বাংলা ছন্দ এবং তার উপাদানগুলি সম্পর্কে আলোচনা কর।
ছন্দ ও ছন্দের উপাদান
ছন্দ (Metre)
ছন্দ হল এক বিশেষ কাব্য-রীতি, ধ্বনি-শিল্প, বাণী শিল্প, যা সুমিত শব্দ বিন্যাস তথা ধ্বনি বিন্যাসের মাধ্যমে আমাদের শ্রবণ ও মননে আনন্দময় ধ্বনি-স্পন্দন সৃষ্টি করে এবং চিত্তে রস জাগায়।
বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড ছন্দময়। প্রভাতে সূর্যোদয় থেকে শুরু করে প্রকৃতির সমস্ত কিছুর মধ্যেই এক অদৃশ্য-ছন্দময় গতি কেবলি অব্যাহত প্রবাহে ধেয়ে চলেছে। ভোরের আলোয় যে পাখি ডাকে, যে ফুল চোখ মেলে, সে নদী কল্লোলে বয়ে যায়, সেই সব কিছুর মধ্যেই ছন্দের স্বাভাবিক প্রকাশ! মানুষও তার জীবনের সব কিছুকে ছন্দে গ্রথিত করে ‘সুন্দর’ হতে চেয়েছে। এইভাবেই সে রচনা করেছে ভাষা-শিল্প, বাণী-শিল্প এবং বিশিষ্ট বাক্য-রচনা-রীতি।
ছন্দের স্বরূপ ও ভূমিকা
(১) ছন্দ হল শ্রুতিমধুর শব্দ ও ধ্বনি।
(২) ছন্দ হল শব্দের ও ধ্বনির সুষম বিন্যাস।
(৩) ছন্দে থাকে দোলা, যা কানের ভিতর দিয়ে মনে প্রবেশ করে।
(৪) ছন্দবদ্ধ চরণ একটি নির্দিষ্ট বেগ এবং বিরতি সহ শ্রুতি-সুন্দর হয়ে ওঠে।
(৫) ছন ভাবকে প্রাঞ্জল, প্রাণময় ও পূর্ণতা দান করে।
ছন্দের উপাদান
ছন্দের বিবিধ উপাদান হল—
(ক) ধ্বনি, (খ) দল বা অক্ষর, (গ) মাত্রা বা কলা, (ঘ) পর্ব, (ঙ) পর্বাঙ্গ, (চ) ছেদ ও যতি (ছ) পদ, চরণ, পংক্তি, (ঝ) স্তবক, (ঞ) লয়।
(ক) ধ্বনি
ভাষায় ব্যবহৃত মানুষের কণ্ঠনিঃসৃত স্বরকে ধ্বনি বলে। এই ধ্বনি শ্রুতিগ্রাহ্য। ধ্বনির প্রতীক হল বর্ণ। বর্ণের শ্রুতিগ্রাহ্য রূপই হল ধ্বনি। ধ্বনির দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপ নেই। বর্ণের আছে। মানুষের কণ্ঠজাত স্বরই সাধারণ ধ্বনি বলে কথিত।
ধ্বনি দু-রকমের হয়— (১) স্বরধ্বনি, (২) ব্যঞ্জনধ্বনি
স্বরধ্বনি
যে ধ্বনি উচ্চারণ কালে নিঃশ্বাস বায়ু মুখ বিবরের কোথাও কোনরূপ বাধা প্রাপ্ত না হয়ে স্বাভাবিক ভাবে উচ্চারিত হয় তাকে স্বরধ্বনি বলে।
বাংলায় স্বরধ্বনি— ১২টি। অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, ঋ, ৯, এ, ঐ, ও, ঔ। স্বরধ্বনির দুটি ধরণ— (ক) মৌলিক (খ) যৌগিক।
(ক) মৌলিক স্বরধ্বনি
যে স্বরধ্বনি, একক ও অবিভাজ্য তাকে মৌলিক স্বরধ্বনি বলে। যেমন— অ, আ, ই, ঈ, উ, ঊ, এ, অ্যা, ও।
(খ) যৌগিক স্বরধ্বনি
একাধিক স্বরধ্বনির সমবায়ে যৌগিক স্বরধ্বনি গঠিত হয়। যেমন— ঐ (অ+ই) এবং ঔ (ও+উ)। ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এরকম ২৪টি যৌগিক স্বরের কথা বলেছেন। যেমন— ইএ, ইয়া, ওয়া, আয়, আই ইত্যাদি। এ ছাড়াও নানা ভাবে ও ভঙ্গীতে স্বরধ্বনি উচ্চারিত হয়। যেমন—(১) হ্রস্ব স্বর, (২) দীর্ঘস্বর, (৩) প্লতস্বর।
(১) হ্রস্বস্বর— সহজে সবচেয়ে কম সময়ে এই স্বরগুলি উচ্চারণ করা যায় বলে এগুলি হ্রস্বস্বর। যেমন— অ, ই, উ।
২) দীর্ঘস্বর— দীর্ঘস্বরের উচ্চারণে বেশী সময় লাগে। যেমন— আ, ঈ, ঊ।
(৩) পুতস্বর— এই স্বরের উচ্চারণে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অনেক বেশি সময় লাগে। দূরের ব্যক্তিকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে, এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রে টেনে উচ্চারণের কারণে সাধারণ স্বর প্রলম্বিত হয়ে উচ্চারিত হয়। যেমন—“সতী দে, সতী দে, সতী দে”। -“দে’-র উচ্চারণ প্রলম্বিত হয়—দে-এ-এ-এ।
ব্যঞ্জনধ্বনি
কণ্ঠ নিঃসৃত যে ধ্বনি জিহ্বার দ্বারা বাধা গ্রস্ত হয়ে উচ্চারিত হয় তাকে ব্যঞ্জনধ্বনি বলে। ব্যঞ্জনধ্বনি দু প্রকার—(ক) মৌলিক (খ) যৌগিক।
(ক) মৌলিক ব্যঞ্জন ধ্বনি
শুধুমাত্র স্বরধ্বনির সাহায্যে উচ্চারিত ব্যঞ্জন ধ্বনিকে মৌলিক ব্যঞ্জনধ্বনি বলা হয়। যেমন— ক, খ, গ, ঘ ইতাদি।
(খ) যৌগিক ব্যঞ্জনধ্বনি
যে ব্যঞ্জনধ্বনি স্বরধ্বনি সহ অন্য ব্যঞ্জনধ্বনির সহযোগে উচ্চারিত হয়, তাকে যৌগিক ব্যঞ্জন বলে। যেমন— জ্ঞ=জ+ঞ+অ। ক্ষ=ক্+ষ+অ। ক্র=++অ। ক্ত=ক্+ত+অ।
দল বা অক্ষর
বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে বা এক ঝোকে শব্দের যে স্বতন অংশটক বা ধ্বনিটুকু উচ্চারিত হয় সেই অংশ বা ধ্বনির নাম দল বা অক্ষর বা Syllable.
