ভক্তের আকুতি: মানব মনের চিরন্তন আকুতির প্রকাশ— ব্যাখ্যা কর।
ভক্তের আকুতি: মানব মনের চিরন্তন আকুতির প্রকাশ
ধর্ম যদি প্রথাবদ্ধতায়, সীমাবদ্ধতার কারণে সীমায়িত হয়ে পড়ে তাহলে সেখানে আচারসর্বস্ব যান্ত্রিকতার আবির্ভাব হয়। প্রথাবদ্ধ ধর্মমতে গতানুগতিকতা মুখ্য হয়ে ওঠে। ধর্মমত প্রথাবদ্ধ আচার-আচরণে পরিণত হলে দার্শনিকতা বা তাত্ত্বিকতা সম্পর্কে মনে কোনো জিজ্ঞাসার আবির্ভাব হয় না। ফলে প্রথাবদ্ধ ধর্মমত গতানুগতিক ও বৈচিত্র্যহীন হয়ে পড়ে। আর যদি এই জাতীয় প্রথাগত ধর্মমতকে কেন্দ্র করে কোনো শিল্পাদর্শের— সঙ্গীত, কবিতা ইত্যাদির আবির্ভাব হয় তবে তাও ধর্মমত স্বীকৃত প্রথানুগত শিল্পে পরিণত হয়। কিন্তু শাক্ত পদাবলি পাঠ করলে দেখা যায় যে, শাক্তমতের সর্বজনস্বীকৃত সাধারণতত্ত্বকে কেন্দ্র করে পদগুলি রচিত হলেও কোনো রচয়িতাই তত্ত্বের কাছে গতানুগতিকভাবে আত্মসমর্পণ করেননি।
আর এর ফলেই প্রতিটি পর্যায়ের পদের রসাস্বাদের ফলশ্রুতি ভিন্নতর। অবশ্য একথাও যথার্থ যে, কোনো কোনো পদরচয়িতা শাক্তধর্মমতকে অবলম্বন করে পদরচনাকালে তত্ত্বের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। ফলে তাদের পদগুলি তত্ত্বের অতিরিক্ত হৃদয়াবেগের স্পর্শে চিরকালীন পাঠকহদয়ে অমরত্ব লাভ করতে পারেনি। যেখানে পদকর্তারা তত্ত্বের আনুগত্য স্বীকার করেও, গতানুগতিকতাকে বর্জন করে কাব্যত্ব অর্জনে প্রয়াসী হয়েছেন, সেখানে কবিকল্পনার বিচিত্র বর্ণসম্পাতে পদগুলি পাঠকহৃদয়ে সপ্তবর্ণ ইন্দ্রধনুর বিচিত্র, বর্ণালিম্পনের ছায়াপাত ঘটিয়েছে। ‘ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের পদগুলি সম্বন্ধে এই বক্তব্য যথার্থ।
‘ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের পদগুলির প্রতি পাঠকের দৃষ্টি প্রথমেই যে কারণে আকৃষ্ট হয় তা হলো—পদগুলিতে দুঃখবেদনাহত মানবজীবনের বিচিত্র মর্মস্পর্শী আলেখ্য চিত্রিত হয়েছে। মানুষ যেন দুঃখের ডিক্রি জারির আসামি। আদালত থেকে অন্যায়ভাবে তার ওপর ডিক্রি জারি করা হয়েছে। এই অন্যায় অবিচার থেকে রক্ষার জন্যে কেউ তাকে সহানুভূতি দেখায় না। মানবজীবনের এই মর্মান্তিক দুঃখ-বেদনা জানানোর কালে স্বাভাবিকভাবে মাতৃরূপের বর্ণনাও আলোচ্য পর্যায়ের পদের অনর্ভুক্ত হয়েছে। অবশ্য লক্ষ্যণীয় ব্যাপার এই যে, এই জাতীয় পদে মাতৃরূপের তন্ত্রসম্মত বর্ণনা অনুপস্থিত। মা কখনো করুণাময়ী জন্মদাত্রী, আবার কখনো বা করুণাহীনা জন্মদাত্রী রূপে এখানে চিত্রিত।
কারণ, এখানে শাস্ত্রসম্মত মাতৃমূর্তি অপেক্ষা মায়ের মানবিক আবেদনই পদকর্তাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। আসল কথা, ‘ভক্তের আকুতি’ পর্যায়ের পদে পদকর্তাদের মূল লক্ষ্য মাতৃস্নেহ লাভ, দুঃখাহত মানুষের বেদনাদীর্ণ রূপাঙ্কন ও মাতৃরূপের বর্ণনা কোনোটাই সেখানে মুখ্য নয়। মাতৃস্নেহপ্রাপ্তির চিরন্তন আকুতিই এই জাতীয় পদের কেন্দ্রীয় নিয়ন্তক শক্তি। স্নেহময়ী মাতৃরূপে দেবীকে চিত্রিত করে শাক্তপদকর্তারা নিজেদের দুঃখ বেদনার কথা জানিয়েছেন, আবার মা যখন সন্তানের সহস্র দুঃখে বিচলিত নন, তখন অভিমানবশে সন্তান তাকে পাষাণী, স্নেহহীনা রূপে সম্বোধন করতেও পশ্চাপদ হন না। প্রকৃতপক্ষে উদ্দেশ্য একটাই— মায়ের প্রতি অভিমান প্রদর্শন করে স্নেহ প্রাপ্তির আকুতি। ভক্তের আকুতি পর্যায়ের সর্বত্র মানবমনের চিরন্তন আকুতির অনিবার্য প্রকাশ। তবে লক্ষণীয় এই যে, ভক্তের আকুতি পর্যায়ে সঙ্কলিত ছিয়াত্তরটি পদের কোনটিই পুনরাবৃত্তিতে আক্রান্ত নয়, বৈচিত্র্যহীনতা নয়, বৈচিত্র্যই এদের সম্পদ।
সাধককবি রামপ্রসাদ সেনের শিল্প-সৌন্দর্যমণ্ডিত অতুলনীয় প্রসাদীসঙ্গীতকে কেন্দ্র করেই অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে শাক্ত পদাবলির জয়যাত্রা শুরু। অবশ্য তার পূর্ববর্তীকালে বেশ কয়েকশো বছর ধরে মঙ্গলকাব্য ও শিবায়নে শক্তিদেবীর যে বিভিন্ন রূপ ও চরিত্র প্রকাশিত হচ্ছিল, রামপ্রসাদের রচিত সঙ্গীতে তার গুণগত পরিবর্তন লক্ষিত হলো। মঙ্গলকাব্যের দেবদেবী বন্দনার মূলে যে স্বার্থবুদ্ধি ছিল, রামপ্রসাদে সেখানে নিঃস্বার্থ ভক্তিবাদ লক্ষ করা গেল। রামপ্রসাদ বৈষ্ণব সাধকোচিত নিষ্কাম মনোবৃত্তি নিয়ে জগজ্জননীকে সমস্ত প্রকার স্বার্থবুদ্ধি ও সাম্প্রদায়িকতার উপরে স্থাপন করে জননীর বিশ্বজননী রূপ প্রতিষ্ঠা করলেন। সন্তানের আকুতির কাব্যরূপে শাক্ত পদাবলি
নতুন মর্যাদা লাভ করলো। রামপ্রসাদ কিন্তু কোথাও ব্যক্তিগত সুখসমৃদ্ধির জন্য এ প্রার্থনা করেননি; তাঁর মূল অভিযোগ হলো, যার জননী বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃজয়িত্রী, তার এত দুঃখ ভোগ কেন।
রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ মণ্ডিত বিশ্বপ্রপঞ্চে মানুষ বার বার জন্মগ্রহণ করে এবং আপন সত্যস্বরূপ বিস্মৃত হয়। পঞ্চেন্দ্রিয় ও ষড়রিপুর তাড়নায় বিভ্রান্ত মানুষ পৃথিবীর মায়ায় এমনই আচ্ছন্ন হয়ে যায় যে, জীবদেহ যে জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর অধীন তা বিস্মৃত হয়। তারপর মৃত্যুর চরম মুহূর্তে তার চৈতন্য উদ্দীপ্ত হয়। কিন্তু তখন আর সময় থাকে না। মৃত্যু-পূর্ববর্তী দুঃসহ নরক যন্ত্রণার অংশীদার মানুষ নিদারুণ হাহাকারের মধ্যে দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করে। জগজ্জননীর সন্তান হওয়া সত্ত্বেও মানুষের নিদারুণ বিপর্যয় কেন— ভক্তের মনে জাগে এই অনিবার্য প্রশ্ন। প্রচণ্ড অভিমানের বশবর্তী হয়েই ভক্ত যেমন মায়ের কাছে নানা অনুযোগ জানিয়েছে, তেমনি সংসারের দুঃখ-বিপদ থেকে তাকে উদ্ধারের জন্যে প্রগাঢ় আকুতি জানিয়েছে।
