//
//

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা কর।

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ব্যাপ্তিকাল আনুমানিক ৬০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দ থেকে ৯০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। এই পর্বের প্রধান ভাষা হল প্রাকৃত ভাষা। এছাড়া ক্লাসিক্যাল সংস্কৃত, বৌদ্ধ সংস্কৃত, বা মিশ্র সংস্কৃত এবং পালি ভাষাও মূলত এই যুগে পড়ে। স্পষ্টত দেখতে পাচ্ছি এই যুগটি সুবিস্তৃত; প্রায় দেড় হাজার বছর হল এর ব্যাপ্তিকাল। এই সুদীর্ঘ কাল ধরে ভারতীয় আর্যভাষা নিশ্চয়ই একই রূপে স্থির হয়ে ছিল না; কালে কালে তারও পরিবর্তন হয়ে চলেছিল। এই পরিবর্তনের সূত্র ধরে মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার ইতিহাসকে বিভিন্ন উপপর্বে বা স্তরে ভাগ করা হয়। আবার ভারতবর্ষে আর্যরা ক্রমে ক্রমে বিভিন্ন অঞ্চলে যতই ছড়িয়ে পড়েছেন, তাদের ভাষার যতই ভৌগোলিক বিস্তার ঘটেছে, ততই বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের ভাষার অল্পস্বল্প আঞ্চলিক স্বাতন্ত্রও গড়ে উঠেছে। তাই মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিভিন্ন কালপর্বে বিভিন্ন আঞ্চলিক রূপও লক্ষ করা যায়। ভাষাবিজ্ঞানীরা এইসব আঞ্চলিক রূপ বা আঞ্চলিক উপভাষাকে পৃথক পৃথক প্রাকৃত রূপে অভিহিত করেছেন। মধ্য ভারতীয় আর্যভাষার বিভিন্ন কালপর্বে তার যেসব আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা গড়ে উঠেছিল তাদের প্রত্যেকটির কিছু স্বতন্ত্র ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য ছিল।

ধ্বনিতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য 

(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার দুটি অর্ধব্যঞ্জন (sonants) ধ্বনি ‘ঋ’ ও ‘৯’ মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় আর রইল না। ‘৯’-কার অনেক আগে বৈদিক সংস্কৃতেরই শেষের দিকে লোপ পেতে আরম্ভ করেছিল, মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষায় তা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গেল। ঋ-কার এক-এক রকম প্রাকৃতে এক এক রকম ধ্বনিতে পরিণত হল। যেমন— ঋ > অ/ ই/ উ/এ-(মৃগ > মগ, মিগ, মুগ; বৃদ্ধ > বুড্‌ঢ; ঋষি > ইসি); ঋ >র/ রি/ রু— (বৃক্ষ > ব্ৰচ্ছ, ব্রুচ্ছ, মৃগ > ম্রিগ, মুগ; ঋসি > রিসি)|

(খ) ‘ঐ’ এবং ‘ঔ’—এই দুটি যৌগিক স্বর একক স্বরে— যথাক্রমে ‘এ’ এবং ‘ও’-তে—পরিবর্তিত হল। যেমন— ঐ > এ (ধর্মানুশস্তৈ > ধম্মানুসত্থিয়ে) ; ঔ > ও (ঔষধানি > ওসধানি);

(গ) ‘অয়’ এবং ‘অব’ সঙ্কোচনের (contraction) ফলে যথাক্রমে ‘এ’ এবং ‘ও’ স্বরধ্বনিতে পরিণত হল। যেমন—অয় > এ (পূজয়তি > পূজেতি/ পূজেদি/ পূজেই); অব > ও (ভবতি > ভোদি, হোদি/ হোই) ;

(ঘ) পদান্তে স্থিত অনুস্বারের (ম্ > ং) পূর্ববর্তী এবং যুক্তব্যঞ্জনের পূর্ববর্তী দীর্ঘস্বর হ্রস্বস্বরে রূপান্তরিত হল। যেমন— কান্তাম্ > কন্তং, দীর্ঘ > দিগঘ।