প্রবোধচন্দ্র সেন এই ধ্বনি খণ্ডকে ‘দল’ বলেছেন। কিন্তু অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় একে ‘অক্ষর’ নাম দিয়েছেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ও ‘অক্ষর’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন, তার ‘ভাষা প্রকাশ বাংলা ব্যাকরণে’। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত syllable-এর প্রতিশব্দ রূপে ‘শব্দ পাপড়ি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ডঃ সুকুমার সেন syllable-কে অক্ষর বলেই চিহ্নিত করেছেন। আমাদের আলোচনায় syllable-কে আমরা দল/অক্ষর বলেই অভিহিত করব।
ধ্বনির রূপ দেখার বা লেখার নয়, তা শোনার। ধ্বনিকে বর্ণ রূপের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ধ্বনিকে চারিত্র্য বিচারে প্রধান দুটি ভাগ করা হয়েছে। একটি স্বরধ্বনি, আরেকটি ব্যঞ্জনধ্বনি। স্বরধ্বনির স্বাধীন উচ্চারণ থাকলেও ব্যঞ্জনের তা নেই। তাই স্বরধ্বনির সাহায্য ব্যতিরেকে ব্যঞ্জনের উচ্চারণ সম্ভব নয়। আমরা পূর্বে যে হ্রস্বতম ধ্বনির কথা উল্লেখ করেছি তা দুপ্রকার—(ক) অ-ব্যঞ্জন স্বরধ্বনি (খ) স-ব্যঞ্জন স্বরধ্বনি।
একটি দল বা অক্ষরের মধ্যে একাধিক স্বরধ্বনি থাকতে পারে না। তাই বাগযন্ত্রের স্বল্পতম প্রয়াসে যে অংশটি উচ্চারিত হয় তার মধ্যে একাধিক ব্যঞ্জন ধ্বনি থাকলেও স্বর থাকে একটি।
দলের শ্রেণিবিভাগ
দল বা অক্ষর দু প্রকার হয়— ক. স্বরান্ত বা মুক্তদল (Open Syllable)। খ. ব্যঞ্জনান্ত বা হলন্ত বা রুদ্ধদল (Closed syllable) আবার স্বরান্ত বা মুক্তদল দুপ্রকার হতে পারে। ক. মৌলিক মুক্তদল খ. যৌগিক স্বরান্ত বা মুক্তদল। মৌলিক স্বরান্ত বা মুক্তদল দুপ্রকার—ক. মৌলিক হ্রস্বমুক্তদল খ. মৌলিক দীর্ঘমুক্তদল।
স্বরান্ত বা মুক্তদল
যে অক্ষরে শুধু স্বরধ্বনি থাকে বা যে অক্ষর বা দলের শেষে স্বরধ্বনি থাকে তাকে স্বরান্ত অক্ষর বা মুক্তদল বলে। মুক্তদল নাম হওয়ার কারণ, শেষে স্বরবর্ণ থাকায় তার উচ্চারণ প্রলম্বিত বা প্রসারিত করা সম্ভব।
ব্যঞ্জনান্ত বা হলন্ত বা রুদ্ধদল
যে অক্ষরের শেষে ব্যঞ্জনধ্বনি থাকে তাকেই ব্যঞ্জনান্ত অক্ষর বা হলন্ত অক্ষর বা রুদ্ধদল বলে। রুদ্ধ নাম হওয়ার কারণ দলটির উচ্চারণ প্রসারিত করা সম্ভব হয় না।
শব্দ ধ্বনির উচ্চারণ অনুযায়ী বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়
উদাহরণ—
ক) ‘এ নহে কুঞ্জ’—এখানে ‘এ’ ব্যঞ্জনধ্বনিহীন স্বরধ্বনি এবং একটি মুক্তদল।
খ) ভারত = (ভ্+আ) + (র্+ত্+অ) (মুক্তদল—‘ভ্+আ’, রুদ্ধদল—‘রত্’)
অক্ষর বা দলের বৈশিষ্ট্য
ক) অক্ষর/দল হল শব্দের সবচেয়ে ক্ষুদ্র ধ্বনি।
খ) অক্ষর বা দলই শব্দের মুখ্য উপাদান।
গ) দল/অক্ষর অনুযায়ী মাত্রা ও ছন্দ নিরুপিত হয়।
ঘ) দলের উচ্চারণ ভেদে মাত্রার ভিন্নতা ঘটতে পারে।
ঙ) ছন্দের প্রকৃতি অনুযায়ী দল/অক্ষরের মাত্রা নিরূপিত হয়।
চ) অক্ষর/দলের উচ্চারণ প্রবণতা থেকে ‘লয়’ নির্ধারিত হয়।
কলা বা মাত্রা (Mora)
