বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাংলা সাহিত্যে মহাভারতের প্রভাব
একটি বিরাট বটবৃক্ষ যেমন তার বিভিন্ন অংশ দ্বারা ভূমির বিশাল অংশকে প্রভাবিত করে ঠিক তেমনি মহাভারতও পরবর্তীকালের সাহিত্যকে বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। একটি বিশাল বৃক্ষ যেমন মাটি থেকে রসদ আহরণ করে বেড়ে ওঠে আবার তা সেই মাটিকেই ছায়াদান করে, মহাভারতের প্রকৃতিও তাই। মহাভারত বেদ-উপনিষদ, বিবিধ শাস্ত্র ও লোকযাত্রাবিধানের তথ্যে পূর্ণ। মহাভারত ভারতীয় প্রজ্ঞার বিশিষ্ট কীর্তি, তাই ভারতীয় সাহিত্যে এই মহাকাব্যের প্রভাবও সুদূরপ্রসারী।
মধ্য যুগের বাংলা অনুবাদ সাহিত্য ভারতকথার প্রভাবে প্রভাবিত। কাশীরাম ‘কবীশদলে’ পুণ্যবান হয়েছেন ব্যাসের ভারতকথাকে বাঙালির উপযোগী করে পরিবেশনের জন্য। ব্যাসদেবের মহাভারতের অনুবাদ বাঙালির কাছে ‘অমৃত সমান’।
শুধু কাশীরাম দাস নয়, সঞ্জয়ের মহাভারত, পরমেশ্বরের মহাভারত উল্লেখযোগ্য। মহাভারতের কোন কোন অংশ অবলম্বনে রচিত হয়েছে পালাকাহিনী। যেমন অশ্বমেধ পর্ব, দাতাকর্ণের উপাখ্যান, দণ্ডী পর্ব প্রভৃতি।
চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে (কবিকঙ্কণ) ফুল্লরা ষোড়শী মূর্তিধারিণী দেবী চণ্ডীকে দূর করার জন্য মহাভারত থেকে পাতিব্ৰত্যের দৃষ্টান্ত দিয়েছে—
শুন শুন ঠাকুরাণী কহি আমি হিতবাণী
ইতিহাস কর অবধান।
ভারত বিধান ক্রমে শুনেছি পণ্ডিত ধামে
সতী সাবিত্রীর উপাখ্যান।।
ধর্মমঙ্গলেও রয়েছে মহাভারতের প্রভাব। যেমন, কাঙুর সমস্যা নিয়ে রাজ্যসভা তোলপাড়। কাঙুরের রাজাভয় দেখিয়েছে—‘গৌড় নিক লুটে’। সভাসদেরা বলেছেন, অধর্ম কখনও জয়ী হয় না—‘কোথা গেল দুর্যোধন-দুষ্ট দুরাচার’। এমন সময়ে সত্যই অত্যাচারী কাঙুররাজকে দমন করতে সভায় উপস্থিত হলেন ‘ধর্মের কিঙ্কর’ লাউসেন। মহাভারতের অন্তরঙ্গ প্রভাব এই ধরনের নতুন আঙ্গিক সৃষ্টি করে বাংলা সাহিত্যে নতুন বৈচিত্র্য সৃষ্টি করেছে।
মধ্য যুগের লোকসাহিত্যেও মহাভারতের প্রভাব পড়েছে। মহাভারতের কৃষ্ণকথা সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে লোকসাহিত্যকে। দাতা কর্ণের কাহিনী, শ্রীবৎস রাজার নানা উপাখ্যান লোকসাহিত্যের উপাদানরূপে গৃহীত হয়েছে। লোকপ্রবাদ রূপেও মহাভারতের প্রসঙ্গ লোকসমাজে ছড়িয়ে রয়েছে। যেমন ‘ঘরের ভিতরে কুরুক্ষেত্র’, ‘ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির’, ‘ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা’, ‘ভীমের গদা’, ‘রন্ধনে দ্রৌপদী’, ‘মাতুল শকুনি’, ‘ব্যাসকূট’, ‘বিদুরের খুদ’ প্রভৃতি।
আধুনিক যুগে বাংলা সাহিত্যেও মহাভারতের প্রভাব অপরিসীম। যেমন—
- কালীপ্রসন্ন সিংহের মহাভারতের গদ্যানুবাদ।
- মহাভারতের খণ্ড অংশ অবলম্বনে রচিত যাত্রা বাংলা সাহিত্যে যথেষ্ট। যেমন—তিনকড়ি বিশ্বাসের ‘অভিমন্যু বধ’, ‘সাবিত্রী সত্যবান’। হরিশ্চন্দ্র মিত্রের ‘নলদময়ন্তী’, ভক্তিমূলক কাহিনী রূপে ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘দুর্বাসার পারণ’, তিনকড়ি বিশ্বাসের ‘পাঞ্চালীর বস্ত্র হরণ’ প্রভৃতি যাত্রা রচিত হয়েছে।
- মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে আধুনিক যুগে রচিত হয়েছে নাটক। যেমন—
- মধুসূদন—‘শর্মিষ্ঠা’ (মহাভারতের শর্মিষ্ঠা-যযাতি-দেবযানীর কাহিনী অবলম্বনে রচিত)।
- রাজকৃষ্ণ রায়—যদুবংশ ধ্বংস।।
- গিরিশচন্দ্র ঘোষ—‘অভিমন্যু বধ’, ‘পাণ্ডবের অজ্ঞাতবাস’, ‘জনা’, ‘পাণ্ডবগৌরব’।
- ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ—ভীষ্ম, নরনারায়ণ।
- মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে রচিত কাব্যও আধুনিককালে রচিত হয়েছে। যেমন, মধুসূদন—‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (দুষ্মন্তের প্রতি শকুন্তলা, শান্তনুর প্রতি জাহ্নবী, অর্জুনের প্রতি দ্রৌপদী, দুর্যোধনের প্রতি ভানুমতী, জয়দ্রথের প্রতি দুঃশলা ও নীলধ্বজের প্রতি জনা)।
Leave a Reply