রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে রঙ্গনা থিয়েটারের অবদান আলোচনা কর।

রঙ্গনা থিয়েটার

১৫৩/২ এ, (পরবর্তীকালে ২ই), আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড, কলকাতা

প্রতিষ্ঠা: ৫ অক্টোবর, ১৯৭০

প্রতিষ্ঠাতা: গণেশ মুখখাপাধ্যায়

স্থায়িত্বকাল: ৫ অক্টোবর, ১৯৭০ – বর্তমান কাল

প্রযোজনা: শিল্পী যাযাবর

প্রথম নাটক: ‘বিনিপয়সার ভোজ’ (রবীন্দ্রনাথ)

দ্বিতীয় নাটক: ‘য্যায়সা কি ত্যায়সা’ (গিরিশচন্দ্র)

প্রযোজনা: মন্মথ নাট্যসংস্থা (শ্রীমঞ্চ)

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে উত্তর কলকাতার আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডে রঙ্গনা থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয়। রাধাবল্লভ ও গোপেন্দ্রকৃষ্ণ শীল মহাশয়ের কাছ থেকে জমিটা কিনে নেন মুখার্জী পরিবার। এই পরিবারের নাট্যানুরাগে খ্যাতি ছিল। সেই পরিবালের এক নাট্যব্যক্তিত্ব গণেশ মুখোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টায় ও গোলক পালের উদ্যোগে নতুন থিয়েটার হল তৈরি হলো শীলদের জমিতে। কোনোরকম সরকারি সাহায্য বা অনুদান ছাড়াই এই থিয়েটার বাড়ি তৈরি হয়েছিল। বিখ্যাত নট অহীন্দ্র চৌধুরীর পরামর্শ ও তত্ত্বাবধানে রঙ্গমঞ্চ নির্মাণ করা হলো। অহীন্দ্র চৌধুরী নামকরণ করলেন ‘রঙ্গনা’। ৮৫০টি আসন। পরে ৯০৫টি।

১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের ৫ অক্টোবর দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীর সন্ধ্যায় এই রঙ্গমঞ্চের উদ্বোধন হলো। শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন অহীন্দ্র চৌধুরী। তারাশঙ্কর ছিলেন প্রধান অতিথি এবং বিশেষ অতিথি রূপে উপস্থিত ছিলেন বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়। প্রথম নাটক অভিনীত হলো রবীন্দ্রনাথের ছোট প্রহসন নাটিকা ‘বিনিপয়সার ভোজ’। প্রযোজনা করল শিল্পী যাযাবর নামে নাট্যগোষ্ঠী। তারপরেই অভিনয় করা হলো গিরিশচন্দ্রের বহুখ্যাত প্রহসন ‘য্যায়সা কি ত্যায়সা’। এই প্রহসনটির প্রযোজনা করলো মন্মথ নাট্যসংস্থা। (শ্ৰীমঞ্চ)।

প্রথম রাতেই নাটক জমে গেল। রঙ্গনা থিয়েটারের নাম লোকমুখে পরিচিত হলো। কিন্তু রঙ্গনা কর্তৃপক্ষের নিজের কোনো নাটক না থাকায়, অভিনয়ে ছেদ পড়লো।

১৯৭০-এর দশক কলকাতা তথা সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক টালমাটাল অবস্থা। বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ তখন উত্তাল। কলকাতা তখন প্রায় দুঃস্বপ্নের নগরী। সেই বিভীষিকা-পূর্ণ অন্ধকারের দিনে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল রঙ্গনা থিয়েটার।

এদিকে কলকাতায় তখন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন তুঙ্গে। সেই আন্দোলনে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে নান্দীকার নাট্যগোষ্ঠী তখন নানাধরনের নাটক অভিনয় করে শিক্ষিত ও রুচিশীল এবং থিয়েটার-প্রেমিক মানুষের মনে উন্মাদনার সৃষ্টি করেছে। সেই নান্দীকার গোষ্ঠী রঙ্গনা থিয়েটার ভাড়া নিয়ে প্রায় পেশাদারি প্রথায় গ্রুপ থিয়েটারের নাটক করা শুরু করলো। প্রতি সপ্তাহের শনি, রবি ও বৃহস্পতিবার নিয়মিত নাটকের অভিনয় আরম্ভ হলো। ‘তিন পয়সার পালা’ (১৯৭০-এর ৭ অক্টোবর) নাটক দিয়ে তাদের রঙ্গনায় অভিনয়ের প্রথম পদক্ষেপ। কলকাতায় তখন গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলনে জার্মান নাট্যকার ও প্রযোজক বারটোল্ট ব্রেখটের চর্চা রীতিমতো চলছে। ব্রেখটের নাটক ‘থ্রি পেনী অপেরা’ অবলম্বনে বাংলা রূপান্তর ‘তিন পয়সার পালা’ নাটক। অনুবাদ ও রূপান্তর করলেন অজিতেশ এবং অভিনয়ে অংশগ্রহণ করলেন নান্দীকার গোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ। নির্দেশনায় অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়।

