//
//

‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধের স্বরূপ ব্যাখ্যা কর।

  • সংসারে মানুষ যে আপনাকে প্রকাশ করিতেছে সেই প্রকাশের দুইটি মোটা ধারা আছে। একটা ধারা মানুষের কর্ম; আর একটা ধারা মানুষের সাহিত্য।
  • মানুষ আপনার প্রয়োজনের সংসারের ঠিক পাশে-পাশেই একটা প্রয়োজন ছাড়া সাহিত্যের সংসার রচনা করিয়া চলিয়াছে।
  • নিজের ভাব-সৃষ্টি দ্বারা নিজের এই যে বিস্তর রচনা করিতেছে, সংসারের চারিদিকে যাহা একটি দ্বিতীয় সংসার, তাহাই সাহিত্য। ‘বিশ্বসাহিত্য’ প্রবন্ধ অবলম্বনে মন্তব্যদুটি বিচার কর।

উপনিষদে ব্রহ্মস্বরূপের যে তিনটি ভাগ করা হয়েছে তা মানব আত্মা সম্পর্কেও প্রযোজ্য। সেই তিনটি ভাগ হল— আমি আছি, আমি জানি এবং আমি প্রকাশ করি। আমি আছি এই নিয়েই তো মানুষের বিচিত্র কর্মপ্রবাহ। সংসারে জীবনধারণ ও জীবিকা নির্বাহের জন্য তাকে নানান সংগ্রহ, রক্ষা এবং গঠনের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। কবি জানেন এর তাগিদে মানুষ বিশ্বের রূপ ও রহস্য অধিকার করতে চায়। এই জানার দরকার বিপুল, এবং ক্রমশই তা ব্যাপ্তি লাভ করছে। জ্ঞান-বিজ্ঞানকে জ্ঞানময় প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গত করে জানা প্রকৃত জানা। প্রাণময় প্রকৃতির মাধ্যমে জানতে চাইলে তা সম্পূর্ণ হয় না। আমি আছি, কেবলমাত্র এই আত্মরক্ষার তাগিদ যখন অহংবোধকে আশ্রয় করে তা নিতান্ত সংকীর্ণ মনোভাবের পরিচয় দেয়। কিন্তু এই আত্মরক্ষার প্রয়াস যখন অপর কোন মানুষের বাঁচার এই অসীমতা বা মানবজীবনের আনন্দ মানুষ সাহিত্যে, চিত্রে ও ভাস্কর্যে প্রকাশ করে থাকে। এবং সেই প্রকাশে আত্মার ঐশ্বর্য দীপ্যমান হয়ে ওঠে। উত্তাপের ঐশ্বর্য যেমন আলোক, মানুষের অনুভূতি, আবেগ ও কল্পনার প্রকাশে আত্মার ঐশ্বর্য উদঘাটিত হয়। স্বার্থ যখন নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে সীমাবদ্ধ থাকে, তখন তা অবশেষের প্রসাদবঞ্চিত, দীনতার পরিচায়ক। আবার তাই যখন লােক কল্যাণে নিয়োজিত হয়, তখন তা নিখিলের আশীর্বাদ লাভ করে থাকে।

কর্মক্ষেত্রে মানুষ তার দেহ-মনের শক্তিও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে সমাজ, রাজ্য ও ধর্ম সম্প্রদায় গড়ে তুলছে। এর দ্বারা তার অভিপ্রায় প্রকাশ পাচ্ছে। এমনি করে যা ভাবের মধ্যে অস্পষ্ট ছিল, তা রূপ লাভ করে। এইভাবেই প্রত্যেক স্বতন্ত্র মানুষ আপন আকাঙ্ক্ষাকে নানা মানুষের গড়া সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে প্রকাশ করে চলেছে। এর ফলে সভ্যতা রূপ গ্রহণ করে। সমাজে বা রাষ্ট্রে যেখানে মানুষ অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে না, বিচ্ছিন্ন থেকে যায়, সেখানে তার অসংস্কৃত মনের প্রকাশ ঘটে। এই কারণে দেখা যায় যে, সভ্য সমাজে ও রাষ্ট্রে যখন আঘাত লাগে, তার প্রতিক্রিয়া সকল লোকের মধ্যে অনুভূত হয়। সমাজ যদি কোনভাবে সংকীর্ণ বা অনুদার হয়, সেখানে ব্যক্তির বিকাশে বাধা ঘটে। সংসারে সমাজ-বিন্যাস কিংবা রাষ্ট্রব্যবস্থা সুসংগত ও সুসংহত হলে মানুষ অবাধে আপন মনুষ্যত্বকে প্রকাশ করতে পারে। সাংসারিক কাজ মানুষের প্রকাশকে উপলক্ষ্য করেছে।

