চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের শ্রেষ্ঠ কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।
কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী
শুধুমাত্র মঙ্গলকাব্যের ধারায় নয়, মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ। মঙ্গলকাব্যের পুচ্ছগ্রাহিতার পথ পরিত্যাগ করে জীবনরসিক কবি মুকুন্দ স্বকীয় মৌলিকতা ও সৃজনশীলতার জন্য বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছেন। মানবতাবাদী কবি মুকুন্দ কাহিনিগ্রন্থনে, চরিত্রচিত্রণে, রচনারীতিতে, জীবন সম্বন্ধে প্রসন্ন ভাবগম্ভীর অথচ বাস্তবনিষ্ঠ ও নাটকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্ময়কর কৃতিত্বের জয়টীকা পরে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজের হৃদয়ের মণিকোঠায় সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।
তাঁর কাব্য ‘চণ্ডীমঙ্গল’ নামে প্রচলিত হলেও আসলে এই কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’। মুকুন্দরাম নামটি প্রচলিত থাকলেও তাঁর আসল নাম মুকুন্দ এবং উপাধি ‘কবিকঙ্কণ’। আর এই উপাধি দিয়েছিলেন তাঁর আশ্রয়দাতা রঘুনাথ রায়।
মুকুন্দরামের আত্মপরিচয়
মধ্য যুগের মঙ্গলকাব্যের কবিদের আত্মপরিচয় থেকে তাদের ব্যক্তিপরিচয় ও কাব্য রচনার কাল নির্ধারণ করা হয়— যদিও তা সবক্ষেত্রে সহজসাধ্য নয়। মুকুন্দের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। এই ধরনের আত্মবিবরণী থেকে কয়েকটি সাধারণ লক্ষণ লক্ষ করা যায়—
১. আত্মবিবরণীর মধ্যে দিয়ে আত্মপ্রচারের একটি আকাঙ্ক্ষা বিদ্যমান।
২. বেশিরভাগ আত্মবিবরণীতে আছে গ্রন্থেৎপত্তির কারণরূপে দেবদেবীর স্বপ্নাদেশ। আর এই অলৌকিক স্বপ্নবিবরণ মধ্যযুগের লক্ষণ।
৩. আত্মবিবরণীতে কবিদের পারিবারিক পরিচয় পাওয়া যায়।
৪. কবির আত্মপরিচয়ের মধ্যে গ্রাম ও স্থানের ভৌগোলিক পরিচয় পাওয়া যায়।
৫. আত্মপরিচয়গুলি অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাসের আকর। এতে রাজা ও রাজপুরুষের নাম, জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা যেমন থাকে তেমনি সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা ইতিহাসের কথাও পাওয়া যায়। এদিক থেকে আত্মবিবরণীর গুরুত্ব যথেষ্ট।
কবিকঙ্কণের আত্মপরিচয় থেকে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য জানা গেলেও তাঁর কাব্য রচনাকাল সম্বন্ধে এ যাবৎ গবেষকগণ সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি।
রামগতি ন্যায়রত্ন তাঁর ‘বাঙ্গালা ভাষা ও বাঙ্গালা সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’ গ্রন্থে কবির প্রকৃত নাম মুকুন্দরাম বলে জানালেও সুকুমার সেন জানিয়েছেন, কবির প্রকৃত নাম মুকুন্দ। ‘রাম সংযুক্ত মুকুন্দ’-এর কোন প্রমাণ নেই। কবিকঙ্কণ তাঁর উপাধি, মুকুন্দ তাঁর নাম এবং চক্রবর্তী তাঁর কৌলিক পদবী। এক্ষেত্রেও সুকুমার সেন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন— “কবিকঙ্কণ’ উপাধি নয়, উপাধি হইলে দাতার উল্লেখ অবশ্যই কোন না কোন ভণিতায় থাকিত। এটি স্বয়ং গৃহীত উপনাম। সেকালে পাঞ্চালিকা-প্রবন্ধের গায়েন পায়ে নূপুরের সঙ্গে হাতে কড়াইভরা আথবা ঘুঙুর দেওয়া মলের মতো বালা পরিত। চণ্ডীমঙ্গলের মূল গায়েন আদ্যাপি হাতে এমনি কঙ্কণ পরিয়া থাকেন, মন্দিরার মতো তাল দিবার জন্য। মুকুন্দ তাঁহার চণ্ডীগানের দলের অধিকারী ছিলেন। তাই এই উপনাম গ্রহণ করিয়াছিলেন।” কবির প্রদত্ত বংশলতিকা মতে রাঢ়ীয় কয়ড়ি গাঁই-এর ছোট তরফের সাধনগোত্রীয় ব্রাহ্মণ ছিলেন তপন ওঝা। তাঁর পুত্র উমাপতি এবং উমাপতির পুত্র ছিলেন মাধব। মাধবের কনিষ্ঠপুত্র হলেন জগন্নাথ। তাঁর পুত্র হলেন গুণীরাজ মিশ্র বা হৃদয় মিশ্র। হৃদয় মিশ্রের দুটি সন্তান কবিচন্দ্র ও মুকুন্দ। মুকুন্দের দুই পুত্র ও দুই কন্যা যথা— শিবরাম ও মহেশ এবং যশোদা ও চিত্রলেখা।
