রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বেঙ্গল থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।
বেঙ্গল থিয়েটার
৯ নং, বিডন স্ট্রিট, কলকাতা
উদ্বোধন: ১৬ আগস্ট, ১৮৭৩
স্থায়িত্বকাল: ১৮৭৩-১৯০১
প্রতিষ্ঠাতা: শরৎচন্দ্র ঘোষ
প্রথম নাটক: শর্মিষ্ঠা (মধুসূদন)
ন্যাশনাল থিয়েটার বন্ধ হয়ে যাবার কয়েক মাসের মধ্যেই বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। ৯ নং বিডন স্ট্রিটে বিখ্যাত ধনী সাতুবাবুর বাড়ির সামনের মাঠে ৫ হাজার টাকার অধিক ব্যয়ে এই থিয়েটার বাড়ি তৈরি হয়। তখনকার কলকাতায় চালু লিউইসের লাইসিয়াম থিয়েটারের অনুকরণে এই নাট্যশালাটি তৈরি হয়।
ম্যানেজার হলেন সাতুবাবুর দৌহিত্র শরশ্চন্দ্র ঘোষ। সুদক্ষ অভিনেতা শরৎচন্দ্র সাতুবাবুর বড়ির ‘শকুন্তলা’ অভিনয়ে শকুন্তলার চরিত্রে অভিনয়ে খ্যাতিলাভ করেন। অবৈতনিক সম্পাদক ছিলেন প্যারীমোহন রায়। নাট্যশালাটি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন মাইকেল মধুসূদন এবং উমেশচন্দ্র দত্ত। উদ্যোক্তা হিসেবে ছিলেন বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, হরিবৈষ্ণব (হরিদাস দাস), গিরীশচন্দ্র ঘোষ (খ্যাতিমান গিরিশচন্দ্র নন), দেবেন্দ্রনাথ মিত্র, অক্ষয়কুমার মজুমদার প্রমুখ।
‘মধ্যস্থ’ পত্রিকার বিজ্ঞাপন (২২-২-১৮৭৩) থেকে জানা যায় যে, ১৮ জন অংশীদার প্রত্যেকে ১ হাজার টাকা করে দিয়ে মোট ১৮ হাজার টাকা সংগ্রহ করে নাট্যশালা প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। প্রধান ছিলেন শরৎচন্দ্র ঘোষ।
এই প্রথম কলকাতায় বাঙালির নিজস্ব থিয়েটার বাড়ি তৈরি হলো। লাইসিয়াম থিয়েটারের আদলে তৈরি হলেও প্রথম দিকে এটি পাকাপোক্ত ছিল না। খোলার চাল, মাটির দেওয়াল এবং সিমেন্টের পলেস্তারা যুক্ত মাটির প্লাটফর্ম তৈরি করা হয়। পরের দিকে টিনের দেওয়াল এবং কয়রাগেটেড টিন ছাদে দেওয়া হয়। মঞ্চটি মাটির হলেও মাঝখানে তক্তা বসানো ছিল। নিচে ছিল সুড়ঙ্গ। কনসার্টের দল এই সুড়ঙ্গ দিয়েই মূলমঞ্চ এবং প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে যাতায়াত করত। শরৎচন্দ্র অভিনয়ে প্রায়ই ঘোড়ায় চড়ে স্টেজে ঢুকতেন; সেই সুবিধের দিকে নজর রেখেই মাটির প্লাটফর্ম করা হয়েছিল। দু’পাশে ঢালু ছিল ঐ কারণেই। শরৎচন্দ্র নিজে ভালো ঘোড়সওয়ার ছিলেন, গড়পারে তার নিজস্ব রেসকোর্স ছিল, তিনি প্রায়ই ‘জকি’ হতেন সেখানে।
রঙ্গমঞ্চ পরিচালনার জন্য গঠিত কমিটিতে ছিলেন মধুসূদন, বিদ্যাসাগর, দেবব্রত সামশ্রমী, উমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ।
বেঙ্গল থিয়েটার অভিনয় শুরু করল মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক দিয়ে, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ১৬ আগস্ট। অভিনয় করলেন, যযাতি—শরৎচন্দ্র। শুক্রাচার্য—বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। দেবযানী—এলোকেশী। দেবিকা—জগত্তারিণী।
প্রথম অভিনয় থেকেই বেঙ্গল থিয়েটার মঞ্চে অভিনেত্রী গ্রহণ করল। প্রথমে চারজন অভিনেত্রী নেওয়া হয়—শ্যামা, জগত্তারিণী, এলোকেশী ও গোলাপ। পরে আরো অভিনেত্রী নেওয়া হয়।
অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘গিরিশচন্দ্র’ গ্রন্থে জানিয়েছেন যে, ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের মহলায় সুকুমারী অংশগ্রহণ করলেও, প্রথম রাতের অভিনয়ে অংশ নেননি। অন্যদের লেখাতেও প্রথম রাতের অভিনয়ে সুকুমারীর নাম নেই। শঙ্কর ভট্টচার্য তাঁর ‘বাংলা রঙ্গালয়ের ইতিহাসের উপাদান’ গ্রন্থে জানিয়েছেন, ২৩ আগস্ট, ১৮৭৩ দ্বিতীয় অভিনয়ের রাতে সুকুমারী প্রথম অবতীর্ণ হন। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে প্রথম রাতে কে ‘শর্মিষ্ঠা’ চরিত্রে অভিনয় করলো? কোনো ‘পুরুষ অভিনেত্রী’ কি?
