আরাকান রাজসভার কবি শমশের আলীর কৃতিত্ব আলোচনা কর।

কবি শমশের আলী

‘আরাকান রাজসভায় বাংলা সাহিত্য’ গ্রন্থে শমশের আলীকে অন্যতম কবি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাঁর কাব্যের নাম ‘রিজওয়ান শাহ’। কবির জন্ম চট্টগ্রামের সুলতানপুর গ্রামে। তিনি ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় আরাকানে গমন করেন এবং সেখানেই তাঁর অকালমৃত্যু ঘটে। তিনি রোসাঙ্গে অবস্থান কালে ‘রিজওয়ান শাহ’ কাব্য রচনা করেছিলেন। সম্ভবত তিনি কোন রোসাঙ্গ-রাজ-অমাত্যের অনুগ্রহ লাভ করতে পারেননি। কাব্যটি উপাখ্যানমূলক। কাব্যে বর্ণিত স্থান খোরাসান ও পারস্য দেশ হলেও বাংলাদেশের নানা প্রচলিত কাহিনি এতে স্থান পেয়েছে। কবি ছিলেন পণ্ডিত ব্যক্তি, ফারসি, উর্দু ও সংস্কৃতে তাঁর দখল ছিল।

মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকান রাজসভার কবিগণের অবদান সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যযুগের ধর্মীয় বিষয়াবলম্বনে রচিত কাব্যের পাশাপাশি রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান রচনা করে তারা এক স্বতন্ত্র ধারার প্রবর্তন করেছিলেন। মানবিক প্রণয়কাহিনি সৃষ্টির মাধ্যমে তারা মধ্য যুগের সাহিত্যকে বৈচিত্র্যধর্মী করে তুলেন। সংস্কৃত ভাষার বাইরে হিন্দি ও ফারসি ভাষায় রচিত সাহিত্য বাংলায় অনুবাদের প্রথম কৃতিত্ব আরাকান রাজসভার কবিগণের। দেশীয় রূপকথা অবলম্বনে সাহিত্যসৃষ্টির নিদর্শন দেখান কোরেশী মাগন ঠাকুর তাঁর চন্দ্রাবতী রচনার মাধ্যমে। আলাওলের হাতে ফারসি সাহিত্যের গল্পকাহিনি নবরূপে রূপায়িত হয়ে ওঠে।

আরাকান রাজসভার কবিগণই বাংলা সাহিত্যের মধ্য যুগের গতানুগতিকতা পরিহার করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুনত্ব দেখান। উন্নততর সাহিত্যের সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের যোগাযোগ স্থাপন করে এবং কাব্যের বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্য আনয়ন করে আরাকানবাসী কবিগণ ১৬২২ থেকে ১৬৮৪ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলা সাহিত্যের যে অগ্রগতি সাধন করেছিলেন তা সে সময়ে বাংলা ভাষার আপন গৃহেও সম্ভব হয়নি। আরাকান রাজসভার অমাত্যগণের উৎসাহ বাংলা সাহিত্যের বিকাশে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল। এখানকার কবিগণের আদর্শে পরবর্তীকালে বাংলা কাব্যের ধারা সম্প্রসারিত হয়েছে। কবিগণ তাঁদের কাব্যের উপাদান বাইরে থেকে সংগ্রহ করলেও সে সবের আবেদন সহজেই বাঙালি জনগণকে বিমুগ্ধ করেছে। সমুদ্র-তীরবর্তী চট্টগ্রামের সন্নিহিত রোসাঙ্গ রাজদরবারের সংশ্লিষ্ট কবিগণের মধ্যে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির যে সমন্বয় ঘটেছিল তার প্রভাবে বাংলা ভাষার মধ্যে এসেছে সমৃদ্ধি, সেই সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে এসেছে নতুন চেতনা। বাংলা সাহিত্যের গতানুগতিক ক্লান্তিতে, পুরনো বিষয় ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুবর্তনে রুদ্ধশ্বাস পরিবেশে রোসাঙ্গ রাজসভার কবিরা একটি নতুন বাতায়ন খুলে দিলেন। বস্তুতপক্ষে, এই কবিগণই মধ্য যুগে মানবিক প্রণয়কাহিনি পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দসম্পদে, ছন্দবৈভবে, পাণ্ডিত্যগর্বে ও ভাষার ঝঙ্কারে বাংলা সাহিত্যকে সুসমৃদ্ধ করে তুলেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!