সংস্কৃত সাহিত্যের ইতিহাসে মহাকবি কালিদাসের অবদান আলোচনা কর।
মহাকবি কালিদাস
সুদূর অতীতের অন্ধকারলোক থেকে যে জ্যোতিষ্কদীপ্তি সমগ্র ভারতের কবিমানসকে আলোকিত করেছেন, তিনি ‘কবিপতি’ কালিদাস। এদেশের কাব্যনিকুঞ্জে তিনি ‘পিককুলপতি’। বাল্মীকি-ব্যাসের মতো তাঁর কাব্যধারা অতি সাধারণলোকের গাটে ঘাটে প্রবাহিত না হলেও ভারতবর্ষের অঘনিত কবি কালিদাসের কাব্য-পীযূষ পান করে ধন্য হয়েছেন এবং তাঁর কাব্যরসে সঞ্জীবিত হয়ে নব কাব্য সৃষ্টি করেছেন। লৌকিক কাব্য-নাটকের রাজ্যে কালিদাস সার্বভৌম সম্রাট।
কালিদাসের দুটি মহাকাব্য— কুমারসম্ভব এবং রঘুবংশ। দুটি কাব্যই সুউচ্চ কল্পনা ও মানব-স্বভাব জ্ঞানের পরিচায়ক। সংস্কৃত কাব্যভাণ্ডারে এরূপ মহার্ঘ রত্ন নেই বললেই চলে।
কুমারসম্ভব
তারকাসুরের অত্যাচারে পর্যদুস্ত দেবগণের সৈনাপত্য গ্রহণ করার জন্য শিবের ঔরসে পার্বতীর গর্ভে কুমার কার্তিকের জন্ম-সম্ভাবনা ‘কুমারসম্ভব’ কাব্যের প্রধান বর্ণনীয় বিষয়। এই কাব্যের মোট সাতেরোটি সর্গ। অধিকাংশ সমালোচকের মতে কাব্যের আটটি সর্গ কালিদাসের রচনা, এবং বাকি অংশ অন্য লেখকের রচনা।
‘অস্ত্যুত্তরস্যাং দিশি দেবতাত্মা হিমালয়ো নাম নগরাধিরাজঃ’— নগরাধিরাজের এই বর্ণনা দিয়েই কুমারসম্ভব কাব্যের সূচনা। এই কাব্যের কাহিনি কালিদাসের মৌলিক সৃষ্টি নয়। রামায়ণ, মহাভারত, শিবপুরাণ, পদ্মাপুরাণের সৃষ্টি খণ্ডে, বামন পুরাণে এই কাহিনির বর্ণনা পাওয়া যায়। তবে পুরাণ থেকে কাহিনি সংগ্রহ করলেও বিষয়ের উপস্থাপন ও বর্ণনা নৈপুণ্য কালিদাসের নিজস্ব। পুরাণের কাহিনি নিরলংকার মাত্র। কিন্তু কালিদাসের বর্ণনা অলংকৃত এবং কাব্যগুণে সমৃদ্ধ। পুরাণের দিব্যাঙ্গনা-অপ্সরা, কিন্নরী, সিদ্ধাঙ্গনা কালিদাসের কাব্যে এই আশ্চর্য মহামায়া বিস্তার করেছে।
কুমারসম্ভব কাব্যে মদনভস্মের ঘটনা, রতিবিলাপ, পার্বতীর তপস্যা, হর-পার্বতীর বিবাহ উল্লেখযোগ্য। প্রকৃতি বর্ণনার দিক থেকেও কুমারসম্ভব উল্লেখযোগ্য। মানবজীবনের কামনা-বাসনাকে প্রকৃতির দর্পণে প্রতিবিম্বিত করে প্রেম-সৌন্দর্যের বর্ণনায় কালিদাস অপূর্ব নিসর্গ দৃষ্টির পরিচয় দিয়েছেন। কুমারসম্ভব কাব্যে বিদেহী প্রেমের জে রূপ অঙ্কিত হয়েছে তা অনবদ্য। এই কাব্য সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন— ‘ভারতবর্ষের পুরাতন কবি প্রেমকেই প্রেমের চরম গৌরব বলিয়া স্বীকার করে নাই, মঙ্গলকেই প্রেমের পরম লক্ষ্য বলিয়া ঘোষণা করিয়াছেন।’
রঘুবংশ
