//
//

রম্যরচনা কাকে বলে? এর বৈশিষ্ট্য ও একটি সার্থক রম্যরচনা ব্যাখ্যা কর।

রম্যরচনা

প্রবন্ধের অন্যতম বিভাগ ব্যক্তিগত প্রবন্ধের সঙ্গে যার সাদৃশ্য সবচেয়ে বেশ সেটি হল রম্যরচনা। ব্যক্তিগত প্রবন্ধের মতোই এর থাকে একটি রমণীয়তা, খেয়ালির কল্পনার অবাধ বিস্তার এবং তথ্যভাবের পরিবর্তে ‘রচনারস সম্ভোগের’ আস্বাদ্যমানতা। তবে তফাৎ এই যে রম্যরচনাকে যে ব্যক্তিগত হতেই হবে এর কোনো মানে নেই, তা বস্তুগত কোনো অবলম্বনকে উপলক্ষ করেও রচিত হতে পারে।

মনে হয় আধুনিক রম্যরচনার উদ্ভব ইংরেজি Belles Letters জাতীয় রচনা থেকেই। শব্দটি সম্ভবত সার জোনাথন সুইফট্‌ ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম ব্যবহার করেন। সাধারণভাবে Belles Letters বলতে আমরা বুঝি কল্পনা-ঋদ্ধ এবং উপভোগ্য গদ্যভঙ্গিসহ যে-কোনো রচনা, জনসন যাকে আখ্যা দিয়েছেন ‘Loose sally of mind.’ বিষয়বস্তুর অমিত বৈচিত্র্য এর প্রধান বৈশিষ্ট্য। এ বিষয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রধান রম্যরচনাকার রবার্ট লন্ড যে মন্তব্য করেছেন তা স্মরণ করা যেতে পারে—এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকায় যা মন্তব্য করা হয়েছে তা স্মরণ করা যেতে পারে— Modern usage applies the word more often to the little hills than to the mountain peaks of literature and denotes the essay and the critical study rather than the epics of Homer or the plays of Shakespeare.

Belles Letters শব্দটির প্রথম ব্যবহার সুইফট করলেও রম্যরচনার পথিকৃৎ বলা যেতে পারে ফরাসী সাহিত্যিক মোতেনকে। পাশ্চাত্য সাহিত্যে এরপর যাঁরা রম্যরচনায় বিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে চার্লস ল্যাম্ব উল্লেখযোগ্য। ল্যাম্ব ছাড়া ডি. কুইনি, গলসওয়ার্দি, এইচ. জি. ওয়েলস, চেস্টারটন, হাতালি, অডেন, স্পেন্ডার প্রভৃতি গদ্য সাহিত্যিক রম্যরচনা সৃষ্টিতে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন।

বাংলা সাহিত্যে প্রথম রম্যরচনা জাতীয় সৃষ্টি কাকে বলা যায় এ বিষয়ে সমালোচকদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ কেউ বলেন কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-কেই প্রথম রম্যরচনা আখ্যা দেওয়া উচিত, আবার কেউ কেউ বলেন সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পালামৌ ভ্রমণ’ সাহিত্য হলেও, তাকেই প্রথম রম্যরচনা বলে স্বীকার করা যুক্তিযুক্ত। আমরা মনে করি, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’-এর মধ্যেই রম্যরচনার সার্থক বীজ প্রথম দেখা গিয়েছে, যদিও এক গভীর জীবনদর্শন একে ঠিক রম্যরচনার স্তরে আবদ্ধ থাকতে দেয়নি। প্রকৃত রম্যরচনা রবীন্দ্রনাথের হাতেই আমরা দেখেছি এবং তার উল্লেখও এর সঙ্গে করা হয়েছে। পরবর্তীকালে এই জাতীয় রচনায় যারা বিশেষ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন তাদের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে সৈয়দ মুজতবা আলি, শ্রীশচন্দ্র দাশ, যাযাবর (বিনয় মুখোপাধ্যায়), সুনন্দ (নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়), বুদ্ধদেব বসু, রূপদর্শী (গৌরকিশোর ঘোয) প্রভৃতির নাম। কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে একজনের নাম না করলে তার প্রতি অবিচার করা হবে, তিনি বীরবল বা প্রমথ চৌধুরী। সম্পূর্ণ মজলিশী ভঙ্গিতে তিনি যে সব রম্যরচনা সৃষ্টি করেছেন সেগুলি বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্যে শাণিত এবং উপভোগ্য।

