//
//

বাংলা শব্দভাণ্ডার সম্পর্কে আলোচনা কর।

বাংলা শব্দভাণ্ডার

ভাষার সম্মান নির্ভর করে তার প্রকাশক্ষমতার উপরে। যে ভাষা যত বিচিত্র ভাব ও বস্তু এবং যত গভীর অনুভূতি প্রকাশ করতে সক্ষম সে ভাষা তত উন্নত। ভাষার এই প্রকাশক্ষমতার মূল আধার হল ভাষার শব্দসম্পদ। ভাষার এই শব্দসম্পদ আবার তিনভাবে সমৃদ্ধ হয়—উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত প্রাচীন শব্দের সাহায্যে, অন্য ভাষা থেকে গৃহীত কৃতঋণ শব্দের সাহায্যে এবং নতুন সৃষ্ট শব্দের সাহায্যে। আজকের উন্নত বাংলা ভাষাও এই ত্রিবিধ উপায়ে নিজের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছে। বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে উৎসগত বিচারে আমরা প্রথমত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করতে পারি— (১) মৌলিক বা নিজস্ব (২) আগন্তুক বা কৃতঋণ (৩) নবগঠিত।

মৌলিক শব্দ

যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা (বৈদিক ও সংস্কৃত) থেকে উত্তরাধিকারসূত্রে বাংলায় এসেছে সেইগুলিকে মৌলিক শব্দ বলে। বৈয়াকরণরা আবার আর এক শ্রেণীর শব্দকে ব্যাকরণে মৌলিক নামে অভিহিত করে থাকেন—যেসব শব্দকে ক্ষুদ্রতর অর্থপূর্ণ অংশে ভাগ করা যায় না, ভাগ করলে অংশগুলির কোনো অর্থ হয় না। সেইসব শব্দকে তারা মৌলিক শব্দ বলেছেন। নামকরণের এই গোলযোগ এড়াবার জন্যে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষা থেকে আগত শব্দগুলিকে উত্তরাধিকাব-লব্ধ নিজস্ব বলতে পারি। এই উত্তরাধিকার-লব্ধ মৌলিক বা নিজস্ব শব্দগুলিকে তিনভাগে ভাগ করা হয়— (ক) তৎসম, (খ) অর্ধতৎসম ও (গ) তদ্ভব।

তৎসম শব্দ

যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষা (বৈদিক} সংস্কৃত) থেকে অপরিবর্তিতভাবে বাংলায় এসেছে সেগুলিকে তৎসম (Tatsama) শব্দ বলে। ‘তৎ’ বলতে এখানে মূল উৎস-স্বরূপ বৈদিক ও সংস্কৃত ভাষাকে বোঝাচ্ছে। ‘তৎসম’ মানে ঠিক তার মতো, অর্থাৎ অপরিবর্তিত শব্দ। বাংলায় বহু প্রচলিত তৎসম শব্দের সংখ্যা কম নয়। যেমন— জল, বায়ু, কৃষ্ণ, সূর্য, মিত্র, জীবন, মৃত্যু, বৃক্ষ, লতা, নারী, পুরুষ ইত্যাদি। তৎসম শব্দগুলিকে আবার দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—সিদ্ধ তৎসম ও অসিদ্ধ তৎসম।

সিদ্ধ তৎসম শব্দ

যেসব শব্দ বৈদিক ও সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় এবং যেগুলি ব্যাকরণ-সিদ্ধ সেগুলি হল সিদ্ধ তৎসম। যেমন-সূর্য, মিত্র, কৃষ্ণ, নর, লতা ইত্যাদি।

অসিদ্ধ তৎসম

যে-সব শব্দ বৈদিক বা সংস্কৃত সাহিত্যে পাওয়া যায় না ও সংস্কৃত ব্যাকরণসিদ্ধ নয় অথচ প্রাচীনকালে মৌখিক সংস্কৃতে প্রচলিত ছিল, সেগুলিকে ড. সুকুমার সেন অসিদ্ধ তৎসম শব্দ বলেছেন। যেমন—কৃষাণ, ঘর, চাল, ডাল (বৃক্ষশাখা) ইত্যাদি।