অন্যদিকে নটবর চক্রবর্তী প্রকাশিত ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ (৩য় সংস্করণ, ১৩৩২ বঙ্গাব্দ), সম্পাদক কবি মুকুন্দের ভিন্ন পরিচয়ের কথা জানিয়েছেন— “কবিকঙ্কণের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার নাম কবিচন্দ্র, পিতার নাম হৃদয়, পিতামহ জগন্নাথ, মাতার নাম দৈবকী, পুত্রের নাম শিবরাম, পুত্রবধূর নাম চিত্রলেখা, কন্যার নাম যশোদা, জামাতার নাম মহীশ ছিল। ইহার একটি কনিষ্ঠ ভ্রাতাও ছিলেন, তাহার নাম রমানাথ বা রামানন্দ।”
কবির পূর্বপুরুষ মাধব ওঝার নিবাস ছিল কর্ণপুরে। দেবসেবার দায়িত্ব নিয়ে তিনি পরে দামিন্যায় বসবাস করেন এবং এই দামিন্যা ছিল কবি মুকুন্দের নিবাস। দামিন্যার বর্তমান অবস্থান বর্ধমান জেলার রায়না থানায়। পুরুষানুক্রমে কবিরা দামিন্যার তালুকদার গোপীনাথ নন্দীর জমি ভোগ করতেন। পরে রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকটে গোপীনাথের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হলে ও কারারুদ্ধ হলে তাঁর ভরসা ত্যাগ করে একমাত্র জীবিকা যেহেতু চাষাবাদ, তাই দামিন্যা ত্যাগ করে কবি পাড়ি দেন অন্যত্র। দামিন্যা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন চণ্ডীবাটি গ্রামের শ্রীমন্ত খাঁ ও মুনিব খাঁর পরামর্শে। পথে যদু কুণ্ডুর সহৃদয় দাক্ষিণ্যের কথা কবি স্মরণ করেছেন। তারপর মামার বাড়ি তেউট্যায় পৌঁছে। গঙ্গাদাসের সাহায্য পান এবং শেষ পর্যন্ত মেদিনীপুরের আরড়া গ্রামে বাঁকুড়া রায়ের আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং তার পুত্র রঘুনাথের গৃহশিক্ষক পদে কবি নিযুক্ত হন। এখানেই কবি কাব্য রচনা করেন।
মুকুন্দরামের কাব্য রচনাকাল
১৭৪৫ শকে (১৮২৩-২৪ খ্রিঃ) রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় কবি মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। এই গ্রন্থের শেষে কালজ্ঞাপক কয়েক ছত্র মুদ্রিত হয়—
শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতা
কতদিনে দিলা গীত হরের বনিতা।
অভয়ামঙ্গল গীত গাইল মুকুন্দ।
আসোর সহিত মাতা হইবে সানন্দ।
রস শব্দকে ছয় ধরলে এই হেঁয়ালিপূর্ণ শ্লোকের অর্থ দাঁড়ায়— রস = ৬, বেদ = ৪, শশাঙ্ক = ১, অর্থাৎ ৬৬৪১ (অঙ্কস্য বামা গতি) = ১৪৬৬ শকাব্দ বা ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১৪৬৬ শক + ৭৮ = ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। আবার রসকে নয় ধরলে দাঁড়ায় ৯৯৪১ (১৪৯৯ শকাব্দ) অর্থাৎ ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে চণ্ডীমঙ্গল রচনার কাল।
দীনেশচন্দ্র সেন ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দকে মুকুন্দের দামিন্যা ত্যাগ ও কাব্যরচনার সময় বলে নির্ধারণ করেছেন।
এ বিষয়ে সুকুমার সেন আমাদের দৃষ্টি অন্যত্র নিয়ে গেছেন। তাঁর মতে— “তাঁহার পাঞ্চালিকা প্রবন্ধ যিনি প্রথম গান করিয়াছিলেন তাহার উল্লেখ আছে দুইটি ভণিতায়। ইহা হইতে জানি যে বিক্রমদেবের (বাঁকুড়া দেবের জ্ঞাতি) পুত্র, তালমানে বিজ্ঞ, প্রসাদ (দেব) ছিলেন মূল গায়েন।’’ এই মর্মে ভণিতা পাই গৌ পুঁথিতে আত্মকথা পদে—
বিক্রম দেবের সূত গান করে অদ্ভুত
বাখান করএ সর্বজন।
তালমানে বিজ্ঞ দড় বিনয়-সুন্দর বড়
মতিমান মধুরবচন।।
দ্বিতীয় ভণিতাটি সব পুথিতে এবং ছাপা বইয়ে আছে কাহিনির উপসংহারে অষ্টমঙ্গলায়—
অষ্টমঙ্গলা সায় শ্রীকবিকঙ্কণ গায়
অমর সাগর মুনিবরে।
চারিপ্রহর রাতি জালিয়া ঘতের বাতি
গাইলেন প্রসাদ আদরে।।