একটি দল বা অক্ষর উচ্চারণে যে সময়ের প্রয়োজন হয় তাকে মাত্রা বা কলা বলা হয়। অর্থাৎ ছন্দে কাল পরিমাণ বোধক একককে (Unit) মাত্রা বলা হয়। সংস্কৃতেও কাল দৈর্ঘ্যকে মাত্রা বা কলা বলা হয়েছে। একবার শ্বাস ফেলার সময়কে একমাত্রা— বা এক কলা বলে ধরা হয়েছে। অন্যভাবে বলা যায়, অপ্রসারিত একটি হ্রস্বদলের উচ্চারণের সময়ের একক হল মাত্রা।
কলা/মাত্রার বৈশিষ্ট্য
ক) মাত্রা সংখ্যার দ্বারা ছন্দের প্রকৃতি নির্ণীত হয়।
খ) উচ্চারিত ধ্বনির ক্ষুদ্রতম অংশের নাম কলা, এবং সমপরিমাণ ধ্বনির উচ্চারণের সময়ের একক হল মাত্রা।
গ) একটি হ্রস্বস্বর বা অপ্রসারিত মুক্ত দলের উচ্চারণ করার সময়টুকুকে একমাত্রা ধরা হয়। অন্যদিকে রুদ্ধদল বা প্রসারিত মুক্তদলের উচ্চারণের সময়টুকুকে দু-মাত্রা ধরা হয়।
ঘ) পর্ব ও চরণের মাত্রা সমতার উপর ছন্দের শ্রুতি মাধুর্য নির্ভর করে।
ছেদ-যতি
কোন বাক্য পড়বার সময় তার সমগ্র বা আংশিক অর্থ পরিস্ফুটনের জন্য ধ্বনি প্রবাহে যে উচ্চারণ বিরতি আবশ্যিক হয় তাকে সাধারণভাবে ছেদ-যতি বলে বা অর্থ-যতি বলে।
কোন বাক্য পড়বার সময় শ্বাস গ্রহণের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়ান্তরে যে উচ্চারণ বিরতি ঘটে তাকেই ছন্দ-যতি বলা হয়।
আমরা যখন কথা বলি তখন মাধে মাঝে থামি। এই থামা বা বিরতি দুটি কারণে হয়— (১) অর্থ বোঝানোর জন্য, বা (২) যন্ত্রের স্বাভাবিক বিরতির প্রয়োজন বা শ্বাস গ্রহণের জন্য। কবিতা পড়ার সময় তাকে সুন্দর করে আবৃত্তি করি আমরা। এমনভাবে আবৃত্তি করা হয় যাতে শুনতে ভালো লাগে, সেই সঙ্গে অর্থের ব্যঞ্জনাও সৃষ্টি হয়। পড়তে পড়তে কোথায় থামব বা আবৃত্তি করার সময় কোথায় কীভাবে স্বর-ক্ষেপণ হবে তার একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। প্রথমত—অর্থ ব্যঞ্জনার জন্য বিরতির ঘটলে তা হবে অর্থ-যতি, আর ছন্দের প্রয়োজনে বিরতি ঘটলে তা হবে ছন্দ-যতি।
যতির বৈশিষ্ট্য
ক) যতি একপ্রকার বিরতি, যা ভাবের ঐক্য রক্ষা করে।
খ) যতি বাক্যের অর্থবোধে সহায়তা করে
গ) যতি পর্ব পরম্পরা রক্ষা করে।
ঘ) যতি অর্থবোধকও হতে পারে।
ঙ) যদি পংক্তি বা চরণের উচ্চারণে শ্রুতি সুষমা আনে।
চ) উচ্চারণের সময় শ্বাস নেবার প্রয়োজন সিদ্ধ করে যতি।
ছ) নির্দিষ্ট স্থানে যতি না দিলে বাক্য অসংলগ্ন হয়ে পড়ে, ফলে বোঝার অসুবিধা হয়।
যতির শ্রেণিবিভাগ
যতি প্রধানত দু প্রকার— ১) হ্রস্ব লঘু যতি ২) পূর্ণ যতি। তাছাড়া আরো তিনপ্রকার ছন্দ যতি হয়ে থাকে—ক) অর্ধ যতি বা পদ যতি খ) উপযতি গ) অনুযতি।
বাক্যের উচ্চারণ কালে শ্বাস গ্রহণের জন্য যে অল্প সময়ের বিরতি প্রয়োজন হয় তাকে লঘু হস্ব যতি বলে এবং বেশীক্ষণ বিরতির যে প্রয়োজন হয় তাকে পূর্ণ যতি বলা হয়। এই দুয়ের মাঝামাঝি আরেকটি যতি আছে। তাকে অর্ধ/মধ্য যতি (পদ যতি) বলে। এই মধ্য যতি হ্রস্ব যতি বা লঘু অপেক্ষা অধিকতর এবং পূর্ণযতি অপেক্ষা অল্পতর যতি এবং এই যতি পদের শেষে বসে।
প্রবোধচন্দ্র সেন ছেদ ও যতিকে পৃথক করতে চাননি। তিনি লিখেছেন—‘যতির অপর নাম ছেদ’। তাঁর মতে—“প্রকৃতি ভেদে যতি দ্বিবিধ-ভাব যতি ও ছন্দ যতি।” অনেকে ছেদ এবং যতিকে পৃথক বলেই দেখিয়েছেন। বিশেষ করে গদ্যে ছেদ-যতি এবং কবিতায় ছন্দ-যতির প্রচলন রয়েছে।
প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে যতি পাঁচ প্রকার—অনুতি, উপযতি, লঘুয়তি, অর্ধযতি, পূর্ণযতি।
