//
//

বাংলা নাটকের ইতিহাসে মধুসূদন দত্তের অবদান আলোচনা কর।

মধুসূদন দত্ত

মধুসূদন (১৮২৪-১৮৭৩) ছিলেন প্রতিভাধর ব্যক্তিত্ব। নাটকের সূত্র ধরেই বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকবি মধুসূদনের প্রথম আবির্ভাব। মধুসূদনের আবির্ভাবে বাংলা নাটক সংস্কৃত নাটকের প্রভাব থেকে দূরে সরে গেল। মধুসূদনের আবির্ভাবের পুর্বে তখন বাংলা নাটকের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ও ইংরেজি নাটকের অনুবাদ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। রঙ্গমঞ্চও গড়ে উঠছিল। রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করে দিয়েছিলেন মধুসূদন। অন্যদিকে বেলগাছিয়া নাট্যশালা স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই কারণে যে, এই রঙ্গালয়কে কেন্দ্র করে নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাব।

মধুসূদন থেকেই বাংলা নাটকের বিকাশ-পর্ব শুরু হয়। একদিকে প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা রক্ষার অন্যদিকে ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য এই দুয়ের সংঘাতে বাংলা নাটকের বিকাশপর্ব শুরু। এই সময়ের সঙ্গে এলিজাবেথীয় যুগের নাটকের পরিবেশগত সাদৃশ্য আছে। তাঁর প্রথম নাটক ‘শর্মিষ্ঠা’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৯ সালের জানুয়ারী মাসে। রাজনারায়ণ বসুকে লিখিত মধুসূদনের চিঠি থেকে জানা যায় যে, তা অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। মধুসূদন বিজ্ঞাপনে লিখেছিলেন— “Should the drama ever again in India, posterity will not forget these noble gentlemen, the artist friends of our rising national theatre.”  ১৮৫৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর তারিখের এক পত্রে যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর গৌরদাস বাসকে লেখেন— “The representation of the drama of Sharmistha has come off gloriously. Night before last was the sixth of last night of its performances.”

শর্মিষ্ঠা

‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকের কাহিনি মহাভারতের আদি পর্বের অন্তর্ভুক্ত। তা শর্মিষ্ঠা-যযাতি-দেবযানীর কাহিনি থেকে নেওয়া হয়েছে। নাটকের কাহিনি এরকম কচ-প্রদত্ত সঞ্জীবনী বিদ্যায় দেবতারা বলীয়ান হলেন। এক সময় ইন্দ্র সুন্দর এক কাননের ভিতরে অবস্থিত সরোবরে স্ত্রীলোকদেরকে জলবিহারে রত দেখে তিনি তাদের পরার কাপড়গুলি মিশিয়ে দিলেন। শর্মিষ্ঠা ভুলবশত দেবযানীর কাপড় পরলে তিনি রুষ্ট হন। শর্মিষ্ঠাও ক্রুদ্ধ হয়ে দেবযানীর বাবা শুক্রাচার্য তার পিতার অন্নে জীবিকা নির্বাহ করে বলে জানায়। এরপর দেবযানী তাকে টেনে ধরলে শর্মিষ্ঠা দেবযানীকে কূপে নিক্ষেপ করে। এই সময় মৃগবিহারী রাজা যযাতি দেবযানীকে কূপ থেকে উদ্ধার করেন। এরপর বিচারে শর্মিষ্ঠা দেবযানীর নিযুক্ত হয়। শর্মিষ্ঠাকেও যযাতি বিবাহ করেন—শুক্রাচার্যের নিষেধ সত্ত্বেও। ফলে তিনি শুক্রাচার্যের অভিশাপগ্রস্ত হন। পাঁচ অঙ্কে ও তের গর্ভাঙ্কে এই কাহিনি বিন্যস্ত। নাট্যশিল্পের প্রয়োজনে মহাভারতের কাহিনির পরিবর্তন সাধন করেছেন মধুসূদন। নাট্যকার এই নাটকে ভারতীয় আলংকারিক রীতি অনুসরণ না করে পাশ্চাত্য রীতি গ্রহণ করেছেন।

