//
//

বাংলা গদ্যের ধ্রুপদী শিল্পী রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব আলোচনা কর।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

(১৮৬১-১৯৪১)

রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) প্রবন্ধ তাঁর জীবননিষ্ঠ মননের ভাষ্য। তিনি যেহেতু যুগপৎ কবি ও মনীষী সেজন্য তাঁর প্রবন্ধে প্রতিভার ভাবুকতা ও সুতীক্ষ্ণ মননশক্তির পরিচয় প্রকাশিত হয়েছে৷ রবীন্দ্র-প্রবন্ধ তথ্য ও তত্ত্বে সুসংবদ্ধ ও সুশৃঙ্খল, যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষণের তীক্ষ্ণতায় সমৃদ্ধ। এই কারণেই প্রচলিত প্রবন্ধের ধারা থেকে তাঁর প্রবন্ধ স্বতন্ত্র। তাঁর প্রবন্ধের বিষয়বৈচিত্র্যও যথেষ্ট—তা আকৃতিতে যেমন বিশাল, রচনারীতিতে তেমনই বৈচিত্র্যময়। শিল্প ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক চিন্তা, সমাজ-সংস্কার সম্পর্কিত সমস্যা, বিজ্ঞান, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, শিক্ষা প্রভৃতি সমস্ত বিষয়ই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধকে সমৃদ্ধ করেছে। তাছাড়া পত্র, স্মৃতিচিত্র, ডায়েরী প্রভৃতি আত্মনিষ্ঠ রচনাও তাঁর প্রবন্ধকে বিশেষ মর্যাদা দিয়েছে। এমনকি সাহিত্যতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্বের মত বিষয়ও তাঁর প্রবন্ধে স্থান পেয়েছে।

আলোচনার সুবিধার জন্য তাঁর প্রবন্ধগুলিকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—১) আর্থ-রাজনৈতিক প্রবন্ধ, (২) সমাজ ও সামাজিক সমস্যামূলক প্রবন্ধ—(ক)প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের বৈষম্য, (খ) সাম্রাজ্যবাদী নীতির রূপ, (গ) প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন; (৩) স্বদেশচিন্তা বিষয়ক, (৪) শিক্ষাচিন্তা বিষয়ক, (৫) ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক, (৬) ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক, (৭) সাহিত্য সমালোচনা বিষয়ক—(ক) প্রাচীন সাহিত্যের সমালোচনা, (খ) প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা, (গ) আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিষয়ক সমালোচনা, (ঘ) লোকসাহিত্য; (৮) সাহিত্যতত্ত্ব বিষয়ক, (৯) ব্যক্তিগত প্রবন্ধ—(ক) আত্মকথা, (খ) চিঠিপত্র, (গ) জীবনস্মৃতি, (ঘ) ডায়েরি, (ঙ) ভ্রমণ কাহিনি; (১০) বিবিধ বিষয়ক।

আর্থ-রাজনৈতিক প্রবন্ধ

রবীন্দ্রনাথ ছিলেন যুগসচেতন ব্যক্তিত্ব। সে ব্যক্তিত্ব জমিদারনন্দন রবীন্দ্রনাথের নয়, তা সর্বকালের সর্বমানবের জন্য নিবেদিতপ্রাণ এক ব্যক্তিমানবের। কোন সংকীর্ণ রীতিনীতি বা সংস্কার-এর বন্ধন তাঁকে তাঁর নিজস্ব শ্রেণীস্বার্থে বেষ্টন করে রাখতে পারেনি; মানুষের কল্যাণবোধে, মনুষ্যত্বের জাগরণে, মানবের আত্মপ্রতিষ্ঠায় তাকে নিয়োজিত করেছে যার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর প্রবন্ধে। তিনি শুধু সাহিত্য সমালোচনায় নিজেকে ব্যাপৃত রাখেননি, সমকালীন রাষ্ট্রিক ও সামাজিক জীবন নিয়েও চিন্তাভাবনা করেছেন ও স্বতন্ত্র সিদ্ধান্তের উপস্থাপন করেছে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে রচিত প্রবন্ধগুলি আর্থ-রাজনৈতিক প্রবন্ধ হিসাবে উল্লেখযোগ্য। এই সময়ের প্রবন্ধের বিষয়গুলি হল—