অনুযতি—চরণের প্রতিটি দলের পর হয়।
উপযতি—প্রতিটি শব্দের পর হয়।
লঘুযতি—কাব্য পঙক্তির স্পষ্টতর বিরতিকে বলে লঘু/হ্রস্ব। অর্থাৎ পর্ব নির্দেশক যতি।
অর্ধযতি বা মধ্যযতি—অধিকতর স্পষ্ট যতি হল—অর্ধযতি/মধ্যযতি। অর্থাৎ পদ নির্দেশক যতি।
পূর্ণযতি—পঙক্তির শেষের বিরতি। অর্থাৎ ছেদ-বিরতি।
অমূল্যধনের মতে যতি দু-প্রকার— ১) অর্ধযতি ২) পূর্ণযতি।
অর্ধযতি—পর্বের পরে বসে।
পূর্ণযতি—পঙক্তির পরে বসে।
তারাপদ ভট্টাচার্যের মতে— ১) পর্বের পর ‘হ্রস্বতম যতি’ (২) পর্ববন্ধের পর ‘হ্রস্বযতি’, (৩) স্তবকের পর—‘অতি দীর্ঘযতি’।
যতি দৌর্বল্য
বাংলা ছন্দে একটি গোটা পর্বের পরই যতি পড়া স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু কখনো কখনো তেমন সুস্পষ্টভাবে যতি বাোঝা যায় না। সে ক্ষেত্রে যতি দুর্বল বলে পর্ব বিভাগ করতে অসুবিধা হয়। একে যতি দৌর্বল্য বলা হয়। সাধারণত অমিত্রাক্ষর বা গদ্য কবিতা বা প্রবহমান রীতির ছন্দের ক্ষেত্রে চরণের মধ্যে পূর্ণ যতি পড়ায় পরবর্তী পর্ব-যতির দৌর্বল্য প্রকট হয়।
সাগর তরঙ্গে যথা । পবন-তাড়নে
দ্রুতগামী ঘায় । রথ । ঘুরায় ঘর্ঘরে
চক্রনেমি । দৌড়ে ঘোড়া । ঘোর ঝড়াকারে।
এখানে ‘দ্রুতগামী’ ও ‘চক্রনেমি’-র পর দীর্ঘচ্ছেদ এত স্পষ্ট যে পর্বের হ্রস্ব যতি চিহ্ন (‘ধায় রথ’ ও ‘ঘোড়া’র পর) দুর্বল হয়ে পড়েছে। এই বৈশিষ্ট্যকেই যতি দৌর্বল্য বলা হয়।
যতি লোপ
বাংলা ছন্দে সাধারণত একটি পূর্ণ শব্দের পরই যতি চিহ্ন বসে। কিন্তু কখনো কখনো গোটা শব্দটি ভেঙ্গে যতিপাত করতে হয়। এরূপ ক্ষেত্রে যতির লোপ হয়েছে বলা হবে।
১) দয়ার স্নেহে । ক্ষুদ্র দেহে। বিশাল পারা । বার:
সৌম্য মূর্তি। তেজের স্ফূর্তি। চিত্ত চমৎ : কার।
২) হরিদত্তের বেটা হই। জয় দত্তের নাতি।
হাটে লয়া বেচাইব বী : রের ঘোড়া হাতি।
দৃষ্টান্ত দুটিতে যতি লোপ দেখানো হয়েছে, ‘পারাবার’, ‘চমৎকার’, ও ‘বীরের’ শব্দগুলি যতি পাতের ফলে খণ্ডিত হয়েছে। এবং (:) চিহ্ন দ্বারা তা বোঝানো হয়েছে। এ সব ক্ষেত্রে যতি অন্তর্গূঢ় বা লুপ্ত হয়েছে। অর্থাৎ যতি লোপ ঘটেছে।
তমাল বনে । ঝরিছে বারি : ধারা
তড়িৎ ছুটে । আঁধারে দিশা : হারা।
এখানেও বারিধারা এবং দিশাহারার মধ্যবর্তী যতি সুস্পষ্ট নয়। এখানে যতি লোপ হয়েছে।
পর্ব
প্রতিটি চরণে এক লঘু বা হ্রস্ব যতি থেকে আর এক হ্রস্ব যতি পর্যন্ত অংশকে পর্ব বলে। অন্যভাবে বলা যায়, লঘু বা হ্রস্ব যতির দ্বারা খণ্ডিত নির্দিষ্ট ধ্বনি প্রবাহকে পর্ব বলে।
কোন বাক্য উচ্চারণ কালে শ্বাস গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট সময়ের পরে স্বাভাবিক বিরতি অর্থাৎ হ্রস্ব যতির প্রয়োজন হয়, এর ফলে বাক্যের ধ্বনি প্রবাহ খণ্ডিত হয়। এমনিভাবে খণ্ডিত ধ্বনি প্রবাহের এক-একটি খণ্ডকে বলা হয় পর্ব। যেমন—
বাঁশ বাগানের মাথার উপর | চাঁদ উঠেছে। ওই।।
মাগো আমার। শোলক বলা | কাজলা দিদি। কই।।
উপরিউক্ত দৃষ্টান্তে প্রত্যেকটি চরণে চারটি করে যতি পড়েছে। ফলে প্রত্যেকটি চরণ চারটি ভাগে বিভক্ত হয়েছে। প্রতিটি চরণের প্রত্যেকটি খণ্ড বা ভাগকে বলা হবে পর্ব।
প্রথম চরণে সূচনা থেকে প্রথম হ্রস্ব লঘু যতি পর্যন্ত অংশ অর্থাৎ ‘বাঁশ বাগানের’— এটি প্রথম পর্ব।
