বাংলা নাটকের ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান আলোচনা কর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ (১৮৬১-১৯৪১) মূলত কবি হলেও নাট্যকার হিসাবে তাঁর খ্যাতি বিশ্বব্যাপী। তাঁর নাটকে সাধারণ মানুষ ভীড় করে আছে। বিশেষ করে রূপক-সাংকেতিক নাটকে তাঁর কৃতিত্ব অবিসংবাদিত। নাটক নিয়ে তিনি নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। কবিপ্রতিভা ও নাট্যপ্রতিভা এই দুয়ের সম্পর্ক অসম। তবুও গীতিকবি হয়েও রবীন্দ্রনাথ একজন অসাধারণ নাট্যকার— এই উদাহরণ বাংলা সাহিত্যে নেই বললেই চলে। আলোচনার সুবিধার্তে রবীন্দ্রনাথের নাটককে পাঁচভাগে ভাগ করা চলে— (১) কাব্যনাট্য, নাট্যকাব্য, গীতিনাট্য (২) নিয়মানুগ নাটক (৩) রঙ্গনাট্য; (৪) সামাজিক নাটক ও (৫) রূপক ও সাংকেতিক নাটক।
কাব্যনাট্য, নাট্যকাব্য, গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য
প্রথম বয়সে লেখা রবীন্দ্রনাথের অনেকগুলি কাব্যনাট্য ও গীতিনাট্য যাতে লিরিক আবেগ, নাটকীয় ঘটনার বিকাশ এবং গীতিধর্ম মিলে রস সৃষ্টি করেছিল। কৈশোর ও যৌবনের ‘রুদ্রচণ্ড’ এবং ‘বাল্মীকি প্রতিভা’, ‘মায়ার খেলা’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ এবং পরিপক্ব জীবনে ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘বিদায় অভিশাপ, ‘কাহিনী’—এ সমস্ত কখনও নাট্যধর্মী কাব্য, কখনও কাব্যধর্মী নাটক, কখনও বা গীতিনাট্য। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ ও ‘মায়ার খেলা’ বিশুদ্ধ গীতিনাট্য, নাটকের আকারে সঙ্গীত পরিবেশনই এর মূল লক্ষ্য। ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ নাটকে নিজের বাড়িতে তিনি প্রথম বাল্মীকির ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। নাটকটি তিনিই পরিচালনা করেন। নাটকটির বিষয়বস্তু রামায়ণের সুপ্রসিদ্ধ বাল্মীকির কবিত্বলাভের ঘটনা থেকে নেওয়া হয়েছে। এতে বিহারীলালের সারদামঙ্গলে’রও প্রভাব আছে। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের মধ্যে ‘চিত্রাঙ্গদা’ সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ এই কাব্যনাট্যের ঘটনাবস্তু, চরিত্র, বিচিত্র বিষয়, অপূর্ব কাব্যসৌন্দর্য ইত্যাদি রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ কলাকৃতি উল্লেখের দাবি রাখে। ‘চণ্ডালিকা’ ও ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্য। শ্যামা’র কাহিনি মহাবস্তু থেকে নেওয়া।
নিয়মানুগ নাটক
‘রাজা ও রাণী’ (১৮৮৯) রবীন্দ্রনাথের প্রথম ও পরিচিত প্রথায় লেখা পঞ্চাঙ্ক নাটক। রবীন্দ্রনাথ নিজের বাড়ীতে ‘রাজা ও রাণী’ নাটকের প্রথম অভিনয় করেন ১৮৮৯ সালে। রবীন্দ্রনাথ বিক্রমদেবের অভিনয় করেন। পূর্ণ অভিনেতারূপে রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তি প্রকাশ এই নাটকে প্রথম দেখা যায়। সমকালীন এমারেল্ড থিয়েটারের নট-নটীরা গোপনে এসে এই অভিনয় দেখে তারাও ১৮৯০ সালের ৭ জুন এই নাটকের প্রথম অভিনয় করে। হৃদয়ের ধনকে দেহে আঁকড়ে ধরে রাখার বাসনা, সমগ্র মানব’কে পাবার দুর্বাসনা ও দুঃসাহস রাজা ও রাণীর ট্রাজেডির হেতু।
রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার প্রথম স্তরে কারুণ্যস্নেহের আলোকে হৃদয়ারণ্য থেকে নিষ্ক্রমণ সূচিত। দ্বিতীয় স্তরে কর্তব্যের সঙ্গে প্রেমের, রূপের সঙ্গে রসের, সংসারের সঙ্গে সত্যের সংঘর্ষ প্রতিফলিত। ‘রাজা ও রাণী’তে এই বিরোধের অবসান ঘটেছে আত্মবিসর্জনে। ‘বিসর্জন’ (১৮৯৫) নাটকে শুধু আত্মবিসর্জন আছে, কিন্তু শুধু তাতেই সমস্যার সমাধান মেলে না, তারও উপরে কঠোরতর ত্যাগের মধ্যে দিয়ে বিরোধের অবসান মিলেছে। ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এ যেমন ‘রাজা ও রাণী’তে তেমনই প্রেমের শান্তি সৌভ্রাত্রের ছায়ায় অপনোদিত। কিন্তু ‘বিসর্জন’-এ এবং ‘রাজর্ষি’তে শুষ্ক কর্তব্যের তৃষ্ণা বাৎসল্যের ধারাবর্ষণে মিটেছে। বিসর্জনের সমস্যা— “কেন প্রেম আপনার নাহি পায় পথ”। ‘রাজর্ষি’ উপন্যাসের মূল কাহিনিকে নাটকের ছকে লিখে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের একটি সুরুচিসঙ্গত ও অনবদ্য নাটক (বিসর্জন) সৃষ্টি করেছেন, যার অভিনয় মূল্য ও সাহিত্য মূল্য দুই-ই প্রশংসনীয়। প্রথা ও সংস্কারের সঙ্গে প্রেমের দ্বন্দ্ব এবং পরিশেষে প্রেমেরই জয়লাভ, এ নাটকের এই তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
‘বিসর্জন’ নাটকে নাট্যকার রঘুপতি ও গোবিন্দমাণিক্য দুই বিরোধী শক্তির দ্বন্দ্বকে রূপ দিয়েছেন। দয়ামায়াহীন রঘুপতিকে নিষ্ঠুর প্রথাসংস্কারের প্রতিভূ এবং গোবিন্দমাণিক্যকে প্রাণের ও প্রেমের প্রতীকরূপে তুলে ধরেছেন। রঘুপতিকে শেষ পর্যন্ত তাঁর পুত্ৰতুল্য জয়সিংহকে হারাতে হল, বন্ধ করতে হল মন্দিরের বহুদিনের বলিদানের প্রথাকে। জয়সিংহের আত্মবিসর্জনে সত্যের প্রতিষ্ঠা হল। এই বিসর্জন রঘুপতির পরিণতিকে করে তুলেছে ট্রাজিক।
‘মুকুট’ এবং প্রায়শ্চিত্ত প্রায় এক ধরনের নাটক। বোলপুরে আশ্রম বালকদের জন্য রচিত ‘মুকুট’ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নাটক নয়—ত্রিপুরার রাজবাড়ীর সিংহাসনাদির দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় কবি এর মধ্যে বালক মনের উপযোগী মহান আত্মত্যাগের কাহিনি লিখেছেন। ‘প্রায়শ্চিত্ত’ তাঁর প্রথম দিকের উপন্যাস ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’-এর কাহিনি অবলম্বনে রচিত। এর নাট্যমূল্য উচ্চস্তরের না হলেও উগ্র বীরত্ব ও জাতিপ্রেমের সর্বনাশা ভয়ালরূপ প্রতাপাদিত্যের চরিত্রের মধ্য দিয়ে চমৎকার ফুটেছে। পরে তত্ত্বনাট্যযুগে ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ভেঙে তিনি ‘পরিত্রাণ রচনা করেন।