এইখানেই প্রথম গাওয়ার তারিখও পাওয়া গেল— অমর (=১৪) সাগর (৭) মুনিবর (৭) অর্থাৎ ১৪৭৭ শকাব্দ (=১৫৫৫-৫৬ খ্রিস্টাব্দ)।”
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, ১৫৭৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি তাঁর গ্রন্থ রচনা আরম্ভ করেন এবং গ্রন্থের রচনাকাল ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দ।
আশুতোষ ভট্টাচার্য ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, ১৫৯৪-১৬০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্যরচনা সমাপ্ত হয়।
অন্যদিকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্তে (২য় খণ্ড) জানিয়েছেন— “১৫৭৭ সালে মুকুন্দরাম ঘর ছাড়িলে এবং স্বপ্নদেশ লাভ করিবার চৌদ্দ-পনের বৎসর পরে কাব্যরচনায় প্রবৃত্ত হইলে স্বাভাবিকতার খুব বেশি হানি হইবে না। কিন্তু ইহার মধ্যে যাঁহারা রঘুনাথ রায়ের রাজ্যকালকে (১৫৭৩-১৬০৩) তুরুপ হিসাবে ব্যবহার করিবেন, তাঁহারাই উপস্থিত ক্ষেত্রে জিতিয়া যাইবেন।”
সুখময় মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ‘মুকুন্দরাম চণ্ডীমঙ্গলের রচনা শেষ হয়েছিল মানসিংহের শাসনকালে, অর্থাৎ ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।
অন্যদিকে কবি মুকুন্দের ‘গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ’ অংশে মানসিংহের উল্লেখ আছে। এই তথ্য অনুযায়ী গবেষকগণ গ্রন্থ রচনার কাল সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী মানসিংহ বিহারের সিপাহসালার নিযুক্ত হন ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে। ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি উড়িষ্যা আক্রমণ করে বিদ্রোহী আফগানদের দমন করেন। তিনি বাংলার শাসক ছিলেন ১৫৯৪ থেকে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)
আচার্য যদুনাথ সরকার তার ‘History of Bengal’ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে জানিয়েছেন যে, মানসিংহ মুঘল সুবাদার হিসাবে বাংলায় এসেছিলেন ১৫৯৪ খ্রিস্টাব্দের ৪ঠা মে, আর এই পদ থেকে তিনি বিদায় নেন ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দের ১লা সেপ্টেম্বর। তবে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে যেহেতু পাঠান সামন্ত ওসমান তাঁর হাত থেকে উড়িষ্যা অধিকার করে নেন সেহেতু মানসিংহের রাজত্বকাল ১৫৯৪ থেকে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দ।
মামুদ সরীপের কথা আছে গ্ৰন্থ উৎপত্তির কারণ অংশে। এই মামুদ সরীপ ডিহিদার অর্থাৎ কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত ডিহির শাসনকর্তা। শেরশাহের আমলে যার নাম ছিল ‘মুকদ্দম। মামুদ সরীপ-এর ঐতিহাসিক সূত্র নেই বললেই চলে। আর একজনের নাম রয়েছে—উজির। ‘দেওয়ান’কে শেরশাহের আমলে উজির বলা হত। ইতিহাসের সূত্রে পাওয়া যায়, ১৫৮৯ তে টোডরমলের মৃত্যু হলে কুলিজ খান দিল্লির প্রধান নিযুক্ত হয়ে শাসনকার্যের সুবিধার জন্য প্রত্যেক সুবাতে উজির নিয়োগের ব্যবস্থা করেন। এই সময়ে বাংলায় উজির হয়ে এলেন কিসুদাস। তাঁর পিতা ছিলেন বাংলার বিখ্যাত দেওয়ান রায় পুত্রদাস, যিনি ১৫৭৯ থেকে ১৫৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ঐ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। কিসুদাস তাঁর পুত্র বলেই হয়তো কবি ‘রায়জাদা’ বলে উল্লেখ করেন সহজেই চিহ্নিত করার কারণে।
