলিম রাষ্ট্রআদর্শ থেকেই, তবে অনুভব সুপাঠ্য, রুচিশীল। লেখকের লেখায় আত্মতুষ্টির আতিশয্য আছে। যে উচ্ছ্বাসময়তা আছে তার একটু বেশি মাত্রার।

আখতার ইমাম

‘রোকেয়া হলে বিশ বছর’ (১৯৮৬), ‘ইডেন কলেজ থেকে বেথুন’ (১৯৯০) আখতার ইমামের কর্ম-অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণ। নারীশিক্ষা-সংস্কৃতির বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে স্বতন্ত্রভাষ্যে তুলে এনেছেন।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ

অনবদ্য রচনা ‘বিদায় অবন্তী’ (১৯৯৫)। নানান পারম্পর্যহীন উপলক্ষে গোটাকয় স্মৃতিচারণমূলক রচনা লিখেছিলেন বিভিন্ন সময়ে এটি তারই গ্রন্থরূপ। ‘জাহানারা ইমাম’, ‘বিদায় অবন্তী’, ‘অনিশ্চিত কালবেলায়’, ‘নীরব সংঘ’ ও ‘রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী’—এমন শিরোনামে সুলিখিত তাঁর প্রবন্ধ। তারুণ্যের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে ঘটনার দিকে এগিয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সে যৌবন প্রতিনিয়ত শ্রেয়কে স্পর্শের স্পর্ধায় জীবনকে প্রাণিত করে দুঃসাধ্যের রাস্তায়, আত্মবিস্মৃতের মত তাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়, সেই যৌবনই ছিল সেদিন আমাদের একমাত্র এবং ক্ষমাহীন প্ররোচক’—এমন বর্ণনায় স্মৃতি পেছনে নয় মানুষকে সামনের দিকেই এগিয়ে নেয়।

আবু রুশদ

লেখকের আত্মজীবনী ‘জীবন ক্রমশ’ (১ম খণ্ড, ১৯৮৬), ‘ঠিকানার পথে’ (২য় খণ্ড, ১৯৯০), ‘এখন বর্তমান’ (৩য় খণ্ড, ১৯৯৭)। দীর্ঘায়ত এ রচনায় আবু রুশদ তীক্ষধী, প্রজ্ঞাঋদ্ধ। জীবনের বিচিত্র পথকে আলিঙ্গন করেছেন—সেখানে উজ্জ্বল তার বন্ধু এবং সে অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ছোটগল্পের ভিত্তি প্রস্তুত করা। ‘আত্মজীবনী’ তাঁর আত্মকথন নয়। চমৎকার গদ্যে, দীর্ঘ প্রস্ততি ও পরিচর্যায়, চলমান জীবনের প্রত্যয় ও পরিবৃত্তকে নৈর্ব্যক্তিক কৃষ্টিতে প্রকাশ করেছেন।

আবুল কালাম শামসুদ্দীন

‘অতীত দিনের স্মৃতি’ (১৯৬৮) স্মৃতিময় আখ্যান, আত্মজীবনীও বটে। এটি বৃহৎ গ্রন্থ। লেখক বাল্যকাল থেকে বিশ শতকের আর্থ-রাজনীতি ও সামাজিক অভিজ্ঞতাকে বয়ান করেছেন। আবুল কালাম শামসুদ্দীন মনোজ্ঞ অভিজ্ঞতাকে রূপময় করে প্রকাশ করেন। তাঁর রচনা ‘তৃতীয় চোখে’র গুরুত্বে অর্জিত। অনেকটা নিজেকে আড়াল করেছেন তিনি এ স্মৃতিকথায়, সেটি হয়ে উঠেছে তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ। বিচিত্র অভিজ্ঞতার, কুলপ্লাবী উচ্চারণ আশা জাগানিয়া। রাজনীতি-ইতিহাসের গুরুত্ব জানার জন্য এটি একটি অনবদ্য গ্রন্থ। ১৯৬৫ (২—৯মার্চ) সালে লেখকের চীন ভ্রমণের কাহিনি নিয়ে লেখা ‘নতুন চীন নতুন দেশ’।

আবু জাফর শামসুদ্দীন

ভ্রমণকাহিনী সংস্কৃতির সামগ্রিক রূপকে দিব্যচেতনায় পরিচয় করায়। শুদ্ধ মননে আবু জাফর শামসুদ্দীন ‘এখন আফগানিস্তান’ (১৯৮২), ‘আরেক ভুবন সোভিয়েত ইউনিয়ন’ (১৯৮২) রচনা করেছেন। ‘আত্মস্মৃতি’ প্রথম খণ্ড বের হয় ১৯৮৯-এ। ব্যাখ্যাত হয়েছে জন্মস্থান-প্রকৃতি ও পরিবেশ, ক্রমশ কর্মজীবন এবং ভারতের নানা অঞ্চল, যেখানে সমকালীন প্রসঙ্গ ধরে সমাজ-রাজনীতি-দাঙ্গা বিপুল হয়ে ওঠে। তৃতীয় অংশে আছে ভাষা আন্দোলন, কাগমারী সম্মেলন, আইউব, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ইত্যাদি নানা অভিজ্ঞতা। পূর্ব-বাংলার সমাজ-রাজনীতির অনুপুঙ্খ চিত্র। লেখকের ভাষা তির্যক, শানিত কখনোবা বিদ্রুপাত্মক। নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ, প্রয়োজনে নিজের সম্পর্কেও করেছেন বিরূপ মন্তব্য। ‘অসামান্য এ আত্মজীবনী’ গ্রন্থটি বাংলাদেশের সামাজিক ইতিহাসের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। লেখকের এসব বিরল অভিজ্ঞতা যেন প্রজন্মান্তরের সাক্ষী। তার অন্য স্মৃতিচারণমূলক রচনা ‘মুসলিম সমাজের ঝড়ো পাখি বেনজীর আহমদ’ (১৯৮৮)

