//
//

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বীণা থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

রাজকৃষ্ণ রায় ও বীণা থিয়েটার

৩৮ নম্বর মেছুয়াবাজার রোড, ঠনঠনিয়া, কলকাতা

প্রতিষ্ঠা: ১০ ডিসেম্বর, ১৮৮৭

স্থায়িত্বকাল: ১০ ডিসেম্বর, ১৮৮৭ – ডিসেম্বর, ১৮৯০

প্রতিষ্ঠাতা: রাজকৃষ্ণ রায়

নাটক: চন্দ্রহাস অথবা দ্বিতীয় প্রহ্লাদ (রাজকৃষ্ণ রায়)

কলকাতার ৩৮ নম্বর মেছুয়াবাজার রোডে কবি ও নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায় (১৮৪৯-১৮৯৪) তাঁর বীণা থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। কবি হিসেবে খ্যাতি ছিলই, নাট্যকার হয়েছেন রঙ্গমঞ্চের প্রয়োজনে ও তাগিদে। বীণা নামে তাঁর নিজের ছাপাখানা ছিল, সেখান থেকে ‘বীণা’ নামে পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। রঙ্গমঞ্চের নামও রাখলেন বীণা থিয়েটার।

রাজকৃষ্ণ রায় ভালো অভিনেতা ছিলেন। মাহেশ ও কলকাতায় তিনি বেশ কিছু অভিনয়ে অংশ নিয়েছিলেন। কলকাতায় আর্য নাট্যসমাজে তিনি নিজের নাটক ‘প্রহ্লাদ চরিত্র’-এ হিরণ্যকশিপুর ভূমিকায় নৈপুণ্য দেখান। ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে এই অভিনয়ের উচ্চ প্রশংসা করা হয়।

অতিমাত্রায় উৎসাহিত হয়ে তিনি নিজের থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। আর্থিক সঙ্গতি তেমন না থাকাতে রঙ্গমঞ্চটি খুব সুদৃশ্যভাবে গড়ে তোলা যায়নি। দৃশ্যপটও মহামূল্যের ছিল না—যদিও পারিপাট্য ছিল। বাইরের চাকচিক্যও তেমন ছিল না। তখনকার খ্যাতিমান নট-নটীদেরও তিনি সংগ্রহ করতে পারেননি। আর্য নাট্যসমাজের সঙ্গে যোগ থাকার ফলে সেখান থেকেই অভিনেতাদের সংগ্রহ করেছিলেন। তিনি তাঁর রঙ্গমঞ্চে অভিনেত্রী গ্রহণ করেননি। অথচ তখন কলকাতার সব মঞ্চেই অভিনেত্রীরাই নারী ভূমিকায় অংশগ্রহণ করছে। অভিনেত্রীপূর্ণ বাংলা থিয়েটারের সেই যুগে রাজকৃষ্ণ অভিনেত্রীদের বাদ দিয়েই অভিনয় করতে চেয়েছিলেন। কিছু নীতিবাগীশ মানুষ ও পত্রপত্রিকা তাঁকে এই কার্যে স্বাগত সমর্থন জানিয়েছিলেন সমাজনীতির কারণে। নাট্যাভিনয়ের পক্ষে তখন অভিনেত্রীদের বাদ দিয়ে থিয়েটার চালানো অসম্ভব ছিল।

রাজকৃষ্ণ রায় ছিলেন বীণা’র মালিক ও নাট্য পরিচালক। মূল নাট্যকারও তিনি। অভিনয়েও অংশগ্রহণ করেছেন।

১০ ডিসেম্বর ১৮৮৭, রাজকৃষ্ণের লেখা ‘চন্দ্রহাস’ (বা দ্বিতীয় প্রহ্লাদ) নাটক দিয়ে ‘বীণা’র উদ্বোধন হল। পরপর কয়েক রাত্রি ‘চন্দ্রহাস’ অভিনয়ের পর প্রহ্লাদ চরিত্র (৩১ ডিসেম্বর) দুর্গেশনন্দিনী, ভণ্ড দলপতি দণ্ড (২৫ ফেব্রুয়ারি, ১৮৮৮) অভিনয় হয়। রাজকৃষ্ণের লেখা চতুরালী (হায়-হায়, একি শুনি ভাই/আটক পড়েছে আমার বিনোদিনী রাই) এবং চন্দ্রাবলী গীতিনাট্যের (তুমি যে কত ভাল/চিকন কালোর বলব কত একটি মুখে) গান দুটি সে সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। প্রহ্লাদ চরিত্রও খুব প্রশংসা পেয়েছিল। অভিনয়ে ছিলেন: প্রহ্লাদ—শরৎ কর্মকার, ষণ্ড—অক্ষয়কালী কোঙার, হিরণ্যকশিপু—রাজকৃষ্ণ। সার্থক অভিনেতার সব গুণই রাজকৃষ্ণ রায়ের অভিনয়ে লক্ষ করেছিল ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকার নাট্য সমালোচক।