(ক) বঙ্গভঙ্গ ও হিন্দু-মুসলমান বিভেদ; যেমন—‘ব্যাধি ও প্রতিকার’, ‘সমস্যা’।

(খ) কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও কলহ এবং নরমপন্থী ও চরমপন্থীদের ক্রিয়াপ; যেমন—‘যজ্ঞভঙ্গ’, ‘মাভৈঃ’।

(গ) স্বদেশী গ্রহণ ও বিদেশী বর্জন এবং তার ফলাফল; যেমন—‘সদুপায়’, ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’।

(ঘ) সন্ত্রাসবাদের বিভীষিকা ও তার প্রতিক্রিয়া; যেমন—‘পথ ও পাথেয়’, ‘দেশহিত’।

(ঙ) ইংরেজের অনুগ্রহ প্রত্যাখ্যান ও আবেদন-নিবেদনের নীতি পরিহার; যেমন—‘ব্যাধি ও প্রতিকার’, ‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’।

(চ) নারীদের ও ছাত্রদের স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণের আহ্বান; যেমন—‘ব্রতধারণ’।

(ছ) জাতির দুর্বলতা ও তার প্রতিক্রিয়া; যেমন—‘দেশীয় রাজ্য’, ‘নকলের নাকাল’।

(জ) পল্লীসংগঠন, জনসেবা, স্বায়ত্তশাসন ও পল্লীপঞ্চায়েত গঠন প্রভৃতি গঠনমূলক পরিকল্পনা; যেমন—‘স্বদেশী সমাজ’।

(ঝ) দেশবাসীকে আত্মশক্তিতে উজ্জীবনের প্রয়াস ও অর্থনৈতিক স্বাবলম্বন; যেমন—‘অবস্থা ও ব্যবস্থা’।

(ঞ) সামন্ততান্ত্রিক জমিদারী ব্যবস্থার সমালোচনা ও নিপীড়িত জনগণের প্রতি সহানুভূতি; যেমন—‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’।

(ট) ইংরেজের শোষণ, অত্যাচার ও দমননীতির প্রতিবাদ ও দেশবাসীকে নির্ভীক মৃত্যু বরণের আহ্বান; যেমন—‘রাজকুটুম্ব’, ‘রাষ্ট্রনীতি ও ধর্মনীতি’।

