//
//

বাংলা গদ্যের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলা গদ্যের উদ্ভব

আধুনিক যুগের অন্যতম সাহিত্যিক বাহন হল গদ্য। এই গদ্যের আবির্ভাব আধুনিক যুগ ছাড়া সম্ভব ছিল না। অবশ্য আধুনিক যুগের আগে গদ্য যে ছিল না তা নয়, কিন্তু তার প্রমাণ ছিল বিচ্ছিন্নভাবে— দু-একটি চিঠিপত্রে, দলিল-দস্তাবেজে। আধুনিক বাংলা গদ্য ইওরোপীয় সংসর্গের ফল। আধুনিক জীবনের যুক্তিবোধ, ব্যবহারিক জীবনের বাস্তবতাবোধ প্রকাশের মাধ্যম হিসাবে গদ্যের ব্যবহার একান্তভাবেই প্রয়োজন ছিল। আধুনিক কাল ও তার বিচিত্র জটিল জীবনযাত্রা বাংলা গদ্যের উদ্ভবকে ত্বরান্বিত করেছিল।

দ্বিতীয়ত, প্রাচীন ও মধ্যযুগে মানুষের মুখের ভাষা ছিল গদ্য কিন্তু লিখত পদ্যে। এর কারণ বাঙালি তখন পদ্যে সাহিত্যচর্চা করতে শুধু স্বচ্ছন্দবোধ করত না, তাঁদের ধারণা ছিল লেখার ভাষা গদ্য হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। গদ্যের ছন্দ যে আছে, তা তারা অনুভব করতে না পেরে ছন্দময় পদ্যকেই সাহিত্যের বাহন করে কিন্তু আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা ও বাস্তবতাকে রূপ দিতে গেলে গদ্য ছাড়া উপায় কি?

তৃতীয়ত, পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে রচিত কাব্য সাহিত্য মধ্যযুগে মানুষকে যতটা তৃপ্তি ও আনন্দ দিয়েছিল, ছন্দের মাধুর্য ও লালিত্য মানুষকে যেভাবে আকর্ষণ করত, সেই আকর্ষণের কারণে চিরাচরিত ঐতিহ্য ভেঙে গদ্যের পথ প্রস্তুত হতে দেরি হয়েছিল।

চতুর্থত, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কারও আধুনিক যুগে গদ্যের উদ্ভবের অন্যতম কারণ। মধ্যযুগে মানুষ পুঁথি-আশ্রয়ী পদ্য শুনে মনে রাখত। কিন্তু ছাপাখানার যুগে সেই কষ্টসাধ্য ব্যাপারটি আরো সহজ হওয়ার পথ পেল। অর্থাৎ পুঁথির জায়গায় ছাপ প্রসার গদ্য রচনার পথকে সুগম করেছে।

পঞ্চমত, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের নানা ধরনের আন্দোলন ও সংস্কার প্রক্রিয়া এবং মিশনারীদের খ্রিস্টান ধর্মপ্রচার গদ্যের উদ্ভব ও বিকাশের পথকে ত্বরান্বিত করে। সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন—“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দখল দৃঢ় হইবার সঙ্গে সঙ্গে (১৭৬৫) রাজ্যশাসন ও রাজস্ব আদায়ের কাজে দেশি ভাষা শিখিবার ও ভাষায় আইন-কানুন লিখিবার প্রয়োজন অপরিহার্য হইল। আগেই বাঙ্গলা ছাপিবার অক্ষর তৈয়ারি হইয়াছিল। এ কাজের কৃতিত্ব কোম্পানির কর্মচারী সংস্কৃতজ্ঞ চার্লস (পরে সার চালস) উলকিন্‌সের। হ্যালহেডের (বা হ্যালেডের; N.B. Halhed বাঙ্গালা ব্যাকরণ উদাহরণ ও উদ্ধৃতিতে বাঙ্গালা ছাপার অক্ষরের প্রথম ব্যবহার দেখা গেল (১৭৭৮)। অতঃপর অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দুই দশকের মধ্যে তিন চারখানি আইনের বই বাঙ্গালা গদ্যে অনুদিত ও বাঙ্গালা হরফে ছাপা হইয়া গেল।” (বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, দ্বিতীয় খণ্ড, ১৩৮৬)

ষষ্ঠত, গদ্যের উদ্ভব সম্বন্ধে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন—“এই গদ্যের উদ্ভব হইয়াছে ঠিক অন্তরের প্রেরণায় নহে, বাইরের প্রভাবে। বাঙালীর মন ঠিক গদ্যানুকূল হইলেও বাহিরের প্রয়োজন সাধনের জন্য উহাকে গদ্যচর্চায় ব্রতী হইতে হইয়াছে। যেমন জলমগ্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে কৃত্রিম বায়ু সঞ্চালনের ফলে স্বাভাবিক শ্বাসক্রিয়া। প্রবর্তিত হয়, তেমনি কাব্যরস-নিমজ্জিত বাঙালী লেখকের ক্ষেত্রেও গদ্য রচনারূপ আরোপিত কর্তব্যের চাপ ক্রমশ স্বভাবকুশলতা ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণায় পরিণত হইয়াছে।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, ১৯৬৩)