‘বিসর্জন’-এর সঙ্গে ‘মালিনী’ নাটকের কিছু মিল আছে। মালিনীর সঙ্গে অপর্ণার এবং সুপ্রিয়-ক্ষেমঙ্করের সঙ্গে জয়সিংহ-রঘুপতির ভাবগত ঐক্য আছে। কাহিনি গঠনে ঋজুতা ও দৃঢ়তা অত্যন্ত স্পষ্ট। ক্ষেমঙ্করের আসল ট্রাজেডি রঘুপতির মতো, ভালোবাসা হারানোর আশঙ্কা। বন্ধুর সঙ্গে প্রথম বিচ্ছেদক্ষণে এই আশঙ্কাই তার মনে জেগেছিল। মালিনীর ইংরেজি অনুবাদ পড়ে কোন বিদগ্ধ ইংরেজ কবি এতে গ্রীক নাট্যকলার প্রতিরূপ দেখেছিলেন। গ্রীক নাটকের মতোই মালিনীর নাট্যরূপ সংযত, সংহত এবং দেশকালের ধারায় অবিচ্ছিন্ন। গ্রীক ট্রাজেডির মতোই অভাবনীয়, অনিবার্য উপসংহার।
রঙ্গনাট্য
গীতিকবিদের প্রধান অবলম্বন কল্পনা ও আবেগ, কিন্তু হাস্যরসের বা কৌতুকের জ্ঞাতিশত্রু হচ্ছে আবেগ। বরং আবেগের বাড়াবাড়িই অনেক সময়ে হাস্যরসের প্রধান উপাদান। তাই শ্রেষ্ঠ গীতিকবিরা প্রায়শই হাস্য ও কৌতুকরসের রঙ্গপ্রহসন ততটা জমাতে পারেন না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মতো বিচিত্র প্রতিভাধর কবিব্যক্তিত্বের পক্ষে সবই সম্ভব। তাঁর ‘গোড়ায় গলদ’ (১৯২৮ সালে ‘শেষরক্ষা’ নামে পুরোপুরি নাটকীয় আকারে অভিনয়যোগ্য সংস্করণরূপে প্রকাশিত), “বৈকুণ্ঠের খাতা’, ‘হাস্যকৌতুক’, ব্যঙ্গকৌতুক’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘প্রজাপতির নির্বন্ধ’ নামে গদ্যকাহিনি রূপে প্রচারিত। এগুলি শ্রেষ্ঠ রঙ্গ নাট্য ও প্রসন্ন কমেডিরূপে বাংলা সাহিত্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে।
‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ বা ছোট কৌতুক নাটিকাগুলির বাগ্বৈদগ্ধ্য বিস্ময়কর, উইটের ব্যাপকতাও কম বৈচিত্র্যময় নয়। কিন্তু ঘটনা গ্রন্থনে বিশেষ কোন নিপুণতার পরিচয় নেই। তবে স্ত্রীভূমিকাবর্জিত ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’র সরল কৌতুকের সঙ্গে একটা স্নিগ্ধমধুর করুণরসের প্রচ্ছন্ন প্রভাব আছে বলে এর একটা স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে। তবে ‘অতিকথন’ দোষ ‘চিরকুমার সভা’কে যেমন কিঞ্চিৎ অপ্রাসঙ্গিকতার ভারে অবসন্ন করে তুলেছে তেমনই আবার সামান্য কথন দোষ, বৈকুণ্ঠের খাতা’কে কিঞ্চিৎ ক্ষুণ্ন করেছে। এখানে ঘটনাগ্ৰন্থন, বৈচিত্র্যসৃষ্টির আরও অবকাশ ছিল। সে যাই হোক, বাংলা কৌতুকনাট্যের ক্রমবিকাশে রবীন্দ্রনাথের দান যে বিশেষভাবে স্মরণীয় তাতে কোন সন্দেহ নেই। ‘গোড়ায় গলদ’ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীত সমাজের অভিনয় প্রয়োজনে রচিত। ১৮৯২ সালে নাটকটি অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ পরিচালনা ও অভিনয়ে অংশ নেন। অন্যদিকে ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ ১৮৯৭ সালে সঙ্গীত সমাজের উদ্যোগে প্রথম অভিনীত হয়। রবীন্দ্রনাথ কেদারের অভিনয় করেন। অবনীন্দ্রনাথ তিনকড়ির অভিনয় করেন। পরববর্তী কালে শিশির ভাদুড়ী কেদারের অভিনয় করেন।
সামাজিক নাটক