মঞ্চে অভিনেত্রী গৃহীত হলে সমাজে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নাট্যাভিনয়ের প্রয়োজনেই নারী চরিত্রে মেয়েদের অবশ্য প্রয়োজন। অভিনয় প্রসঙ্গে একথা সে যুগে অনেকেই মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু সে যুগে ভদ্র গৃহস্থ ঘরের মেয়েদের অভিনয়ের ক্ষেত্রে পাওয়া সম্ভব না হওয়াতে বেঙ্গল থিয়েটার বারাঙ্গনা পল্লী থেকে এই অভিনেত্রীদের জোগাড় করে। তাতেই সমাজপতিদের দুশ্চিন্তার মাত্রা বেড়ে যায়; সে যুগে এই নিয়ে নানা বাকবিতণ্ডা এবং তর্কবিতর্ক চলেছিল। নানা সংবাদপত্র বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে থাকে। কিন্তু অভিনেত্রীদের মঞ্চ থেকে বিদায় করা যায়নি। বরং বাংলা মঞ্চে অভিনেত্রী পাকাপাকিভাবে নিজের জায়গা তৈরি করে নিয়েছিল। মধুসূদনের এই ব্যাপারে উৎসাহ ও সমর্থন ছিল। আর বিদ্যাসাগর এই কারণেই এদের কমিটি থেকে পদত্যাগ করেন।
বেঙ্গল থিয়েটারের অভিনয়
‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক দিয়ে শুরু করার পর এখানে রামনারায়ণের ‘স্বপ্নধন’ (অক্টোবর, ১৮৭৩), ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ অভিনীত হয়। তারপর মধুসূদনের ‘মায়াকানন’ এখানে অভিনীত হয়। বেঙ্গলের জন্যই এই নাটকটি মধুসূদন অসুস্থ ও শয্যাশায়ী অবস্থায় লিখে দিয়েছিলেন। ‘বিষ না ধনুর্গুণ’ এদের জন্য লেখা শুরু করলেও শেষ করতে পারেননি। এছাড়া এখানে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে শর্মিষ্ঠার অনেকগুলি অভিনয় হতে। কিন্তু বেঙ্গল থিয়েটার এই সময়ে কোন অভিনয়েই সুবিধে করতে পারছিল না। অভিনেত্রী প্রসঙ্গ আলোড়ন তুললেও নাট্যাভিনয় দর্শক আনুকূল্য লাভ করতে পারেনি।
এবার তারা অভিনয় করলো ‘মোহান্তের এই কি কাজ!’ নাট্যকার লক্ষ্মীনারায়ণ দাস। ৬ সেপ্টেম্বর, ১৮৭৩। তারকেশ্বরের মোহান্ত ও এলোকেশীর ব্যাপার নিয়ে তখন সারা দেশে হৈচৈ চলছে। সময়োপযোগী এই ঘটনা নিয়ে তখন অনেকগুলি নাটক লেখা হয়েছিল। বেঙ্গল থিয়েটার এই নাটকটি অভিনয় করার সঙ্গে সঙ্গে তাদের কপাল ফিরে গেল। বেঙ্গলের সাফল্যের শুরু তখন থেকেই।
পর পর চক্ষুদান (রামনারায়ণ), রত্নাবলী (অনুবাদ—রামনারায়ণ), কৃষ্ণকুমারী মঞ্চস্থ হয়। বেঙ্গলের অভিনয় দেখে বর্ধমানের মহারাজা প্রীত হন এবং ডিসেম্বর, ১৮৭৪, তিনি বেঙ্গল থিয়েটারের পৃষ্ঠপোষক হন। এই উপলক্ষে ১২ ডিসেম্বর বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপ অভিনীত হয়। এটি খুবই সাফল্য লাভ করে। অভিনয়ে ছিলেন জগৎসিংহ—শরৎচন্দ্র, ওসমান—হরিবৈষ্ণব, তিলোত্তমা—জগত্তারিণী, আয়েষা—গোলাপ। জগৎসিংহের ভূমিকায় শরৎচন্দ্র ঘোড়ার পিঠে চড়ে মঞ্চে প্রবেশ করতেন। এই ঘটনা তৎকালীন দর্শকদের কাছে বিস্ময়কর ও কৌতূহলপ্রদ হয়েছিল। অভিনয়ে শরৎচন্দ্র এবং হরিবৈষ্ণব-এর কৃতিত্ব পরবর্তীকালেও স্বীকৃত হয়েছে।
১৮৭৪ খুবই সাফল্যের যুগ বেঙ্গলের। পদ্মাবতী (মধুসূদন), পুরুবিক্রম (জ্যোতিরিন্দ্রনাথ), বঙ্গের সুখাবসান (হরলাল রায়), মণিমালিনী (হরিমোহন মুখোপাধ্যায়), বিদ্যাসুন্দর, যেমন কর্ম তেমনি ফল, একেই কি বলে বাঙালি সাহেব, প্রভাবতী প্রভৃতি অভিনীত হয়। এর মধ্যে পুরুবিক্রম, যেমন কর্ম তেমনি ফল, বিদ্যাসুন্দর জনপ্রিয় হয়।