পত্র-পত্রিকা প্রশংসা করে উৎসাহিত করলেও দর্শক সমাগম ক্রমেই হ্রাস পেতে থাকলো। এই সময়ে কিছু ধনী ব্যক্তি অর্থ দিয়ে রাজকৃষ্ণকে সাহায্য করেছিলেন, যাতে বারাঙ্গনাবিহীন নৈতিকতার এই থিয়েটার টিকতে পারে। তা সত্ত্বেও দর্শক অভাবে রাজকৃষ্ণের আর্থিক সঙ্কট প্রবলতর হলো। অভিনেতারা সব অবৈতনিক, তা সত্ত্বেও থিয়েটারের আনুষঙ্গিক খরচ যোগানোও সম্ভব হচ্ছিল না। গিরিশচন্দ্র লিখেছেন— ‘‘স্বর্গীয় রাজকৃষ্ণ রায় বালক লইয়া অভিনয় করিতে গিয়া বহু আয়াস-সঞ্চিত সম্পত্তি বিনাশ করিয়াছিলেন।’’

কয়েকমাস থিয়েটার চালিয়েই ঋণগ্রস্ত রাজকৃষ্ণ দেনা শোধের আশায় বীণা থিয়েটার ভাড়া দিলেন ‘আর্য নাট্যসমাজ’কে।

১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বীণা থিয়েটারে আর্য নাট্যসমাজ অভিনয় শুরু করে। রাজকৃষ্ণ নিজেও আর্য নাট্যসমাজের নাটকগুলিতে অভিনয়ে অংশ নিতেন। অর্ধেন্দুশেখর মুস্তাফিও কিছুদিন এখানে যুক্ত থেকে অভিনয় করেন। সব চেষ্টাতেও তারা সফল হতে পারলো না। ১৮৮৮-এর নভেম্বর মাসেই ‘আর্য নাট্যসমাজ’ তাদের অভিনয় বন্ধ করে দেয়।

ঋণগ্রস্ত রাজকৃষ্ণ বীণা থিয়েটার ভাড়া দিলেন এবার উপেন্দ্রনাথ দাসকে। নাটক করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে অভিযুক্ত উপেন্দ্রনাথ এতদিন বিলেতে ছিলেন। বিলেত থেকে ফিরে এখানে তিনি নিউ ন্যাশনাল থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু শত উদ্যম সত্ত্বেও তিনি অসফল হলেন এবং ১৮৮৮-এর ডিসেম্বর থেকে ১৮৮৯-এর মার্চ পর্যন্ত থিয়েটার চালিয়ে তিনি বিদায় নিলেন। রাজকৃষ্ণ রায় এবার নিজেই বীণা থিয়েটার চালাবার চেষ্টা করলেন। শুরু হল বীণা থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্যায়।

এবার আর তিনি আগের মতো ভুল করলেন না। সব আদর্শ বর্জন করে তিনি তার থিয়েটারে অভিনেত্রী গ্রহণ করলেন। তখনকার খ্যাতিময়ী অভিনেত্রী তিনকড়িকে মাত্র কুড়ি টাকা বেতনে নিয়ে এলেন। অন্য অভিনেত্রীও নেওয়া হল। আর্য নাট্যসমাজের অভিনেতারা তার সঙ্গে যোগ দিলেন।

শনিবার ২০ জুলাই, ১৮৮৯ রাজকৃষ্ণ রায়ের দ্বিতীয় প্রচেষ্টার বীণা থিয়েটার উদ্বোধন হলো। নাটক, তাঁরই লেখা ‘মীরাবাঈ’। অভিনয় করলেন: তিনকড়ি দাসী—মীরাবাঈ। অক্ষয়কালী কোঙার—রাণা কুম্ভ। এই নাটকে, রাজকৃষ্ণের লেখা গান—‘খেলার ছলে হরিঠাকুর গড়েছেন এই জগৎখানা’—খুবই জনপ্রিয় হয়। এখানে সম্ভবত তিনি মাইক্রোফোনে নেপথ্য সঙ্গীতগুলি পরিবেশন করেছিলেন। অনুসন্ধান পত্রিকা (৩০-৭-১৮৮৯) লিখেছিল— ‘‘কোথায় গান হইতেছে অথচ বৈজ্ঞানিক ক্রিয়াযোগে সেই গান দর্শকের কানের কাছে কে যেন আসিয়া গাহিয়া যাইতেছে—এই যে সুন্দর কৌশলটি, এটি বাঙ্গালার থিয়েটারে সম্পূর্ণ নূতন’’। ষ্টেটসম্যান পত্রিকার বিজ্ঞাপনে (২০-৭-১৮৮৯) রাজকৃষ্ণ জানিয়েছিলেন— ‘‘Special attraction—songs by scientific process’’.