মুঘল সম্রাটরা তাঁদের রাজকীয় আড়ম্বর ও শক্তির দর্পকে প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রবাহে তা মুছে— “কালস্রোতে ভেসে যায়, জীবন যৌবন ধনমান’’। আধুনিক কালেও শক্তিমান শাসক সম্প্রদায়েরা তাঁদের দম্ভকে প্রকাশ করার চেষ্টা করেন। সম্রাট সাজাহান তাজমহল নির্মাণ করে তাঁর বিরহ বেদনার অলৌকিক আনন্দকে নিত্যকালের হাতে দান করে গেলেন। এখানে নিছক প্রকাশের আনন্দ অভিব্যক্ত হয়েছে বলে কালের কপোলতলে তাজমহল শুভ্র সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। উপনিষদে যেখানে বলা হয়েছে অনন্ত, তা পৃথিবীতে আনন্দ অমৃতরূপে প্রকাশিত। এই আনন্দের প্রকাশকে শক্তির দম্ভ আচ্ছন্ন করতে চায়, কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। প্রয়োজন সিদ্ধ হলে যে আনন্দ অনুভূত হয় তার শেষ আছে, আবার অবসাদও আছে। অন্যদিকে ছোটো ছোটো অনামী ফুল সূর্যের কিরণকে ধ্যান করে, সে ধ্যান অমৃতরূপে তাদের মধ্যে ব্যক্ত হয়। তারা হয়ত ঝরে পড়ে, কিন্তু তাতে কোন ক্ষতি নেই। বাইরে তারা না থাকলেও তারা আছে। কেননা তারা পূর্ণের পাদস্পর্শ লাভ করেছে। তারা সত্য ও পরম নির্ভরস্থল।

সুতরাং দেখা যায় যে, মানুষ কর্মক্ষেত্রে আপন অভিপ্রায়কে প্রকাশ করে থাকে। সেখানে ব্যক্তি পুরুষের প্রকাশ বাধাগ্রস্ত। কিন্তু জীবনে এমন দিন আসে যেদিন মানুষ নিজেকে ব্যক্ত করতে চায়। বাড়িতে যেদিন বিবাহ, খাম্বাজের করুণ তান আকাশে তার আঁচল বিছিয়ে দেয়, সেদিন সেই গৃহের পরিজনবর্গ মঙ্গল ও আনন্দকে প্রকাশ করতে চায়। দৈনন্দিন জীবনের উপরে প্রাত্যহিকতার যে আবরণ থাকে, উৎসবের দিনে তা যেন অপসারিত হয়ে যায়। দীপ জ্বলে, বাঁশী বাজে, ফুল পাতার মালা দিয়ে ঘর সাজানো হয়, চারদিকে আনন্দের ধারা যেন প্রবাহিত হয়। হৃদয়ের ধর্ম হল, অন্তরের আবেগকে বাইরে প্রকাশ করা। কিন্তু এই যে প্রকাশ তা বাইরের জগতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে চলে। যে দেশে মানুষ বাস করে তা তার। কাছে সত্য হয়ে ওঠে। দেশ তার কাছে মৃন্ময়ী নয়, হৃদয়ের অনুভূতিতে তাহা ষড়ৈশ্বর্যময়ী। চিন্ময়ী সত্তায় পরিণত হয়। যেখানে প্রকাশের তাগিদ মানুষ সেইখানে নিঃস্ব হতেও রাজী। থাকে। তখন সে আর হিসেব-নিবেচনা করে না। আনন্দ প্রকাশ করতে গিয়ে বাজে খরচকেই অপরিহার্য কর্তব্য বলে মনে করে। হৃদয়ের গভীর আকাঙ্ক্ষাকে মানুষ নানা ভাবে বাইরে রূপ দিতে চায়। এইভাবেই সে জগৎকে নিজের ও নিজেকে জগতের উপযোগী করার জন্য ব্যাকুলতা প্রকাশ করে থাকে। প্রকাশের তাগিদ মানুষের অন্তরে যে কতখানি প্রবল তার প্রমাণ, অতীত যুগের বর্বর সৈন্যদলের যুদ্ধের উদ্যম থেকে। তারা নিছক জয়লাভের জন্য যুদ্ধ করতে যেত না, নানা ধরণের বাদ্যধ্বনি ও উল্লাসের মধ্যে দিয়ে অন্তরের হিংসাকে বাইরে মূর্ত করে তুলত।