সমাজ ও সামাজিক সমস্যামূলক প্রবন্ধ

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য আদর্শের বৈষম্য

রবীন্দ্রনাথ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের আদর্শের পার্থক্য তুলে ধরেছেন, ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’, ‘সমাজভেদ’, ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’, ব্রাহ্মণ’, ‘চীনেম্যানের চিঠি’, ‘পূর্ব ও পশ্চিম প্রভৃতি প্রবন্ধে। তিনি এইসব প্রবন্ধে একদিকে যেমন প্রাচ্য আদর্শের ঐতিহ্য ও কুসংস্কারকে তুলে ধরেছেন অন্যদিকে তেমন পাশ্চাত্য আদর্শের উগ্র স্বার্থপরতাকে নিন্দা করেছেন। পরাধীন ভারতবাসীর স্বাদেশিকতা ও স্বাধীনতার প্রশ্ন ছিল ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর যুগসন্ধিক্ষণে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন এবং তার সঙ্গে জড়িত ছিল এদেশে বুর্জোয়া শিল্পায়ন ও সামাজিক আবর্তনের দিক। সেই সঙ্গে বেশিরভাগ ভারতবাসীর আকাঙ্ক্ষা ছিল মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক সমাজের অবসান ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীর শাসন ও শোষণের অপসারণ, কিন্তু এই আকাঙ্ক্ষা সবার ক্ষেত্রে সমান না হওয়ায় জটিলতার রূপ ধারণ করে। তাই স্বাদেশিকতাই যাদের একমাত্র ধ্যান তারা জাত্যাভিমানের বশে দেশের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বহু সমাজবিধি ও ধ্যানধারণাকে মনে করতেন ‘ভারতীয় ঐতিহ্য’ বলে। আবার বুর্জোয়া আধুনিকতার ভাবধারায় যাঁরা আগ্রহশীল তাঁদের অনেকে ব্রিটিশ শাসনকেই মনে করতেন আধুনিকতার পরিপোষক। রবীন্দ্রনাথ তাই এই দুই সভ্যতার আসল স্বরূপ প্রকাশ করে দেখালেন ভারতীয় ঐতিহ্য ও পাশ্চাত্য ভাবধারার মধ্যে পার্থক্য কোথায়। ভারতের সামগ্রিক সাধনার মধ্যে যে ঐক্যসূত্র রয়েছে তার প্রকাশের মাধ্যমে সেদিন ভারতবাসীর ঐতিহ্য ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের সমাধান করতে চেয়েছিলেন, প্রান্ত ও অন্ধ পথিককে আলো দেখানোর মতই জাতিকে সেদিন শুনিয়েছিলেন ভারতীয় ঐতিহ্যের আসল মর্মবাণী। সেদিক থেকে তার উপরিউক্ত প্রবন্ধগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

সাম্রাজ্যবাদী নীতির রূপ

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষপাদ থেকে রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছিলেন বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির এক নিষ্ঠুর নির্মম খেলা। এই সময়ে বৃহৎ শক্তিধর দেশগুলি পৃথিবীব্যাপী তাদের শোষণ জাল বিস্তার করে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই শুরু হয় সংগ্রামের পথ—যা রবীন্দ্রনাথকে চিন্তায় ফেলেছিল। পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার এই সংঘাতের বিরুদ্ধে এর ভবিষ্যৎ কী সে সম্পর্কে ‘প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতা’ ‘ইম্পিরিয়ালিজ’, ‘চীনেম্যানের চিঠি’, ‘ধর্মবোধের দৃষ্টান্ত’, ‘নববর্ষ’, ‘সমাজভেদ’, ‘ব্রাহ্মণ’ প্রভৃতি প্রবন্ধে আলোচনা করলেন।

প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবন

রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদী সভ্যতার লালসা ও স্বার্থবোধকে দূর করার জন্য প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের পুনরুজ্জীবন কামনা করেছিলেন। তিনি বুঝেছিলেন লোভ-লালসা, রিপুর তাড়না মানুষের শুভবোধকে বিনষ্ট করে, তার আসল স্বরূপকে করে বিকৃত। তাই প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের ত্যাগ-তিতিক্ষা নিবৃত্তিময় জীবনের আদর্শকে, বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যের সাধনাকে রবীন্দ্রনাথ অনুসরণ করতে বলেছেন। তিনি  প্রাচীন ভারতীয় আদর্শের শ্রেয়ধর্মকে গ্রহণ করার কথাই পরামর্শ দিলেন—‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’, ‘নববর্ষ’, ‘তপোবন’, ‘ব্রাহ্মণ’, ‘ততঃ কিম’ প্রভৃতি প্রবন্ধে। এছাড়া ‘আত্মশক্তি’ (১৯০৫), ‘কালান্তর’ (১৯৩৭), ‘সভ্যতার সংকট’ (১৯৪১), ‘আত্মপরিচয়’ (১৯৪৩) প্রবন্ধে তিনি সমকালীন সমাজ, সংস্কৃতি ও সভ্যতা নিয়ে আলোচনা করেছেন।

