রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে রঙমহল থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

রঙমহল থিয়েটার

৬৫/১ কর্নওয়ালিশ স্ট্রিট (বিধান সরণি), কলকাতা

প্রতিষ্ঠা: ১৯৩১                  

স্থায়িত্ব কাল: ১৯৩১-২০০১

প্রতিষ্ঠাতা: রবি রায় ও সতু সেন   

প্রথম নাটক: শ্রীশ্রী বিষ্ণুপ্রিয়া (যোগেশ চৌধুরী)

১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে রবীন্দ্রমোহন রায় (রবি রায়) ও সতু সেনের উদ্যোগে একটি যৌথ প্রতিষ্ঠানরূপে ‘রঙমহল থিয়েটার’ প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রখ্যাত অন্ধ গায়ক ও অভিনেতা কৃষ্ণচন্দ্র দে (কানাকেষ্ট) ও রবি রায় এর অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন।

রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে ছাড়া ষষ্ঠী গাঙ্গুলি, নির্মলচন্দ্র চন্দ্র, এস, আহমেদ, ডি, এন, ধর, হরচন্দ্র ঘোষ, হেমচন্দ্র দে প্রভৃতিকে নিয়ে একটি যৌথ কোম্পানী গড়ে তোলা হয়। ম্যানেজিং ডিরেক্টর হন অমর ঘোষ।

প্রতিষ্ঠার সময়ে রঙমহল থিয়েটারে অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে যোগ দেন মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, বীরাজ ভট্টাচার্য, যোগেশ চৌধুরী, নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, শেফালিকা, শান্তি গুপ্তা, সরযূ দেবী প্রমুখ সে সময়ের খ্যাতিমান শিল্পীবৃন্দ। রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে তো ছিলেনই। শিল্প নির্দেশনা এবং আলোক সম্পাতের দায়িত্বে ছিলেন সতু সেন (সত্যেন্দ্রনাথ সেন)।

প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক শিশিরকুমার ভাদুড়ি এবং এঞ্জিনীয়র সতু সেন তখন আমেরিকা থেকে নাট্যাভিনয় করে ফিরে এসে নিজের কোনো থিয়েটারের অভাবে বসে ছিলেন। ‘রঙমহল’ তাঁদের দুজনকেই গ্রহণ করলো। শিশিরকুমারকে দশ হাজার টাকা বোনাস দিয়ে নিয়ে আসা হলো।

নতুন থিয়েটারের দ্বারোদঘাটন করেন সেকালের আর্ট থিয়েটারের পরিচালক ও নাট্যকার অভিনেতা অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। আনুষ্ঠানিক এই উদ্বোধন হয় ১৯৩১-এর ১ মে (১৭ বৈশাখ, ১৩৩৮)।

১৯৩১-এর ৮ আগস্ট যোগেশ চৌধুরীর লেখা ‘শ্রীশ্রীবিষ্ণুপ্রিয়া’ নাটক দিয়েই রঙমহলের যাত্রা শুরু। নাটক—যোগেশ চৌধুরী। পরিচালনা—শিশিরকুমার। সঙ্গীত—কৃষ্ণচন্দ্র দে। মঞ্চ—সতু সেন। মঞ্চ সজ্জাকর—ভূতনাথ দাস। স্মারক—মণিমোহন চট্টোপাধ্যায় ও বিমলচন্দ্র ঘোষ। অভিনয়ে—নিমাই ও বিষ্ণুপ্রিয়ার চরিত্রে শিশিরকুমার এবং প্রভাদেবী অংশ নেন। শচীমাতা—কঙ্কাবতী। এছাড়া যোগেশ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রবি রায়, সরযূ দেবী, রাজলক্ষ্মী অভিনয় করেন।

সতু সেন এই নাটকেই প্রথম বাংলা মঞ্চে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন। আলোক-সম্পাতের দায়িত্বও ছিল তাঁর। মঞ্চে আলো ব্যবহারের ধারা এবং সুরটাই তিনি পালটে দিলেন। প্রবীণ অভিনেতা অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য—‘বাংলা রঙ্গমঞ্চে মঞ্চ ও আলোর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে ছিলেন সতু সেন। আমেরিকা থেকে ফেরার পর ‘বিষ্ণুপ্রিয়া’ নাটকে উনি প্রথম আলো করেন। দর্শক হিসেবে সেই আলো দেখে আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। নিমাইয়ের বাড়ির দাওয়া, মা-ছেলের কথা হচ্ছে। সময় তখন ধরা যাক সাড়ে বারোটা, তারপর গভীর রাত্রি, ক্রমশ ভোর হল। এই সম্পূর্ণ পরিবেশটা পেছনে শুধু সাইক্লোরামার সাহায্যে উনি তৈরি করেছিলেন। (সংস্কৃতি, সতু সেন বিশেষ সংখ্যা। বর্য—২, ১৯৯৮)

‘বিজয়িনী’ অভিনয় হলো ১৭ জানুয়ারি, ১৯৩২। ২৫ মার্চ অভিনীত হলো রঙের খেলা (নলিনী চট্টোপাধ্যায়)। বরদাপ্রসন্ন দাশগুপ্তের ‘বনের পাখী’ (২ এপ্রিল)। মে মাসে অভিনীত হলো ‘শাদী কি শুল’ এবং ২৫ জুন নামানো হলো উৎপলেন্দু সেনের ‘সিন্ধগৌরব’। এই নাটকে অভিনয় করেন নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, উৎপল সেন, সরযূবালা প্রমুখ। সতু সেন মঞ্চ ও আলোতে অভিনবত্ব সৃষ্টি করে দর্শকদের চমকে দেন। মঞ্চ জুড়ে সিন্ধুনদের উপকূলে বিশাল নৌকা নির্মাণ করেছিলেন। মঞ্চসজ্জাও করা হয়েছিল জাঁকজমক সহকারে। ‘বনের পাখী’ নাটকটিও খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। রবি রায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, সন্তোষ সিংহ, ধীরাজ ভট্টাচার্য, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, চারুবালা, শশীবালা, শেফালিকা, সরযূ দেবী প্রমুখ শিল্পীর অভিনয়ে নাটকটি জমে গিয়েছিল।

শিশিরকুমার ততদিনে ‘রঙমহল’ ছেড়ে চলে গেছেন। তিনি এখানে ১৯৩১-৩২ পর্যন্ত ছিলেন। ‘রঙমহল’-এর আর্থিক দুরবস্থার ফলে কর্তৃত্বভার হস্তান্তরিত হয়। ১৯৩৩ থেকে যামিনী মিত্র ও শিশির মল্লিক থিয়েটার পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সতু সেন-ও এদের সঙ্গে ছিলেন। উদ্যোগী হয়ে নতুন কর্তৃপক্ষ নলিনী চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাসী’ প্রযোজনা করলো ১৯৩৩-এর ফেব্রুয়ারি মাসে। তারপরেই যামিনী মিত্র ও শিশির মল্লিক যৌথভাবে রঙমহল-এর নতুন মঞ্চ নির্মাণে তৎপর হন। সতু সেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁরই পরিকল্পনা ও প্রচেষ্টায় ‘ঘূর্ণায়মান মঞ্চ’ (Revolving Stage) তৈরি করা হয়। বাংলা তথা ভারতে ‘রঙমহল’ থিয়েটারেই প্রথম এই ধরনের মঞ্চ প্রবর্তন করা হয়। এঞ্জিনিয়ার নাট্যরসিক সতু সেনের উদ্যোগ ও কর্মকুশলতায় প্রবর্তিত হলো ‘ঘূর্ণায়মান মঞ্চ’। এই রকমের মঞ্চের উপযযাগিতা সম্পর্কে সতু সেনেব বক্তব্য—‘‘স্থানু মঞ্চের উপর একটি দৃশ্য থেকে অপর একটি দৃশ্যে যেতে হলে মঞ্চসজ্জার পরিবর্তন, বিভিন্ন চরিত্রের আগমন ও নিষ্ক্রমণে প্রচণ্ডভাবে সময়ের অপব্যবহার হত। দ্বিতীয়ত, নাটকের গতি ও সচলতাও তাতে বিঘ্নিত হয়ে পড়ে। উক্ত অসুবিধাগুলি দূর করার প্রয়াসেই আমি ঘূর্ণায়মান রঙ্গমঞ্চ নির্মাণে ব্রতী হই।’’ এই মঞ্চ তৈরি করতে সে সময়ে খরচ হয়েছিল এগারো হাজার তিনশ টাকা।

এই নতুন মঞ্চে অভিনয়ের জন্য ঠিক করা হলো অনুরূপা দেবীর জনপ্রিয় উপন্যাস মহানিশা। নাট্যরূপ দিলেন যোগেশ চৌধুরী। পরিচালনা—নরেশ মিত্র। অভিনয় করলেন—নরেশ মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি রায়, ভূমেন রায়, শান্তি গুপ্তা, পুতুল, চারুবালা প্রমুখ। রতীন বন্দ্যোপাধ্যায় এই নাটকেই অভিনয়ের জন্য রঙমহলে প্রথম যোগ দেন।

১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দের ১৫ এপ্রিল মহাসমারোহে ‘মহানিশা’ নাটকের অভিনয় দিয়ে ‘রঙমহলে’র নবযাত্রা শুরু হলো। প্রথম ঘূর্ণায়মান মঞ্চে অভিনীত হলো ‘মহানিশা’। মঞ্চ পরিকল্পনা, মঞ্চস্থাপত্য এবং আলোর ব্যবহারে অভিনবত্ব এলো বাংলা মঞ্চে। ‘মহানিশা’ খুবই জনপ্রিয় হয়। ভালো ভালো অভিনেতা-অভিনেত্রী, নরেশ মিত্রের কুশলী পরিচালনা, নতুন ধরনের ঘূর্ণায়মান মঞ্চ, অনুরূপা দেবীর উপন্যাসের কাহিনী-সব মিলিয়ে মহানিশা দর্শকদের ভীষণভাবে আকৃষ্ট করে। রঙমহলের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। এই নাটকে যোগেশ চৌধুরীর অসামান্য অভিনয়ের বিবরণ দিয়েছেন শম্ভু মিত্র তার ‘কিছ স্মরণীয় অভিনয়’ প্রবন্ধে (যোগেশ চৌধুরী অভিনয় করতেন গ্রামের এক সুদখোর বদমেজাজি লোকের চরিত্রে)—‘‘একদিন সেই খিটখিটে স্বভাবের লোকটি তার পুরনো জমজমাট সংসারের বর্ণনা দেন। শুরুটা করেন যেন খানিকটা ব্যঙ্গে, অলিপ্ত তৃতীয় ব্যক্তির মতো। কিন্তু বলতে বলতে তার গলা বদলে যায়, স্পষ্ট বুঝতে পারা যায় যে, বিবরণটা ক্রমশ যেন গভীরভাবে ব্যক্তিগত হয়ে উঠলো। তখন এই নিঃসঙ্গ বদমেজাজি মানুষটার গোপন ক্ষতের জায়গাটা হঠাৎ প্রকাশ হয়ে পড়ে। যোগেশ চৌধুরীর বাচনভঙ্গি ছিল স্বাভাবিক কথা বলারই মতো। এই অভিনয়ে বরং খিচিয়ে ওঠার ভাব ছিল বেশি। সেই কাঠামোর মধ্যেই তিনি অতিকৃতির সাহায্য না নিয়ে এমন একটা সুর আনতেন যে, বর্ণনার শেষটুকুতে মনে হত লোকটা যেন আর্তনাদ করে বিলাপ করে উঠলো।

১৯৩৩-এর ২ ডিসেম্বর অভিনীত হলো মন্মথ রায়ের অশোক। পরিচালনায় নরেশ মিত্র। অভিনেত্রী শান্তি গুপ্ত এই নাটকেই প্রথম রঙমহলে যোগ দেন। অন্য শিল্পীরা হলেন রবি রায়, ভূমেন রায়, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র, চারুবালা প্রমুখ।

এই নাটকেও সতু সেনের মঞ্চসজ্জা ও আলোকসম্পাত উচ্চমানের হয়েছিল। অমৃতবাজার পত্রিকার মন্তব্য—‘‘…of all Play-houses, in Calcutta to-day, Rangmahal is probably doing most to build up a sound tradition for the Bengali Stage on entirely new lines.’’ অথবা ‘‘Cheer up Ranginahal! You have received the fallen glory of Bengali Stage.’’

ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের উপন্যাস ‘স্পর্শের অভাব’ অবলম্বনে নাটক তৈরি করেন যোগেশ চৌধুরী। নাম দেন ‘পতিব্রতা’—প্রথম অভিনয় হল ৩১ মার্চ, ১৯৩৪। অভিনয়ে নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, ইন্দুভূষণ, শান্তি গুপ্ত, যোগেশ চৌধুরী প্রমুখ।

‘বাংলার মেয়ে’ অভিনীত হলো ২০ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৪। প্রভাবতী দেবী সরস্বতীর কাহিনী ‘পথের শেষে’ অবলম্বনে ‘বাংলার মেয়ে’ নাটক তৈরি করেন যোগেশ চৌধুরী। পরিচালনায় ছিলেন সতু সেন ও নির্মলেন্দু লাহিড়ী।

এর আগে কয়েকটি পুরনো নাটক যেমন কাজরী (শৈলেন রায়), রাবণ (যোগেশ চৌধুরী, ১২.১২.৩৪), বনের পাখী (৭.৮.৩৪) অভিনীত হয়েছিল কিন্তু তেমন সাফল্য পায়নি। কিন্তু মহানিশার অভূতপূর্ব সাফল্যের পর অশোক এবং বাংলার মেয়ে অধিক সাফল্য পেয়েছিল।

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে রঙমহল অভিনয় করে অনুরূপা দেবীর ‘পথের সাথী’ (নাট্যরূপ: যোগেশ চৌধুরী, ৯ মে)।

১৯৩৫-এ শিশির মল্লিক রঙমহল-এর দায়িত্ব ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন অমর ঘোষ। তাঁরই নেতৃত্বে এখানে এবার অভিনয় হলো ‘চরিত্রহীন’। ২০ ডিসেম্বর, ১৯৩৫। শরৎচন্দ্রের জনপ্রিয় ও বহু আলোচিত উপন্যাসটির নাট্যরূপ দিলেন যোগেশ চৌধুরী। যুগ্ম পরিচালনায় রইলেন নরেশ মিত্র ও সতু সেন। অভিনয়ে ছিলেন: উপেন্দ্র—মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। সাবিত্রী—শেফালিকা। কিরণময়ী—শান্তি গুপ্তা। দিবাকর—ধীরাজ ভট্টাচার্য। এছাড়া যোগেশ চৌধুরী, নরেশ মিত্র, রতীন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীরাও ছিলেন। উপেন্দ্র চরিত্রে অভিনয় করে বাংলা মঞ্চে খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা পান মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য। ‘চরিত্রহীন’ একটানা দীর্ঘদিন চলে ‘রঙমহল’-এর গৌরব ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করে।

‘চরিত্রহীন’ নাটকের অভিনয় বেশ কিছুদিন চলার পর কর্তৃপক্ষ আবার পুরনো মঞ্চসফল ‘পথের সাথী’ নাটকটি অভিনয় করে (৯ মে, ১৯৩৬)। তারপরে সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘সর্বহারা’ এবং যোগেশ চৌধুরীর নাটক ‘নন্দরানীর সংসার’ (২৩ আগস্ট ১৯৩৬) নামানো হয়। মাঝে অনেকগুলি নাটকের ব্যর্থতার পর ‘নন্দরানীর সংসার’ কিছুটা সাফল্য পেয়েছিল। তাতেও থিয়েটারের দুরবস্থা কাটেনি। তাই থিয়েটার বন্ধ রাখতে হয়।

ঋণভার কাটিয়ে নতুন করে আবার যামিনী মিত্র, যোগেশ চৌধুরী, কৃষ্ণচন্দ্র দে, রঘুনাথ মল্লিক প্রমুখের যৌথ পরিচালনায় রঙমহল চালু হয়। যামিনী মল্লিক এবং রঘুনাথ মল্লিক থিয়েটারের দায়িত্ব নেন। নাট্য পরিচালক হিসেবে যোগ দিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। নতুন নাট্যকার হিসেবে রঙমহলে এলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্যের অভিষেক হলো এখানে। নতুন উদ্যোগে এবার অভিনয় শুরু হলো ১৯৩৭-এর মাঝামাঝি।

প্রথমে নামানো হলো অভিষেক, সর্বহারা প্রভৃতি কয়েকটি সাধারণ মানের নাটক। তারপরে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ডিটেকটিভ’ (১০ জুলাই, ১৯৩৭) ও বন্ধু (১৮ অগস্ট, ১৭) এবং শচীন সেনগুপ্তের প্রলয় (১৯৩৭)। নাটকগুলি মোটের ওপর চললো। ‘রঙমহল’ কর্তৃপক্ষ কিছুটা সামলে নিয়ে নতুনভাবে প্রস্তুত হলেন। ‘বন্ধু’ নাটক পরিচালনায় বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। অভিনয়ে দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় (জ্ঞানাঞ্জন), জহর গাঙ্গুলি (হেমন্ত), তুলসী চক্রবর্তী (কেবল রাম), শেফালিকা (ঊর্মিলা), ঊষা দেবী (মা)। সঙ্গীত পরিচালনায় কৃষ্ণচন্দ্র দে। সুধীন্দ্রনাথ রাহার ‘সর্বহারা’ (৩০.৫.৩৬) নাটকে নজরুল কয়েকটি গান লিখে দেন এবং সুর সংযোজনাও করেন। ‘বন্ধু’ নাটকেও সঙ্গীত পরিচালনা করেন নজরুল।

তারপরেই অভিনীত হলো শচীন সেনগুপ্তের ‘স্বামী-স্ত্রী’। অভিনয় করলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। এদের উল্লেখযোগ্য অভিনয়ে ‘স্বামী-স্ত্রী’ বেশ ভালোভাবে চলল। এই নাটকেই কয়লাখনির দৃশ্য বাস্তবসম্মত ভাবে দেখানো হয়েছিল। আলো ও দৃশ্যপটের কৌশলে কয়লাখনির দৃশ্য এতো জীবন্ত হয়ে উঠেছিল যে, দর্শক বিমোহিত হয়েছিল।

১৯৩৭-৩৮-এর মধ্যেই ‘রঙমহলে’ অভিনেতা হিসেবে যোগ দিয়েছেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অহীন্দ্র চৌধুরী। সে যুগের জনপ্রিয়, সুদর্শন ও প্রতিভাবান এই দুজন অভিনেতাকে একসঙ্গে পেয়ে রঙমহলের ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। তার ওপরে নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য এবং নাট্য পরিচালক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র—এই চারের সম্মিলনে ‘রঙমহল’ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলো।

অভিনীত হলো ‘তটিনীর বিচার’। প্রথম অভিনয় ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৩৮। নাট্যকার শচীন সেনগুপ্ত। অভিনয় করলেন অহীন্দ্র চৌধুরী—ডাঃ ভোস। রাণীবালা—তটিনী। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিনয় করেন। তটিনীর চরিত্রে রানীবালার অভিনয় খুবই প্রশংসিত হয়েছিল। ডা. ভোস চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী নতুন ধরনের চরিত্র রূপায়ণে কৃতিত্ব অর্জন করেন। দারুণভাবে জমে গেল ‘তটিনীর বিচার’। অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে অহীন্দ্র চৌধুরী—রানীবালার স্মরণীয় অভিনয় এই নাটকে দর্শকদের অত্যধিক খুশি করলো।

১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। যুদ্ধের আতঙ্ক, ব্লাক আউট, বোমা পড়ার ভয়—সব নিয়ে কলকাতা তখন বিপর্যস্ত। সব থিয়েটারের মতো ‘রঙমহলে’রও তখন প্রাণান্তকর অবস্থা। এই সময়ে কিছুদিন রঙমহল বন্ধ থাকে। ১৯৩৯-এর ৫ জুলাই শুরু হলো বিধায়ক ভট্টাচার্যের লেখা নাটক ‘বিশ বছর আগে’। রানীবালা এই নাটকে ‘বীণা’ চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেন। তারপরে ‘গৌর শী’র নাটক ‘ঘূর্ণি’, বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘মালা রায়’ অভিনীত হয়। ‘মেঘমুক্তি’ (৯.৯.৩৯) ভালোই চলেছিল।

১৯৪০-এর ২৪ ডিসেম্বর অভিনীত হলো ‘রত্নদীপ’, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘রত্নদীপ’ অবলম্বনে নাটক লিখলেন বিধায়ক ভট্টাচার্য। অভিনীত হলো ‘মাটির ঘর’ (সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯)। এই নাটকে অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাসের সঙ্গে শান্তি গুপ্তা। এই নাটকেই প্রথম মোটে ৬টি দৃশ্যের সেট ব্যবহার করে অভিনয় করা হয়। সে যুগে ‘রত্নদীপ’ খুবই সাফল্য লাভ করেছিল।

১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে রঙমহলের ‘লেসী’ হলেন অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি সে সময়কার সেরা শিল্পীদের এখানে জড়ো করলেন। অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, জহর গাঙ্গুলি, তুলসী চক্রবর্তী, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী প্রভৃতি। রঙমহলের তখন বেশ ভালো অবস্থা। অভিনয়গুলি দর্শক আনুকূল্যে সাফল্য লাভ করছে। উৎসাহিত হয়ে কর্তৃপক্ষ পরপর অভিনয় করে গেলেন বেশ কয়েকটি নাটক। তার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হলো—মাকড়শার জাল, ডা. মিস কুমুদ, আগামীকাল, আঁধার শেষে, রক্তের ডাক ইত্যাদি।

এখানে উল্লেখযোগ্য, রঙমহলের ‘মালা রায়’ নাটকের অভিনয়েই প্রখ্যাত অভিনেতা ও নাট্য পরিচালক শম্ভু মিত্র প্রথম মঞ্চাবতরণ করেন এবং পরবর্তী কালের বিখ্যাত অভিনেতা নীতিশ মুখোপাধ্যায় ‘রক্তের ডাক’ নাটকে অভিনয় জীবন শুরু করেন।

এই সময়কার উল্লেখযোগ্য অভিনয় ‘গোরা’। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসের নাট্যরূপ। গোরা চরিত্রে অভিনয় করেন অহীন্দ্র চৌধুরী।

১৯৪১-এর ১৪ আগস্ট তুলসী লাহিড়ীর নাটক ‘মায়ের দাবী’ অভিনীত হলো। অভিনেতা হিসেবে তুলসী লাহিড়ীও এই নাটকে প্রথম মঞ্চে অবতীর্ণ হন। এই বছরেই অভিনয় হলো বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘তুমি ও আমি’ (৩ ডিসেম্বর)।

১৯৪২-এর গোড়ার দিকে অভিনীত হলো মহেন্দ্র গুপ্তের ‘মাইকেল’ এবং অয়স্কান্ত বক্সীর ‘ভোলা মাস্টার’। দুটি নাটকেই নাম ভূমিকায় অহীন্দ্র চৌধুরীর অসামান্য অভিনয় উল্লেখযোগ্য। হেনরিয়েটা চরিত্রে রানীবালার অভিনয়ও স্মরণযোগ্য।

পুরনো নাটক ‘রিজিয়া’ অভিনীত হলো ১৯৪৩-এর সেপ্টেম্বর মাসে। রিজিয়া চরিত্রে সুশীলাসুন্দরী অনবদ্য অভিনয় করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই সময়ে বেশ কিছুদিন ‘রঙমহল’ বন্ধ থাকে। ১৯৪৪ থেকে আবার অভিনয় শুরু হয়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিশ্বযুদ্ধের মহাঘোর সঙ্কটঘন মুহূর্তে যখন দেশবাসী বিপর্যস্ত এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল জোয়ারে যখন উত্তাল বঙ্গদেশ, তখন কোনো থিয়েটারেই তার রেশ পড়েনি। ‘রঙমহল’ও পারেনি সেই সময়কার দেশবাসীর প্রাণচাঞ্চল্য ও বিপর্যয়কে নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে প্রকাশ করতে। বরং তারা গতানুগতিক ভাব-ভাবনা ও ধারণার নাটকই ক্রমাগত অভিনয় করে গেছে।

১৯৪৪-এর ১৪ সেপ্টেম্বর অয়স্কান্ত বক্সীর নাটক ‘অধিকার’ দিয়ে রঙমহল আবার চালু হলো। অভিনয়ে ছিলেন—অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, শান্তি গুপ্তা, পূর্ণিমা, সুহাসিনী, সন্তোষ সিংহ, জহর গাঙ্গুলি প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ।

তারপরে তারাশঙ্করের নিজের লেখা নাটক ‘বিংশ শতাব্দী’ অভিনীত হলো ১৯৪৪এর ২৫ ডিসেম্বর। তার আগেই অভিনীত হয়েছিল শরৎচন্দ্রের ‘রামের সুমতি’র নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ গুপ্ত), ২২ জুন, ১৯৪৪।

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের নাট্যরূপ (বাণী কুমার) ‘সন্তান’ অভিনীত হলো ১৯৪৫-এর ১৮ জানুয়ারি। অভিনয় করলেন: সত্যানন্দ—অহীন্দ্র চৌধুরী। জীবানন্দ—অমল বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবানন্দ—মিহির ভট্টাচার্য। শান্তি—শান্তি গুপ্তা। ‘সন্তান’ নাটক যুগীয় উন্মাদনার কাছাকাছি আসতে চেয়েছিল। তাই চলেছিলও ভালো।

তারপরেই অভিনীত হলো শরৎচন্দ্রের ‘অনুপমার প্রেম’ বড়ো গল্পের নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ গুপ্ত)। শচীন সেনগুপ্তের ‘সিরাজদ্দৌলা’ এই বছরের (১৯৪৫) উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা।

১৯৪৬-এ রঙমহলে অভিনীত হলো উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কাহিনী অবলম্বনে ‘রাজপথ’ নাটক। নাট্যরূপ—দেবনারায়ণ গুপ্ত। তারপরেই রবীন্দ্রনাথের ‘চিরকুমার সভা’। রবীন্দ্রনাথের এই নৃত্যগীতপূর্ণ কমেডি নাটক এর আগে আর্ট থিয়েটারে অভিনীত হয়ে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। রঙমহলে ‘চিরকুমার সভা’ আর তেমনভাবে চললো না।

১৯৪৬-এ কলকাতায় ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। তাতে সারাদেশের জনজীবন উৎকণ্ঠিত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। থিয়েটারগুলির ওপরেও তার প্রভাব পড়ে। সেই সময়ে কলকাতার থিয়েটারগুলির খুবই সঙ্গীন অবস্থা। ‘রঙমহল’-ও কিছু কিছু পুরনো নাটক অভিনয় চালিয়ে থিয়েটারকে বাঁচাবার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘চিরকুমার সভা’ সেই সময়ে তাই চলেনি। কিন্তু ভালো চললো বিধায়ক ভট্টাচার্যের ‘সেই তিমিরে’ নাটক (১৮ ডিসেম্বর ১৯৪৬)।

১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট, স্বাধীনতা প্রাপ্তির পূর্বরাত্রে, অভিনীত হলো শচীন সেনগুপ্তের নতুন নাটক ‘বাংলার প্রতাপ’। প্রতাপাদিত্যকে কেন্দ্র করে এই নাটক বাঙালির স্বাধীনতা স্পৃহাকে কেন্দ্র করে লেখা। এই নাটকে ‘ফিরিঙ্গি কার্ভালো’ চরিত্রে অসামান্য অভিনয় করেন অহীন্দ্র চৌধুরী। পরে অভিনেতা ভূমেন রায় এই চরিত্রে সমধিক কৃতিত্ব শর্জন করেন। ‘বাংলার প্রতাপ’ খুবই সাফল্য লাভ করলো।

এদিকে দেশ স্বাধীন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দ্বিখণ্ডিত হলো। ওপার বাংলার ছিন্নমূল মানুষের ভিড়ে কলকাতা তখন ব্যতিব্যস্ত। উদ্বাস্তু সমস্যা দেশের এক বিরাট সমস্যা হয়ে দেখা দিল। বাংলার অর্থনীতিতে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করলো। এই সময়ে কলকাতার কোনো রঙ্গমঞ্চই স্বাভাবিকভাবে নাটক অভিনয় চালাতে পারেনি। রঙমহলও তা থেকে বাদ গেল না।

১৯৪৮-এ অভিনীত হলো দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের লেখা ঐতিহাসিক নাটক ‘রাণাপ্রতাপ’, শচীন সেনগুপ্তের ‘আবুল হাসান’।

১৯৪৯-এ কোনো রকমে অভিনীত হলো ‘এই স্বাধীনতা’ (শচীন সেনগুপ্ত) এবং ‘ক্ষুদিরাম’ (শশাঙ্কশেখর)। এই স্বাধীনতার প্রথম অভিনয় ২৪ ডিসেম্বর ১৯৪৯।

স্বাধীনতার সময় থেকে রঙমহলে অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী, জহর গাঙ্গুলি, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, সন্তোষ সিংহ, মিহির ভট্টাচার্য, রানীবালা, সুহাসিনী প্রমুখ খ্যাতিমান শিল্পীবৃন্দ। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অভিনেতা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তিনি ‘লেসী’ হিসেবে দক্ষতার সঙ্গে থিয়েটার পরিচালনা করলেও, বেহিসেবি খরচ-খরচার জন্য দেনায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি ‘দেউলিয়া’ ঘোষিত হন আদালতের নির্দেশে। ১৯৪৯ থেকে দায়িত্ব নেন সীতানাথ মুখোপাধ্যায়। শরৎচন্দ্রের আমলে নাট্যপরিচালক ও প্রধান অভিনেতা হিসেবে অহীন্দ্র চৌধুরী রিজিয়া, মেবারপতন, বঙ্গের বর্গী ইত্যাদি পুরনো নাটকগুলির সম্পাদনা করে কৃতিত্বের সঙ্গে অভিনয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। তবুও শরৎচন্দ্রকে বাঁচানো যায়নি। তিনি নিঃস্ব হয়ে পড়েন।

১৯৪৯-এ আরো অভিনীত হয় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’র নাট্যরূপ (২৯.৭.৪৯) এবং তারাশঙ্করের লেখা নাটক ‘দুইপুরুষ’। রজনীর নাট্যরূপ দেন শচীন সেনগুপ্ত। ‘দুইপুরুষ’ দারুণ সাফল্য লাভ করে। বিশেষ করে নুটুবিহারী চরিত্রের দৃপ্ত সংগ্রামী চেতনা ও সততার অন্বেষণ দর্শকদের মুগ্ধ করে। সেই সময়কার পত্র-পত্রিকায় ‘দুই পুরুষ’ নাটকের খুবই প্রশংসা করা হয়—‘‘The play presents itself as a perfect specimen of a heat drama, masterfully woven by a magic hand, neatly executed with finished touches of productional fineness and re-created by a nicely coordinated band of artists.’’ (Anritabazar Patrika, 28-6-1942)

এই সময়ে সতীশচন্দ্র ঘটকের ‘আদর্শ স্ত্রী’ অভিনীত হয়েছিল (২৯ অক্টোবর, ১৯৪৯)।

১৯৫০-এ শরৎচন্দ্রের ‘দেবদাস’ উপন্যাসের নাট্যরূপ খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। নাট্যরূপ—শচীন সেনগুপ্ত। এই নাটক সম্পর্কে দুটি তথ্য উল্লেখযোগ্য। প্রথম, এই নাটকে ‘বসন্ত’ নামে একটি নতুন চরিত্র নাট্যরূপে সংযোজন করা হয়, যা মূল উপন্যাসে ছিল না। এই চরিত্রটি তৈরি করা হয়েছিল নির্মলেন্দু লাহিড়ীর অভিনয়ের জন্য। দ্বিতীয়, ১৯৫০-এর ২৩ জানুয়ারি ‘দেবদাস’ নাটকের এই নবসৃষ্ট ‘বসন্ত’ চরিত্রেই নির্মলেন্দুর শেষ অভিনয় এই রঙমহল থিয়েটারেই।

১৯৫১-তে শরৎচন্দ্রের রমরমা। তার কাহিনীর ওপর ভরসা করেই ‘রঙমহল’ বেঁচে উঠতে চাইছে। প্রথমে নামানো হলো ‘পণ্ডিতমশাই’ (নাট্যরূপ: বিধায়ক ভট্টাচার্য), ৭ জুন, ১৯৫১। তারপরেই ‘নিষ্কৃতি’। নাট্যরূপ দিলেন দেবনারায়ণ গুপ্ত। অভিনীত হলো ১৯৫১র ২ অক্টোবর। অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করলো। পারিবারিক সেন্টিমেন্টাল কাহিনী এবং বড় ভাই গিরীশ এবং বড়ো বউ সিদ্ধেশ্বরীর চরিত্রে জহর গাঙ্গুলি এবং প্রভাদেবীর অসামান্য অভিনয় নাটকটির সাফল্যের মূলে। প্রচুর আর্থিক উপার্জন হলো এই নাটকে। অন্য শিল্পীরা ছিলেন রানীবালা, হরিধন মুখোপাধ্যায়।

‘নিষ্কৃতি’র সময়েই (১৯৫১) মধ্যে সাপ্তাহিক নাটক হিসেবে ক্ষীরোদপ্রসাদের ‘চাঁদবিবি’ নামানো হয়। নাটকটি খুবই প্রশংসিত হয়। বিশেষ করে চাঁদবিবির চরিত্রে প্রভাদেবীর অনবদ্য অভিনয় এবং রঘুজীর চরিত্রে জহর গাঙ্গুলির আকর্ষণ। ঘোড়ায় চড়ে যোশীবাঈ চরিত্রের মঞ্চে আসা সেই সময়ে দর্শক মহলে খুবই চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল।

১৯৫২-এর প্রথম দিনেই অভিনীত হলো ‘জীজাবাঈ’। নাটক—সুধীর বন্দ্যোপাধ্যায়। জীজাবাঈ চরিত্রে প্রভাদেবী খুবই উৎকর্ষ দেখিয়েছিলেন। এই নাটকেই তাঁর মঞ্চে শেষ অভিনয়। এই বছরে নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের ‘বড় বৌ’ নাটক মঞ্চস্থ হয় দেবনারায়ণ গুপ্তের পরিচালনায়।

১৯৫৩-তে ‘রাণাপ্রতাপ’ অভিনীত হয় (৭.১.১৯৫৩)। নাট্যরচনা—বিধায়ক ভট্টাচার্য। তারপরেই অশোক সেনের লেখা নাটক ‘রানীবউ’ (২৬.১.১৯৫৩)।

১৯৫৩-এর জুন মাসে প্রযোজিত হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’-এর নাট্যরূপ (গোপাল চট্টোপাধ্যায়)। হাজারী ঠাকুরের ভূমিকায় অভিনয় করলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। তাঁর এই অভিনয় বহুদিন বাঙালি দর্শকের স্মৃতি হয়ে ছিল। দীর্ঘদিন চললো এই নাটক।

১৯৫৩-তে আরো কিছু অকিঞ্চিৎকর নাটকের অভিনয় হয়েছিল। ধীরেন্দ্র নারায়ণ রায়ের ‘বিষবহ্নি’ (১৪.৪.৫৩), প্রবোধচন্দ্র সান্যালের ‘শ্যামলীর স্বপ্ন’-এর নাট্যরূপ (১৫.১০.৫৩), ব্রজেন্দ্রনাথ দে’র ‘লাল পাঞ্জা’ (৬.১১.৫৩) এবং মন্মথ রায়ের ‘খুনীর বাড়ি’ (১৫.১২.৫৩) সবগুলিই সাধারণ মানের। কোনোটিই তেমন চলেনি।

এরপরে ‘রঙমহল’ বন্ধ হয়ে যায়। মালিকানা হস্তান্তরিত হয়। ১৯৫৪-এর মে-জুন মাসে রঙমহলের পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন জীতেন বোস (প্রাচী সিনেমার মালিক), ভিটল ভাই মানসাটা (জ্যোতি সিনেমার মালিক)। ব্যবস্থাপক হিসেবে রইলেন নলিনী ব্যানার্জী এবং হেমন্ত ব্যানার্জী। পরিচালক হিসেবে রইলেন কালীপ্রসাদ ঘোষ। প্রযোজনার নিয়ামক হলেন নেপাল নাগ।

নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘দূরভাষিণী’ উপন্যাস অবলম্বনে নাটক তৈরি করলেন সলিল সেন। নতুনভাবে নাটকটি অভিনয় করার জন্য আহ্বান করা হলো ‘বহুরূপী’ নাট্য সম্প্রদায়ের কয়েকজন শিল্পীকে। বিশেষ করে শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, গঙ্গাপদ বসু প্রভৃতি কয়েকজন। ‘বহুরূপী’ তখন ‘রক্তকরবী’ নাটক মঞ্চস্থ করে খ্যাতির তুঙ্গে। তারা এসে যোগ দিলেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই নানা কারণে মতান্তর দেখা দিল। পরিচালক কালীপ্রসাদ ঘোষের হাত থেকে পরিচালনার দায়িত্ব নেন শম্ভু মিত্র। রিহার্সালের সময়েই নানা শর্তে গোলমাল চলে। শেষ পর্যন্ত বহুরূপীর অভিনেতৃবৃন্দ রঙমহল ছেড়ে দেন। তখন সলিল সেনের পরিচালনায় নীতিশ মুখোপাধ্যায়, জীবেন বোস, প্রণতি ঘোষ প্রভৃতি রঙমহলের নিয়মিত শিল্পীরা এগিয়ে এসে কোনক্রমে ‘দূরভাষিণী’ মঞ্চ করলেন। ১৯৫৪-এর ৩১ জুলাই।

এরপরেই নামানো হলো ‘উল্কা’ নাটক। নীহাররঞ্জন গুপ্তের বহুল জনপ্রিয় উপন্যাস ‘উল্কা’ অবলম্বনে নাটকটি তৈরি হলো। পরিচালনা করলেন অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়। অভিনয় করলেন: অরুণাংশু—দীপক মুখোপাধ্যায়। তাছাড়া নীতিশ মুখোপাধ্যায়, জহর রায়, রবীন মজুমদার, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, শিপ্রা মিত্র, তপতী ঘোষ, গীতা সিং প্রমুখ।

১৯৫৪-এর ২ অক্টোবর ‘উল্কা’ নাটক রঙমহলে প্রথম অভিনীত হলো। কিম্ভুতদর্শন পুরুষ অরুণাংশুর চরিত্রে নবাগত দীপক মুখোপাধ্যায় সুন্দর অভিনয় করলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই উল্কার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। ক্রমাগত দর্শকের ভিড়ে নাটকটি একাধিক্রমে ৫০০ রজনী অভিনীত হলো। এরপরেও বেশ কিছু রাত্রি অভিনীত হয়ে প্রায় ৬০০ রজনী পূর্ণ করল। ১৯৫৬-এর ৪ নভেম্বর পর্যন্ত একটানা অবিচ্ছিন্নভাবে ‘উদ্ধার’ অভিনয় চলেছিল। বাংলা থিয়েটারে ‘উল্কা’ অভিনয় জগতে পাঁচশো রাত্রি অতিক্রম করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। কর্তৃপক্ষ আর্থিক সাফল্যের মুখ দেখলেন।

উল্কার অভূতপূর্ব সাফল্যের পরে অভিনীত হলো ‘শেষলগ্ন’। মনোজ বসুর ঐ নামের উপন্যাস অবলম্বনে তৈরি নাটকটি পরিচালনা করলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। ‘শেষলগ্ন’-এ অভিনয় করলেন: রবীন মজুমদার—প্রশান্ত। হরিধন মুখোপাধ্যায়—বনমালী। জীবেন বোস—নিখিল। জহর রায়—গোবিন্দ। সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়—শিবনাথ। অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়—সাতকড়ি। দীপক মুখোপাধ্যায়—নীরদ। প্রণতি ঘোষ—গৌরী। গীতা সিং—বিভা। কেতকী দত্ত—সুরবালা। ইরা চক্রবর্তী—কাদম্বিনী (পরে সাধনা রায়চৌধুরী)। কানন দেবী—রজনী। মঞ্জুদেবী—কমলা।

১৯৫৬-এর ৮ নভেম্বর প্রথম অভিনয় শুরু করে ১৯৫৭-এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত একটানা ‘শেষলগ্নে’র অভিনয় চলেছিল। এই নাটকে সুরকার হিসেবে রাজেন সরকার খুবই কৃতিত্বের পরিচয় দেন। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র নাট্য পরিচালক হিসেবে সাফল্য অর্জন করেন।

এখানে একটি তথ্যের উল্লেখ করি। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ রঙমহলে ১৯৫৬ থেকে ১৯৬১ পর্যন্ত একটানা নাট্য পরিচালক হিসেবে যুক্ত ছিলেন। প্রখ্যাত কৌতুক অভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায় ১৯৫৪ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত টানা ২৫ বছর রঙমহলে নিয়মিত অভিনয় করে গেছেন। ১৯৫৭ থেকে মৃণাল মুখোপাধ্যায় (মৃত্যুঞ্জয়) ১৯৭৭ পর্যন্ত রঙমহলে ২৯টি নাটকে ছোট বড়ো নানা ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।

১৯৫৭-তে অভিনেতা-পরিচালক-নাট্যকার মহেন্দ্র গুপ্ত স্টার থিয়েটার ছেড়ে রঙমহলে যোগ দিলেন। তিনি যোগ দিয়েই এখানে তাঁর নিজের নাটক ‘শতবর্ষ আগে’ অভিনয় করলেন (১.৫,৫৭)। তারপরেই নামানো হলো তারাশঙ্করের স্বকৃত নাট্যরূপ ‘কবি’, ১৯৫৭-এর ১২ জুন। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। এর আগেই চলচ্চিত্রে ‘কবি’ দেবকীকুমার বসুর পরিচালনায় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। সেখানে নিতাই কবিয়ালের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রবীন মজুমদার। গায়ক-নায়ক এই অভিনেতাকে আনা হলো রঙমহলে ওই একই চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। নিতাই কবিয়ালের ভূমিকায় রবীন মজুমদার অভিনয় ও গানে অসামান্য কৃতিত্ব দেখালেন। মাঝে এই ভূমিকায় প্রশান্তকুমারও অভিনয় করেছিলেন কিছুদিন। উল্কার মতো কবিও অসম্ভব জনপ্রিয় হয়ে দীর্ঘরাত্রি অভিনীত হয়েছিল। অভিনয়ে—নিতাই কবিয়াল-রবীন মজুমদার। রাজনীতিশ মুখখাপাধ্যায়। বসন—নীলিমা দাস। ঠাকুরঝি—গীতা সিং। মহাদেব কবিয়াল—হরিধন মুখোপাধ্যায়। বিপদ—জহর রায়। মামী—রাজলক্ষ্মী (বড়)। রাজনের স্ত্রী—কেতকী দত্ত। নীলিমা দাসের পরে কিছুদিন প্রণতি ঘোষ বসনের চরিত্রে অভিনয় করেন।

নাচে, গানে, অভিনয়ে এবং কাহিনীর আকর্ষণে কবি নাটক সাফল্য লাভ করেছিল। বসনের ভূমিকায় প্রথম মঞ্চাবতরণে নীলিমা দাস দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। তারাশঙ্কর রচিত এই নাটকের গানগুলি রাজেন সরকারের সুরে একসময় লোকের মুখে মুখে ফিরেছিল। এই সম্পর্কে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের অভিজ্ঞতা—‘যে নাটক দেখার পর বাড়ি ফিরেও মনের মধ্যে সুরের রেশ গুঞ্জরিত হতে থাকে, মামুলি বিশ্লেষণে তার প্রশংসা করতে মন চায় না। তারাশঙ্করের ‘কবি’ নাটকটি আমার কাছে একটি মধুর করুণ কবিতার মতো উপাদেয়। বারবার উপভোগ করেও আশা মেটে না।

তারপরে তারাশঙ্করের নাটক ‘দুইপুরুষ’ (২১ ডিসেম্বর, ১৯৫৭) অভিনীত হলো। পরিচালনায় মহেন্দ্র গুপ্ত। এই নাটকে নটু বিহারীর চরিত্রে ছবি বিশ্বাসের অনবদ্য অভিনয় এখনো স্মরণীয় হয়ে আছে। শিবনারায়ণ করেন অহীন্দ্র চৌধুরী। ১৯৫৮-এর এপ্রিল মাস পর্যন্ত একটানা চলে। নাটকটি এর আগেও রঙমহলে অভিনীত হয়েছিল।

১৯৫৮-এর উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা ‘মায়ামৃগ’ (১৪ এপ্রিল)। নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি ‘মায়ামৃগ’ নাটকের পরিচালনায় ছিলেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। সুরকার অনিল বাগচী। চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় সুদর্শন অভিনেতা বিশ্বজিৎ এই নাটকের। ছোট একটি চরিত্রে অবতীর্ণ হন। এই নাটকটিও খুব সাফল্যজনকভাবে অভিনীত হয়। ১৯৫৯-এর ২০ মার্চ পর্যন্ত একটানা চলে।

১৯৫৯ থেকে প্রখ্যাত নাট্যকার অভিনেতা-পরিচালক তরুণ রায় (ধনঞ্জয় বৈরাগী) রঙমহলে যোগ দিয়ে নাটক অভিনয় করতে থাকেন। ১৯৫৯-৬০ এই দুই বছর তরুণ রায় তার দল থিয়েটার সেন্টার’-এর লোকজন নিয়ে রঙমহলে নাট্য পরিচালনা করেন। এই সময়ে নাট্যকার হিসেবে শৈলেশ গুহ নিয়োগী এখানে যোগ দেন।

এই দুই বছরে তরুণ রায় তাঁর নিজের দুটো নাটক খুবই সফলভাবে অভিনয় করেন। পরিচালনাও তারই। ‘একমুঠো আকাশ’ (১৫ এপ্রিল, ১৯৫৯), এবং ‘এক পেয়ালা কফি’ (১৯ ডিসেম্বর, ১৯৫৯)।

‘এক মুঠো আকাশ’ একটু ভিন্নধর্মী নাটক। বস্তিবাসীদের জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষা এখানে প্রতিফলিত। নাটকটি এখানে একটানা আটমাস চলেছিল। নতুন স্বাদের এই নাটকটিকে সেদিনের দর্শকবৃন্দ স্বাগত জানিয়েছিল। তরুণ রায় ও দীপান্বিতা রায় গ্রুপ থিয়েটার থেকে এসে সাধারণ রঙ্গালয়ে খ্যাতি অর্জন করেন।

‘এক পেয়ালা কফি’ বিদেশী নাট্যকার ব্রুসেলস-এর নাটকের রূপার (ধনঞ্জয় বৈরাগী)। এই নাটকটিও খুব সাফল্য লাভ করে। ডিকেটটিভ ধর্মী নাটকটি সেদিন দর্শকদের উত্তেজনায় ও রোমাঞ্চে ভরিয়ে রাখতো। তরুণ রায়ের দুটি নাটকেই তাঁর থিয়েটার সেন্টারের অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অংশ নিলেন। সঙ্গে রইলেন রঙমহলের নিয়মিত শিল্পীরা। তরুণ রায়, দীপান্বিতা রায়, রবীন মজুমদার, জহর রায়, নীতিশ মুখোপাধ্যায়, কেতকী দত্ত, শৈলেশ গুহনিয়োগী প্রমুখ। পরে যোগ দেন দীপক মুখোপাধ্যায়, তপতী ঘোষ।

তরুণ রায় দলবল সমেত রঙমহল ছেড়ে চলে গেলে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের পরিচালনায় ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নাটকের অভিনয় শুরু হয়। বিমল মিত্রের সুখ্যাত উপন্যাসের নাট্যরূপ ‘সাহেব বিবি গোলাম’ প্রথম অভিনয় হলো। নাট্যরূপ: শচীন সেনগুপ্ত। প্রথম অভিনয় হলো ১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৬০। উল্লেখ্য, এই নাটকে মুখ্য ভূতনাথ-এর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন বিশ্বজিৎ।

১৯৬১-তে এসে রঙমহলে অভিনীত হলো সুশীল মুখোপাধ্যায়ের ‘অনর্থ’ (২৬ জানুয়ারি) এবং নীহাররঞ্জন গুপ্তের ‘চক্র’ নাটক (১৫ আগস্ট)। প্রথমটি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র এবং দ্বিতীয়টি সলিল সেন পরিচালনা করেন। সাধারণ মাপের নাট্য প্রযোজনা দুটি বেশ কয়েক রাত্রি অভিনীত হয়।

১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এসে রঙমহলে সঙ্কট ঘনিয়ে আসে। থিয়েটারের দুই মালিক জীতেন বোস এবং ভিটলভাই মানসাটা ছিলেন কলকাতার দুটি সিনেমা হলের মালিক। তারা বেশ কিছুদিন ধরেই চেষ্টা চালাচ্ছিলেন, যাতে এই থিয়েটার হলটিও একটি সিনেমা হলে রূপান্তরিত হয়। সেই মর্মে বিজ্ঞাপনও দেন তারা। একথা জানতে পেরে রঙমহলের শিল্পী ও কর্মীবৃন্দ ধর্মঘট করে এবং মালিকপক্ষের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদে মুখর হয়। সমস্ত কর্মী ও শিল্পী থিয়েটারের সামনে ধর্ণা দিতে থাকেন জহর রায়, সরযূবালা সহযোগে। অভিনেতা অজিত চট্টোপাধ্যায় এই সময় থিয়েটারের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। সঙ্গে ছিলেন রঙমহলের শিল্পী কলাকুশলী ও কর্মীবৃন্দ। মালিকপক্ষের হেমন্ত ব্যানার্জী এবং নলিনী ব্যানার্জী কর্মীদের পক্ষে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত ড. প্রতাপচন্দ্র চন্দ্রের মধ্যস্থতায় তৎকালীন কংগ্রেসী মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধানচন্দ্র রায় উভয় পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করেন। ড. রায়ের উদ্যোগেই রঙমহল থিয়েটারটিকে শিল্পীকলাকুশলী ও কর্মীদের হাতেই পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সমবায় ভিত্তিতে এবার রঙমহল পরিচালিত হতে থাকে। অভিনেত্রী সরযূবালা এবং অভিনেতা জহর রায় সমবায় ভিত্তিক (co-operative) থিয়েটারের তরফে পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে এটি একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। মালিকানা ভিত্তিক সাধারণ রঙ্গালয়ের ইতিহাসে এই প্রথম একটি রঙ্গালয় সমবায় প্রথায় পরিচালিত হতে থাকে, শিল্পী-কলাকুশলী কর্মীরা যার সদস্য।

এবারে নতুন উদ্যমে অভিনয় শুরু হলো। সমবায় প্রথায় রঙমহলে প্রথম অভিনীত হলো ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’, ৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২। এই নাটক অনেক বছর আগে এখানেই অভিনীত হয়ে প্রবল সাড়া ফেলে দিয়েছিল। এবারে নতুন শিল্পীরা নতুন উদ্যমে নাটকটিকে আবার সফল করে তুললেন। অভিনয়ে—সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবীন মজুমদার। ‘পদ্ম ঝি’র ভূমিকায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অসামান্য কৃতিত্ব দেখালেন। আগের নাট্যরূপ (গোপাল চট্টোপাধ্যায়) এখানে কিছুটা সংশোধিত হয়ে অভিনীত হয়েছিল। জহর রায়—মতি চাকর। রবীন মজুমদার—শালাবাবু।

১৯৬৩-তে ‘কথা কও’ (সুনীল সরকার, ১২ জানুয়ারি), স্বীকৃতি (সলিল সেন, ২১ ডিসেম্বর) অভিনীত হলে। ‘কথা কও’ নাটকে অভিনয়ের জন্য এলেন গ্রুপ থিয়েটার ‘রূপকার’ গোষ্ঠীর পরিচালক অভিনেতা-গায়ক সবিতাব্রত দত্ত। সঙ্গে রইলেন অসিতবরণ, জহর রায়, রবীন মজুমদার, সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, সরযূ দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, শিপ্রা মিত্র প্রমুখ। নাট্যপ্রযোজনায় উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছিলেন সলিল সেন।

‘স্বীকৃতি’ নাটকে অভিনয়ের সময়ে রঙমহলের নিয়মিত শিল্পীদের সঙ্গে এসে যোগ দিলেন গ্রুপ থিয়েটারের অভিনেতা-পরিচালক শেখর চট্টোপাধ্যায়। আর, রঙমহলে ‘স্বীকৃতি’ নাটকেই রবীন মজুমদারের শেষ অভিনয়।

সমবায় প্রথায় পরিচালিত রঙমহল থিয়েটারে পরপর সফলভাবে নাটক অভিনীত হতে থাকলো। এবং প্রায় সব নাটকই দর্শক আনুকূল্যলাভে সার্থক হলো। পরপর অভিনীত হয়ে চললো একের পর এক নাটক। নাম বিভ্রাট: ২ অক্টোবর, ১৯৬৪। অস্কার ওয়াইল্ডের ‘দ্য ইমপরটেন্স অফ বিয়িং আর্নেস্ট’ নাটকের বাংলা রূপান্তর ( আলো দাসগুপ্ত)। টাকার রঙ কালো: ২ অক্টোবর, ১৯৬৫। নাট্যকার সুনীল চক্রবর্তী। প্রতিমা: ১২ মে, ১৯৬৬। নাট্যকার সলিল সেন। তারই পরিচালনায় অভিনীত হয়। এই সময়ে নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য আবার রঙমহলে যোগ দেন। অতএব: ৬ অক্টোবর, ১৯৬৬। চলেছিল ১৯৬৭-এর জুলাই মাস পর্যন্ত। নাট্যকার বিধায়ক ভট্টাচার্য। পরিচালনায় যুগ্মভাবে জহর রায় এবং হরিধন মুখোপাধ্যায়। আদর্শ হিন্দু হোটেল: ১৮ জুন, ১৯৬৭। (তৃতীয় পর্যায়)। ছায়ানায়িকা: ১৮ জুলাই, ১৯৬৭। চলেছিল ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৮ পর্যন্ত। নাট্যকার পার্থপ্রতিম চৌধুরী। পরিচালনায় যুগ্মভাবে পার্থপ্রতিম এবং সলিল সেন। আলো—তাপস সেন। নাটকটি একদমই চলেনি। নহত: ৯ মার্চ, ১৯৬৮। নাট্যকার সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁরই পরিচালনায় অভিনীত হয়। অভিনয়ে উল্লেখযোগ্য: সত্য বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, হরিধন মুখোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, সরযূ দেবী, আরতি ভট্টাচার্য। এই নাটক অসামান্য সাফল্য লাভ করে এবং রঙমহলের আর্থিক সঙ্গতি ফিরিয়ে আনল। সেমসাইড: ১২ ডিসেম্বর, ১৯৬৮। নাট্যকার শৈলেশ গুহ নিয়োগী ও প্রবোধবন্ধু অধিকারী। যুগ্মভাবে তারাই পরিচালনা করেন। আমি মন্ত্রী হব: ৩০ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৯। চলেছিল ডিসেম্বর ১৯৭০ পর্যন্ত। নাট্যকার সুনীল চক্রবর্তী। পরিচালনা জহর রায়। বাবা বদল: ১ জানুয়ারি, ১৯৭১। নাট্যকার মনোজ মিত্র। পরিচালনায় জহর রায়। মনোজ মিত্রের ‘কেনারাম বেচারাম’ নাটকের প্রভূত পরিবর্তিত রূপ। নাট্যকারকে না জানিয়েই করা হয়। উত্তরণ: ১ মে, ১৯৭১। আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনী নাট্যরূপ দেন বীরু মুখখাপাধ্যায়। পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। সুবর্ণ গোলক: ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২। বঙ্কিমের কাহিনীর নাট্যরূপ ( সন্তোষ সেন)। পরিচালনা জহর রায়। নাচগানে ভরা এবং ব্যঙ্গকৌতুকের এই নাটক জমে গিয়েছিল। তথাস্তু: ২৬ জানুয়ারি, ১৯৭৩। নাট্যকার সুশীল মুখোপাধ্যায়। পরিচালনা সলিল সেন। আলিবাবা: ১৩ মে, ১৯৭৩। নাট্যকার ক্ষীরোদপ্রসাদ বিদ্যাবিনোদ। রঙ্গরস ও নৃত্যগীতে ভরা পুরনো এই নাটক আবার জমে গেল রঙমহলে। অভিনয়ে ছিলেন—কালী ব্যানার্জী (আলিবাবা), প্রভাত ঘোষ (আবদালা), জয়শ্রী সেন (মর্জিনা), মৃণাল মুখোপাধ্যায় (কাশিম), শম্ভু ভট্টাচার্য (দস্যু সর্দার) ছন্দা দেবী (সাকিনা), সরযূদেবী (ফতিমা)। অনন্যা: ২৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। চলেছিল ডিসেম্বর, ১৯৭৫ পর্যন্ত একটানা চলে। নাট্যকার কুণাল মুখোপাধ্যায়। এই নাটকে অভিনয়ের জন্য চলচ্চিত্র জগতের খ্যাতিমান অভিনেতা অসীমকুমার ও স্বরূপ দত্ত রঙমহলে যােগ দেন। নাটকটি পরিচালনা করেন জহর রায়। চণ্ডীদাস বসুর সুরে ও কথায় গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও বনশ্রী সেনগুপ্ত। এই নাটকে ক্যাবারে নৃত্যে মিস চন্দ্রকলা নেমেছিলেন। অন্যান্য অভিনয়ে ছিলেন—জয়শ্রী সেন, বীথি গাঙ্গুলি, জহর রায়, ঠাকুরদাস মিত্র, কামু মুখোপাধ্যায়, ধীমান চক্রবর্তী প্রমুখ।

‘অনন্যা’ নাটক থেকেই রঙমহলে ক্যাবারে নৃত্য চালু হয়। কলকাতার বিশ্বরূপা থিয়েটারে ১৯৭১-এ ‘চৌরঙ্গী’ নাটক অভিনয়ের সময়েই প্রথম রঙ্গমঞ্চে ক্যাবারে নর্তকী নামানো হয়। রাসবিহারী সরকারের মালিকানায় সাধারণ রঙ্গালয়ে ক্যাবারে নর্তকীদের নিয়ে এসে কুরুচিপূর্ণ ও উত্তেজক নৃত্য-গীতের ব্যবহার চালু হয়। নাটক নয়, ক্যাবারে নর্তকীদের ‘বস্ত্র বিপ্লব’-এর আকর্ষণেই তখন থিয়েটারে ভিড় বেড়ে চলেছিল। রঙমহলও এতোদিনের সুস্থ নাট্যাভিনয়ের ঐতিহ্য বিস্মৃত হয়ে ক্যাবারে নৃত্য চালু করে দিয়ে সস্তা প্রমোদ মাধ্যমে দর্শক আকর্ষণের চেষ্টা করে। এতেই বোঝা যায়, এই সময় থেকেই রঙমহলের অবস্থা খারাপ হতে থাকে। সমবায় প্রথার ভিত্তি দুর্বল হতে থাকে। জহর রায়, সরযূ দেবী নাট্য পরিচালনার পুরোদায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। কুণাল মুখোপাধ্যায় এই সুযোগে রঙমহলে এসে সস্তা ও কুরুচিপূর্ণ নাটকের অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়ে যান।

এবার ‘অনন্যা’র পর নামানো হয় পুরনো নাটক ‘ভোলাময়রা’। ভোলাময়রা: ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭৫। নাট্যকার ও পরিচালক—কুণাল মুখোপাধ্যায়। ভোলা ময়রার ভূমিকায় অভিনয় করেন পুরনো দিনের প্রখ্যাত গায়ক অভিনেতা তারা ভট্টাচার্য। নূরজাহান: ১৪ এপ্রিল, ১৯৭৬। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটকটির নাম দেওয়া হলো ‘সম্রাজ্ঞী নূরজাহান’। পুরনো নাটকটির সম্পাদনা করেন শেখর চট্টোপাধ্যায়। পরিচালনা অনুপকুমার। সত্তরের দশক তখন রাজনৈতিক ভাবে উত্তাল। ইন্দিরা গান্ধী সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষীগত করে দেশব্যাপী জরুরী অবস্থা জারি করেছেন। সন্ত্রাস, রাজনৈতিক হানাহানি এবং একনায়কতন্ত্রের নখদন্ত বিস্তারের প্রেক্ষাপটে নূরজাহান নাটকের ঘটনা ও নূরজাহান চরিত্রটিকে স্থাপন করা হয়েছে। পুরনো নাটকের ঘটনা আধুনিক কালে নতুন ডাইমেনশান পেয়ে গেল। শেখর চট্টোপাধ্যায় ও অনুপকুমারের প্রচেষ্টায় রঙমহলে লটকটি অভিনীত হয়েছিল। নন্দা: ২৩ মে, ১৯৭৬। চলেছিল জানুয়ারি, ১৯৭৭ পর্যন্ত। আশাপূর্ণা দেবীর কাহিনী অবলম্বনে নাট্যরূপ দেন প্রভাত হাজরা। পরিচালনা জহর রায়। অপরিচিত: ৩ ফেকয়ারি, ১৯৭৭। কাহিনী সমরেশ বসু। নাট্যরূপ শঙ্কর সিকদার ও সমীর লাহিড়ী। পরিচালনা জহর রায়। অভিনয়ে—দিলীপ রায় (সুজিত নাথ), জহর রায় (ভুজঙ্গ রায়), সরযূ দেবী (কিরণময়ী), লিলি চক্রবর্তী (সুনীতা)। এই নাটকেই প্রখ্যাত চরিত্রাভিনেতা ও কৌতুকশিল্পী জহর রায়ের শেষ অভিনয়।

১৯৭৭-এর ১ আগস্ট জহর রায়ের মৃত্যু হয়। জহর রায়ের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই রঙমহলের শিল্পী কলাকুশলী-কর্মীদের সমবায় প্রথার অস্তিত্ব-ও শেষ হয়ে গেল।

১৯৭০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই রঙমহলের অবস্থা খারাপ হয়ে আসে। সমবায় প্রথা ভেঙে পড়ে, অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী রঙমহল ছেড়ে চলে যায়। টাকা পয়সার হিসাবপত্রও ঠিকভাবে রাখা হয়নি। জহর রায় যে সাংগঠনিক দায়িত্ব নিয়ে অজিত চট্টোপাধ্যায়ের সহযোগিতায় রঙমহল চালাচ্ছিলেন, শেষের দিকে তা নানাকারণে বিঘ্নিত হয়। হতোদ্যম জহর রায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন, দায়িত্ব পালনেও অনীহা ও তিক্ততা সৃষ্টি হয়। রাজনৈতিক পালাবদল ও উত্তেজনায় পূর্ণ সত্তর দশকের উত্তাল সময়ে থিয়েটারের ওপরও আক্রমণ নেমে আসে। আক্রান্ত হন জহর রায়, স্বরূপ দত্ত প্রমুখ শিল্পীবৃন্দ।

এবারে রঙমহলের কর্মাধ্যক্ষ হলেন শান্তিময় বন্দ্যোপাধ্যায় ও অজয় ভদ্র। জহর রায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, সরযূদেবীর উদ্যমে রঙমহলের যে সাফল্যের যুগ শুরু হয়েছিল, এবারে তা শেষ হলো।

ছদ্মবেশী: অক্টোবর, ১৯৭৭। উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের নাট্যরূপ। পরিচালনা রবি ঘোষ। অভিনয়ে—রবি ঘোষ, সন্তোষ দত্ত, সন্তু মুখোপাধ্যায়, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, অলকা গাঙ্গুলি। আলো—কণিষ্ক সেন। অগোছালো এই নাট্য প্রযোজনা বেশিদিন চলেনি।

রঙমহলের দুরবস্থার দিনে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৭৫-এর কিছুদিন রঙমহলে ‘থানা থেকে আসছি’ (নাট্যরূপ: অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়) অভিনয় করেন। মঞ্চের প্রখ্যাত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রও এই নাটকে অংশগ্রহণ করেন। কিন্তু এই নাটক জমেনি, চলেওনি তেমন।

দিলীপ রায়ের পরিচালনায় ‘রাজদ্রোহী’ অভিনীত হলো ১৯৭৮-এ। কাহিনী শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। নাট্যরূপ বীরু মুখোপাধ্যায়। অভিনয় করেছিলেন দিলীপ রায়, লিলি চক্রবর্তী, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, শিপ্রা মিত্র, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, গৌর শী, সন্তু মুখোপাধ্যায়, গীতা কর্মকার, কল্যাণী মণ্ডল। এই নাটকে ফজল আলির চরিত্রে অভিনয় করেন বিজন ভট্টাচার্য। আলো—তাপস সেন। মঞ্চ—সুরেশ দত্ত। সঙ্গীত রচনা ও সুর সংযোজনা—চণ্ডীদাস বসু। আবহ—পার্থপ্রতিম চৌধুরী। নৃত্য—শম্ভু ভট্টাচার্য। গ্রন্থনা—প্রদীপ ঘোষ। সহপরিচালনা—শ্যামল ঘোষ। এই নাটকে গান গেয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, শক্তি ঠাকুর। মঞ্চাধ্যক্ষ—মণি চট্টোপাধ্যায়।

‘রাজদ্রোহী’ খুব সাফল্যের সঙ্গে অভিনয় হয় দীর্ঘ দিন। এরপরে নানাকারণে রঙমহল কয়েকমাস বন্ধ থাকে।

এই অব্যবস্থা ও দুরবস্থার দিনে ‘পিউ কাহা’ নামে এক নাটক নামানো হয়। ৩ মে, ১৯৭৯। কাহিনী সুবোধ ঘোষ। পরিচালনা মৃণাল ঘোষ। ১৯৮০র ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত চলে।

কলকাতার অনেক থিয়েটারেই তখন ‘এ’ মার্কা নাটকের অভিনয় চলছিল, যেখানে নাটক বহির্ভূত অনেক দৃশ্য থাকতো। বিশেষ করে ক্যাবারে নর্তকীদের দিয়ে দেহভঙ্গিমাসর্বস্ব নৃত্যের ব্যবস্থা করা হতো। রঙমহলও সেই স্রোতে গা ভাসিয়ে ‘পিউ কাহা’ নাটকটি নামায়। নাটক হিসেবে অকিঞ্চিৎকর নিম্নমানের এই প্রযোজনায় দর্শকের ভিড় উপচে পড়তে থাকে। কারণ, মিস ববি, মিস জে নামে ক্যাবারে নর্তকীদের দেহসর্বস্ব স্বল্পবাস পরিহিত অশ্লীল নৃত্য। এতে রঙমহলের এতোদিনের সুনামের ঐতিহ্য বিঘ্নিত হয়।

এর বিরুদ্ধে উদ্যোগী হয়ে শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের পরিচালনায় নামানো হলো ‘অমরকন্টক’ ১৯৮০-র ৪ এপ্রিল।

‘পিউ কাহা’র আগে রঙমহলের দুরবস্থার দিনে কলকাতার গ্রুপ থিয়েটারগুলিকে এনে এখানে তাদের খ্যাতিপ্রাপ্ত নাটকগুলি অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ১৯৭৯-এর এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখ থেকে ২২ তারিখ পর্যন্ত থিয়েটার কমিউন তাদের নাটক ‘দানসাগর’ (২টি অভিনয়), সুন্দরম-এর নাটক ‘সাজানো বাগান’ (১টি অভিনয়), থিয়েটার ওয়ার্কশপ-এর ‘নরক গুলজার’ (২টি অভিনয়), ঘটকালি (৪টি অভিনয়) করে। থিয়েটারে নতুন ধরনের নাটক উপস্থাপনার মাধ্যমে দর্শকদের রুচি ফেরাবার চেষ্টা তখনই শুরু হয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হওয়াতে ‘পিউ কাহা’ নামিয়ে তদানীন্তন থিয়েটারের রুচিবিকৃতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়।

‘অমরকন্টক’ তারই প্রতিবাদ। পরিচালনা—শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। তার সঙ্গে সহযোগী হয়ে অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এগিয়ে আসেন। এই নাটকটি প্রথমে ৫০০ রজনী অভিনীত হয়েছিল নেতাজী ইনস্টিটিউটে (পূর্বের ক্রেম ব্রাউন মঞ্চ), তারপর থেকে রঙমহলে ধারাবাহিক অভিনীত হতে থাকে। এখানে সবশুদ্ধ ৬০০ রজনী অভিনীত হয়েছিল।

এবার কিন্তু ক্যাবারে নৃত্য বা ‘এ’ মার্কা থিয়েটার থেকে সরে এসে সুস্থ নাট্যাভিনয়ের চেষ্টা চালানো হয় এবং অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করে। ছ’শো রাত্রি অভিনয়ই তার প্রমাণ।

‘অমরকন্টক’-এর মূল কাহিনী আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ওই নামের উপন্যাস। নাট্যরূপ দেন কুণাল মুখোপাধ্যায়। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা তাদের এই প্রয়াসকে সাধুবাদ জানায়। শতরজনীর স্মারক পুস্তিকায় (২৪-৬-১৯৮০) পরিচালক শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় জানান—‘‘গত কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে কিছু লোক পেশাদার রঙ্গমঞ্চে বিকৃত ক্ষুধার রসদ জুগিয়ে নাটক করে কিছু রোজগার করেছেন ও করছেন। যে কোনও প্রকারে কিছু প্রাপ্তিই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের বক্তব্য দর্শক নিচ্ছে এবং উপভোগও করছে। আমি মনে করি বাংলাদেশের দর্শক সত্যিকারের নাটক ও মনে রাখার মতো অভিনয় দেখতে ভালোবাসেন এবং চান। ‘অমর কণ্টক’ মঞ্চস্থ করে জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থনে আমাদের বিশ্বাস আবার প্রমাণিত হল।’’ (পরিচালকের বক্তব্য)।

এর মধ্যে অনুপকুমারের পরিচালনায় ‘হঠাৎ নবাব’ নাটকটি এখানে কয়েকরাত্রি অভিনীত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই বিখ্যাত প্রহসনটি প্রথম অভিনয় হয় ২৪ মে, ১৯৮০।

জয় মা কালী বোর্ডিং নাটকটি সুধাংশুকুমার মিত্রের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হলো। প্রথম অভিনয় ১০ অক্টোবর, ১৯৮২। মঞ্চ ও চিত্র জগতের খ্যাতিমান চরিত্রাভিনেতা এবং কৌতুক শিল্পী ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় নাটকটি পরিচালনা করেন। আলো—তাপস সেন। মঞ্চ—সুরেশ দত্ত। অভিনয়ে—ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, মনু মুখোপাধ্যায়, অজিত চট্টোপাধ্যায়, উজ্জ্বল সেনগুপ্ত, ধীমান চক্রবর্তী প্রমুখ। নাটকটি মোট তিনমাসে ৭৪ বার অভিনীত হয়। শেষ অভিনয় ১৯৮৩-র ৩০ জানুয়ারি।

এরপরে মার্চ-এপ্রিল রঙমহল বন্ধ থাকে। তারপরে অভিনীত হয় ‘বিবর’। সমরেশ বসুর বহু বিতর্কিত উপন্যাসের নাট্যরূপ দিলেন সমর মুখোপাধ্যায়। তার আরেকটি উপন্যাস ‘অশ্লীল’-এর নাট্যরূপ দিলেন তরুণকুমার। প্রথমটি সমর মুখোপাধ্যায় এবং দ্বিতীয়টি কুণাল মুখার্জীর পরিচালনায় অভিনীত হয়। নাটক দুটিতে অভিনয় করেন প্রশান্তকুমার, গৌরীশঙ্কর ব্যানার্জী, মিন্টু চক্রবর্তী, সুব্রত চট্টোপাধ্যায়, সীমন্তিনী দাস প্রমুখ। দুটি নাটক ‘এ’-মার্কা হয়ে প্রচারিত হতো। ‘বিবর’ তেমন না চললেও, অশ্লীল চলেছিল টানা ৫০০ রাত্রি।

১৯৮৭ থেকে রঙমহল সংস্কারের জন্য বন্ধ থাকে। ১৯৮৭র ২৭ জুন থেকে ‘স্বীকারোক্তি’ অভিনয় শুরু হয়। দেবনারায়ণ গুপ্ত তখন রঙমহলের সর্বাধ্যক্ষ। পরিচালনায় সুভাষ বসু। এই নাটকটি এখানে ২০০ রজনীর মতো অভিনয় হয়েছে। অভিনয়ে—অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, চিরঞ্জিৎ, ধীমান চক্রবর্তী, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, জয় সেনগুপ্ত, সঙ্ঘমিত্রা ব্যানার্জী, রমা গুহ প্রমুখ।

১৯৮৮-তে প্রযোজিত হলো ‘নীলকণ্ঠ’। নাট্যরচনা, নির্দেশনা ও সঙ্গীত পরিচালনায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। আলো—তাপস সেন। মঞ্চ—নির্মল গুহরায়। এই নাটকটি প্রযোজনা করেন শুক্লা সেনগুপ্ত। অভিনয়ে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, নির্মল ঘোষ, সুমন্ত মুখোপাধ্যায়, সায়নী মিত্র, দেবিকা মিত্র।

সাধারণ রঙ্গালয়ের প্রচলিত নাটকের তুলনায় ‘নীলকণ্ঠ’ ভিন্ন ধরনের নাটক। বিষয়ভাবনা, উপস্থাপনা এবং বক্তব্যে এই নাটক নতুন যুগের নতুন চিন্তার দোসর। টানা ৩০০-এরও বেশি বার অভিনীত হয়েছিল। বেশ কিছু পরিমাণে দর্শক যে এই নাটককে গ্রহণ করেছিল, এটাই তার প্রমাণ। আনন্দবাজার পত্রিকা লিখেছিল—‘‘কলকাতার পেশাদার মঞ্চের ক্ষেত্রে একদা ‘কল্লোল’ যেমন বিষয়ে এবং আঙ্গিকে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল, ঠিক তেমনই কিছুকাল আগে বাংলা পেশাদার মঞ্চ যখন সাফল্যের হাতিয়ার হিসেবে কিছু সস্তা উপাদান নিয়ে মত্ত তখন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের নামজীবন ছিল পেশাদার মঞ্চের নতুন করে উত্তরণের সার্থক ইঙ্গিত। ‘ফেরার পর নীলকণ্ঠ’ নিঃসন্দেহে সেই সার্থকতার আরেকটি স্মারক চিহ্ন। (১১-১১-১৯৮৮)।

মনে রাখতে হবে এর আগে সৌমিত্র কাশী বিশ্বনাথ মঞ্চে নামজীবন এবং বিশ্বরূপায় ‘ফেরা দুটি’ ভিন্ন ধরনের নাটক অভিনয় করেছিলেন। প্রযোজিকা শুক্লা সেনগুপ্তের প্রচেষ্টা এবং সৌমিত্রের উদ্যোগে রঙমহলে ‘নীলকণ্ঠ’ অভিনয় নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। তিনটি পেশাদার মঞ্চেই সৌমিত্রের ভিন্ন ধরনের এই নাটকগুলি জনসম্বর্ধনা লাভ করেছিল।

‘পরমা’ অভিনীত হলো ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯। পরিচালনা সুভাষ বসু। মুখ্য চরিত্রে বসন্ত চৌধুরী ও পাপিয়া অধিকারী। তারপরেই নামানো হয় ‘জীবনসঙ্গিনী’ (১২.৭.৯০) অঞ্জনা এন্টারপ্রাইজের প্রযোজনায়। পরিচালনা করেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। সিরিওকমিক এই নাটকটি ভালোই চলেছিল। দাদা ও বৌদি চরিত্রে অভিনয় করেন শুভেন্দু ও সুমিত্রা মুখখাপাধ্যায়। নায়ক-নায়িকা চরিত্রে গৌতম দে ও নয়না দাস। এছাড়া জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, কল্যাণী মণ্ডল অভিনয় করেন। উল্লেখযোগ্য এই নাটকে একাধারে রবীন্দ্রসঙ্গীত এবং পপ সঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। রবীন্দ্রসঙ্গীত দুটি গেয়েছিলেন অরুন্ধতী হোম চৌধুরী এবং পপ সঙ্গীতে গোপা ঘোষ।

রাধাগোবিন্দ এন্টারপ্রাইজ এবার রঙমহলে প্রযোজনায় এসে অভিনয় করল ‘গৌরব’ নাটক। প্রথম অভিনয় ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৩। নাটক ও নির্দেশনা—অসিত বসু। এই নাটকে সিনেমার জনপ্রিয় নায়ক প্রসেনজিৎ অভিনয়ে অংশ নেন। ঐকতান নিবেদিত ‘গৌরব’ নাটক পুরোপুরি ব্যর্থ হয় সবদিক দিয়ে।

তারপরে ডি. মুখার্জি প্রযোজিত ঐকতান নিবেদিত নাটক ‘মাণিকচাঁদ’। নাটক উৎপল রায়। ১৯৯৪-এর এই নাটকটি পরিচালনা করেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়। চলচ্চিত্রের খ্যাতিমান অভিনেতা তাপস পাল এই নাটকে অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেন, মল মাণিকচাঁদ চরিত্রে। অন্য চরিত্রগুলিতে ছিলেন—দিলীপ রায় (ট্রাক ডাইভ্রার দর্শন সিং), জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায় (ভাড়াটে সাতকড়ি), লিলি চক্রবর্তী (ফুলবসন), রাজশ্রী (মাণিকাদের প্রেমিকা মাধুরী)। নাটকটি তাপস পাল, দিলীপ রায় এবং জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল।

এবারে নামানো হলো ‘আলোয় ফেরা’। কাহিনী দুলেন্দ্র ভৌমিক। নাট্যরূপ ও পরিচালনা দেবসিংহ। অভিনয়ে তাপস পাল ও শ্রীলা মজুমদার থাকলেও হাল্কা নাচগান ও হাস্যরসে ভরা এই নাটক তেমন মঞ্চসফল হয়নি।

আর্থিক টানাটানিতে এরপরে রঙমহল বন্ধ হয়ে যায়। মাঝে বেশ কিছু বছর নানাজনকে ভাড়া দিয়ে নাটক অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেইভাবেই চলছিল। এবারে পুরোপুরিই বন্ধ করে দেওয়া হলো।

অনেক দিন বাদে আবার রঙমহল খুললো। এবারে ইউনিফোকাসের তরফ থেকে রত্না ঘোষাল ও সুশীল দাস ‘জয় জগন্নাথ’ নাটকটি নামান। দুলেন্দ্র ভৌমিকের ‘জগন্নাথ কাহিনী’ গ্রন্থ থেকে এর নাট্যরূপটি তৈরি হয়। নাট্য পরিচালনা এবং অভিনয়ে ছিলেন রত্না ঘোষাল। অন্যান্য চরিত্রে—জ্ঞানেশ মুখখাপাধ্যায়, কল্যাণী মণ্ডল, নিমু ভৌমিক, বোধিসত্ত্ব মজুমদার, দেবাশিস রায়চৌধুরী প্রমুখ। ১৯৯৭-এর জুলাই মাসে অভিনয় শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন অভিনয়ের পর ১৯ নভেম্বর এর অভিনয় বন্ধ হয়। সেই সঙ্গে রঙমহলও বন্ধ হয়ে যায়। এইভাবে পড়ে থাকার পর রঙমহল থিয়েটার হলটি বিয়ে বাড়ির জন্য ভাড়া দেওয়া শুরু হয় ১৯৯৯ থেকে। কোনো অভিনয় আর হয়নি।

অবশেষে ২৮ আগস্ট, মঙ্গলবার, ২০০১ খ্রিস্টাব্দের মাঝরাতে বিধ্বংসী অগ্নিকাণ্ডে রঙ্গালয়টি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। (শেষরাতে আগুন, ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত রঙমহল’ শীর্ষক সংবাদ, আনন্দবাজার ২৯-৮-২০০১)

দীর্ঘ ঐতিহ্য লালিত রঙমহল থিয়েটারের ইতিহাস এখানেই শেষ। পুনর্নির্মাণ ও পুনরভিনয়ের কোনো খবর আজ অবধি (২৫ ডিসেম্বর, ২০০২) নেই।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে রঙমহল থিয়েটারের অবদান

বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে রঙমহলের উল্লেখযোগ্য অবদানগুলি হলো—

  • টানা প্রায় পঞ্চাশ বৎসর ধরে একটানা একাধিক্রমে রঙমহল থিয়েটারে নাট্যাভিনয় চলেছিল। যে কোনো থিয়েটারের পক্ষেই এটি শ্লাঘার বিষয়।
  • এই থিয়েটারে উচ্চস্তরের ভাবের ও রসের নানা নাটকের অভিনয় বাংলা থিয়েটারের নাট্যাভিনয়ের মর্যাদাকে বিস্তৃত করেছিল। যেমন মহানিশা, বাংলার মেয়ে, চরিত্রহীন, সন্তান, তটিনীর বিচার, স্বামীস্ত্রী, দেবদাস, বাংলার প্রতাপ, চিরকুমার সভা, আদর্শ হিন্দু হোটেল, উল্কা, দুইপুরুষ, কবি, সাহেব বিবি গোলাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য।
  • রঙমহল থিয়েটারেই ভারতের মধ্যে সর্বপ্রথম ‘রিভলভিং স্টেজ’ ব্যবহার করা হয়। পরে অন্য অনেক থিয়েটার এই ঘূর্ণায়মান মঞ্চ তৈরি করে।
  • এখানে অপরাধমূলক ও রোমাঞ্চকর নাটক অভিনীত হয়ে বাংলা, থিয়েটারের বিষয়ের সীমা বাড়িয়ে দিয়েছে।
  • উল্কা নাটকের অসাধারণ সাফল্যের কারণে এই থিয়েটারেই একটি নাটকের একটানা পাঁচশো রাত্রির অধিক অভিনয়ের নজির সৃষ্টি হলো। এর আগে স্টারে ‘শ্যামলী’ এর কাছাকাছি সাফল্য দেখিয়েছিল।
  • এই থিয়েটারেই প্রথম শিল্পী-কলাকুশলী ও কর্মীদের সমবায় প্রথা চালু হয়। সমবায় প্রথায় শিল্পী কর্মীদের থিয়েটার পরিচালনার এই প্রয়াস ভারতে সর্বপ্রথম রঙমহলেই শুরু হলো।
  • উচ্চভাবের নাটকের অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে এখানে অপরাধমূলক, রোমাঞ্চকর নাটকের যেমন অভিনয় হয়েছে, তেমনি কৌতুকরসাত্মক প্রচুর নাটকের অভিনয় বাংলা থিয়েটারে হাস্যরসের মরাগাঙে জোয়ার এনে দিয়েছিল। এই প্রসঙ্গে জহর রায় ও অজিত চট্টোপাধ্যায়ের উদ্যোগ স্মরণযোগ্য। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এবং কৌতুক রসের মধ্য দিয়ে নাট্য-পরিচালক ও অভিনেতা জহর রায় ১৯৭০-এর দশকের রাজনৈতিক বিপর্যয়কে কিছু অংশে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। তার মাশুলও তাকে দিতে হয়েছিল। কংগ্রেসি রাজনৈতিক দলের কর্মীদের আক্রমণে রঙমহলে নাট্যাভিনয় বন্ধ করে দিতে হয়েছে। আবার অভিনেতা ও পরিচালকের ওপর হুমকি ও নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। কিন্তু তাতেও তারা দমিত না হয়ে নাটকের অভিনয় চালিয়ে গিয়ে জনসম্বর্ধনা লাভ করেছেন।
  • এই মঞ্চেই অভিনেতা-অভিনেত্রী হিসেবে সে যুগের সেরা সম্মেলন ঘটেছিল। দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, অহীন্দ্র চৌধুরী, নির্মলেন্দু লাহিড়ী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, মিহির ভট্টাচার্য, ছবি বিশ্বাস, জহর রায়, তরুণ রায় এখানে দীর্ঘদিন অভিনয় করেন। অভিনেত্রীদের মধ্যে শান্তি গুপ্তা, রানীবালা, শেফালিকা, সরযূবালা, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় উল্লেখযোগ্য।
  • নাট্যকার হিসেবে রঙমহলে যুক্ত ছিলেন তারাশঙ্কর, বিধায়ক ভট্টাচার্য, শচীন সেনগুপ্ত, তরুণ রায়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, দেবনারায়ণ গুপ্ত, সলিল সেন প্রমুখ। প্রখ্যাত নাট্যকারেরা। নাট্যপরিচালক হিসেবে সেকালের সেরা ব্যক্তিত্ববৃন্দ এখানে কাজ করে গেছেন। নরেশ মিত্র, অহীন্দ্র চৌধুরী, দেবনারায়ণ গুপ্ত, মহেন্দ্র গুপ্ত, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, জহর রায়, তরুণ রায়, অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির নাম করা যায়।
  • এখানে অনেক নাট্যকারের মৌলিক নাটক যেমন অভিনীত হয়েছে, তেমনি অনেক ভালো উপন্যাসের নাট্যরূপও অভিনীত হয়েছে। যেমন দেবদাস, চরিত্রহীন, নিষ্কৃতি, মহানিশা, আনন্দমঠ (সন্তান), শেষলগ্ন, কবি, দুইপুরুষ, সাহেব বিবি গোলাম, উল্কা উল্লেখযোগ্য।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু থেকে যে বিপর্যয় বাংলায় দেখা দেয়, তা ক্রমশ সমগ্র চল্লিশের দশক জুড়ে নানা ঘটনায় বাংলার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তোলে। রঙমহল এই সময়ে অভিনয় চালিয়ে গেছে। যুদ্ধ, আগস্ট আন্দোলন, পঞ্চাশের মন্বন্তর, কালোবাজারি, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা, স্বাধীনতা প্রভৃতি নানা ঘটনারাজির মধ্যে চল্লিশের দশক উত্তাল হয়ে ছিল। এই সময়েই গণনাট্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে নাটক জনজীবন-সমস্যার মুখোমুখি হতে পেরেছিল। কিন্তু কখনোই রঙমহল থিয়েটার জনজীবন সমস্যার মুখোমুখি হওয়া তো দূরের কথা, কোনো অংশেই তার প্রকাশ নাট্যাভিনয়ের মাধ্যমে ঘটাতে পারেনি।
  • ঐতিহ্যপূর্ণ দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের থিয়েটার রঙমহল যেমন নানা উচ্চমান ও ভারে এবং বিচিত্র বিষয়ের নাটক অভিনয় করেছে, তেমনি আবার ঐতিহ্যবিচ্যুত হয়ে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য সস্তারুচি, কুরুচিপূর্ণ নৃত্য গীত ও অশ্লীল ভাবভঙ্গির আমদানি থিয়েটারে করেছিল। দীর্ঘ উন্নত ঐতিহ্যের মধ্যে এই ক্ষুদ্র রঙমহলের কৃতিত্বকে কিছু অংশ ম্লান করে দিয়েছে।
  • তাহলেও, দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর একাদিক্রমে নানা ভাব, বিষয় ও ভাবনার নানান নাট্যাভিনয় করে, বহু নাট্যকার, অভিনেতা-অভিনেত্রীর সমাহার ঘটিয়ে, বিভিন্ন খ্যাতিমান নাট্যপরিচালকের সাহায্য নিয়ে যে নাট্যসম্ভার বাঙালিকে উপহার দিয়েছে, তার জন্য রঙমহল বাংলা থিয়েটারের ইতিহাসে অবশ্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!