প্রাচীন মিশর দেশে দরবেশের দল যখন ইংরেজ সৈন্য আক্রমণ করেছিল, সেদিন লড়াই ছাড়াও তারা উদ্দীপ্ত তেজকে প্রকাশ করতে চেয়েছিল। প্রতিটি মানুষ মৃত্যু বরণের মধ্যে দিয়ে নিজের অন্তরের দুর্বার কামনাকে ব্যক্ত করেছিল। এ যুগের যুদ্ধে জিগীষার তীব্র প্রকাশ নেই, পরিবর্তে আছে বুদ্ধির কৌশল, শত্রুপক্ষকে পরাস্ত করার প্রচেষ্টা। শিভালরির দিন অতীত হয়ে গেছে। মানুষ ভগবানের পূজা করে। বুদ্ধিমান ও হিসেবী ব্যক্তিগণ পূজার মাধ্যমে স্বার্থ আদায় করতে চায়, কিন্তু প্রকৃত ভক্ত তাঁর হৃদয়কে প্রকাশ করে চরিতার্থ হন। বুদ্ধিমানের পূজা যেন সুদে টাকা খাটানো এবং ভক্তিমানের পূজা সাংসারিক দৃষ্টিতে একেবারে বাজে খরচ। এই বেহিসেবী খরচ, তার মধ্যেই সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়। প্রকৃতির জগতে ফুল নিজেই বিকশিত হয়, মেঘ থেকে জলধারা নামে, বৃক্ষরাজি সবুজ শশাভায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে এই যাবতীয় কাজের পিছনে কোন প্রয়োজনের তাগিদ নেই, আছে কেবল পরিপূর্ণতা লাভের ঐকান্তিক প্রয়াস। জগৎ রসময় বলেই এখানে আনন্দযজ্ঞে সবার আমন্ত্রণ অবারিত।

অতএব, জগতে একদিকে কাজের প্রকাশ, অন্যদিকে ভাবের প্রকাশ ভাবের প্রকাশে আনন্দ বাক্ত হয়। এখানে তাই পরিপূর্ণতার আসন পাতা আছে। কাজের মধ্যে আমাদের আত্মরক্ষার ধর্ম এবং ভাবের মধ্যে আত্মপ্রকাশের তাগিদ পরিষ্ফুট হয়ে থাকে। এই ভাব নিয়েই সাহিত্যের কারবার। এইজন্য এখানে আত্মপ্রকাশের ক্ষেত্র অবারিত। জগতে সুখ-দুঃখ, বেদনা ও নৈরাশ্যের সংঘাতে আমাদের ব্যক্তিজীবন কোথাও প্রসারিত, আবার কোথাও বা সংকুচিত হয়ে থাকে। সাহিত্যজগতে দুঃখ-বেদনার পরিচয় থাকলেও তারা আমাদের জীবনে হস্তক্ষেপ করে না। তাই সাহিত্য দুঃখের উপলব্ধি আনন্দকর। কবির ভাষায়—দুঃখ আমাদের স্পষ্ট করে তোলে, আপনার কাছে আপনাকে ঝাপসা থাকতে দেয় না। গভীর দুঃখ তাই ভুখা। সাহিত্য সমস্ত মানবজীবনকে আশ্রয় করে বলে তা সুন্দর। Benedetto croce-র একটি অভিমত বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলেই এখানে তার উল্লেখ জরুরী। তিনি বলেছেন— ‘‘Art is essentially, free from practical interest… because in Art there is no suppression of any interest at all; rather art gives all our interests simultaneous free play in the image. It is only in this way that the individual image, transcending the particular and acquiring a value of totality becomes concretely individual.’’

সুতরাং সাহিত্য এক নতুন জগৎ রচনা করে। এই জগৎটি আবার আমাদের প্রয়োজনের সংসারের ঠিক পাশে অবস্থিত। বাস্তব জগৎ প্রয়োজনের সীমায় আবদ্ধ। কিন্তু সাহিত্যে মানুষের যা প্রাচুর্য ও ঐশ্বর্য তাই প্রকাশিত হয়ে থাকে। এখানে প্রয়োজনের কথা একেবারেই গৌণ। অতএব মানুষের প্রাণের দীপ্তি সাহিত্যে পরিস্ফুট হয়। সংসারে আমরা মানুষের পরিচয় পাই, কেবল দেখতে পাই তার শ্রেণিরূপটি। কিন্তু সাহিত্যে দেখি ব্যক্তিরূপের প্রকাশ। সেখানে মানুষের রূপের পরিচয় অবারিত বলে আমরা আনন্দ লাভ করে থাকি। ‘রামায়ণ’ পাঠে বসলে দারিদ্র্য লাঞ্ছিত ব্যক্তির জীবনে পঞ্চবটীর করুণামিশ্রিত বাতাস প্রবাহিত হয়। সাহিত্যস্রষ্টা আপনার বাস্তব অনুভূতিকে ভাবের সত্তায় পরিমার্জিত করে অনেকদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!