মীরাবাঈয়ের ভূমিকায় তিনকড়ি’র অভিনয় খুবই প্রশংসা পায়। তবে কিছু পত্রিকা অভিনেত্রী নেওয়ার জন্য রাজকৃষ্ণের তীব্র নিন্দা করে। কিন্তু দর্শক আনুকূল্যের জন্য রাজকৃষ্ণ বীণা থিয়েটারের দ্বিতীয় পর্যায়ে অভিনেত্রী নিয়েই অভিনয় চালিয়ে গেলেন এবং মীরাবাঈ বহুবার অভিনীত হয়ে জনসম্বর্ধনা লাভ করেছিল।

১৮৮৯-তে লীলাবতী (৩ আগস্ট), শ্রীকৃষ্ণের অন্নভিক্ষা (১৪ সেপ্টেম্বর), সবার একাদশী (২২ সেপ্টেম্বর), চমৎকার (১৬ নভেম্বর), রুক্মিণীহরণ ও খোকাবাবু (১৪ ডিসেম্বর), ঘোষের পো (১৬ ডিসেম্বর) মহাসমারোহে অভিনীত হল।

১৮৯০-তে ডাক্তারবাবু, উভয় সঙ্কট (৪ জানুয়ারি), চন্দ্রহাস, হরধনুভঙ্গ (৫ জানুয়ারি), রাজা বিক্রমাদিত্য (১১ জানুয়ারি), চন্দ্রাবলী (২৬ জুলাই), প্রহ্লাদচরিত্র (১ নভেম্বর) লোভেন্দ্র-গবেন্দ্র (২ নভেম্বর), চতুরালী (৮ নভেম্বর) প্রভৃতি নাটক অভিনীত হল। এর মধ্যে সধবার একাদশী, লীলাবতী, উভয় সঙ্কট ছাড়া বাকি সব নাটকই রাজকৃষ্ণের লেখা। পরিচালক তিনি, মঞ্চ-মালিক তো বটেই! দ্বিতীয় পর্যায়ের ‘বীণা’কে প্রতিষ্ঠা দেবার জন্য রাজকৃষ্ণ সচেষ্ট ছিলেন। অভিনেত্রী নেওয়া, ভালো অভিনেতা সংগ্রহ—এসবও তিনি করেছিলেন। তাছাড়া থিয়েটারের দর্শনী মূল্য খুব কম করে ধার্য করেছিলেন। যাতে সাধারণ দর্শক অতি সহজেই তাঁর রঙ্গালয়ে নাটকগুলি দেখতে আসতে পারে। এইভাবে তিনিই রঙ্গালয়ে প্রথম ‘চীপ থিয়েটারে’র প্রবর্তন করেন। ১৫ মার্চ, ১৮৯০-এর ষ্টেটসম্যান পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায়: সোমবার বাদে রোজ বীণাতে অভিনয় হত। প্রবেশ মূল্য ছিল—এক আনা, দু আনা, তিন আনা, চার আনা, পাঁচ আনা। মহিলাদের জন্য দু আনা, মহিলা বক্স—দু টাকা (ছয় জন), রয়েল বক্স—দশ টাকা (আট জন)। টিকিটের মূল্য হ্রাস করতে করতে রাজকৃষ্ণ এক আনা এবং দুই আনা পর্যন্ত নামিয়ে এনেছিলেন।

তাছাড়া নিত্য নতুন নাটক নামিয়ে, খ্যাতি পাওয়া নাটকগুলি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অভিনয়ের ব্যবস্থাও করেছিলেন। মঞ্চে থিয়েটারি কৌশল ব্যবহার করে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা করেছিলেন। মঞ্চের দৃশ্য সুন্দর ও মনোহর করেছিলেন। একই রাতে একাধিক নাটক একই দর্শনী দিয়ে দেখাবারও ব্যবস্থা করেন।