‘‘সংস্কৃত ভাষায় যত মহাকাব্য আছে তন্মধ্যে কালিদাস প্রণীত ‘রঘুবংশ’ সর্বাপেক্ষা উৎকৃষ্ট’’— মন্তব্যটি স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের। উক্তিটিতে আতিশয্য থাকলেও অলীকতা নেই। প্রগাঢ় পাণ্ডিত্য, জীবনসম্পর্কে গভীর জ্ঞান, কল্পনার মৌলিকতা ও মননধর্মীতা এই কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। রস পরিণামের ওপরই যদি কাব্যের সৌন্দর্য নির্ভর করে তাহলে এই কাব্য যেন বহু বিচিত্র রসের নদীতে ঘেরা এক রস-নদীমাতৃক কাব্য।
রঘুবংশ ভারতবর্ষের বহু পরিচিত একটি রাজবংশের ঐতিহাসিক কাব্যরূপ। ধর্মে-কর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বংশ কেমন করে ক্রমশ অধঃপতিত হয়েছে—কালিদাস সেইদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছেন। এই বংশ পুরাণে সূর্যবংশ নামে খ্যাত। রঘুবংশ এই বংশেরই কীর্তিকাহিনি। ভারতবর্ষের অন্তরে মানবতার যে সমুন্নত আদর্শ আছে, ‘রঘুবংশ’ সেই ভারতীয় সমুন্নত মানব আদর্শের মহাকাব্য। উনিশটি সর্গে রাজা দিলীপ থেকে আরম্ভ করে অগ্নিবর্ণ পর্যন্ত উনত্রিশজন রাজার কাহিনি কবি এই কাব্যে বর্ণনা করেছেন। রঘু থেকে এই বংশের পুনঃপ্রতিষ্ঠা।
তাই এই বংশের নাম রঘুবংশ। পার্বতী-পরমেশ্বরের বর্ণনা দিয়ে কাব্যের শুরু, তারপর দিলীপের জন্ম, তার স্ত্রী সুদক্ষিণার পুত্র কামনা, রঘুর জন্ম, অজ রাজার কাহিনি, অন্ধ ইন্দুমতির পরিণয়, দশরথের জন্মপর্যন্ত অষ্টম সর্গের কাহিনি, নবম থেকে পঞ্চদশ সর্গে রামায়ণের কাহিনি ষোড়শ সর্গে রাজা কুশের আখ্যান, সপ্তদশ সর্গে কুশপুত্র অতিথির রাজগৌরবের বর্ণনা। এভাবে অষ্টাদশ সর্গ পর্যন্ত পরপর একুশজন রাজার রেখাচিত্র অঙ্কিত। এই কাব্যে রাজা দিলীপ ও রঘুর চরিত্র সুচিত্রিত। রঘুবংশ যেন এক বিরাট চিত্রশালা। ঘটনাবৈচিত্র্যও স্মরণীয়। বর্ণননৈপুণ্য আরো চমৎকার।
বিভিন্ন স্থান থেকে কালিদাস তাঁর কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করলেও এই কাব্যের বর্ণনা কবির নিজস্ব। পুরাণের প্রাণহীন তালিকাও কালিদাসের কলমে জীবিত হয়ে উঠেছে। পুরানের অনলংকৃত বিবৃতি কালিদাসের মণ্ডননৈপুণ্যের স্পর্শে অভিনব রূপসজ্জায় বিভূষিত হয়েছে। উপমা প্রয়োগে কালিদাসের যে নৈপুণ্য তা রঘুবংশেও লক্ষ করা যায়। যেমন— ‘রণক্ষিতিঃ শোণিতমদ্যকুল্যার রাজ মৃত্যোরির পানভূমিঃ’। সেজন্য সমালোচক A.B. Keith কুমারসম্ভবের তুলনায় রঘুবংশকে গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন— ‘‘the Raghubansha may rightly be ranked as the finest Indian spiceman of the Mahakavya as defined by writers on poetics.”
