বাস্তববাদ সম্পর্কে আলোচনা কর।
বাস্তববাদ (Realism)
শিল্প-সাহিত্যে ‘বাস্তব’ শব্দটি এসেছে দর্শন থেকে। দর্শনে এর ব্যবহারে কখনো ‘শেমিনালিজম্’ বা কখনো আইডিয়ালিজমের বিপরীতার্থে। শিলার এবং স্লেগেল, এই দুই দার্শনিক অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে শিল্প সাহিত্যে ‘external reality’ অর্থে ‘realism’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা সাহিত্যে শব্দটিকে তেমনভাবে কাম্য মনে করেননি। নতুবা ১৭৯৮-এর একটি চিঠিতে শিলার গ্যেটেকে লিখতেন না যে—রিয়ালিজম্-এর প্রতি আসক্তি থেকে কেউ কবি হন না। আসলে যেহেতু ‘realism’ বলতে তখন ‘external reality’-র হুবহু অনুকরণ বোঝান হত। তাই সাহিত্যে এই শব্দের অনুপ্রবেশের তাৎপর্য শিলার-এর কাছে খুব সুখদায়ক মনে হয়নি। দীর্ঘকাল ধরে ভাববাদী রোমান্টিকদের কাছে ‘realism’, শব্দটি বাহ্যবস্তুর অনুকরণ ছাড়া কিছু ছিল না। এই অর্থেই ‘বাস্তব’ শব্দটিকে গ্রহণ করে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন—“বাস্তবিকতা কাঁচপোকার মতো আর্টের মধ্যে প্রবেশ করিলে তেলাপোকার মতো তাহার অন্তরের সমস্ত রস নিঃশেষ করিয়া ফেলে।’’ কিন্তু সত্যিই কি আর্টের মধ্যে বাস্তবতা প্রবেশ করলে তার অন্তরের রস নিঃশেষ করে ফেলে? এই উত্তরে বলা যায় যে, বাস্তবতা আর্টের অন্তরের রস নিঃশেষ করে না ফেলে, আর্টকে উজ্জ্বল করে তোলে এবং তার প্রমাণ বিগত এক শতকের বিশ্বের শিল্প-সাহিত্যে লক্ষ করা যায়।
‘external reality’-ই যদি সাহিত্যের ‘বাস্তব’ হয় তাহলে বিষয়টাই হয় বাস্তববাদী সাহিত্যের আধার, বিষয়ীর কোনো মর্যাদা থাকে না সেখানে। কিন্তু এমন সাহিত্য বা শিল্পের অস্তিত্ব কি সম্ভব যেখানে বিষয়ীর কোনো ভূমিকা থাকে না? হয়তো রোমান্টিক কাব্য ‘বিজয়ী’ প্রধান ‘বিষয়’ গৌণ। কিস্তু এর অর্থ এই হয় যে, রোমান্টিক কাব্যে বিষয়ের এবং বাস্তববাদী সাহিত্যে বিষয়ীর কোনো মূল্য নেই। তাই যদি হয় তাহলে রোমান্টিক কাব্যে শুধু কবির অলীক কল্পনা, এবং বাস্তববাদী সাহিত্য হল কতকগুলি বাস্তব ঘটনার সমাহারমাত্র। কিন্তু সাহিত্যের পাঠকমাত্রেই জানেন, একথা সত্য নয়। কি রোমান্টিক, আর কি বাস্তববাদী কোনো সাহিত্যই ‘মনের পরশ’ ছাড়া রচিত হয় না। এইখানেই ক্যামেরাম্যানের সঙ্গে চিত্রকরের মৌলিক পার্থক্য। শিল্পী, তিনি যে পদ্ধতিই অবলম্বন করুন না কেন, বস্তুজগৎ থেকে বিষয় গ্রহণ করেন মনের নির্বাচন দক্ষতা দিয়ে এবং তাকে যখন শিল্পমূর্তিতে স্পষ্ট করে তোলেন তখন ‘মন’-ই তার প্রধান সহায়। সুতরাং জগতের উপর মনের কারখানা, মনের উপর বিশ্বমানের কারখানা এবং সাহিত্যের সৃষ্টি সেই উপরতলা থেকে, রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্য বাস্তববাদীদের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। বাস্তববাদী রুশ-দার্শনিক রেলিনস্কির মুখে গত শতকের প্রথমার্ধে শোনা গিয়েছিল— “Fidelity to nature