১৮৭৫-এর উল্লেখযোগ্য খবর হলো, গ্রেট ন্যাশনাল থেকে বেরিয়ে অমৃতলাল বসু, নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিরণচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মদনমোহন বর্মন, যাদুমণি, কাদম্বিনী প্রভৃতি নতুন দল তৈরি করে বেঙ্গলের সঙ্গে মিলিতভাবে কিছুদিন অভিনয় করে। সম্মিলিত প্রথম অভিনয়, ৬ ফেব্রুয়ারি, ১৮৭৫; নগেন্দ্রনাথের লেখা ‘সতী কি কলঙ্কিনী’ গীতিনাট্য। সম্মিলিত আরেকটি অভিনয় হলো মেঘনাদবদ কাব্যের নাট্যরূপের। রাজকৃষ্ণ রায়ের অনুপ্রেরণায়, গিরিশচন্দ্র এই নাট্যরূপ দেন। এইখানেই প্রথম গিরিশ ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন। রাজকৃষ্ণ রায়ের ‘হরধনুভঙ্গ’ নাটকের ভাঙা অমিত্রাক্ষর ছন্দের প্রভাবে গিরিশ এই ছন্দ ব্যবহার করেন এবং তাকে উন্নত ও ত্রুটিমুক্ত করে সংলাপকে স্বচ্ছন্দ করেন। সংলাপে পরবর্তী গৈরিশ ছন্দের সূত্রপাত এইখানেই। মেঘনাদের চরিত্রে কিরণচন্দ্র এবং লক্ষ্মণের ভূমিকায় হরিবৈষ্ণব, মহাদেব—বিহারীলাল, অভিনয়ের কৃতিত্বে ও ভাঙা ছন্দে সংলাপ উচ্চারণে পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন।
এছাড়া সম্মিলিত অভিনয় হয়—কপালকুণ্ডলার নাট্যরূপ, ভীমসিংহ প্রভৃতি। এবারে গ্রেট ন্যাশনালের দল চলে গেল। বেঙ্গল নিজের অভিনয়ের ধারায় গুইকোয়ার নাটক, সুরেন্দ্রবিনোদিনী, বীরনারী, বঙ্গবিজেতা, পলাশীর যুদ্ধ প্রভৃতি অভিনয় করে যায়। এই বছরেই ভূতপূর্ব ন্যাশনাল থিয়েটারের কিছু নট-নটী নিয়ে গঠিত ‘দি নিউ এরিয়ান’ নামে একটি দল বেঙ্গলের মঞ্চে কিছু দিন অভিনয় করে। উপেন্দ্রনাথ দাসের ‘সুরেন্দ্রবিনোদিনী’ (১৪ আগস্ট, ১৮৭৫), বীরনারী (৪ সেপ্টেম্বর)। ‘সুরেন্দ্র বিনোদিনী’র অভিনয়ে: সুরেন্দ্র—নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিনোদিনী—বনবিহারিণী, ম্যাক্রেন্ডেল—হরিবৈষ্ণব। বিরাজমোহিনী—গোলাপ (সুকুমারী)।
সেই সময়ে বরোদা রাজ্যে ব্রিটিশ রেসিডেন্ট সাহেবকে বিষ খাইয়ে হত্যার অপরাধে বরোদার মহারাজার বিচার চলছিল। এই নিয়ে সারাদেশে প্রচণ্ড আলোড়ন ওঠে। এই বিষয় নিয়ে অনেকেই নাট্য রচনা করতে থাকেন। নগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেশচন্দ্র মিত্র উভয়ে মিলে ‘গুইকোয়ার’ নাটক রচনা করেন এবং বেঙ্গল আবার সাফল্যের সঙ্গে তার অভিনয় করে।
১৮৭৬-এর গোড়া থেকেই বেঙ্গল থিয়েটার নতুন বাড়ি নির্মাণে হাত দেয়। ফলে বেশ কিছু দিন অভিনয় বন্ধ থাকে। তিন মাস পর নবনির্মিত পাকা থিয়েটার বাড়িতে আবার অভিনয় শুরু হয়। এখানে
‘বিদ্যাসুন্দর’ এবং পুরনো নাটকগুলির বেশ কয়েকবার অভিনয় হয়। ১৮৭৬-এর ডিসেম্বরে কুখ্যাত ‘অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন’ ব্রিটিশ সরকার চালু করে। ফলে রঙ্গমঞ্চের স্বাধীন বিকাশ ও অভিনয়ের অধিকার নিয়ন্ত্রিত হয়। এই আইনের ফলে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার উঠেই গেল। পাশাপাশি চালু বেঙ্গল থিয়েটারের ওপর প্রচণ্ড চাপ পড়লো।
নানা বিষয়ের নাটক অভিনয়ের যে ধারা বেঙ্গল চালু করেছিল তা এইবার বাধাপ্রাপ্ত হলো। ঐতিহাসিক কিংবা দেশপ্রেমের নাটক বন্ধ হয়ে গেল। শুরু হলো পৌরাণিক নাটক, গীতিনাট্য, অপেরা এবং সামাজিক প্রহসনের পালা। অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের নাগপাশ থেকে বেঙ্গল রেহাই পায়নি।
