মনসামঙ্গল কাব্য রচনায় বিজয়গুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কবি বিজয়গুপ্ত
মনসামঙ্গলের একজন সর্বাধিক প্রচারিত কবি হিসাবে বিজয়গুপ্তের খ্যাতি। বিজয়গুপ্তের কাব্য পূর্ববঙ্গে সর্বাধিক প্রচারিত হয়েছিল। গল্পরস সৃজনে, করুণরস ও হাস্যরসের প্রয়োগে, সামাজিক ও রাষ্টিক জীবনের পরিচয়ে, চরিত্র চিত্রণে এবং পাণ্ডিত্যের গুণে বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মপুরাণ’ একটি জনপ্রিয় কাব্য।
প্যারীমোহন দাশগুপ্ত উদ্যোগী হয়ে ১৩০৩ বঙ্গাব্দে সর্বপ্রথম বরিশাল থেকে বিজয়গুপ্তের পদ্মপুরাণ প্রকাশ করেন। এরপর ১৩০৮ বঙ্গাব্দে দ্বিতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়। দাশগুপ্তের সংস্করণ সম্বন্ধে দীনেশচন্দ্র সেন সংশয় প্রকাশ করে লিখেছেন— “বিজয়গুপ্তের ছদ্মবেশে ‘জয়গোপালগণ’ ঐতিহাসিক মরীচিকা উৎপাদন করিতেছেন।” সুকুমার সেনও এ বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। এই প্রশ্ন উল্লিখিত হয়েছে আসলে পুথির ভাষা নিয়ে।
তাঁর কাব্যের রচনাকাল নিয়ে বিতর্ক আছে। কারণ বিভিন্ন পুঁথিতে সন তারিখের তারতম্য রয়েছে। প্যারীমোহন গায়েনদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জেনেছিলেন, বিজয়গুপ্ত কাব্য রচনা করেছিলেন ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দে। তিনি কয়েকখানি পুঁথিতে ভিন্ন ভিন্ন সন তারিখ জ্ঞাপক পরিচয় পেয়েছেন। যেমন—
(এক) ঋতু শশী বেদশশী শক পরিমিত। ‘অঙ্কস্য বামা গতি’
এই সূত্র অনুযায়ী ঋতু = ৬, শশী = ১, বেদ = ৪, শশী = ১ অর্থাৎ ১৪১৬ শকাব্দ এবং খ্রিস্টাব্দ ১৪৯৪ (১৪১৬+৭৮)-তে কাব্য রচনাকাল।
(দুই) ছায়াশূন্য বেদশশী পরিমিত শক। সনাত হুসেন শাহ নৃপতিতিলক।
অর্থাৎ ছায়া = ০, শুন্য = ০, বেদ = ৪, শশী = ১, অর্থাৎ ১৪০০ শকাব্দ অর্থাৎ ১৪৭৮ খ্রিস্টাব্দ।
(তিন) ঋতুশূন্য বেদশশী পরিমিত শক। সুলতান হুসন রাজা পৃথিবী পালক।
অর্থাৎ ঋতু = ৬, শূন্য = ০, বেদ = ৪, শশী = ১ অর্থাৎ ১৪০৬ শকাব্দ = ১৪৮৪ খ্রিস্টাব্দ।
আমাদের অনুমান হুসেন শাহ যেহেতু ১৪৯৩ খ্রিস্টাব্দে গৌড়ের সুলতান হন, সেহেতু প্রথম উদ্ধৃতি অনুযায়ী কাব্য রচনাকাল ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ হওয়াই সঙ্গত। পদ্মাপুরাণের দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকাতেও লেখা হয়েছে— “জ্যোতিষ দিনচন্দ্রিকা মতে ১৪১৬ শক কাব্যরচনা কাল হিসাবে গৃহীত হইতে পারে।” (১৪১৬ শকাব্দ = ১৪১৬+৭৮ = ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ)। দীনেশচন্দ্র সেনও বলেছেন— “বিজয়গুপ্ত পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে হুসেন শাহের রাজত্বকালে বিদ্যমান ছিল।’ কোন কোন পুঁথির সূত্র অনুযায়ী জানা যায়, বিজয়গুপ্তের নিবাস ছিল অধুনা বাংলাদেশের বরিশাল জেলার গৈলা (ফুল্লী) গ্রামে। বিজয়গুপ্তের বর্ণনা অনুসারে ফুল্লশ্রী গ্রামের পশ্চিমে ঘাঘরা নদী এবং পূর্বে খণ্ডেশ্বর নদ। নিজের সম্বন্ধে বিজয়গুপ্ত লিখেছিলেন— “সনাতন নয় রুক্মিণী গর্ভজাত।’ এছাড়া ব্যক্তি পরিচয় সম্বন্ধে যা জানা যায় তা হল, তিনি সংস্কৃতজ্ঞ ও বেষ্ণবভক্ত ছিলেন। কেননা কাব্যের শুরুতে রয়েছে— ‘গরুড় বাহনে বন্দম বিষ্ণুর চরণ।’
বিজয়গুপ্তের কাব্যের যে সংস্করণ মুদ্রিত হয়েছে, তার সঙ্গে পুঁথির ভাষার পার্থক্য রয়েছে। তাই সমালোচকগণ অনুমান করেন প্যারীমোহন কোন প্রাচীন পুঁথি সংগ করতে পারেননি। এই সমস্ত পুঁথি ঊনবিংশ শতকের পূর্ববর্তী নয়। তাছাড়া পুথিতে স্থানীয় উপভাষার প্রয়োগ ঘটেছে। বাগভঙ্গিমাও পশ্চিমবঙ্গের সাধুভাষার অনুগামী। যেমন— ‘যেওনা যেওনা বলি ডাকে তারে মায়।’
বিজয়গুপ্তের কবিকৃতিত্ব
প্রথমত: বিজয়গুপ্ত কাহিনি বয়নের ক্ষেত্রে প্রচলিত ব্রতকথাকেই গুরুত্ব দিয়েছে। সেক্ষেত্রে কবি বাস্তবতা ও মনস্তাত্ত্বিকতা বজায় রেখেছে। মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুসরণে হর পার্বতীর গার্হস্থ্যজীবন অবলম্বনে বিজয়গুপ্ত কাহিনির সূত্রপাত করেছেন। এই অংশে পুরাণের পরিচয় লেশমাত্র নাই। দেবকাহিনির পরবর্তী অংশে শিব বয়স্কা কন্যা মনসাকে নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। মনসাকে কেন্দ্র করে শিবের দাম্পত্য কলহের যে চিত্র বিজয়গুপ্ত এঁকেছেন তাতে রয়েছে মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের পারিবারিক জীবনের স্পষ্ট রেখাচিত্র। চণ্ডী ও মনসার কলহ বর্ণনায়ও বাস্তবতার ছাপ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত: বিজয়গুপ্তের কাব্যের নরখণ্ড মূলত মানুষেরই কাহিনি। দেবতার ভূমিকাও এখানে সাধারণ মানুষের মতো। নরখণ্ডে ধন্বন্তরি হত্যা এবং উষা-অনিরুদ্ধের পালা শাখা কাহিনির মতো মূল কাহিনির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। উপকাহিনিগুলি কার্যকারণ সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। যেমন, পার্বতীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় নিত্য অশান্তি এড়াবার জন্য শিব মনসাকে বনবাস যাপনের বিধি ব্যবস্থা করে দেওয়ায়, মনসা সখী নেতার সঙ্গে যুক্তি করে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—
নেতার সহিত যুক্তি করিল বিষহরি।
রাখোয়াল বাড়ী যায় যতরূপ ধরি।।
সন্ন্যাসিনী সেজে কথার চাতুরীতে মনসা রাখাল বালকদের বিশ্বাস উৎপাদন করিয়ে তাদের দিয়ে পূজা করালেন। এই পূজার বিঘ্ন ঘটাল মুসলমান শাসক কাজি। কাজির পেয়াদাদের সঙ্গে রাখালদের মারামারি। কাজির হুকুম হল—