is not the be all and end all of art”। লেখকের কল্পনা, মর্জি, যুক্তিবুদ্ধির খুবই মূল্য স্বীকার করতেন তিনি, যেহেতু শিল্পের জগৎ ছিল তার কাছে নতুন সৃষ্ট এক জগৎ— “Art is the representation of reality, the republicated, or, as it were, newly created world.” এই নতুন জগতে, তাঁর মতে, সত্যের সঙ্গে কল্পনার, বিজ্ঞানের সঙ্গে শিল্পের কোনো দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক তো নেই-ই, বরং তারা পরস্পরের সহযোগী। শিল্প সাহিত্যের জগতের সঙ্গে বিজ্ঞানের জগতের পারস্পরিক বৈপরীত্যকে একটি স্বীকৃত সত্যরূপে গ্রহণ করেছিলেন ভাববাদীরা। বিজ্ঞানের জগৎ তাঁদের কাছে ভাবনা ও চিন্তার জগৎ, বস্তুর জগৎ অন্যদিকে শিল্প-সাহিত্যের জগৎ ভাব ও আবেগের জগৎ তথা কল্পনার জগৎ। কিন্তু বেলিনস্কির মতে, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের পার্থক্য ভাব ও ভাবনার পার্থক্য নয়, এই পার্থক্য রূপায়ণপদ্ধতিগত। সাহিত্যের কাজ প্রদর্শন, বিজ্ঞানের কাজ প্রমাণ। সুতরাং তাঁর সিদ্ধান্ত হল— “……atr and science are equally indispensible, and nither science can replace art nor art replace science.” এখন প্রশ্ন হল বিজ্ঞানের এই ক্রমোন্নতির দিনে মানুষ যখন চিরকালীন বিশ্বাস ও ভরসার জগৎ থেকে নির্বাসিত হয়ে বস্তুজগৎকে অবলম্বন করতে শুরু করেছে তখন একজন শিল্পীর ভূমিকা কী হবে? তিনি কি কল্পলোকে বিশ্রাম করবেন, না কি সুখ-দুঃখ ভরা যে বাস্তবজীবন তাকে গ্রহণ করবেন? আসলে মনে রাখতে হবে যে, একজন শিল্প তার দেশ-কালের সন্তান। ফলে শুধুমাত্র স্বাতন্ত্যের জোরে তিনি তাঁর সমকালকে অস্বীকার করতে পারেন না। পারেন না যুগের চাহিদাকে বিসর্জন দিতে। যেহেতু তাঁর কাল ও পরিবেশ থেকে শিল্পী তার প্রাণের রস সঞ্চয় করে থাকেন, সুতরাং সেই কাল ও পরিবেশকে অস্বীকার করা সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে।
যারা চিরন্তন-সাহিত্যের কথা বলেন তাঁদের প্রধান যুক্তি হল—স্থান বা যুগের পরিবর্তন হলেও মানবপ্রবৃত্তি যেহেতু অপরিবর্তনশীল এবং মানবহৃদয় ও মানবচরিত্রই সাহিত্যের উপজীব্য অতএব ক্ষণ-চঞ্চল সমস্যাকে সাহিত্যের বিষয়ীভূত করলে সে সাহিত্য চিরজীবী হতে পারে না। শেক্সপীয়র বা কালিদাস চিরন্তন সাহিত্যের স্রষ্টা, যেহেতু কোনো বিশেষ দেশকালের স্পর্শ লাগেনি তাঁদের সৃষ্টিতে। কিন্তু এ যুক্তি খুব কঠোর ভিত্তির উপর স্থাপিত নয়। স্রষ্টা হিসেবে কালিদাস বা শেক্সপীয়র চিরম্তন সাহিত্যের স্রষ্টা, যেহেতু কোনো বিশেষ দেশকালের স্পর্শ লাগেনি তাদের সৃষ্টিতে। কিন্তু এই যুক্তি খুব কঠোর ভিত্তির উপর স্থাপিত নয়। স্রষ্টা হিসেবে কালিদাস বা শেক্সপীয়র তাদের যুগের সন্তান, এই হচ্ছে সত্য। বিক্রমাদিত্যের কাল বা এলিজাবেথীয় যুগ দ্বিতীয় একজন কালিদাস বা দ্বিতীয় একজন শেক্সপীয়র দেয়নি বলেই যে এঁরা দেশ-কালের সঙ্গে নিঃসম্পর্কিত তা অবশ্যই