বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত সম্পর্কে আলোচনা কর।
বৃন্দাবনদাসের শ্রীচৈতন্যভাগবত
চৈতন্যজীবনী কাব্যগুলির মধ্যে ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ গ্রন্থটি বাংলায় রচিত প্রথম চৈতন্যজীবনী কাব্য। সেজন্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতম’-এ উল্লেখ করেছেন— “কৃষ্ণলীলা ভাগবতে কহে বেদব্যাস।/চৈতন্যলীলার ব্যাস বৃন্দাবনদাস।” চৈতন্যদেবের আদি ও মধ্য জীবনের প্রামাণ্য ঘটনার জন্য গ্রন্থটি বিশেষ জনপ্রিয়। কাব্যটি সমকালীন সমাজ জীবনের তথ্যে তথ্যসমৃদ্ধ, সুপরিচিত এবং কাব্যগুণান্বিত।
বৃন্দাবন দাসের কবি পরিচিতি
চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্যতম পার্ষদ শ্রীবাসের ভ্রাতুস্পুত্রী নারায়ণীর পুত্র হলেন বৃন্দাবন দাস। গ্রন্থমধ্যে বৃন্দাবন পিতার নাম কোথাও উল্লেখ না করলেও মাতা নারায়ণীর পরিচয় দিয়েছেন। বৃন্দাবনের জন্মকথা অনেকটা রহস্যাচ্ছন্ন। উদ্ধব দাস বলেছেন, বাল্যবিধবা নারায়ণী মহাপ্রভুচর্বিত তাম্বুল সেবন করে গর্ভবতী হন—
প্রভুর চর্বিত পান স্নেহবশে কৈলা দান
নারায়ণী ঠাকুরাণীর হাতে।
শৈশব বিধবা ধনী সাধ্বী সতী শিরোমণি
সেবন করিল সে চর্বিত।
প্রভু শক্তি সঞ্চারিলা বালিকা গর্ভিনী হৈলা
লোকমাঝে কলঙ্ক ন হিল।
দীনেশচন্দ্র সেনও মনে করেন, বৃন্দাবনদাস নারায়ণীর বিধবা অবস্থার সন্তান। বিমানবিহারী মজুমদার এ প্রসঙ্গে বলেছেন— “শ্রীবাসের ভ্রাতৃতনয়া মহাপ্রভুর সাক্ষাৎ কৃপাপাত্রী নারায়ণীদেবী বিধবা অবস্থায় গর্ভবতী হইয়াছিলেন একথা মানিয়া লইতে বৈষ্ণব লেখকগণের কষ্ট হয়, তাই তাঁহারা প্রমাণ করিতে ব্যস্ত যে বৃন্দাবনদাস বৈধ বিবাহের ফলে জাত।”
দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবনদাসের জন্ম। সুকুমার সেনের মতে ১৫০৭-১৫১৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বৃন্দাবনদাস জন্মগ্রহণ করেন। বিমানবিহারী মজুমদারের মতে ১৫১৫ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপে কবির জন্ম হয়। বর্ধমান জেলার দেড় গ্রামে তিনি শেষ জীবন কাটিয়েছে। খেতুরী উৎসবেও তিনি যোগ দিয়েছিলেন। নিত্যানন্দের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন। নিত্যানন্দ তাঁকে চৈতন্য জীবনী রচনার নির্দেশ দেন।
বৃন্দাবনদাস সর্বপ্রথম ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নাম দিয়ে চৈতন্যজীবনী কাব্য লিখেছিলেন। কিন্তু মায়ের নির্দেশে তিনি নাম পাল্টে ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ রাখেন। কারণ একই সঙ্গে কবি লোচনদাস ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নামে চৈতন্য জীবনীকাব্য রচনা করেছিলেন। আবার কেউ কেউ অনুমান করেন শ্রীমদ্ভাগবতের লীলা অনুসারে বৃন্দাবনদাস তাঁর জীবনী কাব্যকে সাজিয়েছিলেন বলেই বৃন্দাবনের গোস্বামীরা এই নাম পরিবর্তন করেন। নিত্যানন্দ দাসের ‘প্রেমবিলাস’ গ্রন্থে পাওয়া যায়—