(ঙ) পূদের অন্তে অকারের পরে অবস্থিত বিসর্গ লোপ পেয়েছে এবং সেই বিসর্গের পূর্ববর্তী অকার কখনো ও-কারে, কখনো এ-কারে পরিণত হয়েছে, যেমন—জনঃ > জন > জনো/ জনে; অ-কার ছাড়া অন্য স্বরের পরবর্তী বিসর্গ শুধু লোপ পেয়েছে, যেমন— পুত্রাঃ > পুত্তা।

(চ) পদের শেষে অবস্থিত অনুস্বার (ং) সাধারণত রক্ষিত হয়েছে। যেমন নরম > নরং, এছাড়া পদান্তে স্থিত বাকি সব ব্যঞ্জনধ্বনি লোপ পেয়েছে। যেমন— নরাৎ > নরা।

(ছ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যের তিনটি শিস্ ধ্বনির (শ, ষ, স) সব ক’টি কোনো প্রাকৃতেই রক্ষিত হয়নি, তিনটির জায়গায় একটি মাত্র শিস ধ্বনির ব্যবহার প্রচলিত ছিল— কোনো প্রাকৃতে দন্ত্য ‘স’, কোনো প্রাকৃতে তালব্য ‘শ’। মূর্ধন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে পরিবর্তিত হয়েছে, কেবল কোনো কোনো প্রাকৃতে অল্প কিছু কাল প্রচলিত ছিল। যেমন— শুশ্রূষা > সূস্রূষা/ সুসূসা।

(জ) মধ্য ভারতীয় আর্য ভাষার দ্বিতীয় স্তরে দেখা যায় দুই স্বরের মধ্যবর্তী একক ব্যঞ্জন অল্পপ্রাণ হলে লোপ পেয়েছে এবং তার স্থানে পরে কখনো কখনো য়-শ্রুতি বা ব-শ্রুতি হয়েছে (যেমন—সকল > সঅল > সয়ল), আর মহাপ্রাণ হলে হ-কারে পরিণত হয়েছে (যেমন— মুখ > মুহ)।

(ঝ) ঋ, র, ষ ধ্বনির পরবর্তী দন্ত্য ধ্বনি (ত, থ, দ, ধ, ন) পরিবর্তিত হয়ে মূর্ধন্য ধ্বনির (ট, ঠ, ড, ঢ, ণ) রূপ লাভ করেছে। যেমন— কৃত > কট।

(ঞ) পদের আদিতে অবস্থিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের দু’রকম পরিবর্তন ঘটেছে। কখনো পদের আদিতে অবস্থিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের অন্তর্গত দুটি ব্যঞ্জনধ্বনির মধ্যে একটি লোপ পেয়েছে। যেমন ত্রীণি > তিন্নি। কখনো পদের আদিতে অবস্থিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের অন্তর্গত ব্যঞ্জনগুলির মাঝখানে স্বরধ্বনি এসে সংযুক্ত ব্যঞ্জনকে বিশ্লিষ্ট করে দিয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে বিপ্রকর্ষ বা স্বরভক্তি বলা হয়। যেমন—দ্বাদশ > দুবাদস (‘দ’ ও ‘ব’-এর মাঝখানে ‘উ’ ধ্বনির আগম)।

(ট) পদের মধ্যে অবস্থিত সংযুক্ত ব্যঞ্জনের অন্তর্গত বিষম ধ্বনিগুলি সম ধ্বনিতে পরিণত হয়েছে। একে সমীভবন বলা হয়। যেমন—ভক্ত (ভ্ + অ + ক‌্ + ত‌্ + অ) > ভত্ত (ভ‌্ + অ + ত‌্ + ত‌্ + অ)। এখানে লক্ষণীয় যে, ‘ক্ত’ আপাত দৃষ্টিতে পদের অন্তে অবস্থিত মনে হলেও সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে এটি তা নয়, কারণ শেষে ‘অ’ উচ্চারিত হচ্ছে। এই ‘ক্ত’-এর অন্তর্গত বিষম ব্যঞ্জন দু’টি (ক + ত‌্) সমধ্বনিতে (ত +ত্ ) পরিণত হয়েছে।