মেঘদূত
কালিদাসের বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যকীর্তি ‘মেঘদূত’ গীতিকাব্যের উদ্যানে অন্যতম শ্রেষ্ঠতম পুষ্প। প্রেমের কাব্য হিসাবে কালিদাসের ‘মেঘদূত’ সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যে অদ্বিতীয়। ‘মেঘদূত’ আকারে ক্ষুদ্র কিন্তু প্রকারে সুমহৎ। মেঘদূত দুই খণ্ডে বিভক্ত— পূর্বমেঘ এবং উত্তরমেঘ। রামগিরি থেকে অলকার পূর্ব পর্যন্ত যাত্রাপথের বর্ণনা পূর্বমেঘ নামে খ্যাত। এই পথে আছে বহুখ্যাত গিরি, নদী ও সমৃদ্ধ জনপদ। প্রাকৃতিক শোভা, জনপদ সমৃদ্ধি ও রতি সম্ভোগের দিক থেকে প্রত্যেকটি স্থানের অপরিমেয় আকর্ষণ। এরপর উত্তরমেঘ। উত্তরমেঘের পটভূমি অলকা।
অলকাপুরীর সৌন্দর্যের লীলানিকেতন। এই সৌন্দর্য, আনন্দ ও প্রেমের অমরাবতীতে যক্ষের ভবন। সে ভবন ভোগবতী সদৃশ। প্রিয়ার বিরহে যক্ষের নিজের দশার এই সংবাদ অতি করুণ ও মর্মস্পর্শী। তিনি শিলাতলে প্রিয়ার ছবি আঁকেন, স্বপ্নে তাকে আলিঙ্গন করেন। প্রিয়ার অঙ্গস্পর্শের লোভে উত্তর বাতাসকে আলিঙ্গন করতে যান। শেষপর্যন্ত বিরহদুঃখে মিলনের পূর্বাভাষ সূচনা করে ‘মেঘদূত’ কাব্যের পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
‘মেঘদূত’ সত্যিই একখানি অপূর্ব গীতিকাব্য। এই কাব্যে বিরহী যক্ষের সাকাঙ্ক্ষ অনুভুতির স্পর্শ অতি তীব্র। এই কাব্যে কালিদাসের প্রেম-চেতনা কেবল সম্ভোগের সঙ্গে যুক্ত নয়, প্রেম সম্পর্কে কবির হৃদয়ে যে একটা পূর্ণতার আদর্শ ছিল, মেঘদূত সেই আদর্শের স্বরূপ। ‘মেঘদূত’ কবিহৃদয়ের চিরন্তন romantic nostalgia-র অনবদ্য কাব্যরূপ।
ঋতুসংহার
প্রকৃতি বিষয়ক রচনা হিসাবে ‘ঋতুসংহার’ উল্লেযোগ্য। এই কাব্যের ছয়টি সর্গে ছয়টি ঋতুর বর্ণনা রয়েছে। কামাকুলচিত্ত এক তরুণের মানসিক অবস্থা এক অভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বর্ণনা করেছেন কালিদাস। বর্ণনা প্রধানত চিত্রধর্মী। প্রকৃতির এই রঙ-রেখা, মানুষের মনে কী ধরনের প্রবাব বিস্তার করে তা কবি ফুটিয়ে তুলেছেন। প্রকৃতির ছয়টি ঋতু এক একটি রতিভাবের উদ্বোধক। কোথাও সম্ভোগের, কোথাও বা বিপ্রলম্ভের।
‘ঋতুসংহার’-এ প্রকৃতি প্রধানত প্রেম-চেতনার রঙে রঞ্জিত। বর্ষা বিরহের, বসন্ত মিলনের। ঋতু বর্ণনা চমৎকার। যেমন বসন্তকালের পৃথিবী যেন রক্তাম্বর পরিহিতা নববধূ, তা উদাসীন মুনির চিত্তেও চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে— ‘চিত্তং মুনেরপি হরন্তি নিবৃত্তি রাগম্’। পরবর্তীকালে কালিদাসের এই নিসর্গ চেতনা আরও বিশিষ্টতা লাভ করেছে। ’ঋতুসংহার’ প্রকৃতপক্ষে কালিদাসের পরিণত কমিমানসের পূর্বাভাস মাত্র।