সজনীকান্ত দাস আঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, প্রথম খণ্ডে বাংলা গদ্যের উদ্ভবের পটভূমিকা বিশ্লেষণ করে লিখেছেন—“সমুদ্রপারের সওদাগর ও পাদরিদের আগমনে কবিতাপ্রবণ বাংলাদেশে যে আলোড়ন উপস্থিত হয়, তাহার ফলেই সত্যকার বাংলা গদ্য সাহিত্যের উদ্ভব ও বিকাশ এবং বাঙালির আত্মচেতনায় উদ্বুদ্ধ হইয়া তাহার পরিণতি। বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইহাই সংক্ষিপ্ততম ইতিহাস।”

বাংলা গদ্যের উদ্ভব পর্ব

খ্রিস্টান মিশনারীদের আগমনের পূর্বে গদ্যের ব্যবহার বিচ্ছিন্নভাবে যেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত ছিল সেগুলি হল—

(ক) চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজের গদ্য: ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যভাগে (১৫৫৫) কুচবিহারের রাজা নরনারায়ণ অহোমরাজ চুকামফা স্বৰ্গদেবের কাছে একটি চিঠি লেখেন। নরনারায়ণের লিখিত এই প্রাথমিক বাঙলা গদ্যের নমুনা—“লেখনং কাঞ্চ। এথা আমার কুশল। তোমার কুশল নিরন্তর বাঞ্ছা করি। তখন তোমার আমার সন্তোষ। সম্পাদক পত্রপত্রিগতায়াত হইলে উভয়ানুকুল প্রীতির বীজ অঙ্কুরিত হইতে রয়ে। তোমার আমার কর্তব্যে বাৰ্ধতাক পাই পুষ্পিত ফলিত হইবেক। আমরা সেই উদ্যোগত আছি।”

এরপর ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দের গৌড়ীয় মোহান্তদের কাছে লিখিত ইস্তফা পত্র ও জয়পুরের প্রেরিত সভাপণ্ডিত কৃষ্ণদেব ভট্টাচার্যের ‘অজয়পত্র’ পত্র হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ। কিম্বা ১৭৫৫ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর দেশীয় ভাষায় শহরের বাজারে পণ্য সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি সংক্রান্ত পত্রও উল্লেখযোগ্য। এমনকি সপ্তদশ-অষ্টাদশ শতাব্দীতে আত্মবিক্রয় ও দাসদাসী ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত কয়েকটি পত্রেও গদ্যের নমুনা রয়েছে।

(খ) নিবন্ধ ও কড়চা প্রভৃতিতে ব্যবহৃত গদ্য: ষড় গোস্বামীর অন্যতম শ্রীরূপ গোস্বামী তাঁর ‘কারিকা’য় গদ্যের ব্যবহার করেছেন। তাঁর ভাষার নমুনা হল—“প্রথম শ্রীকৃষ্ণগুণ নির্ণয়। শব্দগুণ, রূপগুণ, রসগুণ ও স্পর্শগুণ এই পাঁচগুণ। এই পঞ্চগুণ শ্ৰীমতী রাধিকাতেও বসে।”

সপ্তদশ শতকের বিখ্যাত গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্য নরোত্তমের নামেও গদ্যে রচিত একটি কড়চা (‘দেহকড়চা’) পাওয়া যায়। নমুনা—“তমি কে! আমি জীব। তুমি কোন্ জীব। আমি তটস্থ জীব। থাকেন কোথায়। ভাণ্ডে। ভাণ্ড কিরূপ হইল। তত্ত্ববস্তু হৈতে।”

(গ) গল্পের গদ্য: ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত ‘মহারাজ বিক্রমাদিত্য চরিত্র’ গল্পে গদ্যের নমুনা পাওয়া যায়—যা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ব্রিটিশ মিউজিয়াম থেকে সংগ্রহ করে আনেন। নমুনা—“মোং ভোজপুর শ্রীযুক্ত ভোজরাজা তাহার কন্যা শ্রীমতি মৌনাবতি ষোড়ষ বরিস্যা বড় সুন্দরী মুখ চন্দ্র তুল্য কেষ মেঘের রঙ্গ চক্ষু আকন্ন পর্যান্তা যুঙ্গা ভুর ধনুকের নেয়ায় ওষ্ঠ রক্তিমে বর্ন হস্ত পদ্মের মৃণাল…..।”

(ঘ) পর্তুগীজদের গদ্য চর্চা ও পর্তুগীজ পাদ্রি ও তার শিষ্যরা সচেতনভাবে বাংলা গদ্য রচনার কাজে ব্রতী হয়েছিলেন। মুদ্রাযন্ত্রের সাহায্য নিয়ে ও রোমান হরফে বাংলা গ্রন্থ মুদ্রণের ভার গ্রহণ করে বাংলা গদ্য রচনার ক্ষেত্রে পাদ্রিরা বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে দুজনের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য—