আবুল ফজল

‘সাংবাদিক মুজিবর রহমান’ (১৯৬৭), ‘শেখ মুজিব: তাকে যেমন দেখেছি’ (১৯৭৮) দুটি আবুল ফজলের জীবনী ও স্মৃতিকথা। বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে লেখকের স্মৃতিচারণা ও অভিজ্ঞতার বয়ান এ রচনা। সাংবাদিক ব্যক্তিত্ব মুজিবর রহমান আর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব সম্পর্কে লেখকের অনুরাগ এ রচনায় বিদ্যমান। ব্যক্তিগত হলেও সেখানে হয়ে উঠেছে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ। ‘রেখাচিত্র’ (১৯৬৬), ‘লেখকের রোজনামচা’ (১৯৬৯), ‘দুর্দিনের দিনলিপি’ (১৯৭২) এগুলোতে আবুল ফজলের শৈশব-কৈশোরের বিচিত্র অনুভূতি ও অভিজ্ঞতার বিষয়গুলি রচিত হয়েছে। এগুলো আত্মজীবনীমূলক। এ সমস্ত রচনায় সময় ও বেড়ে ওঠার চেতনার সত্যতা প্রতিফলিত। সময় ও পরিবেশকে জানা যায় এ রচনায়। তাঁর দিনলিপিও সুপাঠ্য। আবুল ফজলের ভ্রমণকাহিনি ‘সফর নামা’ (১৩৮২)। ভ্রমণ-অভিজ্ঞতার বর্ণনা করেছেন লেখক বিপুল রূপবৈচিত্র্যে, প্রতিফলিত হয়েছে অন্তরঙ্গ সাংস্কৃতিক পটচিত্র, সম্ভ্রমের সঙ্গে।

আবুল মনসুর আহমদ

প্রথিতযশা রাজনীতিকের স্মৃতিকথা ‘আত্মকথা’ (১৯৭৮)। এটি আবুল মনসুর আহমদের ব্যক্তি অভিজ্ঞতার অন্তর্বয়ন। রচনাটির গুরুত্ব সমকালীন সমাজ-রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে। তাঁর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ’ বছর কিংবা ‘শেরে বাংলা হইতে বঙ্গবন্ধু’ এসব রচনার পর এটিকে তিনি ভিন্ন রকমে ভিন্ন প্রতিপাদ্যে পাঠকের সামনে এনেছেন। যেখানে ব্যক্তিচেতনা প্রবিষ্ট, কিন্তু স্বাধীন ও নিরপেক্ষ চেতনায় উত্তরিত।

আবুল হোসেন

কবি আবুল হোসেনের তিনখণ্ডের স্মৃতিকথা বেরিয়েছে। প্রথম খণ্ড ‘আমার এই ছোট ভুবন’ (২০০৩), দ্বিতীয় খণ্ড ‘আর এক ভুবন’ (২০০৫), তৃতীয় খণ্ড ‘দুঃস্বপ্নের কাল’ (২০০৭)। স্মৃতি হয়ে ওঠে প্রজন্মান্তরের পাঠ, সার্বজনীন অভিজ্ঞতা, মূল্যবোধের দীক্ষা। আবুল হোসেন বলেন—‘জীবনের দুঃসহতম সময়…’ বা ‘১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট প্রথম স্বাধীনতার দ্বিতীয় দিন থেকে ১৯৭১-এর ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত সময়ের যে স্মৃতি…’ এমনভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকেও আনেন তিনি স্মৃতিকথায়। শক্তিশালী ও সাবলীল গদ্যে, তীক্ষ্মধী মেধায়, সংযত বচনে, সংহত মেজাজে রচিত হয়েছে।

আব্বাসউদ্দীন আহমদ

আব্বাসউদ্দীন আহমদ লিখেছেন আমার শিল্পী জীবনের কথা (১৯৬০)। এটি খ্যাতিমান এ সঙ্গীতশিল্পীর মনোজ্ঞ আত্মজীবনী। কৈশোরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শুরু করে কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা লিখতে গিয়ে জীবনী অংশটি কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। প্রথম গানের প্রেরণা, কলেজ জীবন, শিল্পীর আসনে, নবজাগরণে বাংলার মুসলমান, উত্তরকাল, বিদেশ ভ্রমণ, জীবন সায়াহ্নের স্মৃতি—এমন শিরোনামে অনুমিত হয় শুধু শিল্পীর সমগ্রতা নয়, একটি কাল হয়েছে অনুসৃতএ রচনায়। অনবদ্য, সুন্দর এ গ্রন্থ তথ্যে-ভাষ্যে-উপাত্তে অসামান্য, সন্দেহ নেই।

আনিসুজ্জামান

একাত্তরের স্মৃতিকথা নিয়ে আমার একাত্তর (১৯৯৭)। মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা লেখকের, শুধু যুদ্ধ-অভিজ্ঞতাই নয়, ব্যক্তিচরিত্র, প্রবণতা, দ্বেষ-হিংসা-অহংকার, স্বার্থ-অস্বার্থ সবমিলে আমার একাত্তর। এটি একটি যুদ্ধদলিলও বলা যেতে পারে। সরল গদ্যে, স্মিত ভাষ্যে স্মৃতি হাতড়ে ব্যক্ত করেছেন জীবনের, সম্পর্কের সূত্রগুলোকে। কাল নিরবধি (২০০৩) বেশ উঁচু মানের কাজ। এটি তাঁর জীবনচরিত। গোটা বিশ শতকের মুসলিম বাঙালির অভিজ্ঞতার চিত্র তাঁর জীবনের ভেতর দিয়ে ব্যাখ্যাত হয়েছে। পিতামহ, প্রপিতামহ থেকে শুরু করে নিজের বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা, তথ্যনিষ্ঠ পথে অবিরাম বর্ণনা করেছেন লেখক। এটি যে কোনো সংস্কৃতিমনস্ক-কালজ্ঞানসম্পন্ন পাঠকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুস্তক। স্মৃতিকে সঞ্চয়েই নয় শুধু, জীবনের বিচিত্র বাঁকের তথ্যগুলোও তিনি পরিবেশন করেছেন সত্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্যে। রবীন্দ্র মৃত্যুর ঘটনা, গান্ধিজী মৃত্যুর পরের পরিবেশ আবেগবর্জিত ও সংহতরূপে বর্ণিত হয়েছে গ্রন্থে। এ রকম অনেক ব্যক্তিগত বা জাতীয়ভিত্তিক উল্লেখনীয় ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন লেখক; সবকিছুই তার প্রবাহকে অর্থাৎ সময়কে যথোচিত রাখার স্বার্থে। কখনোই কোনো ঘটনা আরোপিত নয় আনিসুজ্জামানের লেখায়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে সারা দেশের মানুষ যাতে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে না পারে, তার জন্যে চেষ্টার অবধি থাকলো না। আমি যদিও জগন্নাথ কলেজ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ছিলাম, কিন্তু সেখানে বিশেষ কিছু করিনি, আমার সময় ও সামর্থ্য সবটুকুই ব্যয় হয়েছিল যুবলীগে।’—এভাবে সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ভূমিতে দাড়িয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলেন আনিসুজ্জামান। এখানে তার দৃষ্টিকোণও ব্যবহার হয়েছে। কখনো কৌতুক, কখনো ঘরোয়া আমেজ, কখনো বা সারল্যে মেলানো তাঁর বিচিত্র অভিজ্ঞতা।

আশরাফ সিদ্দিকী

‘যা দেখেছি যা পেয়েছি’ (১৯৭৬), ‘রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন’ (১৯৭৪), ‘স্মৃতির আয়নায়’ (১ম-৫ম খণ্ড ১৯৮৬), ‘শান্তিনিকেতনের পত্র’ (১৯৭৫-১৯৯৭) আশরাফ সিদ্দিকীর স্মৃতিকথামূলক রচনা। নিজস্ব মননে সাংস্কৃতিক সম্বন্ধ ধারণা এখানে ব্যাখ্যাত হয়েছে। অভিজ্ঞতা হয়েছে যুক্ত। স্মৃতির আয়নায় তাঁর অনবদ্য আত্মকথন।

আশরাফ উজ জামান

‘সীমান্তে মুসাফির’ আশরাফ উজ জামানের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা। এ গ্রন্থে তিনি অনেকটা সাবলীল। সীমান্তের অভিজ্ঞতাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গিতে বয়ান করেছেন লেখক।

আহমদ ছফা

স্মৃতিকথা ‘যদ্যপি আমার গুরু’ (১৯৯৮)। স্মৃতি হাতড়ে তুলেছেন ছফা। গুরু তাঁর আবদুর রাজ্জাক। বিচিত্ৰস্পর্শে ভরে তুলেছেন লেখক তাঁর গুরুঅভিজ্ঞতাকে। আত্মকথনের টান এতে নেই, তা বলেনওনি, পরিবেশ-পরিস্থিতিতে উপভোগ্য হয় সে কাহিনি। বর্ণনাও সুন্দর। রসাপ্লুত, আনন্দদায়ী আখ্যান। আহমদ ছফার জার্মান অভিজ্ঞতা নিয়ে ভ্রমণ কাহিনি perspective Germany (1991)

আহমদ রফিক

আহমদ রফিকের স্মৃতিচারণমূলক ইতিহাসগ্রন্থ ‘একুশের ইতিহাস আমাদের ইতিহাস’ (১৯৮৮)। ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা তথ্যমূলকভাবে বয়ান করেছেন লেখক। তাঁর বাচনপ্রয়াস স্মৃতিপ্রদ।

ইব্রাহীম খাঁ

‘ইস্তাম্বুল পথের যাত্রী’ (১৯৫৪), ‘পশ্চিম পাকিস্তানের পথে ঘাটে’ (১৯৫৫) লেখকের ভ্রমণসাহিত্য। সার্থক নতুনত্ব অর্জিত ইস্তাম্বুল বা পশ্চিম পাকিস্তান যাত্রায়, ব্যক্তিত্বপূর্ণ রচনা। ইব্রাহীম খাঁ যাত্রাকে উপভোগ করেছেন, ইতিহাস, প্রত্নচিন্তায় অভিজ্ঞতাতে জারণ করেছেন দুনয়নে। স্বৰ্গৰ্যাত্রার অভিজ্ঞতা যেন অর্জিত, লেখকের রচনায়। আচমকা আবিষ্কারের অধ্যায়ে লেখকের কলম হয়ে উঠেছে রসোদীপ্ত, প্রাণময়। ইব্রাহীম খাঁর স্মৃতিকথা ‘বাতায়ন’ (১৩৭৪ ব.) ও ‘লিপি সংলাপ’। এতে ইব্রাহীম খাঁর লেখকসত্তার পূর্ণায়ত রূপটি মেলে না। তবু স্মৃতিচিত্র পঠনে গৌণ মনে হয় না কিছু।

গোলাম মোস্তফা

গোলাম মোস্তফার জীবনীগ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’ (১৯৪২)। অনস্বীকার্য, অনবদ্য গ্রন্থ। কবিকল্পনার পরিচয় হয়েছে অনুসৃত। জীবনপঞ্জি, সন-তারিখ ধরে নবীজীবনীর সত্যতা গৃহীত এরপর বাকিটুকু কল্পনা। কবি এ সুযোগ পূর্ণাঙ্গরূপে কাজে লাগিয়েছেন। দ্রুততার বর্ণিল আবহে, মরুময় প্রকৃতি, অনুভূতির রসে ব্যঞ্জিত হয়ে চলে। হজরত, গোলাম মোস্তফার দৃষ্টিতে পুনরুত্থিত, নতুন আমেজে পরিবেশিত—পূর্ণাঙ্গ সাহিত্য হয়ে উঠেছে এ জীবনচরিত। আবেগময় গদ্যে প্রকৃত সত্যের আস্ফালন, চমৎকৃত হওয়ার প্রত্যয় নির্ধারিত।