গ্রন্থ উৎপত্তির কারণ অংশে আরড়ার ভূস্বামী বাঁকুড়ারায় এবং রঘুনাথ রায়ের নাম উল্লেখের ফলে তার ঐতিহাসিক সূত্র বিচার করেছেন—রামগতি ন্যায়রত্ন এবং অম্বিকাচরণ গুপ্ত। এঁদের মতে রঘুনাথ রায়ের রাজত্বকাল ১৫৭৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। রঘুনাথ রায়ের উল্লেখ পাওয়া যায় কেশিয়াড়ীর সর্বমঙ্গলার দেউলগাত্রে। সেখানে চক্রধর শর্মা যে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাতে ওড়িয়া অক্ষরে রঘুনাথ রায়ের পরিচয় রয়েছে। সেই পরিচয় থেকে গবেষকগণ সিদ্ধান্ত করেন ১৫২৬ শকাব্দ বা ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দে মানসিংহের রাজত্বকালে রঘুনাথ পুত্র চক্রধর শর্মা কেশিয়াড়ীতে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মুকুন্দের বন্দনা অংশে যেহেতু সর্বমঙ্গলার বন্দনা নেই সেহেতু ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের আগে মুকুন্দ কাব্য রচনা করেন বলে মনে হয়।
এমনকি, কাব্যের বিভিন্ন অংশে উল্লিখিত অভ্যন্তরীণ তথ্য থেকেও উপলব্ধি করা যায়, মুকুন্দের কাব্য রচনাকাল ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের পূর্বে, রাজস্ব নির্ধারণের নীতি ও পদ্ধতি, মুদ্রামানের আদর্শ বা স্ট্যাণ্ডার্ড, মুদ্রাসংস্কার, সমকালীন রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সূত্র প্রভৃতি থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মুঘল আমলে টোডরমলের সময়কার ঘটনা কবি মুকুন্দের কাব্যে উল্লিখিত হয়েছে। যেমন—
(অ) খিলভূমি লিখে লাল’— এই সূত্র থেকে পাওয়া যায় মুঘল আমলের প্রসিদ্ধ দুটি নীতি।
১. রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য আবাদী এলাকার পরিমাণ বাড়ানো (এজন্য ‘পনের কাঠায় কুড়া’ বা জমির পরিমাণ বাড়ানো)।
২. অর্থকরী ফসলের উৎপাদন বাড়ানো, যাতে রাজস্ব বৃদ্ধি করা যাবে।
(আ) ‘পোদ্দার হইল যম, টাকা আড়াই আনা কম’—ইরফান হাবিব (মুঘল ভারতের কৃষি ব্যবস্থা—অনুবাদ)-এর মতে আকবরের সময়ে ১৫৮৩ খ্রিস্টাব্দে টোডরমলের নিয়মাবলীতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে, টাকশালগুলি পুরোনো মুদ্রার বদলে নতুন মুদ্রা দেবে। এই সময়েই মনে হয় পোদ্দাররা এই মুদ্রা বদল করার সময় আড়াই আনা করে কেটে নিত।
(ই) টাকার দ্রব্য বেচে দশ আনা’—‘আইন-ই-আকবরী’ থেকে জানা যায় কলা বা আনা হল ১-এর ১৬ তম অংশ অর্থাৎ ১/১৬। ‘হফৎ ইলিস্’-এর মতে ১৫৯০-৯৫ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় ‘কলা’ ‘আনা’ নামে প্রাথমিক ভগ্নাংশের একক হিসাবে চালু হয়।
(ঈ) সেলামী, বাঁশগাড়ী, ওড়ালোন, সানাভাত প্রভৃতি খাতে প্রজাদের বিভিন্ন দেয় করও ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের পূর্বের দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়।
(উ) ‘যত বৈসে দ্বিজবর।/ কার নাহি নিব কর। চাষভূমি বাড়ি দিব দান’—ব্রাহ্মণদের ব্রহ্মোত্তর সম্পত্তি দিয়ে, ঠাকুর মন্দির প্রতিষ্ঠা করে দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত করা ষোড়শ শতকের শেষ দিকের ঘটনা।
সুতরাং বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ ও গবেষকদের অনুমান থেকে বলা যেতে পারে, কবি মুকুন্দ ১৫৮৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬০৪ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কাব্য রচনা করেছিলেন।
মুকুন্দরামের কাব্যের অভিনবত্ব
কবিকঙ্কণের আধুনিক মন ও জীবনবোধের গভীরতা গতানুগতিক মঙ্গলকাব্যের ধারায় তাঁকে সজীবতা দিয়েছে। এই সজীবতার মূলে রয়েছে কবিপ্রতিভার সুস্পষ্ট অনন্যতা, তাঁর রচিত কাব্যের অবিস্মরণীয় বিশিষ্টতা। কবি প্রচলিত সাহিত্যধারা থেকে তাঁর কাব্যের বিষয়বস্তু আহরণ করেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি ঐতিহ্যকে লঙ্ঘন করেননি। প্রচলিত কাব্য প্রসঙ্গকে গ্রহণ করলেও আধুনিক জীবনবোধের দিক থেকে তাঁর কাব্যকে সাজিয়েছেন। কবিকঙ্কণের প্রতিভার যাদুম্পর্শে তাজস্র চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের মতো তাঁর কাব্যের অকাল-বিয়োগ ঘটেনি। বরং সুস্পষ্ট স্বাতন্ত্র্য মহিমায় মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যাকাশে তাঁর কাব্যটি উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের মতো প্রদীপ্ত রয়েছে। এখানেই তাঁর কাব্যের অনন্যসাধারণ বিশিষ্টতা ও অভিনবত্ব।