অনুরূপ ভাবে প্রথম হ্রস্ব লঘু যতি থেকে পরবর্তী হ্রস্ব বা লঘু যতি ‘মাথার উপর’— দ্বিতীয় পর্ব।
এইভাবে তৃতীয় ও চতুর্থ পর্ব হল ‘চাদ উঠেছে’ এবং ‘ওই’। চরণের শেষে পূর্ণ যতি পড়েছে।
পর্বের গুরুত্ব
১) বাংলা ছন্দে পর্বের গুরুত্ব সমধিক। পর্বের সঙ্গে পর্বের মালা গেঁথে চরণ এবং চরণের সঙ্গে চরণ যুক্ত হয়ে স্তবক রচিত হয়।
২) ছন্দের প্রকৃতি বুঝতে হলে প্রতিটি পর্বের মাত্রা সংখ্যা প্রথমে নির্দিষ্টভাবে গণনা করতে হয়। পর্বের মাত্রা সংখ্যার উপর ছন্দের প্রকৃতি নির্ভর করে।
৩) পর্বের মাত্রা সম্মিতি ছন্দের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
৪) প্রতিটি চরণে মূল পর্ব ছাড়া অতি পর্ব ও অপূর্ণ পর্ব থাকতে পারে।
৫) কোন চরণে একাধিক মূল পর্বের মধ্যে মাত্রা সংখ্যা কম বা বেশী থাকলে ছন্দের প্রয়োজনে প্রসারিত অথবা সঙ্কুচিত করে মাত্রা গণনা করা হয়।
৬) মূল পর্বের মাত্রা সংখ্যার উপর নির্ভর করে ছন্দের প্রকৃতি। যেমন—দলবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব ৪ মাত্রা। কলাবৃত্ত / মাত্রাবৃত্ত ছন্দের মূল পর্ব ৪, ৫, ৬, ৭ মাত্রা এবং মিশ্ৰকলাবৃত্ত / অক্ষরবৃত্তের মূল পর্ব ৮ মাত্রা বা ১০ মাত্রা।
(৭) কবিতায় ছন্দের যে সুর বা দোলা থাকে তা অনেকটাই নির্ভর করে পর্বের উপর।
(৮) কবিতার লয় কী হবে তা নির্ভর করে পর্ব দৈর্ঘ্যের উপর।
(৯) পর্বমাত্রার সম্মিতি থেকেই ছন্দের প্রকৃতি নির্ণয় সম্ভব।
পর্ব সম্মিতি
প্রধান তিনটি ছন্দে পর্ব সমতা প্রায় অপরিহার্য ব্যাপার। পর্বসম্মিতি বলতে পর্বের মাত্রা সমতাকে বোঝায়। পর্বের মাত্রা সমতা না থাকলে ধ্বনি সাম্য বিঘ্নিত হয়, ছন্দস্পন্দ নষ্ট হয়। কোন ক্ষেত্রে দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপে মাত্রা কম থাকলেও ধ্বনি সাম্যে পর্বের মাত্রা সম্মিতি রক্ষা করা হয়।
প্রবহমান ছন্দে, অনেক ক্ষেত্রে প্রতি চরণে পর্ব গুলি অসম-মাত্রিক হয়ে থাকে, বিশেষ করে গদ্য ও মুক্তক ছন্দে।
উদাহরণ
কৃষ্ণকলি । আমি তারেই । বলি ৪+৪+২
কালো তারে । বলে গাঁয়ের । লোক ৪+৪+১
পর্বের শ্রেণিবিভাগ
পর্ব তিন প্রকার— (ক) পূর্ণ/মূল (খ) অপূর্ণ/অন্তিম/প্রান্তিক (গ) অতিপর্ব।
(ক) ছন্দানুযায়ী সুনির্দিষ্ট মাত্রা বিশিষ্ট এক হ্রস্বযতি থেকে আর এক হ্রস্বযতি পর্যন্ত বিস্তৃত চরণাংশকে পূর্ণ পর্ব বা মূল পর্ব বা প্রধান পর্ব বলা হয়।
উদাহরণ
নিরাবরণ | বক্ষে তব | নিরাভরণ | দেহে। ৫+৫+৫+২
চরণটি চারটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম তিনটি পূর্ণ পর্ব। কলাবৃত্ত ছন্দ অনুযায়ী প্রত্যেক পর্বের মাত্রা পাঁচ।
(খ) চরণের শেষে যে পর্বটি থাকে তাকে অন্তিম পর্ব বলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে পর্বটি অপূর্ণ থাকে, তাই এটি অপূর্ণ পর্ব। উপরি উক্ত দৃষ্টান্তে ‘দেহে’ অপূর্ণ পর্ব, মাত্রা সংখ্যা ‘দুই’, যদিও প্রধান পর্বের মাত্রা ‘চার’।
(গ) চরণের শেষে যেমন অপূর্ণ-পর্ব থাকতে পারে, ঠিক তেমনি চরণের প্রথমেও অপূর্ণমাত্রার পর্ব থাকতে পারে। এই পর্বটিকে অতিপর্ব বলা হয়। প্রান্তিক পর্ব শ্বাস বিরতির সহায়ক হয়, কিন্তু অতিপর্ব চরণের গতিবেগ দ্রুততর করতে সাহায্য করে।