জাহানারা ইমাম

‘একাত্তরের দিনগুলি’ (১৯৮৬) জাহানারা ইমামের অমর গ্রন্থ। গ্রন্থটির মূল্যায়নে সাইয়িদ আতীকুল্লাহ বলেছেন—‘৭১-এর ঢাকা শহরের অবস্থা এবং গেরিলা তৎপরতা বুঝবার জন্য এই বইটি অত্যন্ত মূল্যবান বলে বিবেচিত হবে।’ মুক্তিযুদ্ধের বস্তুনিষ্ঠ আলেখ্য এ গ্রন্থ। সংবেদনশীল ভাষা, মর্মস্পর্শী বর্ণনাবিন্যাস, সত্যের নিরঙ্কুশ প্রকাশ, যথোচিত পরিবেশ নির্মাণ, জীবন্ত যোদ্ধার প্রতিকৃতি, অকুতোভয় দেশবীর সবকিছু মিলে অসামান্য এ রচনা।

জুবাইদা গুলশান আরা

জুবাইদা গুলশান আরার গ্রন্থ ‘স্মৃতির সোনালী দিগন্তে’ (১৯৭৯)। ব্যক্তিজীবনের নানা ঘটনাবলীকে আখ্যান আকারে বয়ান করেছেন লেখক। এতে কথকের মুন্সীয়ানা পরিলক্ষিত। ঘটনার বয়ানে পরিবার, তার বেড়ে ওঠা এ গ্রন্থে অনবদ্য ভঙ্গি অর্জন করে।

জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত

আত্মস্মৃতি আসলে তার ‘শৈশবের সাদা দেয়াল’। চোখে দেখা দৃশ্য স্মৃতিতে ধারণের সেই সম্ভবত শুরু এবং শুরু তাঁর আত্মস্মৃতি। তাঁর বয়স সময় সান্নিধ্য এসব নিয়ে এ স্মৃতিকথা। নৈর্ব্যক্তিক তাঁর কথন প্রয়াস। মৃত্যুদৃশ্য ব্যাখ্যান হয়েছে এভাবে—‘আকালের বছরেই মার মৃত্যু হয়। কলেরায়। তার দশদিন পরে আমার মেজদিদি চলে যান—একই রোগে। আরো পাঁচদিন পরে উঠোনে নামিয়ে দিতে হয় আমার নবজাত ভাইটিকে। মা মারা যাওয়ার একুশ দিনের মাথায় বেণীমাধব কলেরা মহামারীর শিকার হন।…’ এভাবে স্পর্শকাতর বর্ণনা চলে জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের। একেবারেই নেই কোনো নাটকীয়তা বা অতিরঞ্জন। নিরুত্তাপ অনেক বিষয় লেখকের লেখায় পেয়েছে দুর্বার উত্তাপ।

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের স্মৃতিমূলক গ্রন্থ ‘অতীত জীবনের স্মৃতি’ (১৯৮৭)। এটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। এখানে লেখকের শৈশব-কৈশোর ও প্রারম্ভিক যৌবনের খুঁটিনাটি বিবরণ রয়েছে। হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতিচিত্র, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও কর্মব্যপদেশের বিবৃতিও এতে আছে। দীর্ঘ প্রলম্বিত লয়ের ধারাবাহিক রচনায় কোথাও কোথাও ইতিহাস ও রাজনীতির বিবৃতি, কোথাও নিজের ব্যক্তিজীবনের বিকাশের বর্ণনা আছে। এটি একটি সুপাঠ্য রচনা।

নাজিম মাহমুদ

‘যখন ক্রীতদাস: স্মৃতি ৭১’ (১৯৯০) নাজিম মাহমুদের যুদ্ধ স্মৃতি। একাত্তরের স্মৃতি নিয়ে এমন মর্মন্তুদ আখ্যান আর কেউ রচনা করেছেন বলে জানা নেই। দুঃসহ অভিজ্ঞতাকে চিত্রার্পিত করেছেন নাজিম মাহমুদ। তাঁর লেখায় কোনো অতিরঞ্জন নেই, নেই কোনো কীর্তিকথন, শুধু স্মৃতিতাড়িত কণ্ঠস্বর। এমনটাই নাজিম মাহমুদের স্মৃতি। একাত্তরকে এক লহমায় যেন চকিত করে তোলেন তিনি, অনুপম আখ্যানের ভেতর দিয়ে। শক্তিশালী তাঁর ভাষাবুননি। অন্তর্দৃষ্টিও প্রখর।

নির্মলেন্দু গুণ

‘ভলগারতীরে’ (১৯৮৫), ‘ভিয়েতনাম ও কম্পুচিয়ার স্মৃতি’ (১৯৯৩), ‘গীনসবার্গের সঙ্গে’ (১৯৯৪), ‘আমেরিকার জুয়াখেলার স্মৃতি ও অন্যান্য’ (১৯৯৫), ‘শক্তিস্মৃতি ও অন্যান্য’ (১৯৯৭), ‘পুনশ্চ জাপান যাত্রী’ (২০০৪), ‘ভুবন ভ্রমিয়া শেষে’ (২০০৪), ‘দিল্লী’ (২০০৪) নির্মলেন্দু গুণের ব্যক্তি-অভিজ্ঞতা। কবির গদ্য নির্ধারিত তাঁর লেখায়। খুব শক্তিশালী গদ্যে পরিবেশটি রচিত। জাপান, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়া, দিল্লীর স্মৃতিচারণ বা বলা চলে ভ্রামণিক বীক্ষা অনবদ্য। সংযত এবং পরিচ্ছন্ন ব্যক্তিত্বে অন্তর্বয়ন, চঞ্চল বিহঙ্গজীবন যাত্রার কাহিনি, স্বতন্ত্র সম্বিৎ ভাবলেশে গৃহীত গুণের দৃষ্টিপাত। ‘আমার ছেলেবেলা’ (১৯৮৮), ‘আমার কণ্ঠস্বর’ (১৯৯৫), ‘রক্তঝরা নভেম্বর ১৯৭৫’ (১৯৯৭) নিখাদ স্মৃতিকথা। কষ্ট-বেদনার চিত্র বৃহৎ সমীক্ষায় উঠে আসে। শ্লেষ-আসক্তি, ক্রোধ-কামনা জড়াজড়ি করে থাকে ‘রক্তঝরা নভেম্বর’, আর ছেলেবেলার দিনান্ত পর্যালোচনা নিজস্ব শৈলীতে প্রতিষ্ঠিত। আত্মস্মৃতিতে সমাজ-রাজনীতি গন্ধ তিরোহিত নয়। যুগ, কাল, সময়-স্পর্শী স্বেদহর্ষ কররেখায় ধরা দেয়। আনন্দময় পরিবেশনায় গুণের এসব রচনা বেশ উপভোগ্য।