নয়। দ্বিতীয়ত, মানবহৃয়ের প্রবৃত্তিগুলি শাশ্বত হলেও তাদের প্রকাশ চিরকাল এক নয়। সমাজের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক নিত্য পরিবর্তনশীল। সমাজের সমস্যা ও উৎপাদন ব্যবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়ে থাকে। যে-অবস্থায় মূলবোধের পরিবর্তন ঘটেছে, বঞ্চনা ও শোষণের স্বরূপ বদল হয়েছে সেই অবস্থান সাহিত্যের বিষয়বস্তু, জীবন সম্পর্কে সাহিত্যিকদের বোধ নিশ্চয়ই প্রাচীন কোনো আদর্শে বদ্ধ হয়ে থাকতে পারে না। বুশযুগ ও পরিবেশের সন্তান হিসেবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির নিত্য নতুন সমস্যা সাহিত্যিক অঙ্গীকার করতে বাধ্য। বস্তুবাদী দার্শনিক চেরনিশেভস্কি ও ভোব্রোলিউবফ বলেছিলেন, বাস্তবজীবনে যার অস্তিত্ব নেই, সাহিত্যে তা কদাপি রূপায়িত হবে না। সাহিত্য হবে প্রচারের মাধ্যম এবং কেমনভাবে এই প্রচারকার্য সম্পন্ন হয় তার উপর নির্ভর করে সাহিত্যের মর্যাদা। এখন প্রশ্ন হল, বাস্তবের কোনটি শিল্পী গ্রহণ করবেন এবং কোনটি বর্জন করবেন? এর উত্তরে বলা যায়, মানুষের জীবনের মূল-সমস্যা কেন্দ্রীভূত যেখানে, শিল্গীর সৃষ্টির উপাদানও সেখানেই মিলবে। মানুষের প্রবৃত্তিগুলি স্থান কালোত্তীর্ণ। সুতরাং মানব-সম্পর্কের বিকাশ বিষয়ে সচেতন শিল্পীরা চিরকালই দেশকালোত্তীর্ণ হয়ে থাকেন। কিস্তু সংশয়বাদীরা এই প্রশ্ন উত্থাপন করতেই পারেন যে, দেশের গণ্ডি অতিক্রম করতে পেরেছেন বলে কালের গণ্ডি অতিক্রম করতে তীরা পারবেন নি? এর উত্তরে বলা যায় যে, শতাব্দীর বাধা ভেঙেছেন এঁরা, একালের পাঠকেরাই তার প্রমাণ। তবে যেহেতু ভবিষ্যতের কথা সুনিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় তখন সংশয় করাটাও নির্থক। কিন্তু প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ত্রুটি-বিচ্যুতি সমালোচনা করে বাস্তববাদী সাহিত্যিকেরা সাধারণ মানুষের প্রতি তীদের যে সহানুভূতি দেখিয়েছেন, বঞ্চিতের সংগ্রামী ছবি এঁকেছেন তার জন্যই আগামীকাল স্মরণ করবে তাঁদের।
শুধু বিষয়ের গুণে কেউ শিল্পী নন, ‘দৃষ্টি’ ও ‘সৃষ্টি’—এই দুই-এ মিলে তবে একজন শিল্পী হন। ১৮৩১-এ ফরাসি বাস্তববাদী ঔপন্যাসিক বালজাক বলেছিলেন, বই লেখার আগে লেখককে হতে হবে মানবচরিত্র বিশ্লেষণ ও রূপায়ণে দক্ষ, মানুষের বিচিত্র প্রকৃতি ও অনুভূতির সঙ্জো সুপরিচিত এবং গভীর চিন্তাশক্তির অধিকারী। অর্থাৎ অভিজ্ঞতা, অনুভূতি ও রূপায়ণ দক্ষতা এই তিনটি উপাদানের উপরই লেখকের সাফল্য নির্ভর করে বলে মনে করতেন বালজাক। স্তাদাঁলও উপন্যাসকে শুধু বাস্তব ঘটনার সমাহার রূপে দেখেননি। তাঁর মতে, উপন্যাস হচ্ছে এমন একখানি ‘আরশি’ যেখানে ‘নীল আকাশ’ ও ‘কর্দমাক্ত পথ’ দুই-ই স্পষ্ট প্রতিবিম্বিত হয় পুশকিন, স্তাদাঁল, বালজাক ও ফ্লোব্যার থেকে আরম্ভ করে হেনরি জেমস্ পর্যন্ত বা তার কোনো বাস্তববাদীই শুধু ‘কর্দমাক্ত পথ’-এর রূপ ফুটিয়ে তোলেননি তাঁদের সাহিত্যে। অথচ ভাববাদীরা বাস্তববাদীদের সম্পর্কে একথাই বলেন যে, এঁদের কাছে ফুল অপেক্ষা কর্দম বাস্তব, যা নীচে থাকে তা তত বাস্তব। আসলে বাস্তবাদীরাই প্রথম নীচুতলার মানুষের দুঃখদৈন্যের ছবি ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন, সক্ষম হয়েছিলেন সামাজিক উৎপীড়ন ও শোষণের ক্লেদান্ত ছবি তুলে ধরতে, তাই তাঁদের বিরুদ্ধে ভাববাদীদের এই অভিযোগ। ইতিহাস খুঁজলে দেখা যাবে, ফ্রান্সে যখন স্তাদাঁল বালজাকের যুগ, তখন ফ্রান্সে গৌরবময় অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে, শুরু হয়েছে অবক্ষয়ের পালা। এই অধঃপতনের অস্ত্ররূপে পূর্বসূরীদের মতো আত্মজৈবনিক রচনা না লিখে ফুটিয়ে তুললেন পুঁজিপতিদের সুতীব্র অর্থলালসা, চারিত্রিক অবিশুদ্ধতা, মাত্রাতিরিক্ত ইন্দ্রিয়াসক্তি ও গোপন ব্যভিচারের ছবি। বালজাক তাঁর বিখ্যাত ‘ড্রোল স্টোরিজ’-এ বিত্তবান পরিবারের মানুষগুলো চরিত্রের বিভিন্ন দিকের দৈন্যকে ফুটিয়ে তুললেন নিপুণ সমালোচকের দৃষ্টিকোণ থেকে। ডাস্টয়েভস্কির ‘Crime and Punishment’ ফ্লোব্যার এর ‘বাদাম বোভারি’ প্রভৃতি রচনায় ধনতন্ত্রের কুফলের ছবি আছে। সুতরাং রবীন্দ্রনাথ কথিত ‘মানবচরিত্রের দীনতা’ হার্বটরীড কথিত “aspect of life…least flattering to human dignity” বালজাক প্রমুখের উপন্যাসে আপাতভাবে সত্য বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। কিন্ত স্তাদাঁলের, জুলিয়েঁ শেরেল, বালজাকের Raphael প্রমুখ তাঁদের মুক্ত হৃদয় ও আদর্শবোধ নিয়ে সংগ্রাম চালিয়েছে ধনতন্ত্রের অনিবার্য কুফলের বিরুদ্ধে। বালজাক জানতেন অভিজাতদের কথা, নয়া বিত্তবান শ্রেণির কথা। তাই ধনতন্ত্রের ধংসকে অনিবার্য জেনেছিলেন, সহানুভূতি প্রকাশ করেছিলেন শ্রমজীবীর প্রতি।
যে পদ্ধতিতে ফ্রান্সে বাস্তবজীবন-সমস্যাকে রূপায়িত করেছিলেন বালজাক প্রমুখ শিল্লীরা, সেই একই পদ্ধতি রুশ-সাহিত্যে ব্যবহার করলেন পুশকিন-গোগোল-আলেকজান্দার এবং কিছুটা অন্যরকম বললেও লিও-তলস্তয়, আর ইংরেজি-সাহিত্যে ডিফেন্স ও হেনরি জেমস্ প্রমুখ। পুশকিন বিশ্বাস করতেন পরিবেশ ও পরিস্থিতির উপর নির্ভর করেই মানবচরিত্র গড়ে ওঠে; আর তাই তিনি তাঁর নায়কের কারণ সন্ধান করেছিলেন সামাজিক ঘটনার মধ্যে। পুশকিন কৃষক বিদ্রোহের কাহিনী নিয়ে লিখলেন The Cap। এই উপন্যাস লেখার সময় তিনি যথার্থ বাস্তববাদীর দৃষ্টি নিয়ে কাজান, ওরেনবার্গ, আরও বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে বেড়িয়েছিলেন। অর্থাৎ জীবনকে বাস্তবতার পটে চিত্রিত করতে চেয়েছিলেন। গোগোলের রচনার যথাযথতা, অস্ট্রোভস্কির দাসত্ব বিরোধী-জীবন-মুক্তি-কামনা, এঁদের সমাজ জীবনের সঠিক বিশ্লেষণ দক্ষতা ও সাহিত্যের বর্ণনায় বাস্তবানুগত্য প্রমান করে। টলস্টয় এঁদেরই মতো ধনতন্ত্রের সমালোচক। ফরাসি ও রুশ সাহিত্যে বাস্তববাদীরা যেভাবে সমালোচনা করেছিলেন, সেই পদ্ধতিতেই ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নগ্ন চেহারা তুলে ধরেছেন ‘ডেভিড কপারকিল্ড’, ‘বিল্ক হাউস’ প্রভৃতি গ্রন্থের প্রণেতা চার্লস ডিফেন্স।