হাসান কাজি বলে পেয়াদাগণ ভাই।
ধরিয়া রাখালগণ রাখ এক ঠাঁই।।
রাখালদের ধরে আনা হল। রাখালেরা মনসার মাহাত্ম্যকথা শুনিয়ে পূজা করার যুক্তি দেখালে কাজি মনসাকে দেখতে চায়। সপার্ষদ কাজি রাখালদের সঙ্গে এল—
পথেতে যাইতে দেখে ভিঙ্গুরের বাসা।
প্রণাম কর্যা রাখাল বলে এইতো মনসা।।
কাজির লোকজনেরা তথাকথিত মনসার উদ্দেশ্যে ঢিল ছোঁড়ার ফল পেল। ভীমরুলের কামড়ে “গলায় কাপড় বান্ধি আল্লা আল্লা ডাকে।” মনসার মাহাত্ম্য এভাবে লৌকিক গল্পকথার ভঙ্গিতে হাস্যকর হয়ে ওঠে।
তাছাড়া মনসার জোর করে পূজা প্রচারের জন্য চাঁদের ‘গুয়াবাড়ী’ ধ্বংস, চাঁদের মহাজ্ঞান হরণ, ধন্বন্তরি হত্যা, লখিন্দরের বিবাহ, বাসরে মৃত্যু, মাতৃহৃদয়ের বেদনা, পিতৃ হৃদয়ের হাহাকার প্রভৃতি বর্ণনায় বিজয়গুপ্ত দক্ষ কাহিনিকারের পরিচয় রেখেছেন। যেমন, লখিন্দরের মৃত্যুদৃশ্য সাধারণ গৃহস্থ ঘরের বাস্তব দৃশ্য—
বার্তা পাইয়া সনকা আসিল লড় দিয়া।
আহা পুত্র বলি ভূমে পড়ে আছাড় খাইয়া।।
তুমি পুত্র পাইয়া আমি করিলাম বড় আশ।।
অভাগার আশা বিধি করিলা নৈরাশ।।
তৃতীয়ত: বিজয়গুপ্তের কাব্যে হুসেন শাহের সময়কালের রাষ্ট্রনৈতিক ও সামাজিক চিত্র ঠাঁই পেয়েছে। সে সময়ে সামাজিক অনুশাসনের কঠোরতা শিথিল হয় এবং সাহিত্য-শিল্পে সুরুচি ও শালীনতার প্রকাশ ঘটে। দেবখণ্ডের কাহিনিতে দেখা যায় শিব বারাণসীতে ব্রাহ্মণ শিরোমণি রূপে বাস করেন, বাগানবাড়িতে প্রমোদলীলায় মত্ত, কুলীনদের মতো বহু পত্নীক তার সংসার। অযোনিসম্ভবা মনসাকে ঘরে এনে তার সামাজিক মর্যাদা নষ্ট করা হয়েছে, এতে প্রতিবেশীরা কানাকানি করেছে।
চতুর্থত: তৎকালীন সমাজে বাল্যবিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল, ছিল ঘটকালি প্রথা। বিজয়গুপ্তের কাব্যে নারদের ঘটকালিতে শিব কন্যার বিবাহ দিয়েছেন। তখনকার দিনে কুলীনেরা বিয়ে করে বউ ফেলে পালিয়ে যেত। জরৎকারু মনসাকে ফেলে চলে গিয়েছিলেন।
পঞ্চমত: প্রাক্-চৈতন্য যুগের পাঠান রাজত্বের রাষ্ট্রনৈতিক চিত্র বিজয়গুপ্তের কাব্যে লক্ষ করা যায়। যেমন, রাখাল সমাজের চিত্র, মুসলমান কাজির অত্যাচার, ভূম্যধিকারীদের প্রতাপ, অভ্যন্তরীণ শাসনের অধিকার ইত্যাদি। মনসা চাঁদের দ্বন্দ্বের মধ্যে সমকালীন যুগের কুটিল ষড়যন্ত্র, উদ্দেশ্যমূলক গুপ্ত হত্যার চিত্র নিহিত রয়েছে। বিজয়গুপ্তের কাব্যে শিবের গঞ্জিকা সেবন, লাম্পট্য, চাঁদের অনমনীয় জেদ, মনসার বর্বরোচিত উগ্র সমকালীন জীবনেরই প্রতিচ্ছবি।