বাসন্তী গুহঠাকুরতা

‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকথা একাত্তরের স্মৃতি’ (১৯৯১) লিখেছেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার স্ত্রী এ লেখক গ্রন্থটিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ও মর্মন্তুদ বিবরণ দিয়েছেন। একাত্তরের পঁচিশে মার্চ থেকে বাহাত্তরের ৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনাক্রম বিষাদমধুর রূপে বর্ণিত। এটি শিহরিত করা কাহিনি। স্মৃতিচারণায় ব্যক্তিগত কথা হয়ে উঠেছে এদেশের ঐ সময়ের হত্যাযজ্ঞের বাস্তব ও সার্বজনীন চিত্র।

মনিরউদ্দীন ইউসুফ

মনিরউদ্দীন ইউসুফের আত্মজীবনীমূলক রচনা ‘আমার জীবন আমার অভিজ্ঞতা’ (১৯৯২)। এখানে লেখক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি, পারিবারিক প্রতিবেশ, মুক্তিযুদ্ধ অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেছেন। কয়েক দশকের অভিজ্ঞতাকে এ গ্রন্থে এনেছেন লেখক।

মাহবুব-উল আলম

‘মোমেনের জবানবন্দী’, ‘পল্টন জীবনের স্মৃতি’ (১৯৪০), ‘ইন্দোনেশিয়া’ (১৯৫৯), ‘তুর্কী’ (১৯৬০), ‘সিলোন’ (১৯৫৯), ‘সৌদি আরব’ (১৯৬০) মাহবুব-উল আলমের রচনা। ‘মোমেনের জবানবন্দী’ তাঁর উৎকৃষ্টমানের সাহিত্য। ইন্দোনেশিয়া, তুর্কী, সিলোন, সৌদি আরব ভ্রামণিক অভিজ্ঞতায় লেখা রচনা। এতে স্বচ্ছ ও সুন্দরের বার্তা আছে। মাহবুব-উল-আলম বেড়ানোর অভিজ্ঞতাকে নীতিবাগীশ করে তোলেন না। কণ্ঠস্বর আয়ত্তে রেখেই ব্যবধান দূর করে ফেলেন, অমোঘ সত্যটি প্রকাশ করেন, সংস্কারের উর্ধ্বে থেকে চেতনাকে অর্থারোপ করেন। ভ্রমণ একান্তই আর তার থাকে না। হয়ে ওঠে পাঠকের। স্মৃতিকথাতেও তিনি আরও সংযমী, নৈর্ব্যক্তিক। এ পর্যায়ের রচনায় তিনি দৃষ্টান্ত, এমনটি বলা যায়।

মুনতাসীর মামুন

‘বিদেশে বাঙালী’ (১৯৯৩), ‘জাপানের ছোট শহর’ (১৯৯৩), ‘কভেন্ট গার্ডেনে সন্ধ্যা’ (১৯৯৬) মুনতাসীর মামুনের রচনা। অসম্ভব আর অদ্ভূত আমোদ মিশে থাকে তাঁর রচনায়। ভ্রমণ হয়ে ওঠে নিখাদ সাহিত্য। মনের অনুরাগ-আবেগ প্রাঞ্জল করে তোলেন তিনি ভাষায়। প্রচণ্ড সংযম ও সংহত তাঁর লেখা। পরিচর্যায় যত্নবান। তাঁর জাপান শহরের বর্ণনায় উঠে আসে বৃষ্টিদৃশ্য, সঙ্গীতমুখর স্মৃতিময় রাত, দ্বীপমালার সৌন্দর্য আর শিল্প-সংস্কৃতির ব্যঞ্জনাবহ মনোলগ। মুনতাসীর মামুনের উপলব্ধি আর তখন নিজের থাকে না হয়ে ওঠে অনুভবেদ্য সব মানুষের। তাঁর অন্যান্য রচনাসমূহও আকর্ষণীয়।

মুহম্মদ আবদুল হাই

বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের বহির্বিশ্ব, বাঙালির নিকট ভ্রমণকাহিনির আস্বাদে, খুব কমই মিলেছে। ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ (১৯৫৮)-এর মধ্যে আবদুল হাই স্বচ্ছচিন্তনে, গতিশীল উচ্ছাসে; বিলেতের রূপরসগন্ধ, প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক আবহে ছবির মতো ফুটিয়ে তুলেছেন। রচনাটির তাৎপর্যময় দিক; ইউরোপের সমাজ-ধর্মদৃষ্টি ও পার্থিব চেতনাকে সূক্ষদৃষ্টিতে তুলনায় এনেছেন নিজের দেশের সঙ্গে। ‘বিলেতে সাড়ে সাতশ দিন’ আবদুল হাইয়ের অত্যন্ত সংবেদনশীল ও প্রাঞ্জল রচনা। ‘তোষামোদ ও রাজনীতির ভাষা’ (১৯৫৯) আবদুল হাইয়ের পরিশুদ্ধ প্রবন্ধগ্রন্থ না হলেও স্মৃতিকথাকে রসমণ্ডিত করে উপস্থাপনা উপভোগ্য অর্জিত। গল্প-স্মৃতি-প্রবন্ধ মিলে মিশ্রস্বাদের পুস্তক এটি।

