মনসামঙ্গল কাব্য রচনায় বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
বিপ্রদাস পিপিলাই
বিপ্রদাস বিজয়গুপ্তের সমসাময়িক কবি। তাঁর কাব্যের নাম ‘মনসামঙ্গল’ বা ‘মনসাবিজয়’। বিপ্রদাস পশ্চিমবঙ্গের সর্বপ্রাচীন কবি। সুকুমার সেন বিপ্রদাসকে প্রাচীন কবি রূপে স্বীকৃতি দিলেও আশুতোষ ভট্টাচার্য তা স্বীকার করেননি। বিপ্রদাস বর্তমান ২৪ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার বাদুড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বিপ্রদাসের আত্মবিবরণী
বিপ্রদাসের কাব্যে আত্মবিবরণী থেকে জানা যায় তার কাব্য রচনার কালের কথা। যেমন—
সিন্ধু ইন্দু বেদ শক পরিমাণ।
নৃপতি হুসেন শাহ গৌড়ের প্রধান।।
হেন কালে রচিল পদ্মার ব্রতগীত।
শুনিয়া ত্রিবিধ লোক পরম পীরিত।।
এই শ্লোক থেকে অনুমান করা যায় হুসেন শাহের রাজত্বকালে ১৪৯৫ খ্রিস্টাব্দে (১৪১৭ শকাব্দ) কাব্যটি রচিত হয়। সুকুমার সেনও বলেছেন—“মনসামঙ্গল পঞ্চদশ শতাব্দ শেষ হইবার আগেই পরিণত এবং পরিপূর্ণ কাব্যরূপ ধারণ করিয়াছিল। তাহার ইঙ্গিত বিপ্রদাসের মনসাবিজয়ে পাই। বিপ্রদাসের কাব্যটি রচিত হইয়াছিল পঞ্চদশ শতাব্দের শেষ দশকে।” তবে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ভাষারীতির সাক্ষ্যে এই কাব্যের রচনাকালকে ষোড়শ শতাব্দীর পূর্বে নিয়ে যেতে রাজী নন। কাব্যের প্রকৃত নামটিও পরিষ্কার নয়। ‘মনসামঙ্গল’, ‘মনসাবিজয়’ ও ‘মনসাচরিত’ তিনটি নামই পাওয়া যায়।
বিপ্রদাস তাঁর কাব্যের শুরুতে যে আত্মপরিচয় দিয়েছেন, তা থেকে জানা যায় তিনি বৈশাখ মাসে শুক্লা দশমী তিথিতে দেবী মনসার স্বপ্নাদেশে কাব্য রচনা করেন। শুক্লা দশমী তিথি বৈশাখ মাসে।/শিয়রে বসিয়া পদ্মা কৈলা উপদেশে।।” তিনি বাৎস্য গোত্রের পিপলাই শাখার (পৈলাদ) সামবেদের অন্তর্ভুক্ত ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন। কবিরা চার ভাই। পিতার নাম মুকুন্দ পণ্ডিত।
বিপ্রদাসের কবিকৃতিত্ব
প্রথমত: কাহিনিয়নে বিপ্রদাস ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন। কাহিনি বর্ণনার ক্ষেত্রে বাস্তবতা বজায় রেখেছেন। বর্ণনাভঙ্গিও জীবন্ত। তাঁর কাব্যে হাসান হোসেনের পালাটি বৃহৎ ও সুচিত্রিত। এই পালায় মুসলমান সমাজের চিত্র চিত্রিত হয়েছে। যেমন—
মিঞা যবে ফৌত হইল গোলামের ঘোষ পাইল
বিবি লইয়া পলাইতে চায়।
অন্যান্য কবিরা যেখানে বেহুলা লখিন্দরের কাহিনিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন সেখানে বিপ্রদাস সমগ্ৰ কাহিনিকে সুবিন্যস্ত করেছেন। সেজন্য সুকুমার সেন বলেছেন—“মনসার কাহিনি সম্পূর্ণ এবং সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে বিপ্রদাসের কাব্যেই মিলে।” কবি তাঁর গ্রন্থের প্রারম্ভে তার বর্ণিতব্য বিষয়ের একটি সংক্ষিপ্তসার দিয়েছেন ও শেষে উল্লেখ করেছেন—