রঙ্গনায় রাতারাতি জনপ্রিয়তা অর্জন করল নান্দীকার। উত্তর কলকাতায় বাণিজ্যিক থিয়েটারের পরিবেশে রঙ্গনায় একটি গ্রুপ থিয়েটারের এই ধরনের প্রয়াস জনসমর্থন লাভে ধন্য হলো।

মনে রাখতে হবে, ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে এইভাবেই প্রখ্যাত নট ও নাট্যকার উৎপল দত্তের উদ্যোগে ও পরিচালনায় লিটল থিয়েটার গ্রুপ মিনার্ভা থিয়েটার মঞ্চে, উত্তর কলকাতার বাণিজ্যিক থিয়েটারের অঞ্চলে, গ্রুপ থিয়েটারের জয়যাত্রা শুরু করেছিল। সে এক সাফল্যের অনন্য ইতিহাস। ধারাবাহিক ও নিয়মিত নানা নাটকের অভিনয়ে তখন মিনার্ভা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। সেই একই অনুপ্রেরণায় অজিতেশ ও নান্দীকার গোষ্ঠী রঙ্গনা মঞ্চে নিয়মিত অভিনয় শুরু করলো। রঙ্গনার জন্মমুহূর্তেই এই প্রয়াস জনমানসে রঙ্গনার প্রতিষ্ঠা সার্থক করে তুললো।

এখানে নান্দীকারের প্রযোজনায় ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় পরপর অভিনীত হলো শের আফগান (লুইজি পিরানদেশ্লো), মঞ্জরী আমের মঞ্জরী (আক্তন চেখভ), নাট্যকারের সন্ধানে ছটি চরিত্র (লুইজি পিরানদেশ্লো)। এগুলি নান্দীকারের আগের প্রযোজনা। সেই নাটকগুলিই রঙ্গনায় নান্দীকার অভিনয় করে যেতে লাগলো নিয়মিত। তারপরে ব্রেখট অনুপ্রাণিত ভালোমানুষ (‘গুড উওম্যান অব সেৎজুয়ান’ অবলম্বনে)। নান্দীকার গোষ্ঠীর সব শিল্পীর অভিনয় ও অজিতেশের নির্দেশনায় ভালোমানুষ রঙ্গনার খ্যাতি অনেকাংশে বাড়িয়ে দিল। এখানে কেয়া চক্রবর্তীর (শ্বেতার ভূমিকায়) পুরুষ ও নারীচরিত্রের একাধারে অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। নান্দীকারের অন্যান্য কুশীলবের কথাও স্মরণযোগ্য। এছাড়া নান্দীকার অভিনয় করে ‘বীতংস’, ‘হে সময় উত্তাল সময়’।

নান্দীকার রঙ্গনায় ছিল একাদিক্রমে পাঁচ বৎসর। পুরো সময়টাই তাদের অভিনয়ের সার্থকতা ও সাফল্যের ইতহাস।

নান্দীকার রঙ্গনা থিয়েটার ছেড়ে দিলে (১৯৭৫) কর্ণধার গণেশ মুখোপাধ্যায় নিজে এখানে নিয়মিত অভিনয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাঁরই উদ্যেগে শুরু হলো ‘নটনটী’। নাট্যরচনা ও পরিচালনায় রইলেন গণেশ মুখখাপাধ্যায় নিজে।

প্রথম অভিনয় হলো ১০ অক্টোবর, ১৯৭৫ শুক্রবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায়। প্রথমে প্রতি শুক্রবার সাড়ে ৬টা, শনিবার ৩টা; রবি ও ছুটির দিন সকাল ১০টা। এইভাবে ৪৫বার অভিনয়ের পর দ্বিতীয় দফায় বৃহস্পতিবার সাড়ে ৬টা, শনিবার ৩টা এবং রবিবার ও ছুটির দিন ৩টা ও সাড়ে ৬টা। এভাবেই একটানা ৪৫৫ বার নাটকটি অভিনীত হয়। সঙ্গীত পরিচালনায় ছিলেন বিখ্যাত সুরকার অনিল বাগচি। অভিনয়ে: গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, মলিনা দেবী, সন্তোষ দত্ত, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়,