কালিদাসের কবি-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
কাহিনি বর্ণনা: কাহিনি বর্ণানায় কালিদাস বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মৌলিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ব্যাস-বাল্মীকি পুরাণ থেকে কাহিনি সংগ্রহ করলেও নিজ প্রতিভাগুণে সেই কাহিনির নবসৃজনজ ঘটিয়েছেন। যেমন—রঘুবংশ কাব্যের ত্রয়োদশ সর্গে বিমানযোগে রাম-সীতার লঙ্কা থেকে অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তনের যে রেখাচিত্র বাল্মীকি অঙ্কন করেছেন, কালিদাস অদ্ভুত কবিত্ব শক্তিতে তাকে পরিবর্তিত করে অতুলনীয় রূপে উপস্থাপিত করেছেন।
প্রকৃতি বর্ণনা: প্রকৃতি বর্ণনায় কালিদাস স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় দিয়েছেন।। কেননা প্রকৃতি কালিদাসের কাব্যে স্বয়ং একটি চরিত্র। রঘুবংশ কাব্যের ত্রয়োদশ সর্গে, কুমারসম্ভব, ঋতুসংহার কাব্যে প্রকৃতি জীবন্ত হয়ে উঠেছে কালিদাসের কলমগুণে।
প্রেমচেতনা: কালিদাস বিদেহী প্রেমের স্বরূপকে তাঁর কাব্যে রূপ দিয়েছেন। কুমারসম্ভব কাব্যে প্রেমের সেই স্বরূপ অঙ্কিত হয়েছে।
সৌন্দর্যচেতনা: কালিদাসের প্রেম ও সৌন্দর্য পরস্পরের পরিপূরক। কালিদাস সত্য, শিব ও সুন্দরের উপাসক। কালিদাস যে সমৃদ্ধি ও প্রাচুর্যের যুগে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তা সৌন্দর্য সাধনার যুগ।
শৈলী ও ছন্দ: কালিদাসের কাব্যপ্রকরণ সম্পর্কে সমালোচক A.B. Keith জানিয়েছেন— In kalidasa we have unquestionably the finest master of Indian poetic style, Superior to Acvaghosa by the perfection and polish of his work, and all but completely free from the extravagances which disfigure the later great writers of Kavya.
কালিদাসের উপমা: ‘উপমা কালিদাসস্য’— একটি বহুখ্যাত লোকশ্রুতি। উপমা সৃষ্টিতে কালিদাস অনুপম। উপমা নির্মাণে তিনি নিপুণ শিল্পী। কালিদাস সেই যুগের সরস্বতীর বরপূত্র—অসাধারণ তাঁর পাণ্ডিত্য ও বহুদর্শিতা, পরিমেয় ধীশক্তি ও সূক্ষ্মদর্শিতা। কালিদাসের উপমা তাই অশেষ বৈদগ্ধের পরিচায়ক।
লাবণ্যময়তা: কালিদাসের রচনার আকর্ষণীয় উপাদান হল লাবণ্যময়তা। পর্বতনন্দিনী উমার সৌন্দর্য বর্ণনায় তিনি বলেছেন, উমার দেহ—‘পুপোষ লাবণ্যময়ান্ বিশেষাণ্’, কালিদাসের রচনাও এই ধরনের লাবণ্যময়তায় শ্যামল ও সবুজ। এই লাবণ্যের শক্তি নিহিত রয়েছে ভাবানুকূল শব্দ ও ধ্বনিযোজনার নৈপুণ্যে।
Leave a Reply