সংক্ষেপে পদ্মার ব্রত কহিল মঙ্গলগীত
বিস্তারে কহিব সপ্তনিশি।।
আশুতোষ ভট্টাচার্য এই প্রসঙ্গে মনে করেন— “ইহাতে মনে হয় সাতটি পালায় তিনি তাঁহার গীত সম্পূর্ণ করিবেন সঙ্কল্প করিয়াছিলেন। কিন্তু উক্ত বৃহত্তর পুঁথিখানিতে নয়টি পালা পর্যন্ত রচিত হইয়াছে এবং যেখানে নবম পালা শেষ হইয়াছে, সেখানে পুঁথিও খণ্ডিত হইয়াছে।” সে যাই হোক, ব্রতকথা ও ব্যালাড-এর অনুসরণে কবি কাহিনি কল্পনা করেছিলেন বলে মনে হয়। কারণ এই দুই লোককথার বৈশিষ্ট্য তার কাব্যে রয়েছে। তাছাড়া তিনি নিজের কাব্যকে ‘ব্রতগীত’ও বলেছেন।
দ্বিতীয়ত: চরিত্রচিত্রণে বিপ্রদাসের অভিনবত্ব দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কেননা মনসা চরিত্রটি বেশিরভাগ কাব্যে বেশ নির্মম ও কঠোর চরিত্ররূপে চিত্রিত। কিন্তু বিপ্রদাসের কাব্যে মনসা স্নেহময়ী করুণারূপিনী মূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছেন। হাসন যখন ভক্তির বশে দেবীর পূজা করেছেন তখন মনসার স্বরূপ চিত্রিত হয়েছে এভাবে—
হাসন এতেক যদি করিল স্তন।
মনসা ব্যথিত অতি হইলা তখন।।
অধিক বাড়িল দয়া আপন কিঙ্করে।
ডাকিয়া বলেন মাতা মধুর সুস্বরে।।
তাই অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন— “বেহুলা মনসা-চাঁদের পারস্পরিক চরিত বর্ণনায়ও মনসাকে করুণাময়ী করিয়া আঁকিবার চেষ্টা লক্ষণীয়। ইহাও কাহিনিটির আধুনিকতার ইঙ্গিত করিতেছে।”
অন্যদিকে চাঁদের চরিত্রে খানিকটা অসামঞ্জস্য লক্ষ করা যায়। কেননা কাব্যের শেষে চাঁদ সাড়ম্বরে মনসার পূজা করেছেন—
অনেক প্রকারে স্তুতি করে চাদো রাজা।
নানাবিধ প্রকারে করয়ে পদ্মা পূজা।।
চাঁদ তার মনসা বিরোধিতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে মনসার কাছে শান্তি প্রার্থনা করেছে—
মক্তক উপরে করো চরণ প্রহার।
দোষ নিন্দা এবে শাক্তি হউক আমার।
তৃতীয়ত: হাস্যরস সৃষ্টিতে বিপ্রদাসের কৃতিত্ব যথেষ্ট। যেমন, লখিন্দরের বিবাহ রাত্রিতে চাদের বর্ণনা—
চাদো রাজা নাচে কান্ধে হেতালের বাড়ি।
ঝলমল করে মুখে পাকা গোঁফ দাড়ি।
চতুর্থত: করুণরসের বর্ণনায়ও কবির কবিত্বশক্তি প্রকাশ ঘটেছে। পুত্রের মৃত্যুতে চাঁদের শোক এভাবে বর্ণিত হয়েছে—
কান্দিয়া করুণা ভাবে চাদো নরপতি।
পুত্র পুত্র বলিয়া সম্রমে পড়ে ক্ষিতি।।
কত পাপ কৈ মুঞি জন্মিয়া ভূতলে।
কত দুঃখ বিধি মোর লিখিল কপালে।।
সুতরাং বিপ্রদাসের কাব্যের রচনাকাল নিয়ে সংশয় থাকলেও তাঁর কাব্য পশ্চিমবঙ্গে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল এবং কবি হিসাবে বিপ্রদাসের কৃতিত্বও প্রশংসনীয়।
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply