//
//

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে মনোমোহন থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

মনোমোহন থিয়েটার

(১৯১৫-২৪)

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী মনোমোহন পাঁড়ে থিয়েটারটির প্রতিষ্ঠা করেন। এমারেল্ড থিয়েটার বাড়িতে কোহিনূর থিয়েটার চলছিল। মনোমোহন লক্ষাধিক টাকায় এই থিয়েটারটি কিনে সেখানে মনোমোহন থিয়েটার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রথমে কোহিনূর নামেই চালু করেন। পরে সেখানে মিনার্ভা মঞ্চের লোককন নিয়ে গিয়ে মিনার্ভার নামে অভিনয় শুরু করেন। মনোমোহনের উদ্বোধন হলো ১৯১৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর, গিরিশের ‘কালাপাহাড়’ এবং সুরেশচন্দ্র রায়ের ‘রূপোর ফাঁদ’ নাটক দিয়ে। শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন তারাসুন্দরী, দানীবাবু, প্রিয়নাথ ঘোষ প্রমুখ। ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘ভীষ্ম’, ‘পলিন’ ও অতুল মিত্রের ‘শিরী-ফরহাদ’ নাটক দিয়ে এর যাত্রা শুরু হল। ১ সেপ্টেম্বর থেকে নাম রাখা হলো মনোমোহন থিয়েটার। সেদিন একসঙ্গে বেশ কয়েকটি নাটক, যেমন ভীষ্ম, ধ্রুবচরিত্র—বড়ো নাটক এবং জন্মাষ্টমী, নন্দবিদায়, চতুরালী প্রভৃতি ছোট গীতিনাট্য অভিনীত হয়। সেই সময় থেকে চুনীলালদেব, তিনকড়ি এখানে যোগ দেন। তারপর থেকে পর পর বেশ কয়েকটি নাটক এখানে অভিনীত হয়। দানীবাবু ২৫০ টাকা বেতনে ম্যানেজার ছিলেন।

ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘বাদশাজাদী’, নিশিকান্ত বসুরায়ের ‘বাপ্পারাও’, দাশরথি মুখখাপাধ্যায়ের ‘কণ্ঠহার’, হরিনাথবাবুর ‘কবীর’, সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মোগল-পাঠান’, গিরিশের ‘চণ্ড’, বঙ্কিমের ‘চন্দ্রশেখর’ উপন্যাসের নাট্যরূপ, ১৯১৭ পর্যন্ত খুবই সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়।

১৯১৮-তে এসে দেবলা দেবী (নিশিকান্ত বসুরায়) খুবই জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯১৯-এ পারদর্শী (পাঁচকড়ি চট্টোপাধ্যায়), ১৯২০-তে ‘হিন্দুবীর’ (সুরেন বন্দ্যোপাধ্যায়), উল্লেখযোগ্য অভিনয়। এছাড়া ‘পানিপথ’, ‘বিষবৃক্ষ’ প্রভৃতি অভিনয় ভালো হয়েছিল। ১৯২৪ পর্যন্ত এইভাবে মনোমোহন থিয়েটার তার অভিনয় চালিয়ে যায়। শেষের দিকে অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়ে। মনোমোহন নিজে অসুস্থ থাকায় ভালোভাবে নজর দিতেও পারেননি। শেষে শিশির ভাদুড়ি এই থিয়েটার লীজ নিয়ে সেখানে খোলেন ‘নাট্যমন্দির’, ১৯২৪-এর এপ্রিল মাসে। মনোমোহন থিয়েটারের প্রথম পর্বের ইতিহাস এখানেই শেষ।

এই থিয়েটার নতুন কোনো উল্লেখযোগ্য নাটকের অভিনয় করতে পারেনি, অন্তত প্রথম পর্বে। তবুও তার মধ্যে পূর্ব অভিনীত নাটকগুলির কয়েকটি এখানে সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় করে। এখানে প্রধান অভিনেতা দানীবাবুর বাবর শা (পানিপথ), খিজির খাঁ (দেবলা দেবী), হিমু (হিন্দুবীর), নগেন্দ্র (বিষবৃক্ষ) অভিনয় উচ্চমানের খ্যাতিলাভ করেছিল। সাধারণ নাটকও শুধু অভিনয়ের আকর্ষণে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।

বিষবৃক্ষ অভিনয়ের সময়ে এখানে নাটকের বিশেষ কয়েকটি দৃশ্য নতুন আমদানীকৃত নির্বাক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে দেখানো হয়েছিল। অন্য থিয়েটারগুলিও এর আগে এই কাজ করেছিল। টিকিট বিক্রির লোভে মনোমোহনও এই পথে পা বাড়িয়েছিল। সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে মনোমোহন থিয়েটার কোনো নতুন নাটক, নাট্যকার বা নাট্যাভিনয়ের পথ প্রদর্শন করতে পারেনি। গতানুগতিকতার পথে এর যাত্রা শুরু ও শেষ।

দ্বিতীয় পর্ব প্রবোধচন্দ্র গুহের আমল। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস থেকে প্রবোধচন্দ্র গুহ এককভাবে মনোমোহন থিয়েটারের পরিচালনার দায়িত্ব নেন। তারই নেতৃত্বে পথের শেষে (নিশিকান্ত বসু রায়), গৈরিক পতাকা (শচীন সেনগুপ্ত), কারাগার (মন্মথ রায়) প্রভৃতি পূর্ব অভিনীত ও জনপ্রিয় নাটকগুলির অভিনয় হয়েছিল।

শচীন সেনগুপ্তের ‘রক্তকমল’ এখানে প্রথম অভিনীত হয় (২-৬-২৯)। এই নাটকের সব কয়টি গানের রচয়িতা এবং সুরকার নজরুল ইসলাম। পূরবী চরিত্রে ইন্দুবালার কণ্ঠে গানগুলি সেই সময়ে খুবই জনপ্রিয় হয়। নির্মলেন্দু লাহিড়ী (দাদামশায়), বিশ্বনাথ ভাদুড়ি (পতিতপ্রসন্ন), সরযূবালা (মমতা) অভিনয় করেন। সেই আমলে সাধারণ রঙ্গালয়ে রক্তকমলের মতো একাঙ্ক নাটকের অভিনয় খুবই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

মন্মথ রায়ের ‘মহুয়া’ এখানে প্রথম মঞ্চস্থ হয় (৩১-১২-২৯)। এতে নির্মলেন্দু লাহিড়ী (হুমড়ো সর্দার ), দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (নদের চাঁদ), ইন্দুবালা (রাধু পাগলি), সরযুবালা (মহুয়া) চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকেও নজরুল গীতরচনা ও সুর সংযযাজনায় কৃতিত্ব দেখান।

মণিলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাহাঙ্গীর (২৫-১২-২৯) এখানে প্রথম অভিনীত হয়। এই নাটকের জন্য নজরুল একটি গান লিখে দেন। দানীবাবু (জাহাঙ্গীর), নির্মলেন্দু (সাজাহান), শশিমুখী (নুরজাহান), দুর্গাদাস (যশোবন্ত সিংহ) উল্লেখযোগ্য অভিনয় করেন। অল্পবয়সী আওরঙ্গজেব এবং হুঁসিয়ার চরিত্রে আঙুরবালা ও ইন্দুবালা অভিনয় করে মাতিয়ে দেন।

রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তির উপায়’ (ওই নামের গল্পের রবীন্দ্রনাথকৃত নাট্যরূপ) এখানে অভিনীত হলো (১৭-৫-৩০)। প্রবোধচন্দ্র গুহের উদ্যোগেই এই অভিনয়ের আয়োজন। অভিনয় করেন রাধিকানন্দ (ফকির), দুর্গাদাস (মাখনলাল), নীহারবালা (হৈমবতী)। অনেক আগে স্টারে ‘দশচক্র’ নামে একই গল্পের নাট্যরূপ (সৌরীন্দ্রমোহন) অভিনীত হয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!