এই বছরেই অভিনেত্রী বিনোদিনী বেঙ্গল থিয়েটারে যোগ দেন। এই সময়েই তারা শুধুমাত্র মহিলা দর্শকদের জন্য একরাত্রি অভিনয় করেছিল। সেইভাবে বিজ্ঞাপন দিয়ে ১৮৭৬-এর ডিসেম্বরে মেঘনাদবধ অভিনয় করেছিল।
১৮৭৭ থেকে শুধুমাত্র শনিবারে অভিনয়ের দিনকে বাড়িয়ে সপ্তাহে তিন দিন-রবি, মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার অভিনয়ের ব্যবস্থা করে। মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার টিকিটের মূল্য অর্ধেক করা হয়।
এই বছরে উল্লেখযোগ্য অভিনয়ের মধ্যে রয়েছে কুলীনকন্যা অথবা কমলিনী, আলিবাবা, অপূর্বসতী, রত্নাবলী, মেঘনাদবধ প্রভৃতি বেশির ভাগ পুরনো নাটক। এছাড়া বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের নাট্যরূপ কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী, দুর্গেশনন্দিনী অভিনীত হয়। বিনোদিনীর অভিনেত্রী জীবনের সার্থকতার পর্ব শুরু হয়, বঙ্কিমের সৃষ্ট নারী চরিত্রগুলির রূপায়ণের মাধ্যমে। দর্শক ও সমালোচক মুগ্ধ হয়। তাকে ‘সাইনোরা’, ‘ফ্লাওয়ার অফ দি নেটিভ থিয়েটার’ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়।
এই বছরেই পঞ্চপাণ্ডবের বনগমন, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ, সুভদ্রাহরণ, সতী কি কলঙ্কিনী ভালভাবে অভিনীত হয়। কিন্তু আলিবাবা কিংবা আয় ঘুরে আয় সোনার চাঁদ—দুটি প্রযোজনা দর্শকের দ্বারা নিন্দিত ও সংবাদপত্রে ভৎর্সিত হয়।
১৮৭৮-এ পুরনো নাটকগুলির সঙ্গে বঙ্কিমের উপন্যাসের নাট্যরূপ এবং দু’একটি নতুন নাটক অভিনীত হয়। এই সময়ে ‘শকুন্তলা’ নাটকের অভিনয়ে বড়লাট লিটন ও তার স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের পর এই প্রথম ব্রিটিশ সরকারের কোন উচ্চপদস্থ ব্যক্তি বাংলা মঞ্চে হাজির হলেন।
১৮৮০-তে বেঙ্গলের প্রাণপুরুষ শরৎচন্দ্র ঘোষের মৃত্যু হয়। থিয়েটারের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। কিন্তু সব আঘাত কাটিয়ে উঠে শক্ত হাতে এই নাট্যশালার সব দায়িত্ব গ্রহণ করলেন বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়। তিনি এই থিয়েটারের প্রথম প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন। অভিনয়েও অংশগ্রহণ করতেন। প্রয়োজনে দুর্গেশনন্দিনীর নাট্যরূপও দিয়েছিলেন তিনি। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বঙ্কিম, রমেশচন্দ্রের উপন্যাসগুলির নাট্যরূপ ও পলাশীর যুদ্ধের অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন। নিজে লেখেন—সুভদ্রাহরণ, রাবণবধ, পাণ্ডবনির্বাসন, শ্রীবৎসচিন্তা, প্রভাসমিলন, নন্দবিদায়, জন্মাষ্টমী প্রভৃতি পৌরাণিক নাটক। ১৮৮০ থেকে ১৯০১-এ মৃত্যু (২০ এপ্রিল) পর্যন্ত এই দুই দশক বিহারীলাল ছিলেন বেঙ্গলের কর্ণধার শুধু নন, নট নাট্যকার, অভিনয় শিক্ষক, মঞ্চাধ্যক্ষ—সব, সবকিছু। ১৮৭৩ থেকে ১৮৮০ অবধি যেমন ছিলেন প্রাণপুরুষ শরৎচন্দ্র ঘোষ। বেঙ্গল থিয়েটারের প্রথম ভাগ যদি শরৎচন্দ্রের হয় তাহলে দ্বিতীয় ভাগ অবশ্যই বিহারীলালের।
১৮৮০র প্রাক্-মুহূর্তের একটি ঘটনা উল্লেখযোগ্য। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অশ্রুমতী’ নাটক দেখবার জন্য দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর বেঙ্গলের সঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থা করেন। যাতে সেদিন শুধুমাত্র ঠাকুর বাড়ির মেয়ে-পুরুষেরাই ঠাকুর বাড়ির ছেলের লেখা নাটক দেখতে পারে। ‘ঘরোয়া’-তে অবনীন্দ্রনাথ তার মজার বর্ণনা দিয়েছেন।