চরিত্র চিত্রণের ক্ষেত্রেও, নাট্যকার বিশেষ পারদর্শিতা দেখাতে পারেননি। ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক গদ্যে লেখা। এই গদ্য ভাষার কোন আদর্শ তিনি তুলে ধরতে পারেননি। মধুসূদন রূপবর্ণনার ক্ষেত্রে কালিদাসকে অনুসরণ করেছেন। এই নাটকে সংলাপের ক্ষেত্রে যে আড়ষ্টতা তার কারণ কবিত্বপূর্ণ বর্ণনা ও আলংকারিক বাক্য বিন্যাস। এজন্য দীর্ঘ সংলাপ ও স্বগতোক্তির ব্যবহার করেছেন। সুতরাং ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটকে নানা ত্রুটি থাকলেও বাংলা নাটকের বিকাশ পর্বে এই নাটক স্মারকচিহ্ন হয়ে থাকবে।

পদ্মাবতী

১৮৬০ সালের মে মাসে ‘পদ্মাবতী’ নাটকের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়। সুন্দরী নারীর স্বাভাবিক ঈর্ষা নিয়ে এই নাটকটি রচিত। এই নাটকের কাহিনি গ্রীক পুরাণ থেকে গৃহীত। তবে ভারতীয় পরিবেশের আদলে তিনি এই কাহিনিকে সাজিয়েছেন। নাট্যকার মূল কাহিনি থেকে বিচার দৃশ্য ও পরাভূত দুই দেবীর ক্রোধজাত প্রতিক্রিয়াকে গ্রহণ করেছেন। গ্রীক পুরাণের কামনালব্ধ প্রেমকাহিনির পরিণতিকে নাটকে গ্রহণ না করে মধুসূদন তাকে জীবনের লীলাচঞ্চল তরঙ্গভঙ্গে স্থাপন করেছেন। তিনি বিরহ-সন্তপ্ত নায়ক-নায়িকার প্রণয়কাহিনিকে গুরুত্ব দিয়েছেন।

‘পদ্মাবতী’ মোটামুটিভাবে সংস্কৃত নাটকের আদর্শে রচিত। কালিদাসের ‘শকুন্তলা’ নাটকের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন। ভারতীয় রীতি মেনেই মধুসুদন নাটকের পাত্র-পাত্রীদের নামকরণ করেছেন। ‘পদ্মাবতী’তেও মধুসূদন সংস্কৃতের ধারা অনুসরণ করে শৃঙ্গার বা প্রেম রসকে মুখ্য স্থান দিয়েছেন। ঘটনা সংস্থাপন ও চরিত্র বর্ণনার দিক থেকে মধুসূদন কালিদাসকে অনুসরণ করেছেন। ভাষাও সংস্কৃতানুগ। সংলাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে এই নাটকে নাট্যকার পূর্বের নাটকের থেকে বেশি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। এই নাটকে প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দের ব্যবহার করেন তিনি।

কৃষ্ণকুমারী

মধুসূদনের তৃতীয় নাটক ‘কৃষ্ণকুমারী’র রচনাকাল ১৮৬০ সালের সেপ্টেম্বর এবং এর প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৮৬১ সালের শেষের দিকে। কেশবচন্দ্রকে লিখিত এক পত্রে তিনি ‘কৃষ্ণকুমারী’ রচনার প্রেরণা ব্যাখ্যা করেন। তিনি দু’রাত্রি টডের রাজস্থানের ইতিহাস পাঠ করেছেন। বিগত রাত্রে একটার সময় কাব্যলক্ষ্মী প্রসন্না হলেন। এর বিষয়বস্তু তার মনকে উৎফুল্ল করে তুলেছিল। তিনি লিখেছিলেন—‘‘What a romantic tragedy it will make. বেলগাছিয়া রঙ্গমঞ্চে ‘কৃষ্ণকুমারী’ অভিনীত হয় মধুসূদনের ইচ্ছায়। কেশবচন্দ্রকে একটি পত্রে তিনি লিখেছিলেন—‘‘What I want is to have it acted by such an actor as your noble self.’’ ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি শোভাবাজার নাট্যশালায় ‘কৃষ্ণকুমারী’ মঞ্চস্থ হয়। অভিনয়ের পর ১১ ফেব্রুয়ারীতে হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকা এই নাটক সম্বন্ধে লিখেছিল—‘কৃষ্ণকুমারী’ বাংলা ভাষায় রচিত মৌলিক ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক। এরপর জোড়াসাঁকো নাট্যশালা এবং ন্যাশানাল থিয়েটারে তা অভিনীত হয়।

‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকের কাহিনি টডের রাজস্থান থেকে গৃহীত। মূল কাহিনি ইতিহাস থেকে সংগৃহীত হলেও মধুসূদন এর ঐতিহাসিক পরিবেশ অক্ষুন্ন রেখে একে রোমান্টিক ট্রাজেডির রূপ দিয়েছেন। ঐতিহাসিক ট্রাজেডি হিসেবে এটি প্রথম নাটক। এই নাটকেই প্রথম নাট্যকার সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য রীতি অনুসরণ করেছেন। রাণা ভীমসিংহের কুমারী কন্যা কৃষ্ণা রাজ্যের কল্যাণে এবং পিতাকে দারুণ বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ ও তার-ই পরিণামী ঘটনা এই নাটকের প্রধান বিষয়বস্তু। মধুসূদন টডের ইতিহাস থেকে মেবারের এমন এক সঙ্কটপূর্ণ অধ্যায়নি করেছেন যা তার চরম দুর্ভাগ্যের কাহিনিকেই তুলে ধরে। কৃষ্ণার অকালমৃত্যু শোক ও নিষ্ঠুর ঘটনা সন্দেহ নেই, কিন্তু এর ব্যঞ্জনা ব্যাপকতর। এর মধ্যে দিয়ে মেবারের নির্বাপিতপ্রায় শেষ ম্লান রশ্মিটুকু মিলিয়ে যাওয়ার করুণ কাহিনি ব্যক্ত হয়েছে।

‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে মধুসূদনের জাতীয়তাবাদের সুর উচ্ছ্বসিত হয়ে এর ঐতিহাসিক রসকে আচ্ছন্ন করেনি। নাট্যকারের কৃতিত্ব এই যে, তিনি ইতিহাসের তথ্য অক্ষুণ্ন রেখে একাধারে ভীমসিংহের ট্রাজিক পরিণাম, দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য কৃষ্ণার আত্মদান, কন্যার শোকে রাজমহিষীর মৃত্যু এবং অন্যদিকে ঐতিহ্যমণ্ডিত কিন্তু হৃতগৌরব মেবারের অনুরূপ বিপর্যয়ের কাহিনি তিনি বর্ণনা করেছেন।

‘শর্মিষ্ঠা’ ও ‘পদ্মাবতী’র তুলনায় কৃষ্ণকুমারীর ভাষা সরল, সংযত ও চরিত্রানুগ হয়েছে। চরিত্রচিত্রণের দিক থেকে ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটকে নাট্যকার কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। উদয়পুরের রাণা ভীমসিংহ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র। একদিকে কুলের মর্যাদা ও অন্যদিকে জাতির কল্যাণ সাধন এই উভয় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অসহায়ভাবে পরিস্থিতির সাক্ষী হয়ে গেছেন। অপরদিকে জগৎসিংহ ভীমসিংহের বিপরীত চরিত্র নয়। জগৎসিংহ সম্বন্ধে নাট্যকার একটি পত্রে লিখেছিলেন—“I have tried to represent Juggutsing as I find him in History, a somewhat silly and voluptuous fellow.” আবার ধনদাসের অর্থলোলুপতা, চাতুর্য, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা উজ্জ্বল রেখায় চিত্রিত। বলেন্দ্ৰসিংহ রাজভ্রাতা ও সেনাপতি। মধুসূদন তা শেক্সপিয়রের King John নাটকের বাস্টার্ড চরিত্রের আদর্শে গড়ে তুলতে চেয়েছে। কৃষ্ণকুমারী নাটকের নায়িকা। ইতিহাস থেকে প্রেরণা নিয়ে মধুসূদন তাকে ‘dignified yet gentle’ রূপে অঙ্কিত করতে চেয়েছেন। সে যাই হোক, ‘কৃষ্ণকুমারী’ মধুসূদনের যে সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

মধুসূদনের বিচিত্রধর্মী প্রতিভার উজ্জ্বল নিদর্শন হল তাঁর প্রহসন দুটি। উনিশ  শতকের মধ্যভাগে পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে বাঙালি জাতীয় জীবনে এক আমূল পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাব বাঙালি জাতিকে মানবিকতার নতুন জগতে যেমন মুক্তি দিয়েছিল, তেমনি ইংরেজদের অনুকরণের ফলে এক পচনশীল ও অনুবিকার এই নব্যপন্থীদের মধ্যে প্রবল হয়ে উঠেছিল। আচারে-ব্যবহারে, খাদ্যে-পানীয়ে, আমোদে-প্রমোদে তারই নিষ্ফল অনুকরণ বাঙালি জীবনে এক বিশাল অন্তঃসারশূন্যতাকে প্রবল করে তুলেছিল। ইয়ংবেঙ্গলের সভ্যদের এই ব্যবহারিক অনাচার ও চারিত্রিক ভ্রষ্টতা মধুসূদন ও দীনবন্ধু মিত্রের প্রহসন রচনার উৎস বলে মনে করা যেতে পারে। অবশ্য মধুসূদনের প্রহসন রচনার পেছনে ছিল দর্শকদের আকাঙ্ক্ষা। দর্শকরা বিচিত্র রসের নাটক চাইতেন বলেই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ১৮৫৯ সালে মধুসূদনকে লিখেছিলেন, প্রহসন জাতীয় নাটক রচনা করতে। মধুসূদনের দুটি প্রহসন ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ ও ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ ১৮৬০ সালে প্রকাশিত হয়। প্রহসন দুটিতে মধুসূদনের অসামান্য নাট্য প্রতিভার পরিচয় রয়েছে।

একেই কি বলে সভ্যতা?

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ প্রহসনের আলোচ্য বিষয় ইয়ংবেঙ্গল সমাজের পদস্খলন। মধুসূদন সমকালীন সমাজজীবনে যে সুসংহত জীবনাদর্শের অভাব লক্ষ করেছিলেন তাকেই এই প্রহসনে উপস্থাপিত করেছেন। রামনারায়ণের ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’র প্রেরণায় মধুসূদন সামাজিক সমস্যা নিয়ে প্রহসন দুটি রচনা করেন। ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় কাহিনির ধারাবাহিকতা নেই, কিন্তু বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে সমাজজীবনের একটি চিত্র অত্যন্ত সার্থকভাবে চিত্রিত হয়েছে। দুই অঙ্ক ও চারটি গর্ভাঙ্কে কাহিনি সমাপ্ত হয়েছে। বিচিত্র ঘটনার সমাবেশে নাট্যকার এই প্রহসনে নব্যবঙ্গ সমাজের পরিচয় পরিস্ফুট হয়ে উঠেছে। কাহিনির সুষম বিন্যাস, চরিত্রের মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও চরিত্রানুগ সংলাপ বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। স্বল্প পরিসরে নাট্যকার শিক্ষিত বাবু সমাজের আত্মাভিমান, সামাজিক সংস্কারের নামে উজ্জ্বল আচরণ ও জ্ঞানতরঙ্গিনী সভার নামে মজা লোটার ব্যঙ্গচিত্র পরিহাস রসিকতার সঙ্গে চিত্রিত হয়েছে। এই প্রহসন রচনায় নাট্যকারের নিরাসক্ত দৃষ্টিভঙ্গী, আত্মপ্রত্যয় ও মানবপ্রীতির পরিচয় সহজলভ্য। নব্যশিক্ষিত বাবুদের ব্যঙ্গ ও বিদ্রুপ ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় নাট্যরূপ পেয়েছে। স্বাধীনতার নামে প্রগলভ আচরণ, উচ্ছৃঙ্খল ভোগাকাঙ্ক্ষা ও পানাসক্তি কীভাবে একশ্রেণির মানুষের মধ্যে অবক্ষয়কে ডেকে এনেছিল তারই বাস্তব নাট্যরূপ এই প্রহসন। সমকালীন উচ্ছৃঙ্খল নব্য যুবকদের জ্ঞানতরঙ্গিনী সভায় মিলিত হয়ে যে সব কার্তিকলাপ করতো তার বাস্তব দলিল এই প্রহসন।

বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ

‘একেই কি বলে সভ্যতা?’য় যেমন নব্য ইয়ংবেঙ্গলদের শ্রেণিচরিত্রকে উপস্থাপিত করেছেন লেখক, তেমনি ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ প্রহসনে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের ধ্বজাধারীদের সমালোচনা করেছেন। নাটকটির প্রথমে নাম ছিল ‘ভগ্ন শিবমন্দির’। এই প্রহসনটি পাইকপাড়ার রাজাদের অর্থানুকূল্যে মুদ্রিত হয়েছিল। যেহেতু এই নাটকে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের সমালোচনা করা হয়েছে তাই নাটকটি মঞ্চস্থ করা হয়নি। আলোচ্য প্রহসনে ভক্তপ্রসাদের মাধ্যমে প্রবীণদের মহাজনি কারবার, অর্থলোলুপতা ও কুমারী কুল কামিনীদের সর্বনাশ সাধন প্রভৃতি চিত্রিত হয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে বাংলায় যে পুরাতন সমাজব্যবস্থা ভেঙে পড়ছিল মধুসূদন তার বাস্তব চিত্র এঁকেছেন ‘বুড়ো সালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে। পল্লীসমাজের গভীর ক্ষতের উপস্থাপনে, মহাজনি শোষণের চিত্রণে, নব্যপন্থীদের সঙ্গে সনাতন রক্ষণশীলদের দ্বন্দ্ব এবং অর্থ, প্রভুত্ব ও ক্ষমতার বলে লাম্পট্য প্রভৃতির বাস্তব চিত্র অঙ্কন করে মধুসূদন সমাজ সচেতনতার পরিচয় দিয়েছেন। মুখ্য চরিত্রে ব্যক্তিলক্ষণ তীব্রভাবে প্রকাশ করে এবং বিচ্ছিন্ন সমাজচিত্রকে গল্পের মাধ্যমে পরিবেশন করে নাট্যকার প্রহসনটিকে নাট্যরস সমৃদ্ধ করে তুলেছেন।

মায়াকানন

মধুসূদন ‘মায়াকানন’ রচনা করেছিলেন ১৮৭৩ সালে ও তা প্রথম প্রকাশিত হয় ১৮৭৪ সালে। মধুসূদন ‘মায়াকানন’ শেষ করে যেতে পারেননি। পাঁচ অঙ্কে সমাপ্ত এই নাটকটিকে পৌরাণিক নাটক রূপে উপস্থাপিত করতে চেয়েছিলেন। একদিকে অলোকসামান্য রাজকুমারী ইন্দিরা ও অন্যদিকে অভিশাপগ্রস্ত দুই গন্ধর্ব নর-নারীর শাপমোচনের কাহিনি এই নাটকের বিষয়বস্তু। নাটকের লৌকিক আবেদন অজয় ইন্দুমতীর পারস্পরিক গভীর প্রণয়কে কেন্দ্র করে উৎসারিত হয়েছে। কৃষ্ণকুমারী নাটকের সঙ্গে মায়াকাননের সাদৃশ্য কোথাও কোথাও লক্ষ করা যায়। মায়াকাননের কাহিনি গ্রীক নাটকের মতো একমুখীন। শেষ বয়সে ‘বিষ না ধনুর্গণ’ নামক একটি রূপক নাটক রচনায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন নাট্যকার, তবে তা তিনি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেননি।