মুহম্মদ এনামুল হক

প্রবন্ধকার এনামুল হকের ভ্রমণকাহিনি বুলগেরিয়া ভ্রমণ (১৯৭৮)। শক্তিশালী গদ্যে লেখক বুলগেরিয়াকে পাঠকের সামনে নিয়ে আসেন। পরিচয় মেলে সেখানকার প্রকৃতি-মানুষ ও ইতিকথার আবর্তসমূহ। শিল্পিত করে তোলেন সবকিছুকে। এক্ষেত্রে এনামুল হক মননশীল, দ্বিধাসতর্ক। তবে এটি সাবলীল সুন্দর একটি ভ্রমণ অভিজ্ঞতার চিত্রপট, সন্দেহ নেই।

মুস্তাফা নূরউল ইসলাম

‘নিবেদন ইতি পূর্ব-খণ্ড’ (২০০৫) অনবদ্যগদ্যে মুস্তাফা নূরউল ইসলামের আত্মকথা। অথেনটিক এ রচনাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্বকালের কথা বর্ণিত হয়েছে অনুপম গদ্যে। তার গদ্য বরাবরই ভিন্ন ব্যক্তিত্বপূর্ণ এবং অর্জিত-অভিজ্ঞতাপ্রসূত। যেটি অন্য আজ্ঞা দেয় পাঠককে।

মোহাম্মদ ওয়ালীউল্লাহ

সাংবাদিক, লেখক। ‘লাল কোর্তা’ এবং ‘ওলী গান্ধী’ নামে খ্যাত। ভ্রমণ বৃত্তান্ত বর্ণিত যুগ-বিচিত্রা (১৯৬৭) গ্রন্থে। এ গ্রন্থে তিনি মূলত সমকালীন জীবনকেই তথ্যনিষ্ঠ করে তুলেছেন।

মোহাম্মদ মোদাব্বের

শিশু সাহিত্যিক, সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের। বক্তব্যের ঋজুতায়, ভাষার সাবলীলতায় চমৎকার গ্রন্থ ইতিহাস ‘কথা কয়’ (১৯৮১)। নিজের জীবন ও সমকালীন অভিজ্ঞতার অনবদ্য দলিল। ‘সাংবাদিকের রোজনামচা’ (১৯৭৭) সামাজিক, রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। ‘জাপান ঘুরে এলাম’ (১৯৫৯), ‘প্রবাল দ্বীপে’ (১৯৬৪) ভ্রমণ কাহিনি। বিভাগ-পরবর্তী সময়ের বিকাশউন্মুখ সাহিত্যে মোহাম্মদ মোদাব্বেরের ভ্রমণসাহিত্য নিজস্ব, ভাষা ও সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কল্পনাশক্তির গুণে শুধু নয়, তাঁর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিপরিমণ্ডলও উন্নত রুচিজ্ঞানে উচ্চকিত ছিল। জাপান ভ্রমণকে অর্থারোপ করেছেন লেখক সমাজ-সংস্কৃতি ঐতিহ্যিক আবহে।

রাবেয়া খাতুন

স্মৃতিচারণায় লিখেছেন ‘স্বপ্নের শহর ঢাকা’ (১৯৯৪), ‘একাত্তরের নয় মাস’ (১৯৯৬), ‘জীবন ও সাহিত্য’ (১৯৯৬)। একেবারেই মূর্ত হয়ে উঠেছে নিজের অভিজ্ঞতা। যুদ্ধের স্মৃতি নিজের অভিজ্ঞতায় বলেছেন কিন্তু যুদ্ধাবেগ, তীক্ষ্ম অন্তদৃষ্টি পায়নি বলেই মনে হয়। আরও গহন অনুসন্ধানের সুযোগ রয়ে যায়। তবুও লেখকের স্মৃতির অর্জন ও উপেক্ষা একান্তই ব্যক্তিচেতনাকৃত। গদ্যরীতিতে কথকমেজাজ, বর্ণনাপ্রবাহে গতিময়তা সার্থক রচনা বলা চলে। ‘কুমারী মাটির দেশে’ (১৯৯৪), ‘টেমস থেকে নায়াগ্রা’ (১৯৯৩) ‘আবার আমেরিকায়’ (২০০৬) এসব নামাঙ্কিত গ্রন্থেই ভ্রমণ বৃত্তান্তের পরিবেশ গৃহীত। ‘টেমস থেকে নায়াগ্রা’ তাঁর জনপ্রিয় রচনা। প্রাঞ্জল ভ্রমণভিজ্ঞতা, দৃষ্টি চেতনায় অর্থ অর্জন করে, রসবোধসঞ্চারি পরিবেশটি পাঠককে উস্কে দেয়, সময় ইতিহাস পায় প্রত্নমাত্রা। রাবেয়া খাতুন সাহিত্যের এ শাখাটিতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যময় মনে হয়।

শওকত ওসমান

শওকত ওসমানের আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথা ‘উত্তরপর্ব মুজিবনগর’ (১৯৯৩), ‘কালোরাত্রি খণ্ডচিত্র’ (১৯৮৬), ‘গুডবাই জাস্টিশ মাসুদ’ (১৩৯৮), ‘রাহনামা-১’ (ছেলেবেলা ও কৈশোর কোলাহল) (২০০৭), ‘রাহনামা-২’ (অন্য রণপ্রান্তরে ও ভুবন জত্তরে) (২০০৭), ‘স্বজন স্বগ্রাম’ (১৯৮৬), ‘স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর’ (১৯৯২)। এগুলো প্রত্যেকটিই সাহিত্যগুণে ঋদ্ধ। তবে অতিরিক্ত তা বলা যাবে না। এক ধরনের পুনরাবৃত্তিও আছে। তবে এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। শওকত ওসমান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শুধু বিশ্বাসী নন, কর্মপ্রযুক্তিতে-সার্বক্ষণিক তিনি সে প্রমাণ দিয়েছেন। ‘রাহনামা’ সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও তার বড় কাজ, ‘উত্তরপৰ্ব ও স্মৃতিখণ্ড মুজিবনগর’ও তাঁর অনবদ্য রচনা। আর্থ-সমাজ, ইতিহাসে অনেকটা সাহসিকতার তিনি প্রকাশ করেছেন।