ওরে) ক্রন্দন নয় । বন্ধন এই ২+৬+৬
শিকল ঝঞ। না ৬+১
এ যে) মুক্তি পথের । অগ্রদূতের ২+৬+৬
চরণ বন্দ । না। ৬+১
দৃষ্টান্তটিতে প্রথম ও তৃতীয় চরণের শুরুতে দু-মাত্রার একটি করে অতিপর্ব আছে।
পৰ্বাঙ্গ
পর্বের অন্তর্গত শব্দ ও দল উচ্চারণের সময় স্বরবাহে যে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, (অক্ষর/দলের উচ্চারণের তারতম্যের জন্য কণ্ঠস্বরে যে স্বাভাবিক হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে) তার ফলে প্রতিটি পর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিভাগ অনুভূত হয়, পর্বের অন্তর্গত এই স্বাভাবিক বিভাগকে পৰ্বাঙ্গ বলা হয়।
শব্দ উচ্চারণের সময় আমরা Syllable ভাগ করে উচ্চারণ করি। পর্বগুলো উচ্চারণের সময়ও একইভাবে বাগযন্ত্রের মধ্যে ধ্বনি প্রবাহ স্বাভাবিক নিয়মে খণ্ডিত হয়ে উচ্চারিত হয়। এরূপ স্বাভাবিক বিরতিকে পৰ্বাঙ্গ বলা হয়। এগুলি আসলে পর্বের ভিতরে স্বতন্ত্র খণ্ডপর্ব।
উদাহরণ
(ক) প্রেম এসেছিল। চলে গেল সে যে। খুলি দ্বার
আর কভু আসি। বে না।
(খ) প্রেম : এসে : ছিল । চলে : গেল । সে যে / খুলি : দ্বার
আর : কভু : আসি : বেনা।।
উক্ত দৃষ্টান্তে ‘প্রেম এসেছিল’ প্রথম পর্ব, ‘চলে গেল সে যে’ দ্বিতীয় পর্ব, ‘খুলি দ্বার’ তৃতীয় পর্ব। প্রথম পর্বটি ‘প্রেম এসেছিল’ উচ্চারণের সময় কণ্ঠস্বরের হ্রাস-বৃদ্ধির ফলে আমরা প্রথমে ‘প্রেম’ এবং পরে ‘এসে’ ও ‘ছিল’ শব্দটির উচ্চারণ করি। পর্বের উচ্চারণের সময় এই যে স্বাভাবিক বিরতি একেই পৰ্বাঙ্গ বলা হয়। পৰ্বাঙ্গ বোঝাতে আমরা দুটি বিন্দু ব্যবহার করেছি। ফলে প্রথম চরণে তিনটি পর্বাঙ্গ স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে।
(১) প্রথম পর্বাঙ্গ—‘প্রেম’ (২) দ্বিতীয় পর্বাঙ্গ ‘এসে’ এবং তৃতীয় পর্বাঙ্গ ‘ছিল’।
পর্বাঙ্গের বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব
(১) সাধারণত যে কোন পর্বে একাধিক পৰ্বাঙ্গ থাকে। একটিমাত্র পর্বাঙ্গ পূর্ণ পর্ব হয়। আবার তিনের অধিক পৰ্বাঙ্গ সাধারণত দেখা যায় না।
(2) অতি পর্বে পৰ্বাঙ্গ হয় না। অপূর্ব পদী পর্বে পৰ্বাঙ্গ থাকতে পারে। পূর্ণ পর্বে সাধারণত পর্বাঙ্গগুলি সমান মাত্রার হয়ে থাকে। পৰ্বাঙ্গ ভাগ করে উচ্চারণ করলে শ্রুতি মাধুর্য সৃষ্টি হয়।
প্রস্বর বা শ্বাসাঘাত
শব্দ বা বাক্য উচ্চারণের শুরুতে একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করার প্রবণতা ভাষার একটি সাধারণ লক্ষণ। একে ‘ঝোঁক’ বলা যায়-ইংরেজি পরিভাষায় Accent। শ্বাসের দ্বারা ওই ঝোঁক বা বল সৃষ্টি হয় বলে একে অনেকে ‘শ্বাসাঘাত’ বলেন। আবার এই ঝোঁক স্বরের উপরেই পড়ে বলে একে ‘স্বরাঘাত’ বা ‘প্রস্বর’ও বলা হয়। ইংরেজিতে একে Pitch Accent বা Musical Accent বলা হয়।
রবীন্দ্রনাথ এই বৈশিষ্ট্যের নাম দিয়েছেন ‘ঝোঁক’, কবি ও গায়ক দিলীপকুমার রায় ঝোঁককে বলেছেন ‘প্রস্বন’। কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় ‘স্বন’ নামটি নির্দেশ করেছেন। প্রবোধচন্দ্রের ভাষায় এটি ‘প্রস্বর’। এটি সংগীতের ‘সম’-এর সমগোত্র। মোহিতলালের মতে প্রস্বর হল—‘স্বরোৎঘাত’। আমরা বলেছি এটি প্রস্বর বা শ্বাসাঘাত।