এই শ্রেণির নাটক হল ‘শোধবোধ’ (১৯২৬), ‘বাঁশরী’ (১৯৩৩)। ‘কর্মফল’ গল্পের নাট্যরূপ হল ‘শোধবোধ’। এতে নকল সাহেবিয়ানাকে তীব্র ব্যঙ্গ করা হয়েছে। অন্যদিকে ‘বাঁশরী’ নাটকে এদেশের অতি-উচ্চশিক্ষিত ও অভিজাত সমাজের একটি প্রণয় কাহিনি স্থান পেয়েছে। ‘বাঁশরী’ চরিত্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব চমৎকার নাট্যরূপ লাভ করেছে। সাহিত্যের বাস্তবতা সম্বন্ধে কবি এই নাটকে জানিয়েছেন— ‘‘‘সীতা ভাবলেন, দেব-চরিত্র রামচন্দ্র তাকে উদ্ধার করবেন রাবণের হাত থেকে, শেষকালে মানবপ্রকৃতি রামচন্দ্র চাইলেন তাঁকে আগুনে পোড়াতে। একেই বলে রিয়ালিজম, নোঙরামিকে নয়।” (দ্বিতীয় অঙ্ক/প্রথম দৃশ্য)।
রূপক ও সাংকেতিক নাটক
রূপক-সাংকেতিক নাটক রচনায় যে নজির তিনি স্থাপন করেছেন এবং এই ধারায় তিনি যে কৃতিত্ব দেখিয়েছেন, তাতে বাংলা নাটক বিশ্বের আধুনিক নাট্য-আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। বাংলা নাটকের মর্যাদাকে তিনি বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
‘শারদোৎসব’ (১৩১৫ বঙ্গাব্দ) বোলপুর ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শারদোৎসব উপলক্ষে ছাত্রদের দ্বারা অভিনীত হওয়ার জন্য রচিত হয়। স্বদেশী আন্দোলনের পটভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ব্যবস্থা ও জাতীয় নীতি নিয়ে পর্যালোচনা করেছিলেন। শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের কীভাবে আদর্শ ছাত্র করে গড়ে তোলা যায় তা নিয়েও চিন্তা করেছিলেন। তপোবনের আদর্শ ছিল রবীন্দ্রনাথের শিক্ষার আদর্শের ভিত্তি। রবীন্দ্রনাথ শিক্ষার ক্ষেত্রে উপলব্ধি করেছিলেন প্রকৃতির সঙ্গে ছাত্রের মিলনের প্রয়োজন। এবং সেই মিলনের উপায় হিসাবে ঋতু উৎসবকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রকৃতি চর্চা রবীন্দ্রনাথের মতে শিক্ষার একটি অঙ্গ। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ এই সময়ে খেলা ও কাজের মধ্যে দিয়ে কীভাবে শিক্ষা গ্রহণ করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করেছিলেন। খেলা ও কাজের মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণে স্বাধীনতা, আনন্দ ও সংযমের প্রকাশ ঘটে তা তিনি বিশ্বাস করতেন। তাই ঋতু উৎসবগুলি উপরিউক্ত রবীন্দ্র চিন্তার অভিব্যক্তি। ছাত্ররা প্রকৃতির উদার উন্মুক্ত আনন্দময় পটভূমিকায় ঋতু উৎসবের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে মিলিত হয়ে শিক্ষা গ্রহণ করবে। ‘শারদোৎসব’ নাটকের মাধ্যমে ছাত্ররা মিলিত হয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মেলার এক অফুরন্ত সর পেয়েছে। নাটকের বক্তব্যও মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক ও মানুষের আত্মোপলব্ধি। এই উপলব্ধি আশ্রমের ছাত্রদেরও।
এর পরের নাটক ‘রাজা’ (১৯১০)। অরূপ, অসীম, ঈশ্বরের স্বরূপ এবং তাঁকে উপলব্ধির জন্যে নানা-পন্থায় সাধনার কথা এ নাটকে বলা হয়েছে। যে যে-পথেই তার সাধনা করুন না কেন, সাধনায় যদি নিষ্ঠা থাকে, অজস্র দুঃখকষ্ট বরণের মধ্যেও যদি চিত্ত অবিচল থাকে, সকল অভিমান ও অহংকারকে বর্জন করে সহজ বিশ্বাস ও একান্ত আত্মসমর্পণের মন নিয়ে যদি তাকে উপলব্ধির চেষ্টা করা হয় তাহলে বুদ্ধি দিয়ে নয়, সহজ বোধের সাহায্যে তাকে লাভ করা যায়—এটাই ‘রাজা ’ নাটকের মূল বিষয়বস্তু।