বিহারীলালের নেতৃত্বে বেঙ্গল থিয়েটার সাফল্যের সঙ্গেই চলতে থাকে। অভিনীত হয়—সুভদ্রাহরণ, হরধনুভঙ্গ, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ।
১৮৮২-তে অমৃতলাল বসু এখানে যোগ দেন। তাঁর লেখা প্রহসন ‘ডিসমিস’ এবং নাটক ‘হরিশ্চন্দ্র’ জনপ্রিয়তা পায়।
১৮৮৩-তে তার ব্রজলীলা মঞ্চস্থ হয়। এই সময়ে নাট্যকার রাজকৃষ্ণ রায়ের কয়েকটি নাটক বেঙ্গলে অভিনীত হয়। হরধনুভঙ্গ (১৮৮৩), প্রহ্লাদ চরিত (১৮৮৪), ভীষ্মের শরশয্যা (১৮৮৬), দুর্বাসার পারণ (১৮৮৫)। পৌরাণিক নাটকের জোয়ার তখন বাংলা মঞ্চে। রাজকৃষ্ণ রায়ও পৌরাণিক নাটক রচনায় সাফল্য লাভ করতে থাকেন। তার প্রহ্লাদ চরিত্র খুবই সফল হয়। এই নাটকটির অত্যধিক জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ, নামভূমিকায় কুসুমকুমারীর অনবদ্য অভিনয়। আবার ‘ভীষ্মের শরশয্যা’ নাটকে ভীষ্মের ভূমিকায় বিহারীলালের অভিনয় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠকীর্তি। মনে রাখতে হবে, বেঙ্গলের সাফল্যের মূলেও তাঁর অভিনয় কাজ করেছিল।
১৮৮৭-তে বিহারীলালের রচিত শ্রীবৎসচিন্তা, পাণ্ডব নির্বাসন, রুক্মিণীহরণ অভিনীত হয়। সাফল্য লাভ করে প্রভাসমিলন। ১৮৮৮-তে বিহারীলালের নন্দবিদায়, ব্রহ্মশাপ দুটিই সফলভাবে অভিনীত হয়। ১৮৮৯-তে শৈলজা, জন্মাষ্টমী এবং শকুন্তলার অভিনয় প্রশংসা লাভ করে।
১৮৯০-এর ৭ জানুয়ারি বেঙ্গল থিয়েটার ‘রয়াল’ উপাধি লাভ করে। ব্রিটিশ যুবরাজের কলকাতায় আগমন, গড়ের মাঠে তার সম্বর্ধনার জন্য লর্ড লিটনের অনুরোধে বেঙ্গল শকুন্তলা অভিনয় করে। তারপরেই তারা ‘রয়াল’ উপাধি পায়, ব্রিটিশ রাজভক্তির জন্য।
১৮৯০-তে উল্লেখযোগ্য অভিনয় হলো—সীতা স্বয়ংম্বর এবং নাট্যবিচার নামে একটি প্রহসন। ১৮৯১-তে গোবরগণেশ, বাণযুদ্ধ, বসন্তমেলা অভিনীত হয়। ১৮৯২-তে পুরনো নাটকের পুনরভিনয় চলার সঙ্গে মোহশেল, শ্রীরামনবমী মঞ্চস্থ হয়। ১৮৯৩-তে ব্যাসকাশী ও খণ্ড প্রলয় উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা। ‘মুই-হাঁদু’ প্রহসনটির অভিনয় জনপ্রিয় হয়নি, উপরন্তু সমালোচক ও সংবাদপত্র নিন্দা করে।
১৮৯০-এর ৭ জানুয়ারি রানী ভিক্টোরিয়ার জ্যেষ্ঠপুত্র প্রিন্স আলবার্ট ভিক্টরের অভ্যর্থনার জন্য কলকাতায় গড়ের মাঠে যে ‘স্বয়ং সমিতি’ হয় সেখানে শকুন্তলা নাটকের অভিনয় করে বেঙ্গল থিয়েটার ‘রয়াল’ উপাধি লাভ করে। ১১ জানুয়ারি থেকে বেঙ্গলের নাম হয় ‘রয়াল বেঙ্গল থিয়েটার’।
১৮৯৪-তে মহেন্দ্রলাল বসু, কুসুমকুমারী, প্রমদাসুন্দরী প্রভৃতি কয়েকজন প্রখ্যাত নটনটী বেঙ্গলে যোগ দেয়। এদের সহযোগে অভিনীত হয় বঙ্কিমের মৃণালিনী ও বিষবৃক্ষ উপন্যাসের নাট্যরূপ। দুটিরই নাট্যরূপ দেন বিহারীলাল। মৃণালিনী খুবই সফল হলেও বিষবৃক্ষ সমালোচিত হয়।
১৮৯৫-তে বঙ্কিমের রজনী উপন্যাসের নাট্যরূপ (বিহারীলাল) কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনীত হয়। মহেন্দ্রলাল বসু এই সময়ে বেঙ্গল ত্যাগ করেন। পর পর দানলীলা, সীতারাম, রক্তগঙ্গা অভিনয়ে প্রশংসা পায়। সীতারামের নাট্যরূপের অভিনয় খুবই খ্যাতিলাভ করে।
১৮৯৬-তে পুরনো নাটকের পুনরভিনয় চলে। সঙ্গে বিহারীলালেব দুটি নতুন নাটক ধ্রুব ও নরোত্তম ঠাকুর এবং বঙ্কিমের রাজসিংহ উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ হয়!