অর্ধ-তৎসম শব্দ

যেসব শব্দ প্রাচীন ভারতীয় আর্য (বৈদিক সংস্কৃত) থেকে মধ্যবর্তী স্তর প্রাকৃতের মাধ্যমে না এসে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে এবং আসার পরে কিঞ্চিত পরিবর্তন ও বিকৃতি লাভ করেছে, সেগুলিকে অর্ধ-তৎসম (Semi tatsama) বা ভগ্ন-তৎসম শব্দ বলে। যেমন— কৃষ্ণ > কেষ্ট, নিমন্ত্রণ > নেমন্তন্ন, ক্ষুধা > খিদে, রাত্রি > রাত্তির ইত্যাদি।

তদ্ভব শব্দ

যেসব শব্দ সংস্কৃত থেকে সোজাসুজি বাংলায় আসেনি, মধ্যবর্তী পর্বে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় এসেছে তাদের তদ্ভব শব্দ বলে। খাঁটি বাংলার মূল শব্দসম্পদ হল এইসব তদ্ভব শব্দ। উদাহরণ—সংস্কৃত ইন্দ্রাগার > প্রাকৃত ইন্দাআর > বাংলা ইন্দারা, সংস্কৃত একাদশ > প্রাকৃত এগারহ > বাংলা এগার, সংস্কৃত উপাধ্যায় > প্রাকৃত উবঝাঅ > বাংলা ওঝা, সংস্কৃত কৃষ্ণ > প্রাকৃত কণহ > বাংলা কানু, সংস্কৃত ধর্ম > প্রাকৃত ধম্ম > বাংলা ধাম ইত্যাদি। কখনো কখনো দেখা যায় একই মূল শব্দ থেকে জাত অর্ধ-তৎসম ও তদ্ভব দুই রূপই বাংলায় একই অর্থে প্রচলিত আছে। যেমন—কৃষ্ণ > অর্ধ-তৎসম কেষ্ট, তদ্ভব কানু; রাত্রি > অর্ধতৎসম রাত্তির, তদ্ভব রাত ইত্যাদি। তদ্ভব শব্দকে দুটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়— নিজস্ব ও কৃতঋণ তদ্ভব।

নিজস্ব তদ্ভব শব্দ

যেসব তদ্ভব শব্দ যথার্থই বৈদিক বা সংস্কৃতের নিজস্ব শব্দের পরিবর্তনের ফলে এসেছে সেগুলিকে নিজস্ব তদ্ভব বলতে পারি। যেমন—ইন্দ্রাগার > ইন্দাআর > ইন্দারা, উপাধ্যায় > উজ্ঋাঅ > ওঝা ইত্যাদি।

কৃতঋণ তদ্ভব বা বিদেশি তদ্ভব

যেসব শব্দ প্রথমে বৈদিক বা সংস্কৃত ভাষায় ইন্দো-ইউরোপীয় বংশের অন্য ভাষা থেকে বা ইন্দো-ইউরোপীয় ছাড়া অন্য বংশের ভাষা থেকে কৃতঋণ শব্দ (Loan word) হিসাবে এসেছিল এবং পরে প্রাকৃতের মাধ্যমে পরিবর্তন লাভ করে বাংলায় এসেছে সেসব শব্দকে কৃতঋণ তদ্ভব বা বিদেশি তদ্ভব শব্দ বলে। যেমন—ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবংশের অন্য ভাষা থেকে গ্রীক দ্রাখুমে (drakhme = মুদ্রা) > সংস্কৃত দ্রম্য > প্রাকৃত দম্ম > বাংলা দাম।

কৃতঋণ শব্দ

যেসব শব্দ সংস্কৃতের নিজস্ব উৎস থেকে বা অন্য ভাষা থেকে সংস্কৃত হয়ে আসেনি, অন্য ভাষা থেকে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে সেই শব্দগুলিকে আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ (Loan words) বলতে পারি। এগুলি অন্য ভাষা থেকে সংস্কৃত প্রাকৃত হয়ে বাংলায় আসেনি বলে এইগুলি হল কৃতঋণ শব্দ; কৃতঋণ তদ্ভব শব্দ থেকে এগুলি পৃথক। এই আগন্তুক বা কৃতঋণ শব্দ দুই শ্ৰেণীর—দেশি ও বিদেশি।

