//
//

মহাকবি বাল্মীকির কবিপ্রতিভা আলোচনা কর।

বাল্মীকির কবি-প্রতিভা

বৃহদ্ধর্মপুরাণে বলা হয়েছে যে, আদি কাব্যবীজ বাল্মীকির অধিকারে ছিল। বাল্মীকি থেকেই নিখিল কাব্যের বিস্তার। বাল্মীকির সময় থেকেই মূলত লৌকিক কাব্য রচনার সূত্রপাত। বাল্মীকির পূর্বে অখণ্ড কোন কাব্য রচিত হয়নি। সুপ্রচলিত অনুষ্টুপ ছন্দকে লৌকিক কাব্যে প্রথম প্রয়োগ করেন বাল্মীকি।

বাল্মীকি শুধু আদি কবি নন, চিরকবির আদি প্রতীক। শ্রী অরবিন্দ বাল্মীকির কাব্যকে বলেছেন— ‘Oceanic Poetry’. রামায়ণে রয়েছে সাগরের বিশালতা, মহাসাগরের বৈচিত্র্য। এই বিশালতা আসলে বাল্মীকির প্রতিভার মধ্যে।

বাল্মীকির প্রতিভার মধ্যে রয়েছে এক অখণ্ডতাবোধ। যে অখণ্ডতাবোধ থেকে জন্ম নিয়েছে কবির সংবেদনশীল মনন। রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ‘বেদনা’। এই বেদনার ফলেই শোক পরিণত হয় শ্লোকে। ক্রৌঞ্চ মিথুনের দুঃখে এভাবেই বাল্মীকির কণ্ঠে ‘মা নিষাদ’ শ্লোক নির্গত হয়েছে। বাল্মীকির রামায়ণ কবির সেই সংবেদনশীল মনের প্রকাশ।

বাল্মীকির অঙ্কিত চরিত্রগুলি যেন পাষাণরেখা। বাল্মীকির বর্ণননৈপুণ্যও প্রশংসনীয়। রামায়ণে অযযাধ্যা ও লঙ্কা নগরীর বর্ণনায় মননের স্বাক্ষর রয়েছে। দুটি নগরীই সর্বরত্ন সমাকীর্ণ, সর্ব ঐশ্বর্যভূষিত ও শিল্পশোভার সার। অযোধ্যার সমৃদ্ধি সাত্ত্বিক সমৃদ্ধি। অন্য দিকে লঙ্কার ঐশ্বর্য প্রধান বর্ণনাও চমৎকার—‘হেমকক্ষ্যা পুরী রম্যা বৈদুর্যময়তোরণা। (অরণ্যকাণ্ড)।

বাল্মীকির প্রকৃতিচিত্রণ দক্ষতাও বিস্ময়কর। তাঁর কাব্যের বন-পাহাড়-সাগরের বর্ণনাগুলি পড়তে পড়তে মন অন্য এক রাজ্যে উধাও হয়ে যায়। তার কাব্যে চিত্রকূট থেকে লঙ্কা পর্যন্ত বনপথের বিচিত্র শোভা। লতাগুল্মশোভিত বন, পুষ্পশোভিত বৃক্ষ, পদ্মেৎপলভূষিত সরোবর, কোকিলকূজিত কুঞ্জ, হংস নিনাদিত বাপী—তার মধ্যে আবার তপস্বীর সিদ্ধাশ্রম। বন বর্ণনারও অন্ত নেই, শুনতে শুনতে শ্রুতিরও যেন ক্লান্তি নেই। এক এক ঋতুর পটভূমিকায় একই বনভূমির নতুন নতুন মূর্তি। যেমন, হেমন্তের পঞ্চবটীর রূপ—

বাষ্পাচ্ছন্নান্যরণ্যানি যবগোধূমবন্তি চ।

শোভন্তেহভ্যুদিতে সূর্যে নদদ্ভিঃ ক্রৌঞ্চসারসৈঃ।।

খর্জুর পুষ্পাকৃতিভিঃ শিরোভিঃ পূর্ণতন্ডুলৈঃ।

শোভন্তে কিঞ্চিদানম্রাঃ শালয়ঃ কনকপ্রভাঃ।।

(অরণ্য)

অর্থাৎ— অরণ্য বাষ্পচ্ছন্ন। তাতে যব ও গোধূমের শোভা। সূর্যোদয়ে ক্রৌঞ্চ সারসের কলরব। কনকবর্ণ শালিধানের খর্জুর পুষ্পাকৃতি পক্কশীর্ষ আনত।

বর্ষার পটভূমিতে মাল্যবান, শরতের কিষ্কিন্ধ্যা। বর্ণনাগুলিও বস্তুনিষ্ঠ। অরণ্যের স্নিগ্ধ নীলিমা, গিরিদরীর অফুরন্ত রঙ কবির চোখে মায়াঞ্জন পরিয়ে দিয়েছে। বাল্মীকির উপমা নিসর্গ-উপমানে পূর্ণ। তার সাগরের উপমান অম্বর, অম্বরের উপমান। সাগর; বৃক্ষের পুষ্পবর্ষণের উপমান মেঘের জলবর্ষণ। বাল্মীকির রামরাজীবলােচন, ভূতলাদুখিতা সীতা প্রকৃতিরই দুহিতা। সীতাকে হারিয়ে রামচন্দ্র যে বিলাপ করেছিলেন, তাতে সীতা প্রকৃতিময়ী। সীতা কদম্বপ্রিয়া’, ‘জাম্বুনদপ্রভা’, ‘মৃগশাবাক্ষী’, ‘চন্দ্রনিভাননা’,কামলক্ষণা’, চম্পকবর্ণাভা’। বিক্রম বর্ণনায় শাদুল, সিংহ, মত্তহস্তী প্রভৃতি উপমান, দশরথ রাজ শার্দুল, বিশ্বামিত্র মুনিশাদুল। রাবণের মৃত্যুতে যে উপমাটি ব্যবহৃত হয়েছে, তা সত্যিই অনবদ্য— ‘ইক্ষাকুসিংহাবগৃহীতদেহঃ সুপ্তঃ ক্ষিতৌ রাবণগন্ধহস্তী।’ (যুদ্ধ)

বাল্মীকির কবিত্ব প্রতিভা অসাধারণ। তিনি তাই কবিগুরু। বাল্মীকির কবিত্ব কালের কষ্টিপাথরে প্রমাণিত হয়ে গিয়েছে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর ‘চতুর্দশপদী কবিতাবলী’তে বাল্মীকির উদ্দেশ্যে তাই যথার্থই বলেছেন—

সে দুরন্ত যুবজন, সে বৃদ্ধের বরে,

হইল ভারত, তব কবি কুলপতি।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!