১৮৯৭-তে অন্য নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বঙ্কিমের দেবী চৌধুরানী ও কৃষ্ণকান্তের উইল উপন্যাসের নাট্যরূপের অভিনয়।
১৮৯৮-১৯০১-এর মধ্যে অভিনীত হয়েছে বজ্রবাহন, দফরখাঁ, প্রমোদরঞ্জন, সুকন্যা, যমুনা, দাওয়াই, নীহার প্রভৃতি অকিঞ্চিৎকর সব নাটকের।
১৯০১-এর ২০ এপ্রিল বেঙ্গলের দ্বিতীয় প্রাণপুরুষ বিহারীলালের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বেঙ্গল থিয়েটার বন্ধ হয়ে গেল। ১৯০১-এর ২৪ এপ্রিল অমৃতবাজার পত্রিকায় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়— ‘‘Royal Bengal Theatre/Beadon Street. Calculta/ Notice/ There will be no performance on Wednesday, the 21th April. 1901. Owing to the lamentable death of our venerable Manager/B.L. Chatterjee.”
দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর ধরে নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার গৌরবের সঙ্গে তার অভিনয়ের ধারা অব্যাহত রাখে। প্রথম দিকে শরৎচন্দ্র এবং দ্বিতীয় অংশে বিহারীলাল—এই দুই কাণ্ডারীর নেতৃত্বে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলা নাট্যাভিনয়ের ইতিহাসে উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখে গেছে। ১৯ শতকের শেষ দশক থেকে বেঙ্গলের অবস্থার অবনতি হয়। শরৎচন্দ্রের মৃত্যুর পর আর্থিক দায়-দায়িত্বের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। যদিও অন্য দিকগুলি বিহারীলাল কৃতিত্বের সঙ্গে সামাল দিয়েছিলেন। এখানে যেমন সে যুগের খ্যাতিমান অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ে অংশগ্রণ করেছেন, তেমনি অনেকেই নানা সময়ে বেঙ্গল ছেড়ে চলে গেছেন। নতুন করে অভিনেতা-অভিনেত্রী তৈরি করা সবসময়ে ভালো হয়নি। নাটকের অভাবও দেখা দিয়েছিল। একা বিহারীলাল প্রয়োজনে আর কততা নাটক লিখবেন। প্রয়োজনে কখনো অমৃতলাল বসু, কখনো উপেন্দ্রনাথ দাস, কখনো রাজকৃষ্ণ রায়কে গ্রহণ করতে হয়েছে। উপায়ান্তর না দেখে, বঙ্কিমের সদ্যপ্রকাশিত উপন্যাসগুলির তড়িঘড়ি নাট্যরূপ দিয়ে অভিনয় করতে হয়েছে। তবুও নাটকের চাহিদা মেটানো যায়নি। একই সময়ে এমারেল্ড, স্টার, ক্লাসিক, মিনার্ভা প্রভৃতি নাট্যমঞ্চগুলি প্রবল প্রতাপে নাট্যাভিনয়ের জোয়ার নিয়ে আসে। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এই সময়ে বারবার পিছিয়ে পড়ে বেঙ্গল।
মনে রাখতে হবে, সেই সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় নট-নাট্যকার-নাট্যশিক্ষক গিরিশ কখনো বেঙ্গলে যোগ দেয়নি বা তাকে বেঙ্গলে নেওয়া হয়নি। গিরিশকে নিয়ে তখন সব মঞ্চ মালিকের টানাটানি। গিরিশ থাকলেই নাটক এবং জনপ্রিয়তা। সেই গিরিশ ব্যতিরেকে বেঙ্গলের ভাগ্য ফেরানো সম্ভব হয়নি।
এছাড়া যে জমিতে বেঙ্গলের পাকা থিমেটার বাড়ি তৈরি হয়েছিল, সেই জমি নিয়ে গোলযোগ দেখা দেয়। শরৎচন্দ্র বিহনে বেঙ্গল সেই দায় সামাল দিতে পারেনি। তার উপরে, দলের ভেতরেই আত্মকলহ ও বিবাদ বেঙ্গলের পতনকে ত্বরান্বিত করে। বিহারীলাল একা সবদিক সামলে উঠতে পারছিলেন না। গোড়াপত্তনের সময়ে যে উপদেষ্টা কমিটি ছিল, তাদের প্রায় সকলেই তখন মৃত, সেই কমিটি প্রায় কার্যহীন অবস্থাতেই ছিল।