কিন্তু কোনো ভাবেই রাজকৃষ্ণ ঋণভার থেকে মুক্তি পেলেন না। অভিনেত্রী না থাকাতে প্রথম পর্যায়ের বীণা ভালো চলেনি, দ্বিতীয় পর্যায়ে ভালো চলেছিল। কিন্তু রাজকৃষ্ণের ব্যবসায়িক বুদ্ধি পাকাপোক্ত না হওয়াতে এবং দর্শনী মূল্য খুবই কম হওয়াতে এবারও রাজকৃষ্ণ তাঁর থিয়েটারে লাভের মুখ দেখতে পেলেন না। বরং ঋণভারে আরো জর্জরিত হয়ে পড়লেন।

‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা মারফৎ (২৯-১১-৯০) তিনি জনসাধারণের কাছে আর্থিক সাহায্যের আবেদন জানালেন। তাতেও সাড়া মেলেনি। দারিদ্র্য, দুর্ভাবনা ও দুশ্চিন্তায় একেবারে হীনবল হয়ে পড়েন। স্টার থিয়েটারের আমন্ত্রণে তখন তিনি স্টারের নাট্যকার হিসেবে নিযুক্ত হলেন, মাস মাইনে একশো টাকা (১৮৯১-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি)। সেখানে তার বেশ কয়েকটি নাটক অভিনীত হলো।

সেই সময়ে বীণা থিয়েটারে ছোট ছোট কিছু নাট্যদল ভাড়া নিয়ে কিছু দিন করে অভিনয় করে গেছে। ইন্ডিয়ান থিয়েটার (৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯১ – ২৯ মার্চ, ১৮৯১), নীলমাধব চক্রবর্তীর সিটি থিয়েটার (১৬ মে ১৮৯১ – ৮ এপ্রিল ১৮৯২) এখানে খোলা হয়েছিল।

ইন্ডিয়ান থিয়েটার অভিনয় করেছিল বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ অবলম্বনে কমলাকান্ত বা উকিল বিভ্রাট (৭ ফেব্রুয়ারি, ১৮৯১)।

ঋণভারে জর্জরিত রাজকৃষ্ণ স্ত্রীকন্যার অলঙ্কার বিক্রি করে, ছাপাখানা বিক্রি করে সর্বস্বান্ত হয়েছিলেন। এবারে তাঁর সাধের ‘বীণা থিয়েটার’ বিক্রি করে দিলেন। কিনে নেন প্রিয়নাথ চট্টোপাধ্যায়, ১৮৯২-এর নভেম্বর মাসে। ভিক্টোরিয়া অপেরা হাউস খুলে সেখানে অভিনয় চলল। প্রিয়নাথ এখানে সব চরিত্রই মহিলাদের দিয়ে করাবার চেষ্টা করে সর্বস্বান্ত হলেন। রাজকৃষ্ণের প্রথমদিকে মহিলা ছিল না, ভিক্টোরিয়া অপেরা হাউসের অভিনয়ে পুরুষ রইলো না। স্রোতের বিপরীত মুখে চলতে গিয়ে বীণা থিয়েটারের সব রকম প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেল।

রাজকৃষ্ণ পরিচালিত বীণা থিয়েটারে শেষ অভিনয়: ১৬ নভেম্বর, ১৮৯০। ভিক্টোরিয়া অপেরা হাউসের শেষ অভিনয়: ডিসেম্বর, ১৮৯২। বর্তমানে এটি সিনেমা হল ‘জওহর’। ঠিকানা—২২ কেশব সেন স্ট্রিট, কলি-৯। এখানে কিছুদিন নীলমাধব চক্রবর্তীর সিটি থিয়েটার আবার খোলা হয়েছিল (১৮৯৩-এর ৭ অক্টোবর)। পরে এখানে নীলমাধব ‘গেইটি’ থিয়েটার চালান ১৮৯৪-এর শেষ থেকে ১৮৯৬-এর গোড়া পর্যন্ত।

দেনাগ্রস্ত, ভগ্নোদ্যম রাজকৃষ্ণ রায়ের অকাল মৃত্যু ত্বরান্বিত হলো। মাত্র ৪৫ বছর বয়সে, ১৮৯৪-এর ১১ মার্চ তাঁর মৃত্যু হয়। বীণা থিয়েটারের ইতিহাস এইখানেই শেষ।

