মহাভারতের কাব্যমূল্য আলোচনা কর।
মহাভারতের কাব্যমূল্য
মহাভারত যেহেতু মর্মের ইতিহাস, তাই কাব্য। আচার্য আনন্দবর্ধন এবং অভিনবগুপ্ত মহাভারতকে অপূর্ব শান্তরসাত্মক কাব্য বলেছেন। বিপুলা শান্তিই মহাভারতের রসধ্বনি। রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের কাব্যত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন—
বিজয়ের শেষে সে মহাপ্রয়াণ
সকল আশার বিষাদ মহান্
উদাস শান্তি করিতেছে দান।
চির-মানবের প্রাণে।
(সোনার তরী/পুরস্কার)
মহাভারতের অপূর্ব কাব্যত্বের মূলে আছে— অপূৰ্বত্ব। যে কাহিনী পাঠ করতে করতে মুহুর্মুহু হর্ষ, দুঃখ, স্তম্ভ, রোমাঞ্চ, নির্বেদ উপস্থিত হয় তা শুধু কাব্য নয়—মহৎ কাব্য। মহাভারতের মহাকাব্যত্ব তার চরিত্র ও বর্ণনার গৌরবের জন্য।
শ্রীঅরবিন্দ মহাভারতের কবিত্ব বিচার প্রসঙ্গে লিখেছেন— “Vyasa is the most masculine of writers.” সত্যিই ব্যক্তিত্বে ও বুদ্ধিমত্তায় ব্যাসদেব অনন্য। মহাভারতের কথা কাহিনীগুলি নানারসের নির্ঝর। শৃঙ্গার, করুণ, বীর, হাস্য, ভয়ানক সব রকমের রসের ভাণ্ডার মহাভারত। পরবর্তীকালে জাতকে, পঞ্চতন্ত্রে, হিতোপদেশে মহাভারতের কাহিনীগুলি সংকলিত হয়েছে। মহাভারতের চরিত্রে আছে জীবনের সোনার কাঠির স্পর্শ। ধৃতরাষ্ট্রের স্নেহান্ধতা ও কুটিলতা, দুর্যোধনের দম্ভ, কর্ণের পুরুষকার, শকুনির শাঠ্য, গান্ধারীর ধর্মশীলতা, দ্রৌপদীর তেজস্বিতা, অর্জুনের ধর্মশীলতা, অর্জুনের বীরত্ব, কুন্তীর ধৈর্য এবং কৃষ্ণের মাহাত্ম্য জীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত। এই চরিত্র পরিকল্পনা শ্রেষ্ঠ কবিত্বের পরিচায়ক।
ব্যাসকূট ও প্রহেলিকা
মহাভারতের প্রায় প্রত্যেকটি শ্লোক হীরকের মতো উজ্জ্বল ও নিহিতার্থবোধক। এতে আশ্চর্য মনস্বিতা ও মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের স্বাক্ষর বিদ্যমান। মহাভারতে শ্লোক ছাড়া আছে কতকগুলি ‘ব্যাসকূট’ ও ‘প্রহেলিকা’। এই শ্লোকগুলি পরবর্তীকালে ধাঁধা, তর্জা ও প্রহেলিকার উৎস।
ব্যাসকূট সম্বন্ধে কিংবদন্তী এই যে, ব্যাসদেব গণেশকে মহাভারত লিখে দেবার অনুরোধ করলে,গণেশ একটি শর্তে রাজি হন যে, শ্লোকগুলি বলার সময় ব্যাসদেব থামতে পারবেন, তাকে অনর্গল বলে যেতে হবে। ব্যাসদেব তাতে স্বীকৃত হয়ে আর এক শর্ত করেন যে, লেখার সময় গণেশকে অর্থ বুঝে লিখতে হবে। ব্যাসদেব কিছু কিছু বর্ণনা করেই এক একটি কূট শ্লোক বলতেন, অর্থ বুঝে তা লিখতে গণেশের একটু বিলম্ব হত। সেই অবসরে ব্যাসদেব আবার চিন্তা করে পরের শ্লোকগুলি বলে যেতেন। তাই ব্যাসকূট উৎপত্তির জনশ্রুতি। সুতরাং ব্যাসকূট আসলে আশ্চর্য প্রহেলিকা-ব্যাসকূটের ভাষা দুর্বোধ্য না হলেও অর্থঅতি রহস্যময়। তার বাচ্যার্থ প্রকৃত অর্থ নয়, প্রকৃত অর্থ হল নিহিতার্থ। যুধিষ্ঠির বারণাবতে যাওয়ার সময় প্রাজ্ঞ বিদুর প্রাজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে দুর্বোধ্য ভাষায় উপদেশ দিয়েছিলেন—
প্রাজ্ঞঃ প্রাজ্ঞপ্রলাপজ্ঞঃ প্রলাপজ্ঞমিদংবচঃ।
প্রাজ্ঞঃ প্রাজ্ঞং প্রলাপজ্ঞঃ প্রলাপজ্ঞং বচোহব্রবীৎ।।
(আদি পর্ব)
এর বাচ্যার্থ— প্রাজ্ঞ ও প্রাজ্ঞকথায় অভিজ্ঞ বিদুর প্রাজ্ঞ কথায় অভিজ্ঞ যুধিষ্ঠিরকে এই কথা বললেন, প্রাজ্ঞ প্রাজ্ঞকে, প্রলাপজ্ঞ প্রলাপজ্ঞকে এই কথা বললেন।
শব্দকল্পদ্রুম মতে, প্রহেলিকা হল কৃটার্থভাষিতা কথা। প্রহেলিকার স্বরূপ প্রচ্ছন্ন—
ব্যক্তীকৃত্য কমপি অর্থং স্বরূপার্থস্য গোপনাৎ।
যত্র বাহ্যান্তরাবর্থেী কথ্যতে সা প্রহেলিকা।।
প্রহেলিকার গূঢ়ার্থ বুদ্ধিগম্য। সাঙ্কেতিক শব্দগুলির অর্থ জানা থাকলে প্রহেলিকার অর্থ নির্ণয়ে কষ্ট হয় না। মহাভারতে এই প্রহেলিকার সংখ্যাও কম নয়। উদাহরণ দেওয়া যেতে পারেউদ্যোগ পর্বে ধৃতরাষ্ট্রের প্রতি বিদুরের এই উক্তিটিও একটি প্রহেলিকা—
একয়া দে বিনিশ্চিত্য ত্ৰীংশ্চতুর্ভিশে কুরু।
পঞ্চ জিহ্বা ষড়বিদিত্বা সপ্ত হিত্বা সুখী ভব।
অর্থাৎ এক দ্বারা দুইকে জেনে, তিনকে চার দ্বারা বশ কর; পাঁচকে জয় করে ছয়কে জেনে, সাতকে ত্যাগ করে সুখী হও।
Leave a Reply