বৈষ্ণব পদাবলির পঞ্চরস সম্পর্কে আলোচনা কর।

রসশাস্ত্র ও বৈষ্ণব পদাবলি

শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং ‘শিক্ষাষ্টক’ ছাড়া অন্য গ্রন্থ রচনা করেছিলেন এমন প্রমাণ পাওয়া যায় না। কিন্তু তিনি তাঁর উপযুক্ত তিন ভক্তশিষ্য সনাতন, রূপ এবং জীবকে ভক্তিশাস্ত্র রচনায় প্রণোদিত করেন। এঁদের মধ্যে শ্রীরূপ গোস্বামী রচিত ভক্তিদর্শন ও রসশাস্ত্র পরবর্তী বৈষ্ণবধর্ম ও দর্শনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ঈশ্বর যেমন বিশ্বসৃষ্টির আগে বিধাতায় শক্তিসঞ্চার করেছিলেন, শ্রীচৈতন্য তেমনি উৎকণ্ঠিত হয়ে বৃন্দাবনে হারিয়ে যাওয়া রসলীলার কথা আবার জাগিয়ে তোলার জন্য শ্রীরূপ গোস্বামীতে শক্তি সঞ্চার করেছিলেন। আর সেই কারণেই চৈতন্যদেবের নির্দেশে গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ভগবৎ-তত্ত্বচিন্তা ও রসপরিকল্পনাকে বিধিবদ্ধভাবে পরিচালনা করার জন্য শ্রীরূপ ১৫৪১ খ্রিস্টাব্দে ‘ভক্তিরসামৃতসিন্ধু’ রচনা করেন। এতে ভক্তিরূপ উচ্চতম চিৎবৃত্তির উদ্ভব, ক্রমবিকাশ এবং চরম পরিণতির সর্বাঙ্গসুন্দর ধারাবাহিক ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়েছে। গ্রন্থটিতে মোট ২১৪১টি শ্লোক রয়েছে। গ্রন্থটি পূর্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম ও উত্তর-এই চারটি ভাগে বিভক্ত। পূর্ব-বিভাগের নাম ‘স্থায়ীভাবোৎপাদন’। এতে আবার সামান্য, সাধন, ভাব ও প্রেমভক্তি বিভেদে চারটি লহরী আছে।

পূর্ব বিভাগের প্রথম লহরীতে উত্তমাভক্তির কথা বলা হয়েছে। ভক্তি আবার দুই রকমের-শুদ্ধা এবং অশুদ্ধা। উত্তমাভক্তিকেই শুদ্ধাভক্তি বলা হয়েছে। এটি আবার তিন রকমের-সাধনভক্তি, ভাবভক্তি, প্রেমভক্তি। এরমধ্যে প্রেমভক্তি বিশেষ আনন্দময় এবং শ্রীকৃষ্ণকে আকর্ষণ করে। দ্বিতীয় লহরীতে কৃষ্ণপ্রেমের নানা বৈচিত্র্যের কথা বলা হয়েছে, কৃষ্ণপ্রেমের প্রথম অবস্থাকে বলা হয় সাধনভক্তি। এই ভক্তি আবার দুই প্রকার-বৈধী ও রাগানুগা। সাধনভক্তির অঙ্গ মূলত নয়টি ভাগে বিভক্ত—১) শ্রবণ, ২) কীর্তন, ৩) স্মরণ, ৪) পাদসেবন, ৫) অর্চন, ৬) বন্দন, ৭) দাস্য, ৮) সখ্য, ৯) আত্মনিবেদন। তৃতীয় লহরীতে ভাবভক্তি আবির্ভাবের প্রকারসমূহের বিবরণ আলোচিত হয়েছে। মোট তিন প্রকারের ভাব আবির্ভূত হয়—১) সাধনায় অভিনিবেশের ফলে, ২) শ্রীকৃষ্ণের প্রসাদে বা দয়ায়, ৩) ভক্তির প্রসাদে। চতুর্থ লহরীতে দুই ধরনের প্রেমভক্তির কথা বলা হয়েছে-১) ভাবোত্থ, ২) অতিপ্রসাদোত্থ। দক্ষিণ বিভাগের প্রথম লহরীতে ভক্তি বা প্রেমের আলম্বন ও উদ্দীপন বিভাবের কথা বলা হয়েছে। দ্বিতীয় লহরীতে অনুভাবের বর্ণনা আছে। তৃতীয় লহরীতে স্তম্ভ, স্বেদ, রোমাঞ্চ, স্বরভেদ প্রভৃতি অষ্টসাত্ত্বিক ভাবের বর্ণনা আছে। চতুর্থ লহরীতে নির্বেদ, বিষাদ, দৈন্যসহ মোট তেত্রিশটি ব্যভিচারী বাবের বর্ণনা আছে। পঞ্চম লহরীতে স্থায়ীভাবের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এই স্থায়ীভাবের রস দুই প্রকার—মুখ্য ও গৌণ। মুখ্য রস পাঁচ প্রকার—শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর। গৌণ রস সাত প্রকার—হাস্য, অদ্ভুত, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস। পঞ্চম বিভাগের প্রথম থেকে পঞ্চম লহরী পর্যন্ত পাঁচটি মুখ্য রসের বিবরণ দেওয়া হয়েছে। উত্তর বিভাগে প্রথম থেকে সপ্তম লহরী পর্যন্ত ক্রমশ হাস্য, বীর, করুণ, রৌদ্র, ভয়ানক ও বীভৎস প্রভৃতি গৌণ সপ্তরসের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!