
রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ— মন্তব্যটি ব্যাখ্যা কর।
রস ও কাব্যের জগৎ অলৌকিক মায়ার জগৎ
অতি দুর্বোধ্য হল কবিকর্ম ও কবিধর্ম। কবি তাঁর প্রতিভার মায়াবলে যে লৌকিক ভাব ও লৌকিক কারণের এক অলৌকিক কাব্যজগৎ সৃষ্টি করে পাঠক ও দর্শকদের মনে রস সঞ্চারে সমর্থ হন। ভাব ও রসের এবং বস্তু জগৎ ও কাব্য জগতের পার্থক্যকে সুস্পষ্ট করার জন্য আলংকারিকগণ রস ও কাব্যের জগৎকে অলৌকিক মায়ার জগৎ বলে অভিহিত করেছেন। যুক্তি ও উদাহরণের সাহায্যে রসের অলৌকিকতা প্রমাণ করা যায়।
প্রথমত: যে বিভাব, অনুভাব ও সঞ্চারী ভাবের দ্বারা রসের নিষ্পত্তি হয় তা লৌকিক জগতের নয়, তা কবির সৃষ্টি। সেকারণে বাস্তবের বেদনাদায়ক ঘটনা আমরা উপভোগ করি না কিন্তু কাব্যের ঘটনা আমরা উপভোগ করি। কাব্যে বিভাবাদির যোগে সুখ বা আনন্দের সৃষ্টি হয়। যেমজন রামলীলা নিতান্ত দুঃখের কাহিনি কিন্তু দর্শক তা উপভোগ করে কারণ কাব্যের দুঃখ বাস্তবের নয়। রবীন্দ্রনাথও বলেছেন লীলা যদি না থাকত তবে কেউ রামলীলা উপভোগ করতো না।
দ্বিতীয়ত: কাব্যে যে রস সৃষ্টি হয় তা অখণ্ড, বাস্তবে থাকে নানা জোড়া তালি অসম্পূর্ণতা। তাই মানুষ কাব্যের মধ্যে খোঁজে পরিপূর্ণতা। কাব্যে আমরা জীবনের পূর্ণ রূপ দেখতে পাই। সুতরাং বলা বাহুল্য তা লৌকিক নয়।
তৃতীয়ত: জগতে মানুষের প্রয়োজনীয় দাবি অনেক। অভাব মোচন হলেও তৃপ্তিহীন কামনা জেগে থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অপ্রয়োজনের মূল্য আছে। বিশুদ্ধ সাহিত্য অপ্রয়োজনীয় ও তার রস অহৈতু। বাস্তবের উদ্দেশ্যে সাধিত হয় না বলেই তা অলৌকিক।
চতুর্থত: রস উপলব্ধি ঘটে অনুভূতির মাধ্যমে। তাই রস অনুভবগম্য। রসের দ্বারা আমাদের চৈতন্যের উপলব্ধি ঘটে। আমরা নিজেকে নতুন করে জানি। অর্থাৎ রস উপলব্ধি ঘটে। পাশ্চাত্য দেশের সমালোচকেরা এই মতকে সমর্থন করেছেন। এপ্রসঙ্গে অভিনব গুপ্ত বলেছেন-‘‘সংবেদন মন আত্মচৈতন্যের আনন্দানুভূতিই রসাস্বাদ।’’ সুতরাং অনুভূতির বাইরে রসের অস্তিত্ব নেই। অতএব তা লৌকিক।
পঞ্চমত: বাস্তব জীবনের সুখ, দুঃখ নির্ভর করে বাইরের ঘটনায়। কিন্তু রসের আনন্দ বাইরের ঘটনায় নির্ভর করে না। সুতরাং রস অলৌকিক।
ষষ্ঠত: দর্শক বা পাঠক যখন কাব্য বা নাটক পাঠ করে তখন সে চরিত্রের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে। আর একই সঙ্গে চরিত্রের সঙ্গে দূরত্ব অনুভব করে। তখন দর্শকের মানসিকতা হয় এই দুঃখ আমার আবার আমার নয়। এ দুঃখ পরের আবার পরের নয়। ‘পরস্য ন পরস্যেতি মমেতি ন মমেতি চ।’ একে বলে রসের সাধারণীকরণ। রসের যখন সাধারণীকরণ ঘটে তখন তা বাস্তব নয় বলাই বাহুল্য। বাস্তবের দুঃখ হলে দর্শক তা উপভোগ করতে পারতো না।
সপ্তমত: আমামদের চৈতন্যের তিনটি দিক থাকে— সৎ, চিৎ ও আনন্দ। এই তিনটি অজ্ঞানতার আবরণে থাকে। যথার্থ রসের অনুভূতিতে এই তিন দিকের উন্মোচন ঘটে। এর পরিণামে আনন্দ লাভ ঘটে। চৈতন্যের আবরণ উন্মোচনে যে আত্ম সাক্ষাৎকার ঘটে তাকেই বলে রসাস্বাদ। রসানুভূতি যেহেতু আত্ম সাক্ষাৎকার বা আত্মচৈতন্যের উন্মোচন সেহেতু বলাবাহুল্য তা বাস্তবের অনুভূতি হতে পারে না। একটি উদাহরণ দিলে বোঝা যাবে—
এবংবাদিনি দেবর্ষৌ পার্শ্বে পিতুরধোমুখী।
লীলাকমলপত্রাণি গণয়ামাস পার্বতী।।
লীলা কলমের পত্র গণনায় পার্বতীর যে লজ্জা ব্যঞ্জিত হচ্ছে সেখানেই এর কাব্যত্ব। তাই রসাস্বাদ কেবল অনুভূতিযুক্ত মানুষই অনুভব করতে পারেন। কারণ এ উক্তি বাস্তবের নয়।
অবশেষে দেখা যায় রস অলৌকিক এবং এক নির্মল আনন্দের অনুভূতি। বারংবার কাব্য পাঠে যার হৃদয় দর্পণের মতো স্বচ্ছ হয়েছে সেই ব্যক্তিই একমাত্র রস অনুভব করতে পারে। তাই বলা যায় কাব্য রসের আধার কবিও নয়, কাব্যও নয় সহৃদয় পাঠকের মন।
তথ্যসূত্র:
১. কাব্যজিজ্ঞাসা: অতুলচন্দ্র গুপ্ত
২. কাব্যালোক: সুধীরকুমার দাশগুপ্ত
৩. ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব: অবন্তীকুমার সান্যাল
Leave a Reply