বিমল দেব, দীপিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসন্তী দেবী, গৌতম দে প্রমুখ।

‘নটনটী’ নাচে গানে অভিনয়ে জমে গিয়েছিল। বিগত শতকের থিয়েটারের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবনযন্ত্রণা, জীবনযাপন এবং জীবনের ঘাত-অভিঘাত তৎকালীন রঙ্গমঞ্চের পরিবেশে গড়ে উঠেছে।

এরপরে অভিনীত হলো ‘বহ্নি’। কাহিনী বনফুল। নাট্যরূপ ও পরিচালনা গণেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত পরিচালনায় অনিল বাগচী। প্রথম অভিনয় ১ জুলাই, ১৯৭৭, বৃহস্পতিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। নাটকটির মোট অভিনয় হয়েছিল ৫০ বার। অভিনয় করেছিলেন—সুজিত বসু, অরুণ মুখোপাধ্যায়, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্তোষ দত্ত, অসিতবরণ, শমিতা বিশ্বাস, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পরিচালনায় সাহায্য করেছিলেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়।

‘বহ্নি’ অভিনয়ের সময়েই রঙ্গনার মালিকানা নিয়ে শরিকি বিরোধ শুরু হলো। কিন্তু সেই বিরোধের মধ্যেও রঙ্গনায় নাট্য প্রযোজনা থেমে থাকেনি। এই বিসংবাদের মধ্যেও দীর্ঘ দশ বৎসর রঙ্গনা বাংলার নাট্য ঐতিহ্য বহন করে চলেছিল। নভেম্বর ১৯৮৬ থেকে হাইকোর্টের নির্দেশে পাল পরিবার তাদের অংশ বিক্রি করে দিল। এবারে পুরো মালিকানা রইলো মুখার্জী পরিবারের হাতে।

শরিকি সংঘর্ষের সময়ে রঙ্গনার মূল প্রযোজকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন হরিদাস সান্যাল। যশস্বী নাট্যকার ও পরিচালক দেবনারায়ণ গুপ্ত রঙ্গনার নাট্যাভিনয়ের ভার গ্রহণ করলেন। ১৯৭৮-এর ৭ অক্টোবর শরশ্চন্দ্রের চন্দ্রনাথ উপন্যাসের নাট্যরূপ (দেবনারায়ণ গুপ্ত) মহাসমারোহে মঞ্চস্থ হলো। দেবনারায়ণ ও হরিদাস সান্যালের যৌথ উদ্যোগে রঙ্গনা আবার নবউদ্যমে নাটকাভিনয় শুরু করলো।

প্রায় একবছর ‘চন্দ্রনাথ’ অভিনয়ের পর ১৯৭৯-এর ১২ জুলাই নামানো হলো ‘জয় মা কালী বোর্ডিং’। নাট্যরূপ ও পরিচালনা দেবনারায়ণ গুপ্ত। তারপরে অঘটন, সুন্দরী লো সুন্দরী, দম্পতি, রাজদ্রোহী। মনোজ মিত্রের লেখা ‘দম্পতি’ (১৯৮৬) এখানে বেশ সাফল্যের সঙ্গে অভিনীত হয়। বাদবাকি সব কয়টি পুরনো এবং অন্যান্য থিয়েটারের মঞ্চসফল নাটক। সেইগুলিকেই রঙ্গনায় অভিনয় করে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিল।

১৯৮৬-এর শেষের দিকে মুখার্জী পরিবারের হাতে রঙ্গনার পুরো মালিকানা আসার পর ১৯৮৮ থেকে গণেশ মুখখাপাধ্যায় পুনরায় রঙ্গনার নাট্যাভিনয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন। তার তত্ত্বাবধানে এবার শুরু হলো ‘জয়জয়ন্তী’। নাটক ও পরিচালনা গণেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত-কল্যাণ সেন বরাট। প্রথম অভিনয় হলো ১৯ জুন, ১৯৮৮ রবিবার, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা। মোট অভিনয় হয়েছিল ৪০০ বার। অভিনয় করেছিলেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়, প্রেমাংশু বোস, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম গাঙ্গুলি, নিমু ভৌমিক, বাসবী নন্দী, গীতা দে, নন্দিনী মালিয়া।