চৈতন্য ভাগবতের নাম চৈতন্যমঙ্গল ছিল।
বৃন্দাবনের মহান্তেরা ভাগবত আখ্যা দিল।।
বৃন্দাবন দাসের কাব্য রচনাকাল
চৈতন্য ভাগবতের রচনাকাল নিয়েও নানা জনের ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। দীনেশচন্দ্র সেনের মতে ১৫৩৫ খ্রিস্টাব্দ বা ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দই ‘চৈতন্যভাগবতে’র রচনাকাল। রামগতি ন্যায়রত্নের মতে এই সময়কাল ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দ। সুকুমার সেনের মতে তা ১৫৩৪-৩৫ খ্রিস্টাব্দ। বিমানবিহারী মজুমদার বিভিন্ন প্রমাণ দিয়ে সিদ্ধান্তে এসেছেন, ১৫৪৮ খ্রিস্টাব্দে ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ রচিত হইয়াছিল।
বৃন্দাবনদাস তিন খণ্ডে এই জীবনীগ্রন্থের পরিকল্পনা করেন। আদিখণ্ডে পনেরটি অধ্যায়, মধ্যখণ্ডে ছাব্বিশটি ও অত্যখণ্ডে দশটি অধ্যায়। আদিখণ্ডে নিমাইর জন্ম, বাল্যলীলা, নিত্যানন্দের জন্ম ও বাল্যলীলা। নিমাইর বিদ্যাশিক্ষা, লক্ষ্মীদেবীর সঙ্গে ব্বিাহ, নিমাইর বিদ্যাশিক্ষা, দিগ্বিজয়ী পরাভব, লক্ষ্মীদেবীর মৃত্যু ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সঙ্গে দ্বিতীয় বিবাহ, যবন হরিদাসের মহিমা, পিতার মৃত্যু ও গয়াগমন, ঈশ্বরপুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ ও প্রেমাবিষ্ট হয়ে নবদ্বীপে ফিরে আসা পর্যন্ত কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। মধ্যখণ্ডে ঈশ্বরপ্রেমে মাতোয়ারা চৈতন্যের বিদ্যার অহংকার প্রকাশ, অধ্যাপনা বন্ধ, চৈতন্যের উভ্রান্ত অবস্থাকে শ্রীবাসের ঈশ্বরপ্রেম রূপে ব্যাখ্যা, নবদ্বীপে নিত্যানন্দের আগমন এবং নিত্যানন্দ ও গৌরঙ্গের মিলন, নবদ্বীপে হরিনাম সংকীর্তন, নিত্যানন্দের জগাই-মাধাই উদ্ধার, কাজীদলন, চৈতন্যের গোপীভাব, সন্ন্যাস গ্রহণের জন্য অভিপ্রায় প্রকাশ, শচীমাতার বিলাপ, কেশব ভারতীর কাছে দীক্ষাগ্রহণ, প্রতাপরুদ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, রূপ নাতনের সঙ্গে সাক্ষাৎ প্রভৃতি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। আদি ও মধ্য খণ্ড যত বিস্তৃত আকারে বর্ণিত হয়েছে অন্ত্য খণ্ড তত সংক্ষিপ্ত রূপে সমাপ্ত হয়েছে। কৃষ্ণদাসের উক্তিতেও তার প্রমাণ মেলে।