শহীদুল্লাহ কায়সার

‘পেশোয়ার থেকে তাসখন্দ’ (১৯৬৬) শহীদুল্লাহ কায়সারের ভ্রমণকাহিনি। মনোজ্ঞ তাঁর এ যাত্রারথ। অনবদ্য বর্ণনাভঙ্গির গুণে তাঁর লেখা উচ্চ শিল্পমাত্রা অর্জন করে। লেখক অভিজ্ঞতাই মূলত পরিশ্রত। তাঁর রাজবন্দীর ডায়েরি ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’ (১৯৬২)। ঘটনাকে স্বচ্ছ ও অন্তর্ভেদী, নির্বিবাদীরূপে পরিবেশন করার সুযোগও তৈরি করতে হয় লেখককে। সেটি স্বচ্ছন্দে পরিবেশন করার কৌশলটিও থাকা চাই। শহীদুল্লা কায়সার অত্যন্ত সাবলীল করে ভ্রামণিক জগতকে তুলে আনেন, মুষড়ে পড়া আবেগ সহজেই অনুপ্রাণিত করে পাঠককে। তাঁর ‘রাজবন্দীর রোজনামচা’ সাহিত্য হয়ে উঠেছে, একই সঙ্গে তা তথ্যেও সমৃদ্ধ।

শাহরিয়ার কবীর

শাহরিয়ার কবিরের অনেক লেখালেখি, এর মধ্যে স্মৃতিচারণ বা আত্মচারণমূলক রচনার তালিকাও কম নয়। এটিতেও তিনি কাজ করেছেন। ‘বিরুদ্ধ স্রোতের যাত্রী’ (১৯৯০), ‘ক্রান্তিকালের মানুষ’ (১৯৯০), ‘অন্তরঙ্গ হুমায়ুন আহমেদ’ (১৯৯২), ‘সাধু গ্রেগরির দিনগুলি’ (১৯৯৪), ‘হাত বাড়ালেই বন্ধু’ (১৯৯৫), ‘জাহানারা ইমামের শেষ দিনগুলি’ (১৯৯৫) তাঁর রচনা। তবে এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহানারা ইমামের সঙ্গে শেষ দিনগুলোর স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থটি। কর্মীসঙ্গি হিসেবে সে আবেগটি নিশ্চয়ই অযথা নয় কিন্তু মূল্যবান অভিজ্ঞতা যা পথচলার সহায়ক শক্তিরূপে পরিগণিত তা ছেঁকে তুলে এনেছেন। এছাড়া অন্যগ্রন্থেও তিনি পরিচ্ছন্ন। কথকতার আমেজে, পরিবেশনার তাৎপর্যটিও প্রশংসনীয়।

সত্যেন সেন

সত্যেন সেনের বিরাট অভিজ্ঞতায় রচিত স্মৃতিচারণমূলক রচনা ‘মনোরমা মাসীমা’ (১৯৭১), ‘বিপ্লবী রহমান মাস্টার’, ‘সীমান্ত সূর্য আবদুল গাফফার খান’ (১৩৮৩ ব.)। পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্বে স্পর্শ করেছেন অন্য ব্যক্তিত্বকে। এখানে তিনি উদ্ভাসিত। এসব রচনায় আনুগত্য আছে, আছে আবেগের প্রাবল্য কিন্তু সত্যেন সেন এসব এড়িয়ে নিরপেক্ষ দৃষ্টিচেতনায় সামাজিক ব্যক্তিত্বরূপে এইসব চরিত্রসমূহকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। ‘সীমান্ত গান্ধী’ খ্যাত খান আবদুল গাফফার খানকে পরিশীলিত ও দার্শনিক বুদ্ধি-বীক্ষণে আলোচনা করেছেন। ব্যক্তি অভিজ্ঞতার প্রাঞ্জল স্বাক্ষর মাসীমা ও বিপ্লবী মাস্টার। প্রভাবিত আদর্শের পরিমার্জিত চিত্রটি এঁকেছেন সত্যেন সেন।

সা’দত আলি আখন্দ

প্রাবন্ধিক সা’দত আলি আখন্দের ‘তরুণ মুসলিম’ (১৩৩৬), ‘তেরো নম্বরে পাঁচ বছর’ (১৯৬৭) স্মৃতিচারণমূলক রচনা হিসেবে অনবদ্য। ‘অন্য দিন অন্য জীবন’ (১৯৬৯) আকর্ষণীয়, ‘যখন দারোগা ছিলাম’ পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা।

সুফিয়া কামাল

‘একালে আমাদের কাল’ (১৯৮৮) সুফিয়া কামালের আত্মস্মৃতিমূলক গ্রন্থ। সময়ের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে লেখকের হাতে। উঠে এসেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতীভূ ব্যক্তি।

সৈয়দ মুর্তাজা আলী

‘আমার কালের কথা’ (১৯৭৫) জীবনের অভিজ্ঞতা, অতীত স্মৃতির বুননি। তাঁর গুরুত্বপূর্ণ রচনা। উচ্চমনস্কতায় ও আধুনিক প্রতিশ্রুতিতে তাঁর এ স্মৃতিচারণ আসলে নিজের ব্যাখ্যায়ন নয় কিংবা তা হলেও তার সমাজের সামগ্রিক অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন। কারণ, পূর্ণাঙ্গ সমাজ-সংস্কৃতি-দেশকাল চেতনা উঠে এসেছে নিরপেক্ষরূপে। তার এ অনুষঙ্গি ভাষাও বেশ তাৎপর্যবহ।