রবীন্দ্রনাথের ‘নৌকাডুবি’ অবলম্বনে ‘কি বিভ্রাট’ নাটকের প্রথম অভিনয় হলো ১৫ এপ্রিল, ১৯৯০ রবিবার, বেলা ৩টা। নাটকটি লিখলেন গণেশ মুখখাপাধ্যায়। পরিচালনাও তাঁরই। সঙ্গীত কল্যাণ সেন বরাট। সেই সময়ে এই মজার নাটক চলেছিল খুব ভালোই। টানা প্রায় ৮০০ রজনী। অভিনয়ে—অনুপকুমার, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক চট্টোপাধ্যায়, অরিন্দম গাঙ্গুলি, নিমু ভৌমিক, গীতা দে, অলকা গাঙ্গুলি, রত্না ঘোষাল প্রমুখ।

এরপরে ‘মোসাহেব’ নাটক অভিনীত হলো রঙ্গনায়। প্রথম অভিনয় হলো ১৪ এপ্রিল, ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে, বুধবার ৩টায়। কাহিনী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের। নাট্যরূপ ও পরিচালনা—গণেশ মুখখাপাধ্যায়। সঙ্গীত কল্যাণ সেন বরাট। মোট অভিনয় হয়েছিল ৪৫৭ রজনী। অভিনয়ে চিন্ময় রায়, জর্জ বেকার, দেবরাজ রায়, নিমু ভৌমিক, গীতা দে, নয়না দাস, পাপিয়া অধিকারী প্রমুখ।

তারপরে ‘বাদশাহী চাল’। নাটকটি শৈলেশ গুহ নিয়োগীর লেখা। সম্পাদনা ও পরিচালনায় গণেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত কল্যাণ সেন বরাট। প্রথম অভিনয় হয়েছিল ১৯৯৫-এর ২ জানুয়ারি, রবিবার বেলা ৩টায়। অভিনয়ে ছিলেন নিমু ভৌমিক, চিন্ময় রায়, অরিন্দম গাঙ্গুলি, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, নয়না দাস, গীতা দে, শাশ্বতী রায়।

‘বিয়ের সানাই’ সম্পাদনা ও নির্দেশনা গণেশ মুখোপাধ্যায়। সঙ্গীত কল্যাণ সেন বরাট। প্রথম অভিনয় ১৫ আগস্ট, ১৯৯৬। অভিনয়ে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, চিন্ময় রায়, চৈতী ঘোষাল, ধীমান চক্রবর্তী, শাশ্বতী রায়।

১৯৯৮ থেকে রঙ্গনায় নাট্য প্রযোজনার দায়িত্ব নেয় ‘নিভা আর্টস’ নামে এক সংস্থা। তাদের প্রযোজনায় প্রথম অভিনীত হয় ‘পাকে চক্রে’। নির্দেশনা অশোক চ্যাটার্জী। সঙ্গীত দেবজিত। প্রথম অভিনয় ২৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮। অভিনয়ে জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সমীর মজুমদার, সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়।

তারপরে ‘জোয়ারভাটা’। নিভা আর্টসের প্রযোজনায়। প্রথম অভিনয় ১৪ অক্টোবর, ১৯৯৯। জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়ের উপদেশনায় এবং অশোক চ্যাটার্জীর পরিচালনায় নাটকটি অভিনীত হয়। অভিনয় করেন জ্ঞানেশ মুখোপাধ্যায়, সুনীল মুখোপাধ্যায়, সমীর মজুমদার, গীতা নাথ প্রমুখ।

রঙ্গনার সব নাটকের আলো ও মঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন হীরক মুখোপাধ্যায়।

এরপরে আবার দায়িত্ব গ্রহণ করেন গণেশ মুখোপাধ্যায়। তিনি নানাভাবে রঙ্গালয়টিকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কখনো নিজে প্রযোজনা করছেন, কখনো বা অন্য কোনো দলকে ডেকে এনে অভিনয়ের ব্যবস্থা করছেন। উত্তর কলকাতার প্রায় সব পেশাদারি থিয়েটার যখন একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, তখন নিরলস প্রচেষ্টায় এই ধরনের একটি থিয়েটার নিরবচ্ছিন্ন চালু রাখা নিঃসন্দেহে প্রশংসাহ।

২০০২-এর শারদীয় পূজার সময় গ্রুপ থিয়েটারের প্রখ্যাত তিনটি নাট্যদলকে নিয়ে এসে রঙ্গনায় প্রতি সপ্তাহে শনি, রবি ও বৃহস্পতিবার অভিনয়ের ব্যবস্থা করা হয়। দর্শক আনুকূল্যও জুটেছিল। কিন্তু কিছুদিন পরেই সে উদ্যোগ বন্ধ হয়ে যায়।