বৃন্দাবনদাস নিত্যানন্দ, গদাধর ও অদ্বৈতের কাছে চৈতন্যের নবদ্বীপলীলা অবগত হয়েছিলেন। তাছাড়া ভাগবতের লীলা তাকে আকৃষ্ট করেছিল। তাই তিনি নবদ্বীপে গৌরাঙ্গলীলা বর্ণনা প্রসঙ্গে ভাগবত থেকেও উপাদান গ্রহণ করেছিলেন। বৃন্দাবনদাসের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল কৃষ্ণ বলরামই যথাক্রমে চৈতন্য ও নিত্যানন্দ। নিত্যানন্দ যেহেতু বৃন্দাবনের গুরু ছিলেন সেহেতু কোন কোন ক্ষেত্রে চৈতন্য অপেক্ষা নিত্যানন্দ অধিক গুরুত্ব পেয়েছেন। গ্রন্থের মঙ্গলাচরণ শ্লোকে বৃন্দাবনদাস শ্রীচৈতন্য ও নিত্যানন্দকে যুগল অবতার রূপে বর্ণনা করে লিখেছেন—
আজানুলম্বিতভুজৌ কনকাবতারৌ,
সংকীর্তনৈক-পিতরৌ কমলায়লাক্ষৌ
বিশ্বম্ভরৌ দ্বিজবরৌ যুগধর্মপালৌ,
বন্দে জগৎ-প্রিয়করো করুণাবতারৌ।।
তাছড়া জীবনীকার নিজেই স্বীকার করেছেন যে—
নিত্যানন্দ লীলা বর্ণনে হইল আবেশ।
চৈতন্যের শেষ লীলা রহিল অবশেষ।
বৃন্দাবনদাস সাধারণ লৌকিক জীবনের মতোই শ্রীচৈতন্যের জন্ম, বাল্যজীবন, বিদ্যাভ্যাস, বাল্যক্রীড়া, অধ্যাপনানুরাগ প্রভৃতি বর্ণনা করেছেন। যেমন, শিশু নিমাইর পাঠাভ্যাস বর্ণনায় লিখেছেন—
দৃষ্টিমাত্র সকল অক্ষর লিখে যায়।
পরম বিস্মিত হই সর্বজনে চায়।।
দিন দুই তিনে লিখিলেন সর্বকলা।
নিরন্তর লেখেন কৃষ্ণের নামমালা।
চৈতন্যের বাল্যলীলা কৃষ্ণলীলার অনুকরণে বর্ণনা করেছেন বৃন্দাবন দাস—
কোন শিশু সাজায়েন পুনার রূপে।
কেহ স্তন পান করি উঠি তার বুকে।।
কোন দিন শিশু সঙ্গে নলখড়ি দিয়া।
শকট গড়িয়া তাহে ফেলেন ভাঙ্গিয়া।।
বৃন্দাবন দাস শুধু জীবনীকার ছিলেন না, তিনি ছিলেন সমাজ ইতিহাস-সচেতন ব্যক্তিত্ব। তিনি অঙ্কন করেছেন পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে চৈতন্যের জন্মকালে নবদ্বীপ, শান্তিপুর প্রভৃতি অঞ্চলের ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির রূপ। বর্ণনা দিয়েছে ঐতিহাসিক চিত্রের—
নবদ্বীপ সম্পত্তি কে বর্ণিতে পারে।
এক গঙ্গাঘাটে লক্ষ লোক স্নান করে।।
ত্রিবিধ বসয়ে এক জাতি লক্ষ লক্ষ।
সরস্বতী দৃষ্টিপাতে সবে মহা দক্ষ।
সমকালীন ধর্মাচরণের স্বরূপ, হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ক ও মনোভাব, জ্ঞানচর্চার ব্যাপকতা, অন্ধবিশ্বাস ও সংস্কার, হিন্দুদের বর্ণভেদ, শাসক শাসিতের রাজনৈতিক সম্পর্ক প্রভৃতি নিপুণ তুলিতে বৃন্দাবনের কাব্যে চিত্রিত হয়েছে। যেমন সমকালীন ধর্মাচরণের বিবরণ—
ধর্মকর্ম লোক সবে এই মাত্র জানে।
মঙ্গলচণ্ডীর গীতে করে জাগরণে।।
অন্তু করি বিষহরি পুজে কোনো জন।
পুত্তলি করয়ে কেহ দিয়া বহু ধন।।
মুসলমান শাসকদের স্বরূপ—
যে হুসেন শাহ গর্ব উড়িষ্যার দেশে।
দেবমূর্তি ভাঙ্গিলেক দেউল বিশেষে।।
ওড্রদেশে কোটি কোটি প্রতিমা-প্রাসাদ।
ভাঙ্গিলে কত মত করিল প্রমাদ।।
কাজির অত্যাচার—
মোরে লঙ্ঘি হিন্দুয়ানি করে।