ষষ্ঠত: চরিত্রচিত্রণের দিক থেকে বিজয়গুপ্তের কৃতিত্ব যথেষ্ট। শিব, চণ্ডী, মনসা সাধারণ মানব-মানবীর মতো। চণ্ডী ও পদ্মার কোন্দল ‘কলহ পটিয়সী’ বাঙালি গৃহিণীদের ছবিকেই প্রকাশ করেছে। এই কাব্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র চাঁদ সদাগর। অনমনীয় পৌরুষের অধিকারী এই চাঁদ সদাগর মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একটি অনন্যসাধারণ চরিত্র। বিজয়গুপ্ত সেই চাঁদের চরিত্রে আনুপূর্বিক সামগ্রিকতা বজায় রাখতে পারেননি। আশুতোষ ভট্টাচার্য বলেছেন— “বিজয়গুপ্তের এই পরিকল্পনাটির মধ্যে চাঁদ সদাগরের আকাশস্পর্শী পুরুষকারের চিত্রটি একেবারে ধূলিসাৎ হইয়া গিয়াছে। চাঁদ সদাগরের যে চরিত্রের সঙ্গে আমরা পরিচয় লাভ করিয়াছি, তাহার পক্ষে কোনও অবস্থাতেই তাহাকে জোড় হাতে মনসার স্তব করিবার কথা কল্পনাও করিতে পারা যায় না।” ভূদেব চৌধুরীও বলেছেন—“বিজয়গুপ্তের চন্দ্ৰধর বিচিত্র, কিন্তু সমগ্র নয়।” অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও একই জুটির দিকে অঙ্গুলি সংকেত করেছেন—“দেবীর মহিমা প্রচারের জন্য বিজয়গুপ্ত চাদের চরিত্রটির পরিণতি নষ্ট করিয়া কাব্যের ভরাডুবি করিয়াছেন।” (বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস)।
আসলে এই সমালোচনার সবটাই বিজয়গুপ্তের প্রাপ্য নয়। বিজয়গুপ্ত চাঁদ সদাগরকে মনসা বিদ্বেষের প্রতীকী চরিত্ররূপে আঁকতে চাননি। অনার্যদেবী ‘চেঙমুড়ি কানী’ মনসাকে আর্য সংস্কৃতির প্রভাবপুষ্ট চাদ স্বীকার করেননি। তাই জেদি সদাগরের কাছে মনসা জোর করে পূজা আদায় করতে চেয়েছেন, প্রলোভন দেখিয়েছেন, অত্যাচার করে ভয় দেখিয়েছেন, কিন্তু কিছুতেই তাকে বিচলিত করতে পারেননি। শেষ অবস্থায় কাহিনির প্রয়োজনে মনসার পূজা তাকে করতে হল এবং চণ্ডী মনসার অভেদত্ব জেনে অনুতপ্ত হয়ে তিনি মনসার স্তব করলেন, এতে পৌরুষের অপহ্নুতি ঘটেনি। তবে শেষ মুহূর্তে চাঁদ সদাগরকে দিয়ে বিজয়গুপ্ত মাথা মুড়িয়ে প্রায়শ্চিত্ত করিয়েছেন। অন্যান্য কবিদের মতো বিজয়গুপ্ত যদি শুধু বিশ্বাসবশত ফুল দিতেন, তাহলে আমাদের আপত্তি ছিল না।
সপ্তমত: মনসামঙ্গল কাব্য মূলত করুণরসের আকর। করুণরসের প্রকাশে বিজয়গুপ্ত যথেষ্ট কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। সীতার মতোই ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবনের কাহিনি বেহুলার। তার চরিত্র তাই পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণ করে। কবি বিজয়গুপ্ত মুন্সিয়ানার সঙ্গে বেলার কাহিনিকে বাস্তব রসসমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছেন। পতিহারা বেহুলার ক্রন্দন সত্যই আমাদের ব্যথিত করে। বিজয়গুপ্তের বর্ণনা এখানে স্বাভাবিক—
কান্দে সুন্দরী বেউলা বাসরে করে রোল।
লখাইর সন্তাপে বেউলা বালিসে দিল কোল।।