রম্যরচনা আমাদের রম্যতা বিধান করে, সন্দেহ নেই; আধুনিক ব্যস্ততার যুগে এই জাতীয় রচনার চাহিদা অনেক বেড়েছে লেখকের সংখ্যা বেড়েছে, এতে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। কিন্তু আপাতরম্যতার সুযোগে বেশ কিছু অল্প শক্তিমান লেখকও যে এই জাতীয় রচনায় আসতে পারে। এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর। রম্যরচনায় পর্যবসিত করবার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র এখানে অতি দুরূহ বিষয়কেও পরিবেশন করেছেন অতি সরস ভঙ্গিতে, অন্তত প্রস্তাবনায় তার চেষ্টা সর্বত্র করেছেন। অথচ রচনায় কমলাকান্ত এমন একটি সঞ্জীব চরিত্র হয়ে উঠেছে, প্রসন্ন গোয়ালিনীর সঙ্গে তার সরস সংলাপ প্রসন্নকেও এমন চরিত্র করে তুলেছে যে অনেকেই রচনাগুলির মধ্যে ছোটগল্পের লক্ষণ খুঁজে পেয়েছেন।

ব্যক্তিগত প্রবন্ধ যত লঘুই হোক, প্রবন্ধ বলেই তার মধ্যে ভাষা ব্যবহারের একটা ঋজুতা এবং অস্পষ্ট হলেও বক্তব্যের পার থাকে। যারা ভালো রম্যরচনার লেখক তাদের মধ্যে প্রায়শই তা থাকে, কিন্তু রম্যরচনায় তা থাকতেই হবে এমন কোনো কথা নেই, অর্থাৎ রম্যরচনায় তা আবশ্যিক গুণ নয়।

রম্যরচনার বৈশিষ্ট্য

  • হালকা বৈঠকি চালে, ঘরোয়া মেজাজে, লঘু হাস্যরসাত্মক, রম্য কল্পনার স্পর্শযুক্ত গদ্যরচনাকেই রম্যরচনা’ বলা যায়।
  • রবীন্দ্রনাথের মতে রম্যরচনা হলো ‘বাজে কথা’-র রচনা— অন্য খরচের চেয়ে বাজে খরচেই মানুষকে যথার্থ চেনা যায়। কারণ মানুষ ব্যয় করে বাধা নিয়ম অনুসারে, অপব্যয় করে নিজের খেয়ালে। যেমন বাজে খরচ, তেমনি বাজে কথা। বাজে কথাতেই মানুষ আপনাকে ধরা দেয়। এই মন্তব্যের আলোকে দেখলে নির্ভার, স্বচ্ছন্দ, খেয়ালি কল্পনার সর্ববন্ধনমুক্ত রম্যতাই এ-জাতীয় রচনার চরিত্রলক্ষণ।
  • ভার বর্জনের প্রয়াস থাকবে ভাষা ও আঙ্গিকে, তেমনি থাকবে বিষয়েরও।কোনো গভীর তত্ত্বকথা প্রকাশের তাগিদ বা পাণ্ডিত্য প্রদর্শনের বাসনা যেমন থাকবে না, ভাষাভঙ্গি তেমনই স্বচ্ছন্দ স্বাধীন গতিতে চলবে, কোনো স্থির অনুশাসনের পরোয়া না করে।
  • লেখক ও পাঠকের নিবিড় সান্নিধ্য এবং লঘু-সরস আড্ডাই রম্যরচনার প্রাণ। মজলিশি মেজাজ না থাকলে এই রচনার উপভোগ্যতাই হারিয়ে যায়।
  • জরুরি বিষয়ের গম্ভীর আলোচনা/বিশ্লেষণের পরিবর্তে মজাদার আলাপচারিতাই রম্যরচনায় প্রত্যাশিত।

একটি সার্থক রম্যরচনা

একটি বাংলা রম্যরচনা কালীপ্রসন্ন সিংহ বিরচিত দু’খণ্ডের ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-কে কেউ কেউ প্রথম বাংলা রম্যরচনার স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিষয়মুখ্য রম্যরচনাও যে রম্যতা হারায় না, এই গ্রন্থটি তার প্রমাণ। কারণ, অতি সামান্য দুটি-একটি রচনা বাদে (যেমন, ঘুচোর ছেলে কুঁচো’) বাকি সব রচনাই এমন সব বিষয় নিয়ে লেখা যার তথ্যগত মূল্যেই আমরা এখনো তার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারি, যথা— কলিকাতার চড়ক পার্বণ, রথ, দুর্গোৎসব, রামলীলা, প্রতাপাদ, লালা রাজাদের বাড়ি দাঙ্গা, পাদ্রি লং ও নীলদর্পণ, সাত পেয়ে গরু, দরিয়াই ঘোড়া, লক্ষ্ণৌয়ের বাদসা প্রভৃতি। অথচ বিশিষ্ট রচনাভঙ্গিতে এবং সরস মন্তব্যে, কোথাও কোথাও সে সরসতা আজকের বিচারে একটু স্থূল হলেও, বিষয় ও রচনারীতি যে তুল্যমূল্য হয়ে উঠেছে, এ সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ নেই। যে-কোনো একটি রচনাকে অবলম্বন করেই তার পরিচয় দেওয়া যেতে পারে।