প্রস্বর বা শ্বাসাঘাতের গুরুত্ব
(ক) প্রস্বর এক প্রকার ধ্বনি স্পন্দন সৃষ্টি করে ছন্দের শ্রুতি-সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
(খ) চরণের প্রথমে প্রস্বর, শেষে যতি একটি সম্পূর্ণ ধ্বনিপ্রবাহ সৃষ্টি করে, ফলে ধ্বনি সৌষম্য সৃষ্টি হয়।
(গ) প্রস্বর পর্বের সূচনা নির্দেশ করে।
(ঘ) দলবৃত্ত ছাড়াও অন্যান্য ছন্দেও প্রস্বর থাকে।
(ঙ) প্রস্বর দু-প্রকার—Musical (সুরাঘাত) ও Stress accent (স্বরাঘাত)। বাংলা কবিতায় উভয় প্রকার প্রস্বর থাকলেও স্বরাঘাত বেশী অনুভূত হয়।।
লয়
কবিতা পাঠকালে কণ্ঠনিঃসৃত ধ্বনি প্রবাহের গতি ভঙ্গীর প্রকৃতি হল ‘লয়’।
অক্ষর বা দলের প্রকৃতি, শব্দের প্রকৃতি এবং বাক্য ও ভাবের প্রকৃতি অনুযায়ী এক একটি কবিতা এক এক রকম করে পড়তে হয়—কোনটা দ্রুত তালে, কোনটা একটু বিলম্বিত তালে, কোনটা বা খুবই ধীর তালে। পর্বোচ্চারণের কাল পরিমাণকেই তাই লয় বলা চলে।
রবীন্দ্রনাথ লয়কে স্পন্দন বা Rhythme অর্থে প্রয়োগ করেছেন। বাতাসে যেমন হিল্লোল, সমুদ্রে যেমন কল্লোল, ছন্দে তেমন স্পন্দন বা লয়। কবিতা ও গানের মধ্যে এই যে স্পন্দন, যা আমাদের কানে শ্রুতিমধুর রূপে ধ্বনিত হয় তাকেই লয় বলা চলে।
লয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য
(১) তিনটি প্রধান ছন্দের উচ্চারণ ও পঠন পদ্ধতি তিনরকম লয়ের হয়ে থাকে।
(২) দলবৃত্ত ছন্দের পর্ব সংক্ষিপ্ত এবং প্রস্বর থাকায় লয় হয় ক্ষিপ্র বা দ্রুত।
(৩) কলাবৃত্ত/মাত্রাবৃত্তে যুক্তবর্ণ বিশ্লিষ্ট হয় ও পর্বগুলি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ হওয়ায় লয় হয় মধ্যম।
(৪) অক্ষরবৃত্তের/মিশ্রবৃত্তের দীর্ঘ পর্বের জন্য লয় হয়ে যায় ধীর।
(৫) লয় একপ্রকার স্পন্দন ভঙ্গী (Rythm)।
(৬) লয় ছন্দের ধ্বনি প্রবাহের গতিক্রম (Tempo)।
উদাহরণ
(ক) দ্রুত লয়ের ছন্দ (দলবৃত্ত)
চরকার ঘরঘর/পড়শীর ঘরঘর
ঘরঘর ক্ষীরসর/আপনায় নির্ভর
পড়শীর কণ্ঠে/জাগলো সাড়া।
দাঁড়া আপনার/পায়ে দাঁড়া। (সত্যেন্দ্রনাথ)
(খ) মধ্যম লয় (মাত্রাবৃত্ত)
সাগর জলে/সিনান করি/সজল এলো/চুলে
বসিয়া ছিল/উপল উপ : কূলে
শিথিল পীত/বাস
মাটির পরে/কুটিল রেখা/লুটিল চারি/পাশ।
(গ) ধীর লয়ের ছন্দ (অক্ষরবৃত্ত)
চিত্ত যেথা ভয়শূন্য/উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা/গৃহের প্রাচীর….।
চরণ
পূর্ণযতির দ্বারা নির্দিষ্ট ধ্বনিপ্রবাহকে চরণ বলা হয়। চরণ একাধিক পর্ব (ও পদের) সমন্বয়ে গঠিত হয়।
আচার্য প্রবোধ চন্দ্র সেন চরণ শব্দটিতে আপত্তি জানিয়েছেন। তিনি অনুরূপ স্থলে বলেছেন ‘পঙক্তি’। ‘‘আবৃত্তির আরম্ভ থেকে পূর্ণযতি পর্যন্ত পদ রচনার ধ্বনি প্রবাহকে ছন্দপরিভাষায় বলা যায় পঙক্তি (Verse)”।
পঙক্তি
পঙক্তি হল কবিতার চরণকে ছন্দোবদ্ধ রূপে সাজাবার প্রকৌশল। (এ সম্বন্ধে পূর্বেই বলা হয়েছে) চরণকে ভেঙে ভেঙে পদ ও পর্ব অনুযায়ী বিভিন্ন পঙক্তিতে সাজানো যায়। তাই একটি চরণ একাধিক পঙক্তিতে সজ্জিত হতে পারে।
শুধু-ধাও, । শুধু ধাও, । শুধু বেগে ধাও
উদ্দাম উধাও—
ফিরে নাহি চাও,
যা-কিছু তোমার । সব দুই হাতে। ফেলে ফেলে যাও। ৬+৬+৬