উপযুক্ত দৃশ্যপট এবং সুনিপুণ আলো ও সামঞ্জস্যপূর্ণ সাজসজ্জা রঙ্গনার অভিনয়ের গৌরবৃদ্ধি করেছে। ‘জয়জয়ন্তী’ নাটকে পেশাদারি মঞ্চে ‘লাইভ সঙ’-এর পুনঃপ্রবর্তন করা হয়। মঞ্চে লাইভ সঙ-এর ব্যবহার বাংলা ব্যবসায়িক থিয়েটার থেকে বিলুপ্ত হতে বসেছিল। আগে এর চল খুবই ছিল। রঙ্গনায় সেই ঐতিহ্য এখনো প্রবহমান।

উত্তর কলকাতার পেশাদারি তথা বাণিজ্যিক থিয়েটারের পরিমণ্ডলে ১৯৭০-৮০-র দশকে যে সমস্ত সস্তা চটকদারি সংস্কৃতির নামে যথেচ্ছাচারের প্রয়োগ চলছিল, রঙ্গনা তার মূর্ত প্রতিবাদ হিসেবে এইসব নাটক অভিনয় করে যেতে থাকে। সুস্থ সংস্কৃতি, নির্মল মজা, আনন্দ এবং নাটকীয় ঘটনায় পূর্ণ সব নাটকের অভিনয় দর্শকদেরও খুশি করেছে।

রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে রঙ্গনা থিয়েটারের অবদান

দীর্ঘ পঁচিশ বছরের বেশি সময় ধরে রঙ্গনা থিয়েটার নানা উত্থানপতনের মধ্যে দিয়ে সুস্থ সংস্কৃতি ও নির্মল নাট্য-ঐতিহ্যের ধারাকে সংগ্রামী দৃঢ়তায় রক্ষা করে চলেছে।

  • রঙ্গনার পঁচিশ বছরের ইতিহাসে দেখা যায়, সেখানে যেমন বিশুদ্ধ প্রমোদের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তেমনি বাণিজ্যসফল প্রযোজনার দিকেও নজর দিয়েছে। বাণিজ্য ও বিশুদ্ধ প্রমোদের চিরকালীন বিবাদ মিটিয়ে মঞ্চসফল নাটক করার চেষ্টা করেছে।
  • রঙ্গনা থিয়েটারেই গ্রুপ থিয়েটারের নান্দীকার গোষ্ঠী একাদিক্রমে পাঁচবছর ভিন্ন স্বাদের নাটক অভিনয় করে বাণিজ্যিক থিয়েটারের ধ্যানধারণাকে পাল্টে দিয়েছিল। বিদেশী নাটকের বঙ্গীকরণ এবং দৃপ্ত অভিনয় ও সুনিপুণ পরিচালনা যে ব্যবসায়িক মঞ্চেও সফলভাবে করা যায়, তার প্রমাণ নান্দীকার রঙ্গনায় করে দেখিয়েছিল।
  • তবুও বলা যায়, আধুনিক নাট্যভাবনা ও প্রযোজনা গ্রুপ থিয়েটারের মাধ্যমে যেভাবে প্রসারলাভ করে চলেছে, রঙ্গনায় নান্দীকার গোষ্ঠী যে বাতাবরণ গোড়াতেই তৈরি করে দিয়েছিল, রঙ্গনা সেই ধারা থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ও নান্দীকারের চেষ্টায় যে নবতম প্রচেষ্টা রঙ্গনায় শুরু হয়েছিল সেই ধারা রঙ্গনা কর্তৃপক্ষ বজায় রাখতে পারেনি।
  • এই সময়ে উত্তর কলকাতা অঞ্চলের পেশাদারি বাণিজ্যিক থিয়েটারের মধ্যে প্রবলভাবে যে ক্যাবারে নৃত্য তথা অশ্লীল অপসংস্কৃতির প্রসার ঘটে চলেছিল, রঙ্গনা অবশ্য তার থেকে সবসময় নিজেকে দূরে রেখে, বিশুদ্ধ প্রমোদ ও নাটকীয় উত্তেজনা ও সংঘাত বিতরণের চেষ্টা করেছে।
  • সমসাময়িক আধুনিক নাট্যভাবনার সঙ্গে কিন্তু রঙ্গনা কখনোই নিজেকে জড়িত করতে পারেনি।

এখনো রঙ্গনা কর্তৃপক্ষ কখনো নিজেরাই নাট্যাভিনয়ের প্রযোজনা করছেন, অথবা অন্য কোনো প্রযোজককে ভাড়া দিয়ে অভিনয় চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে চলেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!