রচনার নাম ‘দুর্গোৎসব’, নকশা-র দ্বিতীয় ভাগে আছে। আগে বনেদি বাড়িতেই এ দুর্গাপূজা হত, আজকাল পুঁটে তেলীকেও প্রিতিমা আনতে দ্যাখ্যা যায়। আগে যে কৃষ্ণনগরের শিল্পীরাই কুমারটুলি ও সিদ্ধেশ্বরীতলায় প্রতিমা গড়তে আসতো, পুজোর আগে আগে ফিরিওয়ালারা মধু চাই’, শাখা নেবে গো’ বলে ঘুরে বেড়াত, নানা চরম জিনিসপত্রের বেচাকেনায় দোকানগুলি সরগরম হয়ে উঠত, প্রতিপদের পরই ব্রাহ্মণ পণ্ডিত-বিদায় হত, এই সব করে করে চতুর্থ শেষ হলেই যে রীতিমতো পুজোর আয়োজন শুরু হয়ে যেত, তার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। পঞ্চমীতে ‘দুর্গামণ্ডা’ আর ‘আগাতোলা’ সন্দেশ বিক্রির ধুম, ষষ্ঠী এলেই ‘বাজারের শেষ কেনাবেচা, মহাজনের শেষ তাগাদা, আশার শেষ ভরসা। ষষ্ঠীর সন্ধ্যায় প্রিতিমার অধিবাস’, কলাবউ স্নান করানো, বলিদান ইত্যাদি থেকে একেবারে বিজয়া পর্যন্ত বর্ণনা আছে এই রচনায়। প্রতিমা নিরঞ্জনের পর নীলকণ্ঠ, শঙ্খচিল উড়িয়ে, ‘দাদা গো দিদি গো’ বাজনার সঙ্গে যে ঘট নিয়ে বাড়ির দিকে আসতে হত এবং কাঁচা হলুদ ও ঘটজল খেয়ে কোলাকুলি শুরু করতে হত, তার উল্লেখও আছে।

তথ্য কম নয়, কিন্তু রচনার রম্যতায় আগাগোড়া তা উপভোগ্য ও আকর্ষণীয়। একটু উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে— ‘‘রাস্তায় বেজায় ভিড়। মাড়ওয়ারি খোট্টার পাল, মাগীর খাতা ও ইয়ারের দলে রাস্তা পুরে গ্যাচে। নেমতন্নের হাতলণ্ঠনওয়ালা বড় বড় গাড়ির সইসের প্রলয় শব্দে পইস পইস কচ্চে, অথচ গাড়ি চালাবার বড় বেগতিক।’’

তথ্যসূত্র:

কাব্যজিজ্ঞাসা – অতুলচন্দ্র গুপ্তDownload
কাব্যতত্ত্ব: আরিস্টটল – শিশিরকুমার দাসDownload
কাব্যমীমাংসা – প্রবাসজীবন চৌধুরীDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – নরেন বিশ্বাসDownload
ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব – অবন্তীকুমার সান্যালDownload
কাব্যজিজ্ঞাসার রূপরেখা – করুণাসিন্ধু দাসDownload
কাব্য-শ্রী – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
সাহিত্যের রূপরীতি ও অন্যান্য – কুন্তল চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য ও সমালোচনার রূপরীতি – উজ্জ্বলকুমার মজুমদারDownload
কাব্যালোক – সুধীরকুমার দাশগুপ্তDownload
কাব্যপ্রকাশ – সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তDownload
নন্দনতত্ত্ব – সুধীর কুমার নন্দীDownload
প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ – অবন্তীকুমা সান্যালDownload
পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যভাবনা – নবেন্দু সেনDownload
সাহিত্য প্রকরণ – হীরেণ চট্টোপাধ্যায়Download
সাহিত্য জিজ্ঞাসা: বস্তুবাদী বিচার – অজয়কুমার ঘোষDownload

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!