সৈয়দ মুজতবা আলী

‘দেশে বিদেশে’ (১৯৪৮) ভ্রমণকাহিনী রচনা করে সাহিত্যে তাঁর অক্ষয় আসন প্রতিষ্ঠা করেছেন। দুধিগম্য রহস্যাবৃত আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের অপূর্ব শিল্পরূপ ‘দেশে বিদেশে’। ভাষা মনোরম, অভিনব বাচনভঙ্গি ও তীক্ষ রসবোধ সৃষ্টির পারঙ্গমতা এর রচনাশৈলীর গুণ। বহু বিচিত্র মানবচরিত্র, দেশ অভিজ্ঞান সুগভীর প্রজ্ঞায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে মুজতবা আলীর লেখায়। এক্ষেত্রে তাঁর মজলিসি মেজাজ, রঙ্গকে ব্যঙ্গে পরিণত করা কিংবা সরসতায় বুদ্ধিকে আঘাত করে করুণার পরিবেশ সৃষ্টি, মহৎ গুণ। ভ্রমণকাহিনীতে আদর্শ ও বাস্তবের বিশ্বস্ত চরিত্র যেমন থাকে তেমনি মনোলোকের অবাস্তব বায়বীয় চরিত্রও থাকে। এসব চরিত্রকে ব্যাপকতায়, গভীরতায়, সজীবতায়, মনীষায় ছবিময় করে তোলেন সৈয়দ মুজতবা আলী। ইউরোপ ভ্রমণের মনোমুগ্ধকর বিবরণ নিয়ে ‘পঞ্চতন্ত্র’ (১৯৫২), ছোটদের উপযোগী ভ্রমণকাহিনী ‘জলে-ডাঙায়’ (১৯৫৭), ‘ভবঘুরে ও অন্যান্য’ (১৯৬২), ‘মুসাফির’ (১৯৭১)।

সৈয়দ শামসুল হক

‘প্রণীত জীবন’ (২০০৮) তাঁর পরিকল্পিত জীবনচরিতের প্রথম পর্ব। এতে চরিত্ররূপে আছেন তার বাবা অতঃপর শৈশব কৈশোর পরিবেশ, ইসলামিক ঐতিহ্য, পেশা-অভিজ্ঞতা—এসবে প্রণীত জীবন সংবাদ। স্মৃতিময় সে আলিঙ্গন। স্পর্শ অন্তরঙ্গ, লেখক বলেন—‘‘আত্মজীবনীকে আমি প্রণীত জীবন বলেই জানি এবং এই প্রণয়নের ভেতরেই ব্যক্তির মূল শাসটিকে পাই।’’ এভাবে স্মৃতি ও শ্রুতিতে হাজির হন তিনি পাঠকের সম্মুখে।

সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন

বিপুল, বিপুল পৃথিবী, দূরের সুর ভ্রমণ পরিবৃত্তে সৈয়দ শাহাদৎ হোসেন পৃথিবীর মাতাল আলিঙ্গনে অন্তরঙ্গ হয়ে ওঠেন রচনায়। আনন্দময় আহ্বানকে যেন পৌঁছে দেন পাঠক সমীপে।

হারুন হাবীব

‘সূর্যোদয় দেখে এলাম’ হারুন হাবীবের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত। তাঁর গদ্য অনুপম। ভ্রমণের রসবোধের আতিথ্য তাঁর রচনায় মেলে। অভিজ্ঞতাকে দান করেন সংজ্ঞার্থ। এটি নিছক আত্মকথা নয়, ভ্রমণের আনন্দে সকলকে উৎসারিত করা এবং তা পাঠের ভেতর দিয়ে। এটি সম্ভব করে তুলেছেন লেখক।

হাসনাত আবদুল হাই

‘ট্রাভেলগ’ (১৯৯২), ‘ট্রাভেলগ/২’ (১৯৯৩), ‘সাফারি’ (১৯৯৪), হাসনাত আবদুল হাইয়ের ভ্রমণকাহিনি। অনুপম তাঁর বর্ণনাভঙ্গি। লেখকের উপলব্ধি ‘আন্দালুসিয়া’ সম্পর্কে—‘‘এ কেবল রাজ কাহিনী, পাথর-মার্বেল তৈরি ভবনের ইতিহাস অথবা ছোট বড় জনপদের চিত্রাবলী নয়। অনেক কিছু দেখা আর জানার পরও আন্দালুসিয়ার যা অবশিষ্ট থাকে সেটা কল্পনার জগৎ।’’ এরূপ আলেখ্যে-নির্ভর তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা।

হাসান আজিজুল হক

তাঁর স্মৃতিকথা ‘এইসব আখরগুলো’, ‘দুয়ার হতে দূরে’, ‘টান’ (২০১৩)। ‘টানে’ চারটি পরিচ্ছেদ। ‘টান’, ‘দূরবাসী’, ‘আবার যদি ইচ্ছে করো’, ‘ভোরবেলাকার চোখে’—নিজ গ্রামের ফেলে আসা শৈশব-কৈশোরের ঘটনাংশ নিয়ে বিবৃত টান। ‘বাতাসহীন সময়টায় দম যেন বন্ধ, কুলকুল করে ঘেমে উঠছে শরীর, এক্ষনি কি হবে কি হবে করে এই আশায় দারুণ ভালো লাগছে আমার। থমকে-যাওয়া সময়টায় শুকনো ধুলো নাকে এসে ঢুকছে। চোখে ধুলোর আঁধার। ঘুনধুন করে কালো নিকষ ভোমরাটা ঘরে এসে ঢুকলো’—এভাবে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে তাঁর কথকতা। ‘উঁকি দিয়ে দিগন্ত’ (২০১২), ‘নিমমধু’, ‘ফিরে যাই ফিরে আসি’ (২০১২), ‘আমার যেদিন গেছে ভেসে’ (২০১৭) নির্মল আনন্দের রচনা। মেলানো চলে পরিবেশ, লাগামহীন স্মৃতিভাষ্য কিন্তু অমর আখ্যান। তা আকর্ষণীয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!