তাদের এই আকৃতির মর্মকেন্দ্র মায়ের অভয়পদ প্রাপ্তির অন্ত আকুলতা। মাতৃপদ প্রাপ্তির জন্যে নিঃসীম আকাঙ্ক্ষা থাকলেও তারা পারিপার্শ্বিক জগৎ বিস্মৃত হননি। সাংসারিক জীবনের সঙ্গে তারা ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। সমাজ সংসার পরিত্যাগ করে তারা নিরালম্ব সাধনার পথে বা বাড়াননি। তারা সমাজসচেতন ভক্ত-সাধক ছিলেন বলেই তাদের প্রগাঢ় আধ্যাত্মিক আকুতির সঙ্গে যুগজীবন যাপনের দুঃসহ গ্লানিরও কাব্যরূপায়ণ ঘটেছে।
অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের সামাজিক-রাষ্ট্রনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ওই সময় বাংলা দেশে শোচনীয় অরাজকতা বিদ্যমান ছিল। দিল্লীর রাষ্ট্রবিপ্লবের ফলে বাংলাদেশের সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, অর্থনৈতিক জীবনে প্রবল দুর্দিন দেখা দিল। দিল্লীর শাসন কর্তৃপক্ষের প্রভাব ক্রমবিলীয়মান, বাংলাদেশের নবাবী মসনদকে কেন্দ্র করে বিদ্বেষ, ষড়যন্ত্র ও আত্মকলহ— ইতিহাসের এই সঙ্কটের সুযোগে বণিকবেশী ইংরেজ আপন আধিপত্য বিস্তারে সচেষ্ট হয়। এই অবস্থায় মারাঠাদের আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের কৃষিকেন্দ্রিক ভূমি-উপজীবী মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হলো। পর্তুগীজ জলদস্যুদের উপদ্রবে বাংলার বাণিজ্যের অবস্থাও শোচনীয় অবস্থা প্রাপ্ত হলো।
শাসন কর্তৃপক্ষের করভারে জাতি বিপর্যস্ত হল; দৈনন্দিন অর্থনীতির জগতে দুর্গতির ঘনায়মান মেঘচ্ছায়া বিস্তারিত হলো। কুশাসন, দস্যুর উপদ্রব, ভয়াবহ অর্থসঙ্কট, নির্মম প্রজাশোষণ, অবাধ লুন্ঠন, হত্যা, মৃত্যু, নীলাম, পেয়াদার অত্যাচার, ডিক্রিজারি ও নবাবের অত্যাচার—সর্বাঙ্গীণ বিপদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে জাতি জগজ্জননীর চরণে আশ্রয়লাভের জন্যে ব্যাকুল প্রার্থনায় আকাশ বাতাসে উন্মথিত করে তুললো। বিশ্বজননীর কাছে আপন অবস্থা বিবৃত করে ভয়াবহ নৈরাজ্য ও নৈরাশ্যের অন্ধকার থেকে মুক্তির জন্যে প্রার্থনা জানালো। শাক্তপদকর্তারা তাদের রচিত শক্তি গীতিসঙ্গীতে আধ্যাত্মিক আকুতির সঙ্গে সঙ্গে যুগের নির্মম দুঃসহ দুঃখ-বেদনার কথাও উল্লেখ করলেন।
অত্যাচারীও যদি মাতৃসন্তান হয় তবে তাকে শুভবুদ্ধি প্রদান করা মায়ের কর্তধ্য। কিন্তু তা হয় না বলেই ভক্তের মনে অভিমান জেগেছে যে জগৎচিন্তাময়ী জননীই তার এই দুঃখের কারণ? অবশ্য তার জন্যে মাকে পরিত্যাগ করা যায় না। ভক্ত শিশুর মত “মা”, “মা” বলে ক্রন্দন করে মাকে সর্বপ্রকার দুঃখের কারণ জেনেও মায়ের চরণে আশ্রয় প্রার্থনা করে। ফলে ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে সংসারের দুঃখকষ্ট এবং পীড়িত মানবহৃদয়ের গভীর আর্তি একটা সাধারণীকৃত রূপ লাভ করে শাক্ত পদাবলির কাব্যের সামগ্রী হয়ে উঠেছে।