তবে জাতি নিমু আজি সবার নগরে।।
মনসা পূজা, চণ্ডীর গান এবং পুতুলনাচে যে সমকালীন লোকেরা অর্থ ব্যয় করত। বৃন্দাবনদাস তার পরিচয় দিয়েছেন এইভাবে—
বাশুলী পূজয়ে কেহো নানা উপহারে।।
মদ্য মাংস দিয়া কেহো যক্ষপুজা করে।।
বিশ্বাস, ভক্তি এবং ভালোবাসা চৈতন্যভাগবতের গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত হয়ে কাব্যটিকে স্নিগ্ধ ও সরস করে তুলেছে। সহজ, পরিচ্ছন্ন, সর্বজনচিত্তাকর্ষী জীবনীকাব্য হিসাবে এই কাব্যের মূল্য সর্বজনস্বীকৃত। চৈতন্যের বাল্য ও কৈশোর লীলার বর্ণনায় তিনি যে ধরনের বাস্তবতা, সরলতা ও লোকচরিত্র জ্ঞানের পরিচয় দিয়েছে তা অন্য কোন জীবনী গ্রন্থে দুর্লভ। তাছাড়া চৈতন্য-জীবনকথা, চৈতন্য-ধর্মসম্প্রদায় ও চৈতন্য-প্রবর্তিত ভক্তিকথা তিনি যেভাবে বর্ণনা করেছেন তেমনই আবার চৈতন্যের মানবমূর্তি ও ভাগবতমূর্তির অনুপাত রক্ষা করে চলেছেন।
সাধারণ বৈষ্ণব সমাজের উদ্দেশ্যে বৃন্দাবনদাস রচনা করলেও বৃন্দাবনের সহজাত কবিত্বশক্তির স্বরূপ তাঁর কাব্যে উদঘাটিত হয়েছে। তার রচনার মধ্যে মানবীয় রস রচনাকে আস্বাদ্য করে তুলেছে। শিশু নিমাই যখন পাঠশালা থেকে পাঠ সেরে ফিরছেন, তার বর্ণনা—
ধূলায় ধূসর প্রভু শ্রীগৌরসুন্দর।
লিখন কালির বিন্দু শোভে মনোহর।।
উপমা প্রয়োগেও বৃন্দাবনের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়। যেমন, নিত্যানন্দের পরম পবিত্র চরিত্রের বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে—
পদ্মপত্রে যেন কভু নাহি লাগে জল।
এই মত নিত্যানন্দ স্বরূপ নির্মল।।
নিমাইর সন্ন্যাস গ্রহণের পর গৃহত্যাগকে কেন্দ্র করে শচীমাতার অশ্রুবেদনা পাঠকের হৃদয়কে স্পর্শ করে—
যাইহ না যাইহ বাপ মায়েরে ছাড়িয়া।
পাপিনী আছয়ে সবে তোর মুখ চাহিয়া।।
তোমার অগ্রজ আমা ছাড়িয়া চলিলা।
বৈকুণ্ঠে তোমার বাপ গমন করিলা।।
তোমা দেখি সকল সন্তাপ পাসরিনু।
তুমি গেলে প্রাণ মুই সর্বথা ছাড়িমু৷৷
পয়ার, ত্রিপদী ছন্দের ললিত প্রয়োগে কাব্যটি উৎকৃষ্ট। কবির কবিত্বশক্তিও প্রশংসনীয়। বর্ণনার পরিচ্ছন্নতা, করুণ বেদনার আবেগ-ব্যাকুলতা ইত্যাদির প্রকাশে তিনি প্রথম শ্রেণির কবি প্রতিভার পরিচয় দিয়েছেন। তবুও ‘পদকল্পতরু’র সম্পাদক সতীশচন্দ্র রায় বৃন্দাবনদাসের ত্রুটির উল্লেখ করেছেন—“বৃন্দাবনদাসের আদিলীলার বর্ণনা সুবিস্তৃত উৎকৃষ্ট হইলেও, যে জন্যই হউক, তিনি চৈতন্যদেবের কিশোরী পত্নী শ্রীমতী বিষ্ণুপ্রিয়া দেবীর সহিত তাহার প্রেম সম্পর্কের কোনো ধারণা করিতে পারেন নাই, সুতরাং এ প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। বলাবাহুল্য যে, এজন্য তাহার উৎকৃষ্ট গ্রন্থখানার একটা বিশেষ ত্রুটি রহিয়া গিয়াছে।”
Leave a Reply