স্বদেশচিন্তামূলক প্রবন্ধ

স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বমুহূর্তে যখন সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিকগণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস ঘেঁটে জাতীয় বীরত্ব ও শৌর্যময় চরিত্র ও কাহিনি অনুসন্ধান করছিলেন, রবীন্দ্রনাথ সেই সময় উগ্র জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগের সাধু সন্তগণ পর্যন্ত ভারতবর্ষের এই দীর্ঘ ঐতিহ্যধারায় ঐক্য ও মিলনমূলক ধর্ম ও আধ্যাত্মসাধনার অন্বেষণে ব্যাপৃত হলেন। ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (ভাদ্র-১৩০৯) প্রবন্ধে তিনি ভারতবর্ষের মূল সুরটিকে অনুধাবন করতে বললেন। কারণ ইওরোপের সাম্রাজ্যবাদী লোলুপতা, মিথ্যা স্বাজাত্য, অহমিকা ও পরজাতিবিদ্বেষ মানবতার পরিপন্থী এবং তা ভারতীয় ঐতিহ্যেরও প্রতিবন্ধক।

শিক্ষাচিন্তামূলক প্রবন্ধ

পরাধীন ভারতে শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল মূলত কেরাণী তৈরির যন্ত্র। ইংরেজি শিক্ষা লাভ করলে চাকরি জুটবে—এজন্যই মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা ইংরেজি শিখতো। ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে পাশ্চাত্য ভাবনা-চিন্তার সংস্পর্শে এলে ভারতীয়রা যে অনেক উন্নত হয়ে উঠতে পারবে, কুসংস্কারমুক্ত যুক্তিধর্মী ও বাস্তববাদী হতে পারবে—এক কথায় আধুনিক হতে পারবে, উনিশ শতকের প্রথমার্ধে এ দেশের ইংরেজি শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের এই ছিল চিন্তা-ভাবনা। সাধারণ মধ্যবিত্তরা অর্থের খাতিরে যখন এই শিক্ষাব্যবস্থার দিকে ঝুঁকল তখন ইংরেজ সরকার সেই আকর্ষণকে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করল। শিক্ষাক্ষেত্রে শাসক সম্প্রদায়ের এই স্বার্থসিদ্ধির মুখোশ খুলে দিতে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে যাঁরা অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ, রবীন্দ্রনাথ, নিবেদিতা, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা চেয়েছিলেন শিক্ষাকে জাতীয় পটভূমিতে স্থাপন করতে।

বিংশ শতকের শুরু থেকেই জাতীয় শিক্ষার রূপকে বাস্তবে রূপদান করলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রাচীন ভারতের আদর্শ ও সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্রহ্মবিদ্যালয়’ (১৯০২ খ্রিঃ)।  রবীন্দ্রনাথ স্বদেশী আন্দোলনের সময় দেশবাসীকে বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে দেশের বিদ্যাশিক্ষার ভার নিজেদেরকেই গ্রহণ করতে হবে। কারণ আমাদের শিক্ষাসমস্যা মূলত দ্বিবিধ। প্রথমত আমাদের শিক্ষার অবাস্তবতা ও অপূর্ণতা, দ্বিতীয়ত শিক্ষাবিস্তারের অভাব। যে শিক্ষানীতি এতদিন যাবৎ আমাদের দেশে অনুসৃত হয়ে আসছে, তার লক্ষ্যগত সংকীর্ণতার ফলেই এই দ্বিবিধ ত্রুটির উদ্ভব হয়েছে। সেজন্য আমাদের দেশের শিক্ষানীতি অন্য সভ্যদেশের শিক্ষানীতি অপেক্ষা স্বতন্ত্র।