সেই অভিনবত্ব ও আধুনিকতার স্বরূপ কবির কাব্যে কতখানি তা বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। সমালোচক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় এই প্রসঙ্গে বলেছেন—“কাব্যটির আধার তৈরী হয়েছে দেবী চণ্ডীকে ঘিরে, আর আধেয় হচ্ছে সজীব বাঙালীর গৃহজীবন। …চণ্ডীমঙ্গলের আকর্ষণ কাব্যটিতে পরিব্যাপ্ত বাঙালীর জীবনরসের জন্যে। এখানেই মধ্যযুগের কবি হয়েও মুকুন্দ স্বতন্ত্র। এটি যে জীবনকে নানা কোণ থেকে দেখা, জীবনের উষ্ণতাকে উপলব্ধি করা, রূঢ় বাস্তবতার স্বরূপ উদঘাটন করা—এখানেই কবির আধুনিকতা।’’
(এক) মঙ্গলকাব্যের অন্যান্য কবিদের মতো গতানুগতিকভাবে মুকুন্দ চক্রবর্তী ঘটনা বিবৃত করেননি। আখ্যায়িকা উপস্থাপনে ও ঘটনা বর্ণনায় তিনি অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি কখনো ঔপন্যাসিকের মতো, কখনো বা নাট্যকারসুলভ। ঔপন্যাসিকের বাস্তবতাপ্রীতি, পর্যবেক্ষণ কুশলতা, অভিজ্ঞতাপরায়ণতা, মনস্তত্ত্বশীলতা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যগুলি তাঁর মধ্যে দেখা যায়।
ব্যাধ কালকেতু কাননে পশু শিকার করতে গিয়ে কোন পশু না পেয়ে কালকেতুর মানসিক অবস্থা যেন একজন আধুনিক মানুষের মনস্তত্ত্বকে ফুটিয়ে তোলে—
দুঃখিনী ফুল্লরা মোর আছে প্রতি আসে।
কি বলিয়া দাণ্ডাইব যেয়্যা তার পাশে।।
তৈল লবণের কড়ি ধারি ছয় বুড়ি।
শ্বশুর ঘরের ধান্য ধারি দেড় তাড়ি।।
কিরাত পাড়াতে বসি না মেলে উধার।
হেন বন্ধুজন নাহি কেহ সহে ভার।।
বিষম সম্বল চিন্তা মহাবীর লাগে।
একচক্ষে নিদ্রা যায় এক চক্ষে জাগে।।
কালকেতু সংসারী মানুষ। স্বামী-স্ত্রীতে মিলে দিন আনে, দিন খায়। এভাবেই সুখে-দুঃখে চলে যায় দিনগুলি। কিন্তু যখন পশু না পেয়ে কালকেতু চিন্তিত হয়, তখন তার প্রথমেই মনে আসা উচিত ফুল্লরার কথা এবং তারপর তান্যান্য তাভাবের কথা। তাকেই স্পষ্ট করে চিত্রিত করার জন্য কবির নিখুঁত আধুনিক মনস্ততত্ত্বের প্রয়োগ— ‘একচক্ষে নিদ্রা যায় এক চক্ষে জাগে।’ এতো চিরকালের কথা। মানুষের যখন জীবিকাতে টান পড়ে, তখন তো তা-ই হয়।
ধনপতির উপাখ্যানে, আখ্যায়িকার উপস্থাপনে ও ঘটনার সুচারু সমন্বয়ে কবিকঙ্কণ অভিনবত্বের পরিচয় রেখেছেন। এক্ষেত্রে তিনি কখনো ঔপন্যাসিকের বাস্তবতাকে এনেছেন, আবার কখনো নাটকের দ্বন্দ্বকে ফুটিয়ে তুলেছেন। এমনকি নাট্য সিচুয়েশন সৃষ্টি করে কাহিনীর মধ্যে চমক এনেছেন। তাই আলৌকিক দেব আশ্রিত ঘটনাও হয়ে উঠেছে সম্ভাব্য ও অপরিহার্য। যেমন, ধনপতির পায়রা ওড়ানোকে কেন্দ্র করে যে কাহিনীর সূত্রপাত সেই কাহিনীতে স্বাভাবিকভাবে এসে গিয়েছে ধনপতির দ্বিতীয় বিবাহকে কেন্দ্র করে সতীন সমস্যা রূপ সামাজিক সমস্যার বিভিন্ন দিক।
আবার ধনপতির দ্বিতীয় স্ত্রী খুল্লনার চণ্ডীপূজার ঘট স্থাপনকে কেন্দ্র করে পরবর্তী কাহিনীর গতি নির্ধারিত হয়েছে। এমনকি বিবাহের খবর রাজাকে ঝানাতে গিয়ে রাজার নির্দেশে যেতে হয়েছে সিংহলে। সুতরাং নিছক পায়রা ওড়ানো রূপ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাহিনীর ধারা সামাজিক থেকে রাষ্ট্রনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেছে। অপরদিকে শ্ৰীমন্ত ও তার গুরুর বাক্বিতণ্ডা রূপ ঘটনা পরবর্তী কাহিনীর ধারাকে গতিদান করেছে। কারাগারে ধনপতি ও শ্রীমন্তের কথোপকথনের মধ্যে দেখা দিয়েছে নাটকীয়তা।