পত্রিকা সম্পাদক ও কবি রাজকৃষ্ণ রায়ের প্রতিভা ছিল। কয়েকটি নাটকে অভিনয়ে খ্যাতিলাভ করেই তিনি রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠা করতে আসেন। থিয়েটার প্রতিষ্ঠান পরিচালনা এবং থিয়েটারে নাট্যাভিনয় পরিচালনায় তিনি একেবারেই ব্যর্থ হয়েছিলেন। থিয়েটার পরিচালনার জন্য যে বাস্তব বুদ্ধি, ব্যবসায়িক চিন্তা, পেশাদারি দক্ষতা এবং নিয়মশৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা তাঁর ছিল না। আবার নাট্যপরিচালনা করার যে বোধ ও উদ্যম প্রয়োজন তাও তাঁর ছিল না। শুধু আবেগ ও ভালবাসা দিয়ে থিয়েটারের মতো একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও মিশ্র শিল্পের (composite art) পরিচালনা কখনোই সম্ভব নয়। তাছাড়া সে যুগে মঞ্চে অভিনেত্রীদের চাহিদা যখন ক্রমবর্ধমান, তখন নিজের মঞ্চে তাদের বর্জন করা—একেবারেই স্রোতের বিপরীতমুখী প্রচেষ্টা। প্রথম দিকে এই চেষ্টা করে কোনো থিয়েটারই টিকতে পারেনি। স্রোতের বিপরীতে ইতিহাসের ধারাকে প্রবাহিত করতে গেলে যে প্রতিভা, উদ্যোগ এবং কর্মকুশলতার প্রয়োজন, রাজকৃষ্ণের তা ছিল না।

ফলে শেষের দিকে তিনি ঋণগ্রস্ত হয়ে সর্বান্ত হন। যে রঙ্গমঞ্চের প্রতি পূর্ণ ভালবাসায় তিনি তার জীবন, যৌবন, ধনমান সব ঢেলে দিয়েছিলেন, শেষ জীবনে সেই রঙ্গমঞ্চের প্রসঙ্গ এলেই তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠতেন। দ্বারে দ্বারে ভিক্ষাপ্রার্থী রাজকৃষ্ণের নির্মম পরিণতি দীর্ঘশ্বাসের মতো বাংলা থিয়েটারে রয়ে গেছে। রঙ্গমঞ্চ সুদে আসলে তাঁর জীবনকে নিংড়ে নিঃশেষ করে দিয়েছিল।

নাট্যকার হিসেবে রাজকৃষ্ণ একেবারে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত থেকেই নাট্য রচনা করেছেন। প্রথমে বেঙ্গল থিয়েটার, পরে নিজের বীণা থিয়েটার, তারপরে স্টার থিয়েটারে যুক্ত থেকে তিনি নাট্য রচনা করেছেন। এবং তখনকার রঙ্গমঞ্চে যে ধরনের ও প্রথার নাটক চলছিল, নাট্য রচনায় তিনি তাঁরই অনুগামী ছিলেন। থিয়েটার পরিচালনায় যিনি অভিনেত্রী না নিয়ে তদানীন্তন থিয়েটারের ধারার বিপরীতমুখে চলতে চেয়েছিলেন, নাটক রচনায় কিন্তু প্রচলিত ধারার বাইরে যাননি বা যেতে চাননি। ফলে তখন রঙ্গমঞ্চে যে ধরনের নাটক হতো, তিনি সেই পৌরাণিক নাটক, প্রহসন—পঞ্চরং নক্সা, গীতিনাট্য অপেরা এবং কিঞ্চিৎ সামাজিক নাটকই রচনা করেছিলেন। একদিকে যাত্রাধর্মী মনোমোহন বসু এবং অন্যদিকে নাট্যধর্মী গিরিশ—দুজনের মাঝখানে অবস্থান করে নাট্য রচনায় কোনো নিজস্বতা সৃষ্টি করতে পারেননি। তবুও তার বেশ কিছু গীতিনাট্য-অপেরা এবং পৌরাণিক নাটক সে যুগে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল।

রাজকৃষ্ণের ‘বীণা থিয়েটার’ বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে কোনো স্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারেনি। নাট্যকার হিসেবেও রাজকৃষ্ণকে স্থায়ী প্রতিষ্ঠা দিতে পারেনি। তার নাট্যশালার মতো তাঁর নাটক-প্রহসন-অপেরাগুলিও সে যুগের মঞ্চের তাৎক্ষণিক চাহিদা মিটিয়েই শেষ হয়ে গেছে।

তবে নাট্যমঞ্চ চালনায় অপরিণামদর্শিত মালিক ও পরিচালককে কীভাবে সর্বস্বান্ত করে দেয়, তার ঋণাত্মক (Negative) উদাহরণ হিসেবে রাজকৃষ্ণ ও তাঁর বীণা থিয়েটার পরবর্তী বাংলা থিয়েটার পরিচালনায় শিক্ষার উদাহরণ হিসেবে সাহায্য করেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!