এখন ঊনবিংশ শতকের ফরাসি, রাশিয়া ও ইংরেজি সাহিত্যের বাস্তববাদীদের যে স্বভাবধর্ম তাঁদের সৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল—
- বিশ্লেষণ-প্রবণতাই এঁদের রচনার প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
- ব্যক্তির সঙ্গে তার পরিবেশের ছন্দ এঁদের সকলের রচনারই উপজীব্য বিষয়।
- শ্রম ও পুঁজির দ্বন্দ্বের নিখুঁত ছবি এঁকেছেন এরা।
- ধনতন্ত্রের চাপে ব্যক্তিহৃদয়ের যন্ত্রণার ভাষ্যকার এই বাস্তববাদীরা।
- বর্ণনায় যথাযথতা বজায় রাখতে চেয়েছেন সকলে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, মোটামুটি তত্ত্বগতভাবে বাস্তববাদীরা এই সত্য মানতেন যে, সাহিত্যের বিষয়বস্তু হবে বাস্তবজীবনকেন্দ্রিক, সমস্যা হবে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণের সঙ্গে সম্পর্কিত, চরিত্র হবে সজীব, প্রাণবান। লেখক হবেন জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ এবং তাঁর বর্ণনা হবে যথাযথ। কিন্তু লক্ষ করলে দেখা যাবে, এই বাস্তববাদীরা জীবনের দ্বন্দ ও সংকটের ছবি তুলে ধরলেও সামাজিক কাঠামো পরিবর্তনের কোনো ইঙ্গিত দেননি। বালজাক স্পষ্টই মনে করতেন এই পরিবর্তন উপরের কোন শক্তি দ্বারা সাধিত হবে। ব্রান্ট এবং ডিফেন্সও পরিবর্তন চেয়েছেন, কিন্তু এঁরা কেউই সমাজের স্থিতাবস্থার পরিবর্তন কামনা করেননি। এই জাতীয় বাস্তববাদীদের গোর্কি ‘Critical Realists’ নামে চিহ্নিত করেছেন। বাংলা সাহিত্যে এই বাস্তবতার চিত্র ফুটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, তারাশঙ্করের মতো মহান শিল্পীরা। রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিক, তাই জীবনের গোড়ার দিকে সাহিত্যে কোনো রকম বাস্তবতার অনুপ্রবেশককে সহ্য করেননি। অবশ্য পরবর্তীকালে শুধু আপত্তি তুলেছিলেন বাস্তবের নামে জঘন্যতার আমদানির বিরুদ্ধে। রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং ‘রক্তকরবী’ও ‘রথের রশিতে’ বাস্তবজীবন-সমস্যার রূপ দিয়েছেন। ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসে সন্দীপের মতো এবং ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদনের মতো বাস্তব চরিত্র অঙ্কন করেছেন। কিন্তু যেহেতু রবীন্দ্রনাথ মানুষের অনন্ত সম্ভাবনায় বিশ্বাস করতেন তাই রক্তকরবীতে যক্ষপুরীর বঞ্চিত মানুষগুলিকে একটি বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে না দেখিয়ে রাজারই ভিতর থেকে জাত ভূমিকম্পে তার আত্মার জাগরণ দেখিয়েছেন। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসগুলিতেও আছে আমাদের সামন্ততান্ত্রিক গ্রামীণ সমাজের দীর্ঘকালীন অন্ধ বিশ্বাস, কুসংস্কার এবং বঞ্চনা ও শোষণের বেদনাদায়ক আলেখ্য। কিন্তু শরৎচন্দ্রও সত্যের প্রতিলিপিকর মাত্র, সমাজ-মুক্তির পথ প্রদর্শক নন। আর তারাশঙ্কর দেখেছেন প্রাচীন সামন্ততন্ত্রের তিরোধান, কলকারখানাভিত্তিক ধনতন্ত্রের প্রসার। তিনি ধনতন্ত্রের সমালোচক;
কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন অতীতে সামন্ততন্ত্রের জন্য। ‘Critical Realist’-রা অনেকেই এই পশ্চাদমুখীনতার ত্রুটিতে ভুগেছেন; শুধু তারাশঙ্কর নন। বালজাকও অভিজাততন্ত্রের রুচির সমর্থক ছিলেন। এঁরা জীবনসমস্যার সমাধানের যে ইঙ্গিত দিয়েছে তার মধ্যেও কিছুটা পশ্চাৎপরতা। ধনতান্ত্রিকেরা তাদের পুঁজির বিকাশে সবচেয়ে সহায়তা পেয়েছে বিজ্ঞানের কাছে, যন্ত্রের কাছে। কিন্তু কলকারখানায় শ্রমজীবী মানুষগুলি শুধু যন্ত্র-দাসেই পরিণত হয়েছে। ফলে মানুষে মানুষে তৈরি হয়েছে একধরনের বিচ্ছিন্নতা alienation, বা এই alienation ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার এই অনিবার্য অভিশাপ। এই অবস্থার পরিবর্তন যদি হয় তো তা আসবে শ্রমিকদের তরফ থেকেই। কিন্তু ‘Critical Realist’ বা কৃষক বা শ্রমিকদের দুঃখ সহানুভূতি প্রকাশ করলেও এদের শক্তির
বিস্ফোরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই যক্ষপুরীর কাওয়াল, বিশু শুধু সংখ্যা, নামহীন সংখ্যার দল, তারা রাজার প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি নয়। শরৎচন্দ্রের গফুর সেই অত্যাচারিত কৃষক সে বিচারের আশায় ঈশ্বরের শরণাপন্ন হয়।
আসলে বাস্তবকে অস্বীকার করে কেউই সাহিত্যিক তথা মহৎ সাহিত্যিক হন না। আবার বস্তুর দর্পণ রূপেও ‘সাহিত্য’ও হয় না। স্রষ্টা এবং সমালোচকের পৃথক দুটি সত্তার অভিন্ন মিলন ঘটেছিল রবীন্দ্রনাথের মধ্যে। রবীন্দ্রনাথ বস্তুকে স্বীকার করেও চৈতন্যের সর্বব্যাপী কর্তৃত্বে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই তিনি ভাববাদীরূপে পরিচিত। তিনি সাহিত্যকে সৌন্দর্যের সৃষ্টি এবং আনন্দদায়ক উপায় বলেই মনে করেন। সাহিত্য হল তাঁর কাছে অপ্রয়োজনের আনন্দ। অর্থাৎ সাহিত্যের আনন্দের সঙ্গে ব্যন্তিবিশেষের লাভ বা ক্ষতির কোনো সংযোগ নেই। শুধু ব্যক্তি নয়, কোনোরকম সামাজিক লাভ-ক্ষতির সঙ্গেও সাহিত্যের সম্পর্ক তিনি স্বীকার করেননি। বস্তুবাদী সাহিত্যতত্ত্বের সামাজিক উপযোগিতা একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ।
রবীন্দ্র-বিরোধীরা রবীন্দ্র-সাহিত্যের এই বস্তুতন্ত্রহীনতা এবং লোকহিত সাধনে তাঁর অমনোযোগের দিকটি নিয়ে বিশদ সমালোচনা করেছেন। এই কটাক্ষপাতকে লক্ষ করে কবি ১৩২১ এর ‘বাস্তব’ প্রবন্ধে কবি বলেছিলেন—“উপরস্তু লোকশিক্ষার কী হইবে। সে কথার জবাবদিহি সাহিত্যিকের নহে।’’ পরে ‘লোকহিত’ প্রবন্ধে এই কথাটিই আরও স্পষ্ট ভাষায় জানালেন—“আমরা যেমন অন্য মানুষের হইয়া খাইতে পারি না, তেমনি আমরা অন্য মানুষের হইয়া বাঁচিতে পরি না।’’ ‘তথ্য ও সত্য’ প্রবন্ধে কবি বলেছেন—“তথ্যের মধ্যে সত্যের প্রকাশই হচ্ছে প্রকাশ।’’ প্রকাশ বলতে তিনি প্রকাশিত সাহিত্য রূপকে বোঝাচ্ছেন। সুতরাং তাঁর বন্তব্য হল তথ্যের মধ্যে সত্যের প্রকাশিত রূপই হচ্ছে সাহিত্য। বস্তুবাদীরাও মনে করেন যে সাহিত্য প্রাত্যহিক জীবনের তথ্যের সংকলন মাত্র নয়। বস্তুবাদী হাওয়েলস মনে করেন, সাহিত্য জীবনের ঘটনাবলীর ‘মানচিত্র’ নয়, বর্ণনয় ‘চিত্র’। রবীন্দ্রনাথ বস্তুবাদীদের এভাবে বোঝেননি। তাঁর বিশ্বাস, বস্তুবাদীরা বিশুস্ক প্রেমহীন বাস্তব জীবনের ঘটনা রূপায়ণেই অধিক মনোযোগী। আসলে বাস্তববাদীদের সাহিত্যদর্শের প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিরূপতার একটি প্রধান কারণ হল, সাহিত্যের উপযোগিতার প্রশ্ন। বস্তুবাদী-সাহিত্য হল উদ্দেশ্য-প্রধান সাহিত্য। একথা ধরে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ বললেন—“বাস্তব ব্যবহারের যার মূল্য নেই যাকে কেবল একান্তভাবে বোধ করা যায়, তারই প্রকাশ সাহিত্যকলা, রসকলায়।’’ কিন্তু প্রয়োজনের বিষয় নিয়ে কেন সাহিত্য লেখা সম্ভব নয়? প্রতিদিনের সংসার যার ঠাঁই সাহিত্যের ভোজে তার ঠাই হবে না কেন? রবীন্দ্রনাথ তলস্তয়ের ‘আনা কারেনিনা’কে যতই sickly বই বলুন না কেন বিশ্বের তাবৎ রসিকেরা তা মানেন না। আসলে রবীবন্দ্রনাথ রোমান্টিক বলেই মনে হয়, বস্তুবাদীদের সাহিত্যদর্শনের মূলে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না তাঁর পক্ষে। পৃথিবীতে এমন অনেক বস্তুবাদী সাহিত্যে আছে যার মূল্য কম নয়। গোর্কির ‘মাদার’ কি উন্নত শিল্পকর্ম নয়? তা কি প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গে পাঠককে আনন্দ দেয় না? নিশ্চয়ই দেয়, কিন্তু রোমান্টিক রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনের কথা ভেবেই বস্তুবাদী সাহিত্যকে মেনে নিতে পারেননি।
তথ্যসূত্র:
কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্ত | Download |
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাস | Download |
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরী | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাস | Download |
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যাল | Download |
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাস | Download |
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্ত | Download |
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত | Download |
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দী | Download |
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যাল | Download |
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেন | Download |
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায় | Download |
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষ | Download |
Leave a Reply