কবিতাংশটি এভাবেই সাজানো যায়—
শুধু ধাও,
শুধু ধাও
শুধু বেগে ধাও
উদ্দাম উধাও
ফিরে নাহি চাও,
যা কিছু তোমার
সব দুই হাতে
ফেলে ফেলে যাও
পঙক্তি ও চরণ কখনো কখনো সমার্থক হয়ে যায়, যখন পূর্ণযতি পড়ে পঙক্তির শেষে। একইভাবে পর্ব ও পদ, পঙক্তির সঙ্গে সমার্থক হতে পারে।
পদ
কবিতার প্রতি পঙক্তির মধ্য যতি (অর্ধযতি) দ্বারা খণ্ডিত নির্দিষ্ট ধ্বনিপ্রবাহকে পদ বলে।
পর্ব— লঘু বা হ্রস্ব যতির দ্বারা নির্দিষ্ট, খণ্ডিত ধ্বনি প্রবাহ। চরণ—পূর্ণ যতি দ্বারা খণ্ডিত ধ্বনি প্রবাহ।
পদ— মধ্যযতি/অর্ধযতি দ্বারা খণ্ডিত ধ্বনি প্রবাহ। পদে ভাবের অর্থ প্রকাশ হয়। হ্রস্ব যতিতে বিরতির সময় লঘু, পূর্ণ যতির বিরতি দীর্ঘ, এবং মধ্যযতির বিরতি মধ্যম।
মধ্যযতি স্থানে লঘু বা হ্রস্বযতিও পড়ে। মধ্যযুতির ক্ষেত্রে বাক্যের অর্থ আংশিক সমাপ্ত হয়, তাই হ্রস্বচ্ছেদ হয়, হ্রস্ব বা লঘু যতির ক্ষেত্রে তা হয় না। লঘু বা হ্রস্বযতি ও হ্রস্বছেদ মিলে বিরতির সময়কালকে দীর্ঘ করে।
মিল
দুটি চরণের অন্তিম ধ্বনির সমতাই মিল। একে মিত্রাক্ষরও বলা হয়।
অলংকার শাস্ত্রে যা ‘অনুপ্রাস’, ছন্দশাস্ত্রে সেটাই ‘মিল’। ‘মিল’ প্রবোধচন্দ্র সেনের মতে ‘উপমক’। তাঁর মতে—“দুটি স্বতন্ত্র দল বা দলগুচ্ছের সব স্বর ও ব্যঞ্জন ধ্বনির যথানুক্রমিক শ্রুতিসাম্যের পারিভাষিক নাম যমক। তাই যমকের প্রথম ব্যঞ্জন বাদে বাকি সব ধ্বনির অনুরূপ শ্রুতিসাম্যের পারিভাষিক নাম হতে পারে উপযমক। এই উপযমকেরই প্রচলিত নাম মিল। (RHYME)।
মিলের শ্রেণিবিভাগ
মিল নানা প্রকার হতে পারে— (ক) পৰ্বান্তিক (খ) পদান্তিক (গ) চরণাস্তিক/অন্তমিল
পৰ্বান্তিক মিল—
এ জগতে হায়/সেই বেশী চায় । যার আছে ভুরি ভুরি
রাজার হস্ত/করে সমস্ত । কাঙালের ধন/চুরি।
পদান্তিক মিল—
রুটি দেবে না কো?/ দেবে না অন্ন।
এ লড়াইয়ে তুমিনও প্রসন্ন?
চরণান্তিক মিল—
মহাবিদ্রোহ/রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন/ হব শান্ত।
স্তবক
একাধিক চরণের সুসংহত ও সুশৃঙ্খল সমাবেশ যখন একটি নির্দিষ্ট ভাব প্রকাশ করে তখন তাকে স্তবক বলা হয়। গদ্যের পরিচ্ছেদের মত কবিতার স্তবক।
স্তবকের বৈশিষ্ট্য
(ক) একাধিক চরণের সমন্বয়ে স্তবক গঠিত হয়। একাধিক স্তবকে কবিতাটি বিভক্ত হয়ে ভাবের সংহতি রক্ষা করে।
(খ) এক-একটি স্তবক কবিতার আংশিক ভাব প্রকাশ করে।
(গ) প্রাচীন পদবন্ধের শৃঙ্খল ঘুচিয়ে বহু চরণের সন্নিবেশে ভাবের প্রবহমানতাকে স্বীকার করে নিতেই স্তবকের সৃষ্টি।
উদাহরণ:
(১) বর্ষে বর্ষে দলে দলে/আসে বিদ্যামঠ তলে
চলে যায় তারা কলরবে,
কৈশোরের কিশলয়/পর্ণে পরিণত হয়,
যৌবনের শ্যামল গৌরবে।
(২) গান গেয়ে তরী বেয়ে/কে আসে পারে
দেখে যেন মনে হয়/চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোন দিকে নাহি চায়
ঢেউগুলি নিরূপায়/ভাঙে দু-ধারে।
(৩) কৃষ্ণ কলি/আমি তারেই/বলি
কালো তারে/বলে গাঁয়ের/লোক।
মেঘলা দিনে/দেখে ছিলেম/মাঠে
কালো মেয়ের/কালো হরিণ/চোখ।
প্রতিটি দৃষ্টান্তেই দেখা যায়, কয়েকটি চরণে সমন্বিত একটি ভাবপ্রবাহ বাঁধা পড়েছে সুষম শৃঙ্খলে। দৃষ্টান্তগুলি এইভাবে একটি পূর্ণ ভাব প্রকাশক স্তবক হয়ে উঠেছে।
Leave a Reply