রবীন্দ্রনাথের ওপর মহাভারতের প্রভাব আলোচনা কর।
মহাভারত ও রবীন্দ্রনাথ
মহাভারতের প্রতি রবীন্দ্রনাথের অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ ছিল। ভারতীয় জীবনের প্রতিনিধি এইমহাকাব্যের রসাস্বাদটিও ছিল সুগভীর। মহাভারতের কয়েকটি আখ্যানকেও তিনি নূতনভাবে রূপ দিয়েছেন। যেমন, ‘বিদায় অভিশাপ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’, ‘নরকবাস’ নাট্যকাব্য এবং ‘চিত্রাঙ্গদা’ নাটক। যদিও এইসব নাট্যকাব্যে মহাভারতীয় কথাকে নতুন যুগের আলোকে উপস্থাপিত করেছেন।
‘গান্ধারীর আবেদনে’র মূল কাহিনী রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করেছেন মহাভারতের সভা পর্বও উদ্যোগ পর্ব থেকে। সভা পর্বে দ্রৌপদীর লাঞ্ছনাচরমে উঠলে গান্ধারী বলেছিলেন—‘তস্মাদয়ং মদ্বচনাৎ ত্যজ্যতাং কুলপাংসনঃ।’ মহাভারতে গান্ধারী ধর্মভীরু নারী, ধর্মের পথিক। রবীন্দ্রনাথও এইনাট্যকাব্যে সেই আদর্শ রক্ষা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের গান্ধারী তাই বলেছেনত্যাগ করো এই বার।
‘কর্ণকুন্তীসংবাদে’ও রবীন্দ্রনাথ মহাভারতের উদ্যোগ পর্ব থেকে কাহিনী সংগ্রহ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের কর্ণও কুন্তী মহাভারতের অনুসারী। তবে রবীন্দ্রনাথের কর্ণ একটি বিষয়ে স্বতন্ত্র, তা তাঁর স্নেহবুভুক্ষা—
এসো স্নেহময়ী
তোমার দক্ষিণ হস্ত ললাটে চিবুকে
রাখো ক্ষণকাল।।
—কর্ণের এই দিকটি মূল মহাভারতে নেই।
বন পর্বের সোমক-ঋত্বিক কাহিনী অবলম্বনে ‘নরকবাস’ কবিতা রচনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। তবে মহাভারতের কাহিনীকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মহাভারতে আছে, ঋত্বিক একপুত্ৰক সোমক রাজাকে দিয়ে পুত্ৰমেধযজ্ঞ করিয়ে তাকে শতপুত্রের অধিকারী করে তোলেন। বৈধকর্মে হিংসার জন্য ঋত্বিক প্রত্যবায়ভাগী হয়ে নরকে গমন করেন এবং রাজা সোমক স্বর্গগমনের অধিকার লাভ করেন। কিন্তু রাজা ঔদার্যবশে নিজের পুণ্যফল ঋত্বিককে অর্পণ করে সমভাবে ঋত্বিকের সঙ্গে নরকভোগ করে একসঙ্গে গুরুর সঙ্গে মুক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ এই কাহিনীতে নরকের বর্ণনা দিয়েছেন নরকবাসী প্রেতদের মর্ত্যপ্রীতির কথা বলেছেন—যা মহাভারতে নেই। রবীন্দ্রনাথ মূল কাহিনীটিকে শাস্ত্রীয় ধর্মের দিক দিয়ে বিচার না করে একে মানবধর্মের দিক থেকে বিচার করেছেন।
সোমকের আত্মত্যাগের দৃষ্টান্ত মহাভারত ও কবিতায় অনবদ্য ভাবে চিত্রিত। যেমন, মহাভারতের বন পর্বে রয়েছে—
পুণ্যান ন কাময়ে লোকনৃতেহহং ব্রহ্মবাদিন।
ইচ্ছাম্যহমননৈব সহ বস্তুং সুরালয়ে।।
নরকে বা ধর্মরাজ কর্মর্ণাহস্য সমো হ্যহম্।
পুণ্যাপুণ্যং ফলং দেব সমমন্ত্ববয়ো রিদম্।।
রবীন্দ্রনাথের সোমক বলেছে—
যতকাল ঋত্বিকের আছে পাপভোগ
ততকাল তার সাথে কর মোর যোগ,
নরকের সহবাসে দাও অনুমতি।
‘চিত্রাঙ্গদা’ নাট্যকাব্যেও মহাভারতের প্রসঙ্গকে অভিনবরূপে উপস্থাপিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। মহাভারতে আছে, অর্জুন মণিপুর রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে মণিপুররাজের কাছে চিত্রাঙ্গদাকে প্রার্থনা করেন। মণিপুররাজের শর্ত অনুযায়ী চিত্রাঙ্গদাকে অর্জন গ্রহণ করেন ও তাদের ঔরসে চিত্রাঙ্গদার বভ্রুবাহন নামে এক পুত্র হয়। অর্জুন তিন বছর মণিপুরে থেকে সেখান থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। মহাভারতের এই কাহিনীপ্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে রবীন্দ্রনাথ তার চিত্রাঙ্গদা নাট্যকাব্যে রচনা করেছেন এক অপূর্ব প্রেমের বৃত। রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা একজন অসামান্য নারী, সর্বোপরি সে এক তত্ত্বের কাব্যরূপ। তাই বিদায় কালে অর্জুনকে চিত্রাঙ্গদা বলেছে—
আমি চিত্রাঙ্গদা।
দেবী নহি, নহি আমি সামান্যা রমণী।
সুতরাং রামায়ণের মতো মহাভারতেরও প্রভাব পড়েছে বাংলা সাহিত্যে। ভারতবষে ‘হৃদপদ্মসম্ভব’ ও ‘হৃদপদ্মবাসী’ এই দুই কাব্য ভারতীয় জীবন, সংস্কৃতি, সাহিত্য সব কিছুকে প্রভাবিত করেছে।
Leave a Reply