মধুসূদনের নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য

  • যথার্থ বাংলা নাটকের মুক্তি মধুসূদনের হাতে শর্মিষ্ঠা প্রকাশের সঙ্গে।
  • মাইকেলের নাটকের সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য ও গুণ হল তিনি নাটকের কাহিনিকে আদি থেকে অন্ত্য পর্যন্ত দৃঢ়সূত্রে আবদ্ধ করেছেন।
  • মধুসদন প্রথম পাশ্চাত্য কলাঙ্গিককে নাটকে অনুসরণ করেছেন। তবে তিনি যেমন সংস্কৃত নাটকের প্রভাব স্বীকার করেছেন তেমনই পাশ্চাত্য নাট্যাঙ্গিকেরও অনুসরণ করেছেন।
  • মধুসূদন দুঃখ করে লিখেছিলেন—অলীক কুনাট্য রঙ্গে/ মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে/নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়। রাঢ়বঙ্গের অধিবাসীদের কুনাট্য প্রীতি দূর করে তিনি তাদের যথার্থ নাটকের স্বাদ দিতে পেরেছে বলেই নাট্যসাহিত্যে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
  • মধুসূদনের নাটকগুলি বিভিন্ন রঙ্গমঞ্চে জনপ্রিয়তার সঙ্গে অভিনীত হওয়ায় সেগুলির অভিনয় মূল্যও যথেষ্ট।
  • মধুসূদন কাব্যজগতে যেমন ছিলেন বিদ্রোহী, অসম সাহসী, অসাধারণ প্রতিভাবান, তেমনি নাটকের ক্ষেত্রে তার সেই প্রতিভার পরিচয় সাবলীল ও স্বতঃস্ফূর্ত।
  • বাংলা নাটকে (পদ্মাবতী) প্রথম তিনি অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।
  • ‘তার নাটকের সংলাপ কোন কোন ক্ষেত্রে একঘেয়ে ও বৈচিত্র্যহীন হলেও প্রহসনে তিনি যে সংলাপ ব্যবহার করেছে তার নাট্যোপযোগিতা অসাধারণ। তাঁর প্রহসন দুটিতে স্বল্পতম পরিসরের মধ্যে তাহার ব্যঙ্গের তীক্ষ্ণতা ও অভ্রান্ত লক্ষ্য তাহার নিখুঁত সঙ্গতিবোধ ও নাটকীয় উদ্দেশ্যের একমুখিতাকে উজ্জ্বলভাবে পরিস্ফুট করিয়াছে।” (শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, পৃঃ৩৪)।
  • মধুসূদনের নাট্যপ্রতিভার বৈশিষ্ট্য আলোচনা প্রসঙ্গে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছে— “মধুসূদনের নাট্যরচনায় সংস্কৃত ও পাশ্চাত্য আদর্শের অনুকরণের চিহ্ন থাকিলেও, দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ফলে ঘনীভূত নাট্যরসে নাটকীয় রসপুষ্টির জন্য ঘটনাবিন্যাসে এবং চরিত্রসৃষ্টি ও মূল্যায়নে আধুনিক যুগের বাঙালীর প্রাণধর্ম ও জীবননিষ্ঠতার পরিচয় সুস্পষ্ট।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, পৃঃ-৩৪)।
  • সুবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত নাট্যকার মধুসূদনের কৃতিত্ব আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন— ‘‘নাট্যসাহিত্যেও তাঁহার দান উপেক্ষণীয় নয়, তিনিই আধুনিক বাংলা নাটকের জনক এবং তার পরে নাট্যসাহিত্য খুব বেশী দূর অগ্রসর হয় নাই। শুধু সাহিত্যিক মানদণ্ড দিয়া বিচার করিলে বলা যাইতে পারে যে কৃষ্ণকুমারী বা বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ— এখনও বাংলা নাটকের ইতিহাসে উচ্চস্থান পাইবে।” (মধুসূদন ও কবি ও নাট্যকার১৩৮০, পৃঃ-১১৮)।
  • মধুসূদন তার নাটকে গ্রীক নাটকের ঐক্যবিধি অনুসরণ করেছেন। এজন্য তাঁর নাটকের কাহিনি দৃঢ়সংবদ্ধ ও গতিশীল।
  • মধুসূদনের নাটকের কথোপকথন একঘেয়ে এবং বৈচিত্র্যহীন। এর কারণ অনাবশ্যক ও আত্যন্তিক দীর্ঘত’। এই দীর্ঘ কথোপকথন নাটকে রসসৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। তিনি যেহেতু একাধারে কবি ও নাট্যকার তাই নাটকের মধ্যে নিসর্গ বর্ণনা ও উপমা অলংকারের প্রয়োগ করে কবিত্ব ফুটিয়ে তুলতে চেষ্টা করেছেন।
  • মধুসূদনের প্রতিভা মূলত কবির হলেও নাট্যকার হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল যথেষ্ট, তিনি বিভিন্ন উপাদান থেকে তাঁর নাটকের নাট্যচরিত্রগুলিকে গ্রহণ করলেও চরিত্রগুলি মধ্যে মৌলিকতা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। তাঁর নাটকে কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতিকে স্বীকার করে নিলে নাট্যকার ও প্রহসনকার হিসেবে তাঁর লোকচরিত্র জ্ঞান ও জন রসরসিকতার যে পরিচয় পাওয়া যায় তা নিতান্ত তুচ্ছ নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!