ধনপতির কারাগারে বন্দি হওয়ায় যে কাহিনীর জট সৃষ্টি হয়েছিল তা দেবতার হস্তক্ষেপে গ্রন্থিমোচন হলেও শেষ পরিণতি কী হবে এ নিয়ে দ্বন্দ্ব তৈরি করতে পেরেছেন কবিকঙ্কণ। অপরদিকে কাহিনীকে গতি দেবার জন্য লৌকিক কাহিনীর মধ্যে সুকৌশলে পৌরাণিক কাহিনী সন্নিবেশ করেছেন। যেমন শ্রীমন্তের সিংহল যাত্রার সূত্রে সাগরে ডিঙা এলে সেই কাহিনীর সূত্রে অবলীলাক্রমে কবিকঙ্কণ শুনিয়েছেন—সগর বংশের ধ্বংস, গঙ্গামাহাত্ম্য, ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন, সেতুবন্ধ তথা সেতুভঙ্গ রূপ ঘটনার কথা। ফলে মূল কাহিনীর মধ্যে অভিনবত্ব সঞ্চারিত হয়েছে।
(দুই) আধুনিক জীবন দ্বন্দ্ব-সংঘাতময়। কবি মুকুন্দের কাব্যেও আধুনিক জীবনসুলভ নাটকীয় দ্বন্দ্বসংঘাত, বিস্ময়, উৎকণ্ঠা কিম্বা কৌতূহলের নিপুণ প্রয়োগ লক্ষণীয়। ছদ্মবেশিনী দেবীকে ঘিরে ফুল্লরা ও কালকেতুর মনে যে ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি হয়েছে তাতে রয়েছে অভিনবত্ব। যেমন—
হয় নয় জিজ্ঞাসা করহ যায়্যা বীরে।
যদি বীর বলে যাব স্থানান্তরে।।
(‘ফুল্লরার প্রতি চণ্ডী’)
ধনপতির আখ্যানে ধনপতি মধ্য যুগের আর পাঁচটা পুরুষের মতোই চেয়েছিল দ্বিতীয়বার বিবাহ করতে, কিন্তু সেই বিবাহকে কেন্দ্র করে এত সমস্যা সৃষ্টি হবে তা তিনি জানতেন না। কিম্বা কেই বা দেবতার লীলা বা অলৌকিকতায় বিশ্বাসী ছিল না মধ্যযুগে, কিন্তু সেই অলৌকিক দৃশ্য (কমলেকামিনী) দেখে রাজাকে বলার জন্য এবং তা আবার রাজাকে না দেখাতে পারানোর জন্য কারাগারে যেতে হবে তা ধনপতি কখনো স্বপ্নেও ভাবেনি।
কিম্বা খুল্লনা তো জেনে শুনেই সতীনের সঙ্গে সংসার করতে এসেছিল। কিন্তু এভাবে তাকে দ্বন্দ্ব সংঘাতের মধ্যে পড়তে হবে, যেখানে তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দেবে—এটা সে কখনো ভাবেনি। এই যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত সৃষ্টি করার কৌশল কবিকঙ্কণের ছিল। তাই সরলরৈখিক কাহিনী পেয়েছে জটিল কাহিনীর মর্যাদা এবং তার মধ্যে রয়েছে। সূক্ষ্ম উত্থান-পতন রূপ নাটকীয়তার রূপ।
(তিন) আধুনিক সাহিত্যে আধুনিক জীবন সমস্যার রূপায়ণ বিশেষ ভাবে লক্ষ করা যায়। সামাজিক সমস্যা মুকুন্দের কাব্যে জীবন্তরূপে চিত্রিত হয়েছে। যেমন সতীন সমস্যা মধ্যযুগের একটি বিশেষ সামাজিক সমস্যা যা চিত্রিত হয়েছে ‘কালকেতুর প্রতি ফুল্লরা’ অংশে—
শাশুড়ী নননদী নাহি নাহি তোর সতা।
কার সঙ্গে দ্বন্দ্ব করি চক্ষু কৈলি রাতা।।
সপত্নী সমস্যার রূপায়ণেও কবিকঙ্কণ অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছেন। বল্লাল সেনের যুগের কৌলীন্য প্রথার বলি হয়েছে কত অসহায় নারী। সপত্নী সমস্যা তাই বাংলার চিরন্তন সমস্যা। সেই সমস্যাকে করুণ মধুর করে এঁকেছেন কবিকঙ্কণ— তাঁর ধনপতির কাহিনীতে। কালকেতুর কাহিনীতে যার প্রকাশ ছিল সহজ সরল, তাকেই তীব্র রূপ দিয়েছেন ধনপতির কাহিনীতে।
স্বামীর অবর্তমানে জাল চিঠি রচনা করে, কিম্বা দুর্বল দাসীর কূট অভিসন্ধি চরিতার্থ করবার বাসনার দিক থেকে সতীন সমস্যা অত্যন্ত সূক্ষ্মরূপে তুলে ধরা হয়েছে এই কাহিনীতে। যে হলনা সামান্য ‘পাটশাড়ী’ ও গহনা এবং স্বামীর মিষ্ট বাক্যে প্রতারিত হয়ে ধনপতিকে দ্বিতীয় বিবাহের অনুমতি দিয়েছিল সেই লহনাই পরে বুঝতে পারে—সে কি ভুল কাজ করেছে। তাই লীলাবতীর কাছে লহনা বলে—
দিনে থাকি ভাল রাত্রি হয় কাল
দুঃসহ বিরহ ব্যথা।
এরূপ যৌবনে দারুণ সতিনে
ওই সনে মন-কথা।।
সতীন সমস্যারূপ অগ্নিতে ঘি দেয় দুর্বলার অভিসন্ধি। তার রূপায়ণেও কবিকঙ্কণ অনবদ্য। যেমন দুর্বলা বলে—
যেই ঘরে দু-সতিনে না হয় কন্দল।
সে ঘরে যে দাসী থাকে সে বড় পাগল।।