১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ৩০ জুন শিলাইদহে অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ ‘অচলায়তন’ নাটক লেখেন। ‘অচলায়তন’ তত্ত্বমুখ্য নাটক এবং রূপক-সাংকেতিক রীতিতে রচিত। অচলায়তন তত্ত্বনাটক, রবীন্দ্রনাথের তত্ত্ব নাটকের মূল বিষয় মৌলিক দ্বন্দ্ব, আর সেই দ্বন্দ্ব হল জড়ধর্মের সঙ্গে প্রাণধর্মের। জড়ধর্মের প্রাধান্য যতই প্রবল হোক না কেন প্রাণধর্মের কাছে তার পরাজয় নিশ্চিত – এই তত্ত্বকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নানাভাবে উপস্থাপিত করেছেন। প্রমথনাথ বিশীর মতে, তিনটি ভাবে উপস্থাপন করেছেন–১) মানুষের সঙ্গে ভগবানের সম্পর্ক, ২) মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক, ৩) মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক। ‘অচলায়তন’ নাটকে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক প্রাধান্য পেয়েছে, দ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে সেই সম্পর্ক স্পষ্টতা লাভ করেছে। মানুষের তৈরি বহুদিনের অর্জিত অন্ধ ও বিকৃত সংস্কার এবং অনুশাসনগুলি সমাজকে কীভাবে নাগপাশের সহস্র বন্ধনে বেঁধে রেখেছে তার স্বরূপ প্রকাশ করে সেখান থেকে মুক্তির কথা বলেছেন ‘অচলায়তন’ নাটকে। তাহলে এই নাটকে অচলায়তনের শরিক কারা ? কেবলই কি মহাপঞ্চকের অনুগামীরাই? না, মূলত মহাপঞ্চকের নিয়মের বেড়াজালকে প্রাধান্য দেওয়া হলেও রবীন্দ্রনাথ তিনটি অচলায়তনের কথা বলেছেন—১) মহাপঞ্চকের অনুগামীদের অচলায়তন, ২) শোনপাংশুদের অচলায়তন, ৩) দর্ভকদলের অচলায়তন—এই তিনদলের স্বরূপ স্বতন্ত্র তাই এদের সাধনার পথও ভিন্ন পথ এবং মুক্তির ঠিকানাও। মহাপঞ্চকের অচলায়তনের সাধনা জ্ঞানমার্গে, শোনপাংশুদের অচলায়তনে সাধনা কর্মমার্গে, দর্ভকদলের অচলায়তনের সাধনা ভক্তিমার্গে। নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ থেকে এরা নিজস্ব পথে কেবল সাধনাই করে বেড়িয়েছে কখনও একে অপরের সঙ্গে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করেনি। নিজের পথটাকেই তারা শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেছে। অথচ এরা তিন দলই গুরুর সন্ধান করেছে। মহাপঞ্চকের অনুগামীরা জ্ঞানমার্গের সাধনায় মন্ত্রকে মননের চেয়ে, পুঁথিকে গুরুর চেয়ে এবং আচারকে মানুষের চেয়ে বড় মনে করেছে। আর তাদের নিয়মের প্রাচীরে আহত হয়েছে সুভদ্র, পঞ্চকেরা। অপরদিকে, শোনপাংশুর দল কাজকে প্রাধান্য দিয়েছে কিন্তু কেন কাজ করে তারা জানে না। তারা কাজ করাকেই স্বাধীনতা মনে করে, কেবল শরীরে খেটে যাওয়া। একইভাবে দর্ভকদের পথ ভক্তির পথ–অন্ধভক্তি, তার স্বরূপও তারা জানতে আগ্রহী নয়। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ কেবল আচারসর্বস্বতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেননি, মননহীনতার বিরুদ্ধে তার অভিযান, মননের স্বাধীনতার তিনি প্রয়াসী যার একমাত্র উপায় জ্ঞান, ভক্তি ও কর্মের একত্র সমন্বয় ঘটিয়েছেন।