অন্যদিকে পুত্রহারা চাঁদ ও সনকার বিলাপ করুণ রসের উদ্রেক করেছে। সমালোচক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় যথার্থই বলেছেন— “পুত্র হারাইয়া চাঁদের গম্ভীর বিলাপ এবং সনকাকে সান্ত্বনাদানের চেষ্টা মাইকেল মধুসূদনের রাবণের বিলাপ এবং মন্দোদরীকে সান্ত্বনাদানের চিত্রকে স্মরণ করাইয়া দিবে।’’ যেমন, চাঁদ সদাগর পত্নী সনকাকে প্রবোধ দিচ্ছেন—
শীতল চন্দন যেন আভের ছায়া।
কার জন্য কান্দ প্রিয়া সকল মিছা মায়া।।
অষ্টমত: করুণরসের মতো হাস্যরসের পরিবেশনেও বিজয়গুপ্ত কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছে। বিজয়গুপ্ত কামাসক্ত শিব ও কোপনা চণ্ডীর উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্যে চমৎকার হাস্যরস। সৃষ্টি করেছেন। যেমন মনসাকে আবিষ্কার করে চণ্ডী তাকে মারধর করতে থাকেন—
খলখলি হাসে দেবী হাতে দিয়া তালি।
চোপড় চাপড় মারে দেয় চুন কালি।।
নবমত: বিজয়গুপ্ত কাহিনি বিন্যাসে, চরিত্র-চিত্রণে, ছন্দ ও অলঙ্কার প্রয়োগে কবিত্ব প্রতিভার পরিচয় রেখেছেন। অলৌকিক দেবমাহাত্ম্যকে তিনি রূপকথার অবাস্তব কল্পনারাজ্যের বিষয় করে তোলেননি। আসলে বিজয়গুপ্তের প্রগাঢ় জীবনবোধ, শিল্পীজনোচিত নিরাসক্ত প্রসন্ন দৃষ্টি, কল্পনাশক্তির ব্যাপকতা, ভাষার সাবলীলতা তাঁর কাব্যে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ছিলেন সহজ কবিত্বের অধিকারী, তাই তাঁর কাব্যের বর্ণনায় রয়েছে প্রাঞ্জলতা। উপমা প্রয়োগেও তার পাণ্ডিত্য লক্ষ করার মতো। যেমন, মনসার দুঃখের বর্ণনায়—
জনম দুঃখিনী আমি দুঃখে গেল কাল।
যেই ডাল ধরি আমি ভাঙে সেই ডাল।।
তাছাড়া পয়ার, ত্রিপদী ও একাবলী ছন্দের ব্যবহার কাব্যের শিল্পগুণকে বাড়িয়ে দিয়েছে। দলবৃত্ত ছন্দনির্মাণে বিজয়গুপ্তের মুন্সিয়ানা মধ্যযুগে বিরল। যেমন—
প্রেতের সনে/শ্মশানে থাকে/মাথায় ধরে/নারী। (৪/৪/৪/২)
সবে বলে/পাগল পাগল/কত সৈতে/পারি। (৪/৪/৪/২)
সমালোচক আশুতোষ ভট্টাচার্য যথার্থই বলেছেন— “একদিকে মনসার হৃদয়হীনতা ও অন্যদিকে সনকার একান্ত মানবিক স্নেহশীলতা এই উভয়ের ভিতর দিয়া অগ্রসর হইয়া বিজয়গুপ্তের কাহিনি উচ্চাঙ্গের কাব্যরস সৃষ্টিতে সার্থক হইয়াছে। বিজয়গুপ্ত দেবতার মাহাত্ম্য রচনা করেন নাই, মানবেরই মঙ্গলগান গাহিয়াছেন।”
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
২. বাংলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাংলা সাহিত্যের ইতিকথা: ভূদেব চৌধুরী
৪. বাঙলা সাহিত্যের রূপরেখা: গোপাল হালদার
৫. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
৬. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
Leave a Reply