দেশি শব্দ

যেসব শব্দ এদেশেরই অন্য ভাষা থেকে সোজাসুজি বাংলায় এসেছে। সেগুলিকে দেশি (Deshi) শব্দ বলে। দেশি শব্দ আবার দু’রকম হতে পারে—অন্-আর্য এবং আর্য। যেমন অন্-আর্য—অস্ট্রিক বংশের ভাষা থেকে ডাব, ঢোল, ঢিল, চেঁকি, আঁটা, ঝোল, ঝিঙ্গা, কুলা ইত্যাদি। আর্য—হিন্দি থেকে লগাতার, বাতাবরণ, সেলাম, দোস্তু, ওস্তাদ, মস্তান, ঘেরাও, জাঠা (এগুলির মধ্যে যেগুলি মূলত আরবি-ফারসি শব্দ, সেগুলি আরবি-ফারসি থেকে এদেশেরই ভাষা হিন্দির মাধ্যমে বাংলায় এসেছে বলে সেগুলিকেও দেশি শব্দ রূপে গ্রহণ করতে হবে)। গুজরাতি থেকে—হরতাল।

বিদেশি শব্দ

যেসব শব্দ এদেশের বাইরের কোনো ভাষা থেকে বাংলায় এসেছে সেগুলিকে বিদেশি শব্দ বলে। যেমন—ইংরেজি থেকে স্কুল, কলেজ, চেয়ার, টেবিল, ফাইল, টিকিট, কোট, লাট (<Lord), সিনেমা, থিয়েটার, হোটেল, কমিটি ইত্যাদি।

মিশ্র বা সংকর শব্দ

মিশ্র বা সংকর কথাটির সাধারণ অর্থ হল দুই বা তার বেশি ভিন্ন উপাদান মিশিয়ে প্রাপ্ত। যে কোনো ভাষার শব্দভাণ্ডারে বিভিন্ন উৎস থেকে শব্দ, ধাতু, উপসর্গ, প্রত্যয় প্রভৃতি গ্রহণ করা হয়। এইসব ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে নেওয়া উপাদানের মধ্যে অনেক সময় মিশ্রণ ঘটতে দেখা যায় ‌‌‌। এই ভাবে ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আগত একাধিক শব্দের মিলনে অথবা, ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে আগত শব্দ ও শব্দাংশের (শব্দাংশ বলতে এখানে উপসর্গ ও প্রত্যয়) মিলনে যে শব্দ গঠিত হয়, তাকে মিশ্র শব্দ বা সংকর শব্দ বলে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে—দুটি শব্দের মিলনে নতুন শব্দ গঠিত হলেই তা মিশ্র শব্দ নয়। মিশ্র শব্দ হ‌ওয়ার জন্য উপাদানগুলিকে অবশ্যই ভিন্ন উৎস থেকে আগত হতে হবে। যেমন তৎসম + তদ্ভব, বিদেশি + তৎসম, দেশি + বিদেশি ইত্যাদি। বিদেশি শব্দের সঙ্গে বিদেশি শব্দের যোগেও মিশ্র শব্দ হতে পারে, কিন্তু সেক্ষেত্রে দেখতে হবে উপাদান শব্দগুলি যেন এক‌ই ভাষা থেকে আগত না হয়। যেমন—আরবি ও  ইংরেজি বা ফারসি ও তুর্কির মিশ্রণে মিশ্র শব্দ হতে পারে, কিন্তু ইংরেজি শব্দের সঙ্গে আর একটি ইংরেজি শব্দের মিশ্রণে মিশ্র শব্দ হবে না। যেমন— হেডমাস্টার শব্দটি মিশ্র শব্দ নয়, এটি একটি ইংরেজি শব্দ হিসেবে বিদেশি শব্দের অন্তর্ভুক্ত হবে। মিশ্র বা সংকর শব্দের উদাহরণ—হেডপণ্ডিত (বিদেশি + তৎসম), কেষ্টঠাকুর (অর্ধতৎসম + তদ্ভব), বদরাগি (বিদেশি + তদ্ভব), রেলগাড়ি (বিদেশি + বিদেশি)

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!