বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
বাংলা ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির পূর্বে বাঙালিরা সংস্কৃত-প্রাকৃত-অপভ্রংশ ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছে। মৌর্য-গুপ্ত যুগে ব্রাহ্মণ আদর্শ, সংস্কৃত সাহিত্য ও স্মার্ত সংস্কারে ব্রাত্য বাঙালির যে দীক্ষা হয়েছিল, সেন যুগের তার পল্লবিত বিকাশ ঘটল। অজস্র লিপি-লেখন, স্মৃতিশাস্ত্রের শ্লোক, ন্যায়শাস্ত্রের টীকা-টিপ্পনী, সবোর্পরি গৌড়ীয় রীতির উল্লেখ থেকে মনে হয় বাঙালি সংস্কৃত ভাষায় প্রথম সাহিত্য চর্চা করত। সেন যুগে সংস্কৃত সাহিত্য চর্চার সেরা নিদর্শন জয়দেবগোষ্ঠী। এছাড়া বাঙালির কবি-প্রতিভার স্বাক্ষর রয়েছে ধোয়ীর ‘পবনদূত’, গোবর্ধন আচার্যের ‘আর্যাসপ্তশতী’র মধ্যে। এই প্রসঙ্গে বাঙালির দুটি সংকলন গ্রন্থের নাম উল্লেখযোগ্য—‘কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়’ (সুভাষিত রত্নকোষ) এবং ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ (সূক্তিকর্ণামৃত)। এইসব সংকলন গ্রন্থের বিভিন্ন প্রকীর্ণ কবিতাগুলি থেকে বাংলা ভাষার জন্ম বলে অনুমান করা হয়।
বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম সাহিত্যিক নিদর্শন চর্যাপদ। কোনো কোনো পণ্ডিতদের মতে ময়নামতির গান, গোরক্ষ বিজয়, শূন্যপুরাণ, ডাক ও খনার বচন, রূপকথা প্রভৃতির মধ্যে বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন রয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে এগুলি চর্যাপদ পূর্ববর্তী রচনা নয়। মাগধী-অপভ্রংশ-অবহটঠের খোলস ত্যাগ চর্যাপদ-এর মধ্যেই বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন হয়েছে তা বলা যেতে পারে।
বাংলা সাহিত্যের বর্তমান বয়স প্রায় হাজার বছর। এই দীর্ঘ হাজার বছরের ইতিহাসে বাংলা সাহিত্যের গতি প্রকৃতির নানা পরিবর্তন ঘটেছে, আর্থ সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে, নানা রাজনৈতিক বিপর্যয় ঘটেছে। এইসব দিক মাথার রেখে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—
ক. আদিযুগ (৯০০-১২০০ খ্রিস্টাব্দ)
খ. মধ্যযুগ (১৩৫০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ, মতান্তরে ১৩৫০-১৭৬০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, বা ভারতচন্দ্রের মৃত্যু পর্যন্ত)
গ. আধুনিক যুগ (১৮০১ থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত)
আদি যুগ
বাংলা সাহিত্যের আদি যুগের একমাত্র নিদর্শন চর্যাপদ। তুর্কি আক্রমণের পূর্ববর্তী দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর সময় পর্যন্ত আদি যুগের ব্যাপ্তিকাল। এই যুগের সাহিত্যে বৌদ্ধ সহজিয়া মতাবলম্বীদের সাধনতত্ত্বের কথা রূপকের মাধ্যমে সন্ধ্যা ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। যেখানে তৎকালীন আর্থ-সামাজিক জীবনে প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে।
মধ্য যুগ
তুর্কি আক্রমণের অব্যবহৃত পরে বাংলা সাহিত্যে মধ্যযুগের সূচনা। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণের ফলে বাঙালির রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনের চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেজন্য অনুমান করা হয় এই দুটি শতাব্দীতে কোন সাহিত্য সৃষ্টি হতে পারেনি কিংবা হয়ে থাকলেও তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এই সময়কালকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ‘অন্ধকারাচ্ছন্ন’, ‘বন্ধ্যাযুগ’, ‘মাৎসন্যায়’ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হয়। চতুর্দশ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রকৃত মধ্যযুগের সূচনা আর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশ রাজত্বের শুরুতে মধ্যযুগের অবসান। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে প্রধানত চারটি ধারা—১. গীতি সাহিত্যের ধারা, ২. মঙ্গলকাব্যের ধারা ৩. জীবনী সাহিত্যের ধারা ৪. অনুবাদ সাহিত্যের ধারা। চৈতন্যদেবের আবির্ভাব মধ্যযুগের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। তাই সেদিক থেকে মধ্যযুগের সাহিত্যকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—১. চৈতন্য পূর্ববর্তী যুগ ২. চৈতন্য সমসাময়িক যুগ এবং ৩. চৈতন্য পরবর্তী যুগ।
গোপাল হালদারকৃত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
গোপাল হালদার বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা বইটিতে মধ্যযুগের সাহিত্যের ধারাকে চারটি ভাগে ভাগ করেছেন—
প্রথম পর্ব: যুগসন্ধিকাল (১২০০-১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ)
দ্বিতীয় পর্ব: প্রাক্ চৈতন্য যুগ (১৩৫০-১৫০০ খ্রিস্টাব্দ)
তৃতীয় পর্ব: চৈতন্য যুগ (১৫০০-১৭০০ খ্রিস্টাব্দ)
চতুর্থ পর্ব: নবাবী আমল (১৭০০-১৮০০ খ্রিস্টাব্দ)
এই যুগের সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ধর্ম নির্ভরতা ও ভক্তিবাদ। তুর্কি আক্রমণের প্রভাবে বাঙালির ভক্তিনির্ভরতা অর্থাৎ দৈববিশ্বাস বেড়ে যায়। চৈতন্য আবির্ভাবে মানবিকতার কিছু প্রসার ঘটে কিন্তু মধ্যযুগের শেষ দিকে নাগরিক ছলা কলা, অবিশ্বাস ও সংশয়ের মনোভাব প্রকাশিত হতে থাকে। এসবের পরিচয় রয়েছে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যে এবং শাক্ত পদাবলীতে।
দীনেশচন্দ্র সেন কৃত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
হিন্দু ও বৌদ্ধ যুগ
ক. শূন্য পুরাণ
খ. নাথ গীতিকা—ময়নামতীর গান ও গোরক্ষ বিজয়
গ. কথাসাহিত্য
ঘ. ডাক ও খনার বচন
গৌড়ীয় যুগ অথবা শ্রীচৈতন্য পূর্ব সাহিত্য
ক. পঞ্চগৌড়
খ. অনুবাদ শাখা—
খ.১ কৃত্তিবাস
খ.২ অনন্ত রামায়ণ
খ.৩ সঞ্জয়, কবীন্দ্র পরমেশ্বর এবং শ্রীকর নন্দী
খ.৪ মালাধর বসু
গ. লৌকিক ধর্মশাখা—
গ.১ লৌকিক ধর্মের উৎপত্তি
গ.২ শিবের ছড়া
গ.৩ চাঁদ সওদাগর ও বেহুলা
গ.৪ কানাহরি দত্ত, বিজয়গুপ্ত, নারায়ণদেব ও কবি জনার্দন চক্রবর্তী প্রভৃতি, শীতলামঙ্গল, কমলামঙ্গল বা লক্ষ্মীচরিত্র, গঙ্গামঙ্গল, সূর্যের পাঁচালী।
ঘ. পদাবলী শাখা—
ঘ.১ পদাবলী সাহিত্য
ঘ.২ চণ্ডীদাস ও রামী
ঘ.৩. বিদ্যাপতি ঠাকুর
ঙ. সামাজিক ইতিহাস বা কুলজী সাহিত্য
চৈতন্য-সাহিত্য বা নবদ্বীপের প্রথম যুগ
শ্রীচৈতন্যদেব ও এই যুগের সাহিত্য—
ক. পদাবলি শাখা
খ. চরিত শাখা—
খ.১ গোবিন্দদাসের কড়চা
খ.২ জয়ানন্দের চৈতন্যমঙ্গল,
খ.৩ বৃন্দাবন দাসের চৈতন্যভাগবত
খ.৪ লোচন দাসের চৈতন্যমঙ্গল,
খ.৫ কৃষ্ণদাস কবিরাজ শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃতম্,
খ.৬ নরহরি চক্রবর্তীর ভক্তিরত্নাকর, নরোত্তম বিলাস, নিত্যানন্দ দাসের প্রেমবিলাস প্রভৃতি।
সংস্কার যুগ
ক. লৌকিক শাখা—
ক.১ মাধবাচার্য, মুকুন্দরাম, রামেশ্বর ভট্টাচার্য, কেতকাদাস ক্ষেমানন্দ প্রভৃতি ও ঘনরাম,
ক.২ কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী, শিবায়ন, মনসাদেবীর ভাসান রচকগণ, ধর্মমঙ্গল
খ. অনুবাদ শাখা—ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপাখ্যানাদি, রামায়ণ, মহাভারত, ধর্মমঙ্গল, ভাগবত, চণ্ডী প্রভৃতি।