(চার) চরিত্র-চিত্রণের মধ্যেও রয়েছে আধুনিকতা ও স্বাতন্ত্র্য। পরিচিত চরিত্রসমূহ কবিকঙ্কণের প্রতিভাস্পর্শে অভিনব হয়ে উঠেছে। দেবচরিত্র চিত্রণে তিনি কল্পিত কোনো উপাদানের সহায়তা গ্রহণ করেননি। বরং মর্ত্যের মানব-মানবীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, মান-অভিমান, লোভ-ঈর্ষা প্রভৃতি বৃত্তিতাড়িত হিসেবেই তাঁদের দেখিয়েছেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলি প্রায় সর্বত্রই বাস্তব ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে এবং যার তুলনা সমগ্র বাংলা সাহিত্যে খুব কম আছে বলে সমালোচকগণ মনে করেন। কালকেতু আদিম বন্য ব্যাধনায়ক।
গ্রাম্য বর্বরতা ও গ্রাম্য সারল্য তারই চরিত্রে বর্তমান। ফুল্লরা তার যোগ্য সহচরী, স্বামীগতপ্রাণা পত্নী। ভাঁড়ু দত্ত শঠ ও ধূর্ত-কায়স্থ কুলতিলক। মুরারি শীল বণিক সমাজের চিরকালের প্রতিনিধি। বাণ্যানীও তার যোগ্য পত্নী। মহাদেব আত্মভোলা, ভোজনবিলাসী, দরিদ্র গ্রাম্য গৃহী। গৌরী তাঁর কলহপরায়ণা অথচ পতি-দরদিনী স্ত্রী। ইন্দ্র স্নেহাতুর পিতা, স্বার্থপরায়ণ ব্যক্তি। চরিত্রের নিখুঁত মনস্তত্ত্বের রূপায়ণে চরিত্রগুলি মধ্যযুগের মাটি থেকে আধুনিক যুগের মহাকাশে অবলীলাক্রমে স্থান পেয়ে যায়।
চরিত্রের ‘আঁতের কথা’কে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কবিকঙ্কণ ধনপতির কাহিনীতে বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। পরিচিত চরিত্রসমূহ কবিকঙ্কণের প্রতিভাস্পর্শে অভিনব হয়ে উঠেছে। সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ শক্তি ও সহানুভূতি ছিল বলেই কবি চরিত্রের মনের গহনে ডুব দিয়েছেন এবং চরিত্রগুলিকে জীবন্ত ও শাশ্বত রূপ দিতে পেরেছেন। তাই দুর্বল দাসী যেমন রামায়ণের মন্থরার নবসংস্করণ আবার তেমনই আধুনিক যুগের ঠকচাচার দোসর এবং হীরামালিনীর পূর্বসুরী। হলনাও জীবন্ত চরিত্র। বিগত যৌবনা, বন্ধ্যা নারীর মনস্তত্ত্বকে যেভাবে লহনার মধ্যে কবিকঙ্কণ রূপ দিয়েছেন, তা নিঃসন্দেহে অভিনব। খুল্লনার প্রেম, ভালবাসা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ধৈর্য, নিষ্ঠা, সহনশীলতা যেভাবে চিত্রিত করেছেন, তাতে খুল্লনা একজন অসহায়, অত্যাচারিতা নারীর প্রতিনিধিস্থানীয় হয়ে উঠেছে। চণ্ডীর প্রতি খুল্লনার এই উক্তিতে—
পুত্রবর চাব কিনা স্বামী নাহি ঘরে।
কি করিব ধন বহু আছয়ে ভাণ্ডারে।।
—নারীর মর্মকথাটি অকপটে ব্যক্ত হয়েছে। সত্যিই তো, নবপরিণীতা বধূর কাছে স্বামী নেই। এর চেয়ে বড় আক্ষেপের বিষয় আর কী হতে পারে? তাই নারীর পুত্রবর কামনা, অলংকার, কামনা, তার কাছে নিরর্থক হয়ে পড়ে। সেজন্য খুল্লনা দেবীর কাছে যে বর চায় তার মধ্যে বাঙালি নারীর ঐকান্তিকতা, ভক্তি ও বিশ্বাসের কথাই ব্যক্ত হয়। যেমন—
যদি বর দিবা মাতা সেবকবৎসলে।
অনুক্ষণ রহে মন তব পদতলে।।
(পাঁচ) ঔপন্যাসিক নৈর্ব্যক্তিকতা আধুনিক সাহিত্যের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য কবিকঙ্কণের কাব্যে বর্তমান। কবি নিজে জীবনে দুঃখ পেলেও কাব্যে কোন দুঃখবাদের পরিচয় নেই, কবিও দুঃখবাদী নন। তার কারণ দুঃখের বর্ণনা জীবনরসসিক্ত হয়ে উঠেছে। যেমন পশুদের ক্রন্দন ও বিলাপের মধ্যে একটু লক্ষ্য করলেই তৎকালীন শোষিত মানুষের করুণ ক্রন্দনের সুরটুকু শোনা যায়—
প্রাণের দোসর ভাই গেল পরলোক।
উদরের জ্বালা আর সোদরের শোক।।
সামন্তশ্রেণির আত্যাচারে অত্যাচিরিত তৎকালীন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মর্মকথাকে নিস্পৃহ উদাসীনতায় ব্যক্ত করেছেন কবি—
উইচারা খাই পশু নামেতে ভালুক।
নেউগী চৌধুরীনই না করি তালুক।।
এই বর্ণনার সময় একদিকে যেমন দুর্বলের করুণ অসহায় রূপটি চোখের সামনে প্রকাশিত হয় তেমনি জীবনরসিক মুকুন্দের স্বচ্ছ পরিহাস তরল জীবনদৃষ্টির বিদ্যুৎ দুঃখের বর্ষার মধ্যেও ঝিলিক দিয়ে উঠে। আর এখানেই কবিকঙ্কণের আধুনিকতা তথা অভিনবত্ব।