বলাবাহুল্য রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাচিন্তার প্রাসঙ্গিকতা আজও হারায় নি। বিশেষ করে পরাধীন ভারতে শিক্ষার যে আদর্শ তিনি সেদিন স্থাপন করেছিলেন তা সবারই শ্রদ্ধা। আকর্ষণ করেছিল। সেদিক থেকে তার শিক্ষাচিন্তার একটি বিশেষ মূল্য রয়েছে। তার শিক্ষাচিন্তার স্বরূপ উপলব্ধি করতে হলে শিক্ষামূলক প্রবন্ধগুলিই সাহায্য করবে যা এই বিষয়ক গ্রন্থ ‘শিক্ষা’ ১৯০৮-এ প্রকাশিত হয়।

ধর্ম ও দর্শন বিষয়ক প্রবন্ধ

ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে আমাদের দেশে ধর্মীয় চিন্তা-ভাবনার বিকাশ হচ্ছিল। তখন জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ধর্মের মোড়কে নতুন রূপ নিয়েছিল। ব্রাহ্ম সমাজ, আর্যসমাজ, থিওসফিক্যাল সোসাইটি, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের ধর্মর্সমন্বয়ের আদর্শ প্রভৃতির মাধ্যমে ধর্মীয় চিন্তাভাবনায় এক ঝড় উঠেছিল। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের প্রগতিবাদিতা, ইংরেজি শিক্ষার ফলে এদেশের হিন্দুধর্মের রক্ষণশীলতা সম্পর্কে মানুষের সংশয়ও জেগেছিল। উদ্ভব হয়েছিল নব্যহিন্দুদের মননধর্মী আন্দোলন। হিন্দুধর্মের এই সংকটের মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ ধর্মের নতুন ব্যাখ্যা দিলেন। ভারতীয় জীবনের তথা হিন্দু সমাজের মূল লক্ষ্য কি তা তিনি এই সূত্রে আমাদের জানালেন। তাঁর ধর্মভাবনা হল মানবধর্মের। তাই মনুষ্যত্বের অবমাননা যেখানে তিনি লক্ষ করেছেন সে ব্রাহ্মই হোক, আর হিন্দু-ই হোক—তার সমালোচনা করতে তিনি দ্বিধা করে নি। একদিকে হিন্দু সমাজের রক্ষণশীলতা, কুসংস্কার ও অবক্ষয় অন্যদিকে ব্রাহ্মসমাজে বাড়াবাড়ি—এ সব কিছুই ছিল তাঁর সমালোচনার বিষয়। তাঁর এই শ্রেণির প্রবন্ধগ্রন্থ হল ‘ধর্ম’ (১৯০৯), ‘মানুষের ধর্ম’, ‘বিশ্ব পরিচয়’ (১৯৩৭), ‘আশ্রমের রূপ ও বিকাশ’ (১৯৪১), ‘বিশ্বভারতী’ (১৯৩৩), ‘বিশ্ব পরিচয়’ (১৯৫১) ইত্যাদি।

ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রবন্ধ

ভারতবর্ষের ইতিহাস সমাজ ও সংস্কৃতির আলোচনায় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্ব প্রকাশ পেয়েছে। প্রাচীন যুগ থেকে ভারতবর্ষ বহু জাতি এবং বহু সভ্যতার মিলন ক্ষেত্র। বহু মানুষের ভাবের ধারা ও সাধনার ধারা এখানে এসে মিলিত হয়েছে। জাতি বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে এসেছে, যুদ্ধ করেছে, প্রেমের সম্বন্ধ স্থাপন অনেছে। বহুর মধ্যে একের উপলব্ধিই ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রধান কথা। রবীন্দ্রনাথ ‘ভারতবর্ষ’ প্রবন্ধে লিখেছেন— “ভারতবর্ষের মন যে নিজের অতীত ও ভবিষ্যৎকে কোনো ঐক্যসূত্রে গ্রথিত করে নাই তাহা স্বীকার করতে পারি না। সে সূত্র সচ্ছ, কিন্তু তাহার প্রভাব সামান্য নহে; তাহা স্থূলভাবে গোছের নহে, কিন্তু তাহা আজ পর্যন্ত আমাদিগকে বিচ্ছিন্ন বিক্ষিপ্ত হইতে দেয় নাই। সর্বত্র যে বৈচিত্র্যহীন সাম্য স্থাপন করিয়াছে তাহা নহে, কিন্তু সমস্ত বৈষম্য ও বৈচিত্র্যের ভিতরে একটি মূলগত অপ্রত্যক্ষ যোগসূত্র রাখিয়া দিয়াছে।’’

সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ

প্রাচীন ভারতীয় জীবনের প্রতি কবির আসক্তির কারণ বোধ হয় পাশ্চাত্য সাহাজ্যবাদী সভ্যতার পৈশাচিকতা, অর্থগৃধ্নতা, যা মানুষকে, মানুষের শুভবুদ্ধিকে, কল্যাণময়তাকে নষ্ট করে দিচ্ছে, মানুষে মানুষে সৃষ্টি করছে বিভেদ, জাতিবৈরিতা ও সাম্প্রদায়িকতা। তাই তিনি এ অবস্থায় ভারতীয় জীবনের প্রাচীন মূল্যবোধকে, তার জীবনাদর্শকে সে সময়ের উপযোগী করে গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ‘সমালোচনা’ (১৯৮৮), ‘প্রাচীন সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘আধুনিক সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘লোকসাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬), সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) প্রভৃতি তাঁর সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ গ্রন্থ।

সাহিত্যতত্ত্ববিষয়ক প্রবন্ধ

‘সাহিত্য’ (১৯০৭), ‘সাহিত্যের পথে’ (১৯৩৬), ‘সাহিত্যের স্বরূপ’ (১৯৪৩) গ্রন্থত্রয়ে রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তা-বিষয়ক প্রবন্ধগুলি স্থান পেয়েছে। তাঁর সাহিত্যসৃষ্টি যেমন বিপুল সাহিত্য চিন্তাও তেমনই বিচিত্র। এইসমস্ত প্রবন্ধগুলিতে সাহিত্যের সংজ্ঞা, সাহিত্যের বিষয়, সাহিত্যের সৌন্দর্যবোধ, সাহিত্যের বিচারপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক।

ব্যক্তিগত প্রবন্ধ

শুধু মননশীল এবং তত্ত্বমূলক প্রবন্ধ ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত প্রবন্ধ রচনা করেছে। এর মধ্যে জীবনস্মৃতি, ডায়েরি, ভ্রমণকাহিনি, চিঠি-পত্র প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। ব্যক্তিগত প্রবন্ধের উৎকৃষ্ট নিদর্শন হল ‘পঞ্চভূত’ (১৮৯৭), ‘বিচিত্র প্রবন্ধ (১৯০৭)। এই গ্রন্থে ব্যক্তিগত অনুভূতি কাব্যময় রূপ লাভ করায় তা যেন গদ্যকাব্যের রূপ লাভ করেছে। তাঁর ‘ছিন্নপত্র’ ও অন্যান্য চিঠিপত্র ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথের স্বরূপকে চিনিয়ে দেয়। ছিন্নপত্র তো রবীন্দ্রগল্পের সাজঘর। ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘সমাপ্তি’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ প্রভৃতি গল্পের পটভূমি ছিন্নপত্র থেকে জানা যায়। ‘ছিন্নপত্রাবলী’ প্রকাশিত হয় ১৯৬০-এ। ‘ছেলেবেলা’ (১৯৪০), জীবনস্মৃতি’ (১৯১২) তাঁর ব্যক্তি জীবনের বহু ঘটনার নিদর্শন। ‘য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারী’ (১ম-১৮৯১, ২য়-১৮৯৩), ‘জাপানযাত্রী’ (১৯১৯), ‘রাশিয়ার চিঠি’, ‘পথের সঞ্চয়’ প্রভৃতি শুধু ডায়েরি বা ভ্রমণকাহিনি নয়। এগুলি আবার বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবনের দলিল স্বরূপ।

বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ

উপরিউক্ত বিষয় ছাড়া রবীন্দ্রনাথ আরো বহু শ্রেণির প্রবন্ধ লিখেছেন। যেমন— বিজ্ঞান, সমবায়, পঞ্চায়েত, কৃষি, সৃষ্টিতত্ত্ব, ভাষাতত্ত্ব, ব্যাকরণ, ছন্দ প্রভৃতি। তাঁর অন্যান্য প্রবন্ধগ্রন্থ ‘চারিত্রপূজা’ (১৯০৭), ‘পশ্চিম-যাত্রীর ডায়ারী’ (১৯২৯), ‘ভানুসিংহের পত্রাবলী’ (১৯৩০), ‘ভারতপথিক রামমোহন রায়’ (১৯৩৩), ‘জাপানযাত্রী’ (১৩২৬), ‘ভারতবর্ষ’ (১৯০৬), ‘মহাত্মা গান্ধী’ (১৯৪৮), ‘রাজাপ্রজা’ (১৯০৮), ‘রাশিয়ার চিঠি’ (১৯৩১), ‘সমবায়নীতি’ (১৯৫৪), ‘পথে ও পথের প্রান্তে’ (১৩৪৫), ‘আত্মপরিচয়’ (১৯৪৩) ইত্যাদি।

প্রাবন্ধিক রবীন্দ্রনাথের কৃতিত্ব

শুধু বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে নয়, আঙ্গিকগত ঔজ্জ্বল্যেও রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ স্বতন্ত্র। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্রের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথে এসে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা প্রবন্ধের যে গদ্যরীতির স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তার প্রভাব রবীন্দ্রনাথের প্রথম দিককার প্রবন্ধে থাকলেও রবীন্দ্রনাথ নিজ প্রতিভাবলে বাংলা প্রবন্ধে গদ্যরীতির যে মৌলিকতার প্রবর্তন করলেন তাতে তাঁর প্রবন্ধ সাহিত্য সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

তাঁর প্রবন্ধের গদ্যরীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল তা ভাবের গদ্য, জ্ঞানের গদ্য নয়। তিনি ঘন ঘন ভাষা ও রীতির পরিবর্তন করেছিলেন বলেই তাঁর গদ্যের ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। গদ্যের এই ঔজ্জ্বল্য ব্যক্তিত্বের স্পর্শজনিত। তাঁর রীতি যেমন বস্তুধর্মী, ভাষাও তেমনই প্রাণময়। ফলে তাঁর শিল্পীজনোচিত রসস্নিগ্ধ, মধুর ও মোহময় ভাষা পাঠককে আকর্ষণ করে। শব্দচয়নের মুন্সিয়ানায়, শব্দ সংস্থাপনের অভিনব কৌশলে, নব প্রকাশের সংযমে, ভাষার স্বরবৈচিত্র্য ও মাধুর্যে রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের রীতি হয়ে উঠেছে রমণীয়। তাই রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের প্রকৃতি নির্ণয় করতে গিয়ে অতুলচন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন— ‘‘বরীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ মহাকবির হাতের প্রবন্ধ। সাহিত্যের সমালোচনায়, কী রাষ্ট্র ও সামাজিক সমস্যার আলোচনায়, বাংলা কবিতার ছন্দবিচারে, কী বাংলা ব্যাকরণের রীতি ও শব্দতত্ত্বের স্বরূপ উদ্ঘাটনে—সর্বত্র মহাকবির মনের ছাপ, সর্বত্র মহাকবির বাগবৈভব। বিচারে যুক্তির মধ্যে এল উপমা। বিষয়ের সঙ্গে বিষয়ান্তরের স্পর্শে অদ্ভুত ঐক্যের আলোর চমক পথ আলো করে দিল।”  

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!