কৃষ্ণচন্দ্রীয় যুগ অথবা নবদ্বীপের দ্বিতীয় যুগ
ক. নবদ্বীপ ও কৃষ্ণচন্দ্র
খ. সাহিত্যে নতুন আদর্শ
গ. কাব্য শাখা—পদ্মাবতী, বিদ্যাসুন্দর, অন্নদামঙ্গল প্রভৃতি কাব্য
ঘ. গীতিশাখা—সাধক রামপ্রসাদ
সুকুমার সেন কৃত আদি ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে আদি ও মধ্য যুগের ইতিহাসকে নিম্নরূপে ভাগ করেছেন—
ক. উপক্রমণিকা (অ-বাংলা রচনা)
খ. আদিযুগ (চর্যাপদ)
গ. অন্ধকার যুগ (ত্রয়োদশ, চতুর্দশ শতাব্দী)
ঘ. আদি মধ্য যুগ (পঞ্চদশ শতাব্দী)
ঙ. অন্ত্যমধ্য (ষোড়শ থেকে অষ্টাদশ)
ভূদেব চৌধুরী কৃত আদি ও মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ
ভূদেব চৌধুরী তাঁর ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা’ গ্রন্থে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করেছেন—
ক. আদি যুগ (দশম-দ্বাদশ শতাব্দীর বিপর্যয় ও শূন্যময় যুগ)
খ. আদি-মধ্য যুগ (পঞ্চদশ)
গ. মধ্য যুগ-পরিণাম ও চৈতন্যযুগ চেতনা (ষোড়শ)
ঘ. অন্ত্য-মধ্য যুগ বা চৈতন্যোত্তর যুগ (সপ্তদশ, অষ্টাদশ)
আধুনিক যুগ
১৮০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা। ইংরেজ মিশনারীদের আগমন ও ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় থেকে বাংলা সাহিত্যের এই যুগের সূচনা। ইংরেজদের হাত ধরে মুদ্রণযন্ত্রের আগমন, বাংলা লিপির সংস্কার, গদ্যের বিকাশ ও ব্যাপ্তি, সংবাদপত্র সাময়িক পত্রের ব্যাপক প্রচলন আধুনিক যুগের যুগ বৈশিষ্ট্যকে চিহ্নিত করে। বাংলা সাহিত্য নতুন রূপ পরিগ্রহ করে আধুনিক যুগে—মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারের ফলে। গদ্যে রামমোহন, বিদ্যাসাগর; কাব্যে মধুসূদন, উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র, আধুনিক যুগের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য যুক্তিবাদকে প্রতিষ্ঠা করেন। রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘকালের সাহিত্য সাধনা বিশ্বের দরবারে বাংলা সাহিত্যের বৈচিত্র্য ও বিস্তারকে প্রকাশিত করে। আজও বাংলা সাহিত্যের ধারা সগৌরবে প্রবহমান।
তথ্যসূত্র:
বাঙ্গালা সাহিত্যের কথা – সুকুমার সেন | Download |
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (১ম খণ্ড) | Download |
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (২য় খণ্ড) | Download |
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (৩য় খণ্ড) | Download |
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (৪র্থ খণ্ড) | Download |
বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস – সুকুমার সেন (৫ম খণ্ড) | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (১ম) – ভূদেব চৌধুরী | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা (২য়) – ভূদেব চৌধুরী | Download |
বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত ইতিবৃত্ত – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (১ম) – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (২য়) – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত (৩য়) – অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় | Download |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস – আশুতোষ ভট্টাচার্য | Download |
বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা (১ম খণ্ড) – গোপাল হালদার | Download |
বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা (২য় খণ্ড) – গোপাল হালদার | Download |
Leave a Reply