(এক) দোম আন্তোনিওর ব্রাহ্মণ-রোমান ক্যাথলিক সংবাদ। এই গ্রন্থের রচনাকাল সপ্তদশ শতাব্দীর শেষপাদ। ভাষার মধ্যে বাংলার উপভাষার চিহ্ন যথেষ্ট। নমুনা—“আর রামের দুই পুত্র লব আর কুশ সঙ্গে রামের বিস্তর যুদ্ধ করিলেন পুত্র না চিনিয়া। শেষ মুনিসিয়া পরাজয় করিয়া দিল।”

(দুই) ঢাকার ভাওয়াল পরগণার পর্তুগীজ পাদ্রি মনোএল-দ্য-আসসুম্প সাম্-এর রচিত ‘কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ’ ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে রোমান অক্ষরে লিসবন শহর থেকে মুদ্রিত হয়। পরে ১৩৪৬ বঙ্গাব্দে রঞ্জন প্রকাশালয় থেকে বাংলা অক্ষরে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থটি প্রশ্নোত্তর ছলে খ্রিস্ট ধর্মের ব্যাখ্যা। ভাষার নমুনা—“সেভিল্যা। শুহরে এক গৃহস্থ আছিল, তাহার নাম সিরিলো, সেই সিরিলো কেবল এক পুত্রো জন্মাইল; তাহারে এতো দয়া করিল যে কোনো দিন তাহারে শিক্ষা ও না দিল এবং শাস্তিও না দিল; সেই যাহা করিতে চাহিত, তাহা করিত।”

এছাড়া মনোএল বাংলা পর্তুগীজ ব্যাকরণ রচনা করেছিলেন ১৭৩৪ খ্রিস্টাব্দে। গ্রন্থটির প্রথম অংশ ব্যাকরণ এবং পরের অংশ পর্তুগীজ বাংলা ও বাংলা-পর্তুগীজ শব্দকোষ। ব্যাকরণ অংশ পতুর্গীজ ভাষায় রচিত। মনোএল বাংলা গদ্যে বিশেষ কোন প্রভাব মুদ্রিত করতে না পারলেও কেরি ও মার্শম্যানদের পথপ্রদর্শক হিসাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

(ঙ) ইংরেজদের প্রাথমিক গদ্যচর্চা ও মুদ্রাযন্ত্রের আবিষ্কারের পর ইংরেজরা তাকে বিস্তৃতি দান করে বাংলা গদ্য রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীরা শাসন কার্য পরিচালনার জন্য গদ্যের অনুশীলন করেছিলেন। বাংলা ভাষায় দক্ষ হালহেড ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে “The Grammar of the Bengali Language”, রচনা ও মুদ্রিত করেন। তিনি খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জন্য এই গ্রন্থ রচনা কহে, সজনীকান্ত দাস তাঁর ‘বাঙলা গদ্যের প্রথম যুগ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন—“১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দকেই আমরা বাঙলা গদ্যের ঐতিহাসিক যুগের আরম্ভ বৎসর বলিব।” অন্যদিকে গোপাল হালদার তাঁর ‘বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা’ (দ্বিতীয় খণ্ড) গ্রন্থে এই মতকে খণ্ডন করে লিখেছে—“১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হালহেডের গ্রামারে বাঙলা গদ্য রচনার আরম্ভ হয়নি; তবে বাঙলা মুদ্রণে গদ্যের সেই দীর্ঘ ‘অন্ধকার যুগ’ শেষ হল, তাতে সন্দেহ নেই।” হালহেডের বাংলা ব্যাকরণের পরে ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে জোনাথান ডানকানের (Jonathan Duncan, 1756-1811) দেওয়ানী কার্যবিধি মুদ্রিত হয়।

১৭৯১ খ্রিস্টাব্দে এডমনস্টোন্ (N.B. Edmunstone, 1765-1841) ফৌজদারী কার্যবিধির অনুবাদ প্রকাশিত হয়, যার ভাষা ফারসি ঘেঁষা।

তারপর ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় হেনরি ফরস্টার-এর ‘কর্নওয়ালীসী কোড়’-এর অনুবাদ।

এঁরা প্রয়োজনের খাতিরে বাংলা অনুবাদে ব্রতী হলেও বাংলা ভাষা তাদের মুগ্ধ করেছিল। অনুবাদের ক্ষেত্রে আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ বেশি ব্যবহার করেছেন।

অন্যদিকে গেরাসিম (হেরাসিম) লেবেডেফ ১৭৯৫ ও ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দে দুটি ইংরেজি প্রহসন-এর (‘The Disguise’ ও ‘Love is the Best Doctor’) বাংলা অনুবাদ করেন। এ দুটি প্রহসন মুদ্রিত হলে বাংলা চলিত গদ্যের একটা রূপ পাওয়া যেতে পারত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!