বাংলা ১৩১৮ সালে পূজোর ছুটির শেষে শিলাইদহ থেকে শান্তিনিকেতনে এসে কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর বহুখ্যাত ‘ডাকঘর’ নাটকটি রচনা করেন। এই নাটক সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজে জানিয়েছেন— “শান্তিনিকেতনের ছাদের ওপর মাদুর পেতে পড়ে থাকতুম। প্রবল একটা আবেগ এসেছিল ভেতরে। চল, চল বাইরে, যাবার আগে তোমাকে পৃথিবী প্রদক্ষিণ করতে হবে—সেখানকার মানুষের সুখ-দুঃখের উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেতে হবে। সে সময় বিদ্যালয়ের কাজে বেশ ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ কি হল। রাত দুটো-তিনটের সময় অন্ধকার ছাদে এসে মনটা পাখা বিস্তার করল। যাই যাই এমন একটা বেদনা মনে জেগে উঠল। আমার মনে হচ্ছিল, একটা কিছু ঘটবে, হয়ত মৃত্যু। যেন এখান হতে যাচ্চি। বেঁচে গেলুম। কোথাও যাবার ডাক ও মৃত্যুর কথা উভয়ে মিলে, খুব একটা আবেগে সেই চঞ্চলতাকে ভাষাতে ‘ডাকঘরে’ কলম চালিয়ে প্রকাশ করলুম। ভিতরের প্রেরণায় লিখলুম। এর মধ্যে গল্প নেই। এ গদ্য লিরিক। আলংকারিকদের মতানুযায়ী নাটক নয় আখ্যায়িকা।’’
নাটিকাটির মূল কেন্দ্রে আছে একটি অতিরিক্ত কল্পনাপ্রবণ রোমান্টিক শিশু অমল। তার শৈশবে মা ও বাবাকে হারিয়ে সে একরূপ বন্ধনহারা। তার নিজের আর কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। ঘটনাচক্রে এই শিশুই অবস্থাপন্ন এক নিঃসন্তান ব্যক্তির পোষ্যপুত্র। অসুস্থ অমল ঘরে বন্দি। সে চায় মুক্তি। স্বাভাবিক জীবন। অমল এখানে হয়ে উঠেছে মানবাত্মার প্রতীক। আত্মা চায় মুক্তি। সে ব্যাকুল হয়ে ওঠে রাজা বা অরূপের সাথে মেলার জন্য। এখানে ঘুম হয়ে উঠেছে মৃত্যু তথা মুক্তির প্রতীক। এই মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, তা নবজীবন লাভের মাধ্যম মাত্র। মৃত্যু পূর্ণতায় পৌঁছানোর সোপান। মৃত্যুর মধ্যেই মানুষের বন্ধনমুক্তি ঘটে। সুতরাং ঘুম এখানে প্রতীক নিদ্রা হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি দেখা যায় যে নাটকের নামকরণেও একটি রূপকের ব্যবহার রয়েছে । এখানে ‘ডাকঘর’ হল বিপুল বিচিত্র পৃথিবী তথা বিশ্বপ্রকৃতি। চিঠি যেন সৌন্দর্য্য ও আনন্দ রূপের প্রতীক হয়ে উঠেছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সমস্ত নাটকেই রূপক–সংকেতের মাধ্যমে তিনি মূলত রুদ্ধ ও বদ্ধ জীবন থেকে আনন্দ–সৌন্দর্য্য–মুক্তির বাণী পৌঁছে দিতে চেয়েছেন অমলের মাধ্যমে। রূপকের স্পর্শে নাটকটি যথার্থই রূপক নাটক হয়ে উঠেছে।