(ঠ) সংযুক্ত ব্যঞ্জনের মধ্যে কেবল ক্ষ’ (ক + য)-এর পরিবর্তন হয়েছে স্বতন্ত্র ধারায়। এটি কখনো হয়েছে ‘কখ’, কখনো বা ‘চছ’। যেমন—বৃক্ষ > লুকখ, রুচ্ছ।

রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য

প্রাচীন ভারতীয় আর্যভাষার তুলনায় মধ্য ভারতীয় আর্যে শব্দরূপ, ক্রিয়ারূপ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নানা দিক থেকে সরলতা দেখা গেল। যেমন—

(ক) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে শব্দের অন্তে স্থিত ধ্বনির পার্থক্য অনুসারে শব্দরূপ পৃথক হত। কিন্তু মধ্য ভারতীয় আর্যভাষায় সাধারণত আ-কারান্ত, ই-কারান্ত ও উ-কারান্ত শব্দ ছাড়া বাকি সব শব্দের রূপ অ-কারান্ত (যেমন-নর’) শব্দের মতো হত। এমনকি ই-কারাস্ত ও উ-কারান্ত পুংলিঙ্গ ও ক্লীবলিঙ্গ শব্দেও অ-কারান্ত শব্দের প্রভাব ছিল। যেমন ‘মুনি’ শব্দের ৬ষ্ঠীর এক বচনে মুনি (তুলনীয়-নরস্‌স)।

(খ) ব্যঞ্জনান্ত শব্দগুলির মধ্যে যেসব শব্দের শেষে অনুস্বার ছিল শুধু সেইগুলি ব্যঞ্জনান্ত রইল। অন্য ব্যঞ্জনান্ত শব্দের অন্তে স্থিত ব্যঞ্জনধবনি ওপ পাওয়ার ফলে সেগুলি সবই স্বরান্ত শব্দে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। সুতরাং দু’একটি শব্দ ছাড়া প্রায় সব ব্যঞ্জনান্ত শব্দেরও রূপ ‘নর’ শব্দেরই মতো হত। যেমন ‘কর্মণ’ শব্দের ৪র্থীর একবচনে কর্মণে-এর স্থানে হল কর্মায় > কম্মায় (তুলনীয় নরায়)। ঋ-কারের স্বরধ্বনিতে রূপান্তরের ফলে ঋ-কারান্ত শব্দও সাধারণ স্বরান্ত শব্দের রূপ লাভ করল।

(গ) মধ্য ভারতীয় আর্যে দ্বিবচন লোপ পাওয়ার ফলে শব্দরূপে শুধু একবচন ও বহুচনের রূপভেদ রইল, দ্বিবচনের স্থানে বচনের রূপ ব্যবহৃত হত। যেমন—‘দৌ-ময়ূরৌ’-এর স্থানে হল ‘দ্বো মোরা’।

(ঘ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে বিশেষ্য ও সর্বনামের শব্দরূপ পৃথক হত। মধ্য ভারতীয় আর্যে কোথাও কোথাও বিশেষ্যের শব্দরূপ সর্বনামের শব্দরূপের মতো হতে দেখা যায়। যেমন— সপ্তমীর একবচনে সর্বনামের বিভক্তি *স্মিন > মহি, এই বিভক্তি সর্বনাম ছাড়া অন্য ক্ষেত্রেও প্রায়ই প্রযুক্ত হত (বিজিতে/ *বিজিতস্মিন্ > বিজিতে/বিজিতমহি)।