একদিকে অভিনয়ের জন্য নাটক রচনা, নিজে অভিনয় করা এবং অভিনয়ে শিক্ষাদান করা, তার উপরে দলের নানা গোলমাল, নট-নটী জোগাড় করা, আর্থিক দায়, জমির বিবাদ, ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রীর অভাব, নাটকের অভাব-সব মিলিয়ে বেঙ্গল থিয়েটার ১৯ শতকের শেষের দশ বছর বেশ কাহিল হয়ে পড়ে। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দের ২০ এপ্রিল, বিহারীলালের মৃত্যুর পরে পরেই তাই বেঙ্গল থিয়েটারের পাদ-প্রদীপের আলো নির্বাপিত হয়ে যায়।
২১ এপ্রিল শেষ অভিনয়—‘নীহার’ ও ‘দাওয়াই’। নীহার সামাজিক নাটক এবং দাওয়াই সামাজিক নক্সা।
রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে বেঙ্গল থিয়েটারের অবদান
ত্রিশ বছর একটানা অভিনয় অব্যাহত রেখে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে যে স্বাক্ষর রেখেছে, তার কয়েকটি দিকের কার্যাবলী অবশ্যই উল্লেখযোগ্য—
- বাঙালির থিয়েটারে প্রথম নিজস্ব স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ ও প্রেক্ষাগৃহ বেঙ্গল থিয়েটার থেকেই শুরু হয়। প্রথমে কাঁচা এবং পরে পাকাপোক্তভাবে নাট্যশালা গড়ে তোলে বেঙ্গল থিয়েটার।
- প্রথম যথার্থ সাধারণ রঙ্গালয় এবং পেশাদারি থিয়েটার এই বেঙ্গল থিয়েটার। ন্যাশনাল থিয়েটারের প্রচেষ্টার মধ্যে যে সাধারণ রঙ্গালয়ের সূত্রপাত এবং পেশাদারি থিয়েটারের অঙ্কুরোদগম হয়েছিল, বেঙ্গল থিয়েটার প্রতিষ্ঠার মধ্যে তার ধারাবাহিক বিকাশ প্রথম সার্থকভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল। সেই অর্থে বাংলায় প্রথম প্রফেশনাল থিয়েটারের শুরু বেঙ্গল থিয়েটার থেকে।
- ১৮ জন সদস্যের টাকা নিয়ে শেয়ারভিত্তিক থিয়েটার পরিচালনা শুরু করে বেঙ্গলই প্রথম।
- থিয়েটার পরিচালনার যৌথ দায়িত্ব বেঙ্গলই প্রথম তৈরি করে। শুধু পরিচালন কমিটি নয়, উপদেষ্টা পর্ষদও তৈরি করা হয়। নাট্যশালা ঠিকমত দেখাশোনা এবং নাট্যাভিনয় পর্যালোচনা করার জন্য এইভাবে জ্ঞানীগুণীদের নিয়ে কমিটি তৈরি করে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলা সাধারণ রঙ্গালয়ের যাত্রাপথে যথেষ্ট উৎসাহ জুগিয়েছিল।
- সাধারণ রঙ্গালয়ে প্রথম অভিনেত্রী গ্রহণ করে বেঙ্গল থিয়েটার অভিনব ও দুঃসাহসিক কাজ করেছিল। সমাজরুচি ও নীতির দিক দিয়ে অনেক প্রতিবাদ হলেও, থিয়েটারের দিক দিয়ে যে এটি একটি বলিষ্ঠ পদক্ষেপ তা অস্বীকার করা যাবে না। পরবর্তী বাংলা থিয়েটারে অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় সুদৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
- বেঙ্গলের স্থায়ী মঞ্চ তৈরিতে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে অভিনয় প্রচেষ্টা শুরু করেন। ভুবনমোহন নিয়োগী বেঙ্গল থিয়েটারের কয়েক মাসের মধ্যেই (ডিসেম্বর, ১৮৭৩) নতুন মঞ্চ ও থিয়েটার বাড়ি তৈবি করে গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটারের পত্তন করেন।
- বিদেশী থিয়েটারের মডেলে রঙ্গমঞ্চ তৈরি করে বেঙ্গল থিয়েটার বাংলায় বিলিতি রঙ্গমঞ্চের স্থায়ী প্রতিষ্ঠার সূচনা করে। পরবর্তী সব থিয়েটারই বিলিতি থিয়েটারের আদলে তৈরি হতে থাকে।