শ্রেষ্ঠ কবির মতো কবিকঙ্কণ তাঁর সমকাল থেকে কাব্যের উপাদান যেমন গ্রহণ করেছেন, তেমনি আধুনিক কবির মতো তিনি ভাবী কালকেও প্রভাবিত করেছেন। তিনি যুগ যুগ ধরে অভিজ্ঞতায় দেখেছেন নারীকে হতে হয় পুরুষ শাসিত সমাজে অত্যাচারের বাহন। দ্রৌপদীকে হতে হয় পাশা খেলার বাজি, টাকার অঙ্কে নারীর সতীত্ব যাচাই হয়। কবিকঙ্কণ দেখিয়েছেন খুল্লনার সতীত্ব পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সমাজের সমাজপতিদের অর্থগৃধ্নতা, নীচতার পরিচয়। বণিকরা ধনপতির বাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারে, যদি—
খুল্লনা পরীক্ষা দেক যদি হয় সতী।
তবে নিমন্ত্রণে দিব সবে অনুমতি।।
এমনকি, খুল্লনার সতীত্ব পরীক্ষা দেবার পরও সমস্তই খুল্লনার ছলনা মনে করে তারা—
কহেন মাধবচন্দ্র এসব কপট ধন্ধ।
বারিলে অনল হয় জল।
তঙ্কা দেহ এক লাখ ঘুচিবে সকল পাপ
পরীক্ষায় নাহি কিছু ফল।।
লহনা যাতে খুল্লনাকে জব্দ করতে পারে সেজন্য ধনপতির নামে জাল চিঠি রচনাও সে যুগের বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করে। সতীন সমস্যাকে রূপায়ণের ক্ষেত্রে কবিকঙ্কণ অত্যন্ত সচেতনভাবে জার চিঠি রচনা, বশীকরণ ঔষধ সংগ্রহ প্রভৃতি প্রসঙ্গ এনে সমকালীন সমাজের সমস্যার গভীরে ডুব দিয়ে সমস্যাকে বাস্তবরূপ দেবার চেষ্টা করেছেন।
(ছয়) অসাম্য বা অসঙ্গতি থেকেই জন্ম নেয় কৌতুক। এই কৌতুকপ্রবণতা কবিকঙ্কণের কাব্যে স্বাতন্ত্র চিহ্নিত। অসঙ্গতি সব সমাজেই থাকে, কিন্তু সেই অসঙ্গতিকে প্রকাশ করবার যে মানসিকতা ও রুচি তার মধ্যেই আধুনিকতা— যা কবিকঙ্কণের কাব্যে যত্রতত্র ছড়িয়ে রয়েছে। কবির জীবনরসিক শিল্পীমন পশু চরিত্রে মানবীয়তার আরোপে যেমন কৌতুকবোধ করে, তেমনি মেনকা ও গৌরীর কলহে কিংবা শিব-শিবানীর মনান্তর প্রসঙ্গে অথবা মুরারি শীলের বর্ণনাতেও কৌতুকের আশ্রয় গ্রহণ করে। কালকেতুর সঙ্গে ফুল্লরার বিবাহ প্রস্তাব আনয়নকারী সোমাণ পণ্ডিতের উক্তিটি যেন চিরকালের ঘটকের উক্তি—যার মধ্যে বিদগ্ধ কবির কৌতুকরসসিক্ত মানসিকতার পরিচয় নিহিত—
সেই বরযোগ্যা-কন্যা তোমার ফুল্লরা।
খুঁজিয়া পাইল যেন হাঁড়ির মত সরা।।
গুজরাট নগরে প্রজাপত্তন অংশে বিভিন্ন জাতির পরিচয় প্রসঙ্গে মুসলমান সমাজের পরিচয় দানে কবির কৌতুকবোধ দৃষ্টি এড়িয়ে যায় না—
আপন টোপর নিয়া বসিলা গাঁয়ের মিয়া
ভুঞ্জিয়া কাপড়ে মোছে হাত।
পারাবত ক্রীড়ার সময় খুল্লনার সহিত ধনপতির কথোপকথন অংশে—
তুমি ত রাজার সাধু কে তোমাতে টুটা।
তবে দিব পারাবত দাঁতে কর কুটা।।
পরিহাসে ধনপতি বুঝে কার্যগতি।
এ কন্যার পিতা বুঝি সাধু লক্ষপতি।।
ধনপতির বিবাহ উপলক্ষ্যে বর ও বরযাত্রীর গমন অংশেও সেই কৌতুকরসের পরিচয়—
দুই দলে ঠেলাঠেলি চুলাচুলি গালাগালি
বরাতি দেউড়ি দেউড়ি নাহি ছাড়ে।
(সাত) কবিকঙ্কণের বাম্ভঙ্গির বিশিষ্টতা তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও অভিনবত্বকে সূচিত করে। উজ্জ্বল, শানিত, মার্জিত বাঙ্গির প্রয়োগে কবিকঙ্কণ অসাধারণ কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন। গভীর ভাবের ভাষা হয় সহজ সরল। যেমন, কৌলীন্য বিড়ম্বিত সমাজের ক্ষুব্ধ আর্তনাদ গৌরীর একটি মাত্র উক্তিতে ব্যঞ্জনাময় হয়ে ওঠে—‘দুঃখ যৌতুক দিয়া বাপ বিভা দিল গৌরী।’ খুল্লনার ছাগ অন্বেষণ প্রসঙ্গে সুন্দর উপমা প্রয়োগ—
অচেতন হয়ে কান্দে হারায়ে সৰ্বশী।
লোচনের লোহেতে মলিন মুখশশী।।
তথ্যসূত্র:
১. বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস: আশুতোষ ভট্টাচার্য
২. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস: সুকুমার সেন
Leave a Reply