(ঙ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে বহুবচনে প্রায়ই প্রথম ও দ্বিতীয়ায় স্বরান্ত শব্দের রূপ পুংলিঙ্গে পৃথক ছিল। যেমন—‘নর’ শব্দের বচনে প্রথম ও দ্বিতীয়ার রূপ পৃথক ছিল—‘নর’ শব্দের বচনে প্রথমার রূপ নরাঃ, দ্বিতীয়ার রূপ নরান। মধ্য ভারতীয় আর্যে এই পার্থক্য প্রায়ই লুপ্ত হতে দেখা যায়। যেমন—প্রথমা ও দ্বিতীয়া উভয় ক্ষেত্রেই হল নরা।

(চ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে তৃতীয়ার বহুবচনের বিভক্তি ছিল ‘ভিস’ (ভিঃ) (যেমন— মুনিভিঃ)। ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে মধ্য ভারতীয় আর্যে এটি হল ‘হি’। মধ্য ভারতীয় আর্যে তৃতীয়ার এই বিভক্তিটি পঞ্চমীতেও ব্যবহৃত হতে থাকে। যেমন পঞ্চমীর বহুবচনের আসল বিভক্তি –‘ভ্যস’ (ভ্যঃ) যোগ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্যে হত ‘আজীবিকেভ্যঃ’। এর স্থানে মধ্য ভারতীয় আর্যে ‘হি’ বিভক্তি যোগ করে হল ‘আজীবিকেহি’।

(ছ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে ক্রিয়ার ধাতু ভ্বাদি, দিবাদি প্রভৃতি ‘গণ’ বা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল এবং প্রত্যেক গণের ক্রিয়ার রূপ পৃথক হত। কিন্তু মধ্য ভারতীয় আর্যে সাধারণত সব ধাতুরই রূপ ভ্বাদিগণীয় ধাতুর মতো হয়ে গেল।

(জ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে ক্রিয়ারূপে আত্মনেপদ ও পরস্মৈপদ দুই প্রকারভেদ ছিল। মধ্য ভারতীয় আর্যে আত্মনেপদ লোপ পেল, প্রায় সর্বক্ষেত্রে শুধু পরস্মৈপদের ব্যবহার প্রচলিত হল।

(ঝ) শব্দরূপে যেমন, ক্রিয়ারূপেও তেমনি প্রাচীন ভারতীয় আর্যের দ্বিবচন মধ্য ভারতীয় আর্যে লোপ পেল, তার জায়গায় বহুবচনের রূপই ব্যবহৃত হত।

(ঞ) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে (বৈদিকে) ক্রিয়ার ভাব (Mood) ছিল পাঁচটি— নির্দেশক (Indicative), অনুজ্ঞা বা লোটু (Imperative), অভিপ্রায় (Subjunctive), নিবন্ধ (Injunctive) ও সম্ভাবক বা বিধিলি (Optative)। মধ্য ভারতীয় আর্যে এগুলির মধ্যে অভিপ্রায় ও নিবন্ধ ভাব লোপ পেল। প্রাকৃতে ছিল শুধু নির্দেশক, অনুজ্ঞা ও সম্ভাবক।

(ট) প্রাচীন ভারতীয় আর্যে -ত্বা, -ত্বায় ইত্যাদি প্রত্যয় যোগ করে বহু বিচিত্র অসমাপিকা ক্রিয়ার রূপ সৃষ্টি করা হত। মধ্য ভারতীয় আর্যে অসমাপিকার এত বৈচিত্র্য আর রইল না।

(ড) বৈদিকে নয়, ক্লাসিক্যাল সংস্কৃতে নিষ্ঠা প্রত্যয় (-ক্ত, “ক্তবতু) যোগ করে ক্রিয়ার যে রূপ রচিত হত (গম্ + ত = গত ইত্যাদি) তা অতীত কালের সমাপিকা ক্রিয়া অর্থে ব্যবহৃত হত। এই রীতি মধ্য ভারতীয় আর্যে ব্যাপকভাবে অনুসৃত হয়।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!