অষ্টাদশ শতাবীর দ্বিতীয়ার্ধে দেশে মাৎস্যন্যায় চলাকালে সাধারণ দরিদ্র মানুষের মর্মান্তিক দুঃখ কবির আধ্যাত্মিক আকৃতির পদে স্মরণীয় ছত্রে লিপিবদ্ধ হয়—“আমি তাই অভিমান করি/আমায় করেছ গো মা সংসারী। অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসার সবারি। ও মা তুমি কোন্দল করেছ বলিয়ে শিব ভিখারী’’। সংসার কর্তব্যে নিষ্ঠুরভাবে বিজড়িত রামপ্রসাদের এই ব্যক্তিগত অভিমানের পাশাপাশি এই সর্বজনীন সত্যের প্রতিলিপিটি সে যুগের সামগ্রিক হতাশারই ধ্রুবপংক্তি। অর্থ বিনা ব্যর্থ যে এই সংসার সবারই। পাইক, পেয়াদা, শমন, ডিক্রিজারি, বিনাবিচারে কয়েদ প্রভৃতি যুগের নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বাস্তব জীবনের অবস্থা কবিরা তাদের কাব্যে রূপক হিসেবে ব্যবহার করে যে সমস্ত পদ রচনা করেছেন, সেখানে আধ্যাত্মিক আকুতির সঙ্গে দুঃখকষ্ট পীড়িত মানব হাদয়ার্তিও অনুপমভাবে মিশ্রিত হয়েছে—
১. মাগো তারা, ও শঙ্করি,
কোন অবিচারে আমার পরে করলে, দুঃখের ডিক্রী জারি
এক আসামী ছয়টা প্যাদা বল মা কিসে সামাই করি।
আমার ইচ্ছা করে, ঐ ছয়টারে বিষ খাওয়ায়ে প্রাণে মারি।
২. মা আমায় ঘুরাবে কত,
কলুর চোখ-ঢাকা বলদের মত?
ভবের গাছে বেঁধে দিয়ে মা, পাক দিতেছ অবিরত।
তুমি কি দোষ করিলে আমায় ছটা কলুর অনুগত।
৩. মলেম ভূতের বেগার খেটে
আমার কিছু সম্বল নাইকো গেঁটে।
অত্যাচারীর কবলে পতিত হয়ে নিদোর্ষ ব্যক্তি সমস্ত হারিয়ে দুঃখের জীবন অতিবাহিত করতে বাধ্য হয়। অন্যদিকে আবার সে ভবসংসারে যেন দীর্ঘ মেয়াদের কয়েদী। অসহায় জীব দুঃখের দহনে দগ্ধ। তাই সে আর্তনাদ করে ওঠে— ‘এবার হল না সাধনা, ওমা শবাসনা, সংসার বাসনা বড়ই প্রবল।’ নিঃসম্বল জীব ভূতের বেগার খেটে মরে, পঞ্চভূত ষড়রিপু-দশেন্দ্রিয় তাকে বিপর্যস্ত করে; ফলে তার আকুলতা ক্রমবর্ধিত— ‘‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা/আমার কেহ নাই শঙ্করী হেথা।’’ অবশেষে জীবন সায়াহ্নে করুণ মিনতিতে ভেঙে পড়ে আর্তস্বরে উচ্চারণ করে— “সারাদিন করেছি মাগো সঙ্গী লয়ে ধূলা খেলা/ধুলা ঝেড়ে কোলে নে মা, এসেছি গো সন্ধ্যাবেলা।” শাক্ত পদাবলির অন্তর্গত ভক্তের আকুতি শীর্ষক পদণ্ডলির মধ্যে শাক্ত কবিদের একটি গভীর দুঃখচেতনা ও স্নেহবুভূক্ষা লক্ষ করা যায়। শাক্ত পদাবলীর উদ্ভবকালের অন্তর্বেদনা ও কবিদের সামাজিক ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে, এই কারণেই বলা যায় যে, জীবনের প্রাত্যহিক সংসার যাতনা ও দৈন্যদুর্দশার হৃদয়ার্তিই যেন সাধারণীকৃত হয়ে ভক্তের আকুতিতে কাব্যসামগ্রীতে পরিণত হয়েছে।
Leave a Reply