- সেই যুগের খ্যাতনামা ব্যক্তিদের থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত করে জনসমর্থন ও আকাঙক্ষা বাড়িয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল।
- বেঙ্গলের প্রতিষ্ঠার কাল থেকেই বঙ্কিমের উপন্যাসগুলি প্রকাশ পেতে থাকে। বেঙ্গল প্রয়োজনে বঙ্কিমের প্রায় সব উপন্যাসেরই নাট্যরূপ এখানে অভিনয় করে এবং সাফল্য লাভ করে। এইভাবে বঙ্কিমের উপন্যাসের খ্যাতি বিস্তারের মূলে বেঙ্গলের প্রচেষ্টা অস্বীকার করা যাবে না। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা নাটকের বিষয়ের বিস্তারও বঙ্কিমের উপন্যাস গ্রহণের ফলে ঘটেছিল।
- নাট্যকার হিসেবে বিহারীলাল চট্টোপাধ্যায়, রাজকৃষ্ণ রায়, উপেন্দ্রনাথ দাস, অমৃতলাল বসু এই থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এঁদের মধ্যে বিহারীলালের অন্য প্রতিভার সঙ্গে নাট্যকার সত্তারও বিকাশ এই থিয়েটারের মাধ্যমেই ঘটেছিল।
- শরৎচন্দ্র, বিহারীলাল, অক্ষয় মজুমদার, প্রিয়নাথ বসু প্রমুখ বেঙ্গলের খ্যাতিমান অভিনেতারা সকলেই সখের নাট্যশালায় অভিনয়ে অভিজ্ঞ হয়েছিলেন। সাধারণ রঙ্গালয়ে তারাই সুনামের সঙ্গে অভিনয় কবে সেই অভিনয়রীতিকে অব্যাহত রাখেন।
বেঙ্গল থিয়েটারের সীমাবদ্ধতা
তবে কয়েকটি দিক দিয়ে বেঙ্গল থিয়েটারের কার্যাবলীর সমালোচনা না করে পারা যায় না—
- প্রথম দিকে বেঙ্গল থিয়েটার ছিল ধনী বাঙালির প্রাসাদ-মঞ্চের নবরঙ সংস্করণ। ধনীর জমিতে ধনীর নাতি থিয়েটার খুলেছে। তফাৎ ছিল শুধু টিকিট বিক্রির মধ্যে—এই অভিনয় আমন্ত্রণমূলক ছিল না। অনেকেই তাই বেঙ্গলের প্রথম দিককার কাজকে রাজাদের জাঁকজমকপূর্ণ শৌখিন থিয়েটারের নব্যসংস্করণ বলে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন।
- নাট্যাভিনয়ে প্রথম থেকেই এদের কোনো উচ্চ আদর্শ ছিল না। সামাজিক কোনো দায়িত্ববোধও এরা পালন করতে পারেনি। যখনই সামাজিক কোনো উত্তেজনাকর ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে, বেঙ্গল তাকে বিষয়বস্তু করে নাটক অভিনয় শুরু করেছে, এইভাবে ‘মোহান্তের এই কি কাজ’! কিংবা ‘গুইকোয়ার’ অভিনয় করে সস্তা জনপ্রিয়তা পেতে চেয়েছে। জনমত গঠনের দায়িত্ব পালন করেনি।
- আবার অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৮৭৬) কবলে পড়ার ভয়ে তারা এরপর আর কখনোই কোন দেশপ্রেমমূলক নাটক অভিনয় করেনি। সেই সময়ের অন্য থিয়েটারগুলির মতোই তারাও শুধু পৌরাণিক, সামাজিক, গীতিনাট্য-অপেরা এবং বঙ্কিমের উপন্যাসের নাট্যরূপ অভিনয় করে নিরাপদে জনপ্রিয়তা লাভ করতে চেয়েছে।
- ব্রিটিশ সরকারের প্রতি তাদের ঐকান্তিক আনুগত্যের ফলস্বরূপ তারাই প্রথম নাট্যমঞ্চ যারা অভিনয়-নিয়ন্ত্রণ আইন চালু হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে ‘রয়্যাল’ খেতাব লাভ করেছে। অনেকে সেই যুগে যাকে ‘লয়্যাল’ খেতাব বলতে চেয়েছেন।
সে যাইহোক, এসব দোষত্রুটি সত্ত্বেও বেঙ্গল থিয়েটার প্রায় ত্রিশ বছর ধরে বাংলায় নাট্যাভিনয়ের ধারাবাহিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছিল। সমসাময়িক ও পরবর্তী থিয়েটারের ওপর প্রভাব সৃষ্টি করে, বাংলা নাট্যশালার ইতিহাসে স্থায়ী আসন লাভ করেছে।
Leave a Reply