‘মুক্তধারা’ উত্তরকূটের রাজা একটি পরিত্যক্ত শিশুকে ঝর্ণাতলে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে রাজ পরিবারে পালন করেন। ইনিই মানুষের মুক্তদাতা অভিজিৎ। বিভূতি যন্ত্রদানবের সহায়তায় মুক্ত জলধারাকে বন্দী করে শিব তরাইয়ের মানুষদের কৃত্রিম জলকষ্ট দিয়েছিল। অভিজিং যন্ত্রে আঘাত হেনে ঝরণার রুদ্ধ জলধারাকে মুক্ত করেছিলেন। কিন্তু যন্ত্রের পাল্টা আঘাতে তিনি প্রাণ হারালেন। যন্ত্রের চেয়ে মানুষ বড়—সে কথা মানুষকে প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। অভিজিৎ সেই শহীদ মানুষের প্রতীক।
‘রক্তকরবী’ কর্ষণজীবী এবং অ-কর্ষণজীবীর দ্বন্দ্ব দেখানো হয়েছে এই নাটকে। কর্ষণজীবী সভ্যতার প্রতীক নন্দিনী, আর অ-কর্ষণজীবী সভ্যতার প্রতীক রাজা। নন্দিনী রাজাকে মরা সোনার তালের জগৎ থেকে ফসলের বৈচিত্র্যের মধ্যে পেতে চেয়েছিল। রাজা বদ্ধ আত্মা এবং অ-বিদ্যা দ্বারা আচ্ছন্ন। নন্দিনীর ডাকে সে নিজেই তার যক্ষপুরীর কারাগার ভেঙে মুক্ত আলোয় এসে দাঁড়িয়েছে। এতদিন সে ছিল নিঃসঙ্গ এখন মানুষের মাঝখানে তার পাকা ঠাই হল।
‘ফাল্গুনী’-তে রবীন্দ্রনাথ জীবন ও মৃত্যু, শীত ও বসন্ত, জরা ও যৌবনের দ্বৈত সত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের পটভূমিকায় এক নতুন ঋতু নাট্যের পরিকল্পনা করেছেন। একদল তরুণ গুহার জরাকে ধরে আনার পণ করে এবং ধরে আনে। কিন্তু দেখে তারা ধরে এনেছে তাদের সর্দারকে যিনি যৌবন ও বসন্তের প্রতীক।
রবীন্দ্রনাথের নাট্য-প্রতিভার বৈশিষ্ট্য
- বাংলা থিয়েটারে যখন পেশাদারি নাট্যশালার যুগ চলছে তখন রবীন্দ্রনাথের নাট্যরচনার প্রয়াস এবং বিভিন্ন স্থানে সেই সব নাটকের অভিনয়, নাট্যপরিচালনার ব্যবস্থা করে শুধু নাট্যসাহিত্যের নয়, নাট্যামোদী মানুষের কাছেও আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছেন।
- নাট্যমঞ্চ, নাট্য প্রযোজনা, নাট্যাভিনয় সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গী ছিল আধুনিক।
- রবীন্দ্রনাথ গ্রীক নাট্যকলা ও শেক্সপীয়রীয় উভয় নাট্যকলাকে অনুসরণ করেছেন। যেমন, মালিনী নাটকে রবীন্দ্রনাথ গ্রীক ট্রাজেডির মতো অভাবনীয় ও অনিবার্য উপসংহার রচনা করেছেন। কোন কোন ক্ষেত্রে শেক্সপীয়রীয় ট্রাজেডিকে অনুসরণ করে মৌলিকতা সৃষ্টি করেছেন। যেমন, তার বেশিরভাগ ট্রাজেডিতেই পাপীকে লোভের বন্ধন থেকে মুক্ত করতে গিয়ে একটি মহৎ চরিত্রের মৃত্যু হয়েছে। ‘রাজা ও রাণী’তে কুমারসেন, তপতী’তে সুমিত্রা, ‘বিসর্জনে’ জয়সিংহ, মুক্তধারা’তে অভিজিৎ, রক্তকরবী’তে রঞ্জনকে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে।
- রবীন্দ্র নাটকে গণচেতনার দিকটি জনতা চরিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছে। ‘বিসর্জন’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘মালিনী’তে শেক্সপীয়রের জনতা চরিত্রের মতো এই শ্রেণির চরিত্রগুলি নাট্যকারের অপরূপ সৃষ্টি—যা পরবর্তীকালের নাট্যকারদের প্রভাবিত করেছিল।
- রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটকগুলি ভাব বা আদর্শের প্রতীক হয়েও নাটকীয় দ্বন্দ্বের জন্য বাস্তব ও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে। মানসদ্বন্দ্বে তত্ত্বময় ব্যাখ্যার মধ্যে নাটকীয়তা, সাংকেতিকতা একই সঙ্গে আভাসিত হয়েছে। ‘রক্তকরবী’ নাটকের নন্দিনী প্রতীকী চরিত্র হয়েও মানবীর ছবি। ‘রক্তকরবী’ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পাশ্চাত্য যান্ত্রিকতা, জড়বাদ ও বিজ্ঞানশক্তির অপপ্রয়োগের সাংকেতিক নাটক হয়েও তা এক অর্থে মুক্তির গান। ‘মুক্তধারা’র অমল মুমুক্ষু মানবাত্মার প্রতীক হয়েও সে চিরশিশু। এক অর্থে রবীন্দ্রনাথের সাংকেতিক নাটক সীমার সঙ্গে অসীমের প্রেমমুক্তির গান।
- রবীন্দ্র নাটকে সংগীতের ব্যবহার অনবদ্য। তিনি জীবনস্মৃতিতে জানিয়েছেন— ‘‘বাক্য যাহা বলিতে পারে না, গান তাহাই বলে।’’ কিংবা ‘রাজা’ নাটকে বলেছেন— ‘হাত দিয়ে দ্বার খুলব না গো, গান দিয়ে দ্বার খোলাব’। রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলিতে এই উক্তি বিশেষভাবে প্রযোজ্য। যেমন, ‘রক্তকরবী’ নাটকে ফসল কাটার একটি নেপথ্য সঙ্গীত একদিকে যক্ষপুরীর নিষ্প্রাণতা এবং অন্যদিকে প্রকৃতির প্রাণোচ্ছলতা এবং বৈপরীত্যকে ফুটিয়ে তুলেছে—“পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে—আয় রে চলে/আয়, আয়, আয়” গানটি।
- ঠাকুরদা চরিত্র রবীন্দ্রনাথের এক অপরূপ সৃষ্টি। ‘শারদোৎসব’-এ যে ঠাকুরদা চরিত্রের প্রথম সাক্ষাৎ আমরা পাই, ‘রাজা’ নাটকে তার বিকাশ। তারপর ‘ডাকঘর’-এ ফকির বেশে, ‘অচলায়তন’-এ দাদাঠাকুর রূপে, ‘মুক্তধারা’য় ধনঞ্জয় বৈরাগী রূপে, ‘ফাল্গুনী’তে বাউল রূপে উপস্থিত হয়েছেন। ঠাকুরদা হলেন মুক্ত আত্মা। এই মুক্তি জগৎ ও জীবনকে অস্বীকার করে নয়। ঔপনিষদিক আদর্শে বিশ্বাসী ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে ঠাকুরদা চরিত্রের মাধ্যমে প্রেমের মুক্তি তথা আত্মপ্রকাশের মুক্তির কথা শুনিয়েছেন।
- রবীন্দ্রনাথ তাঁর নাটকে নানাসূত্র থেকে কাহিনির উপাদান সংগ্রহ করেছেন। তার মধ্যে বৌদ্ধ সাহিত্যের উপাদান তিনি অনেকগুলি নাটকে গ্রহণ করেছেন। ‘নটীর পূজা’, ‘চণ্ডালিকা’, ‘মালিনী’, ‘রাজা’, ‘অরূপরতন’, ‘শাপমোচন’ প্রভৃতি নাটকে বৌদ্ধ সমাজজীবন তথা সাহিত্যের পরিচয় রয়েছে। আবার লোকসাহিত্যের উপাদানও রয়েছে নাটকে।
- রবীন্দ্র নাটকের সংলাপের বৈচিত্র্য বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তাঁর গদ্য সংলাপের যে বাগ্বৈদগ্ধ্য তা শেষজীবনের নাটকগুলিকে বিশেষত্ব দান করেছে।
- রবীন্দ্রনাথ প্রথম দেখালেন নাটক একটি সূক্ষ্ম কলারূপ। বিশেষ করে কৌতুক নাটকগুলিতে এত মার্জিত সূক্ষ্ম রসবোধ অননুকরণীয় সম্পদে পরিণত হয়েছে। তাই অজিতকুমার ঘোষ বলেছেন—“রবীন্দ্রনাথে আসিয়া বাংলা নাটক তাহার পরিপূর্ণ আভিজাত্য এবং গৌরব লাভ করিল। নাটকের মধ্যে তিনি যে সূক্ষ্ম কলাকৌশল এবং সুগভীর অন্তর্দৃষ্টির সুস্পষ্ট পরিচয় দিলেন তাহা তাহার পূর্বে দেখা যায় নাই, এবং পরেও অনুসৃত হয়নি।”
Leave a Reply