শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের রাধাবিরহ কি প্রক্ষিপ্ত অংশ? আলোচনা কর।

রাধাবিরহ কি প্রক্ষিপ্ত?

শ্রীকৃষ্ণের বংশীধ্বনিতে উন্মাদিনী রাধার কৃষ্ণ-অদর্শন জনিত হাহাকার বিরহ পর্যায়ে এসে তীব্রতর হয়েছে। কৃষ্ণ আজ কর্তব্য পালনার্থে মথুরা নগরীতে, অন্যদিকে রাধার প্রাণ কৃষ্ণবিহনে ওষ্ঠাগত। শ্রীরাধিকা কৃষ্ণের এমন আচরণের জন্য ক্ষোভ উগরে দিয়েছে। দূতী বড়াই এখানে তার একমাত্র অবলম্বন, প্রাণের দোসর। মাসের পর মাস অতিবাহিত হচ্ছে অথচ কৃষ্ণ ফিরে আসছে না। এমন হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে রাধার প্রাণ ধারণ অসম্ভব হয়ে উঠছে। কদম্বতলে কৃষ্ণতনুতে নিশ্চিন্তে ঘুমের মাঝে কৃষ্ণ না বলে মথুরা গমন করেছে। নিদ্রাভঙ্গে সেই রাধা বিরহ-সমুদ্রে নিমজ্জিতা।

সমগ্র শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের অন্তিম অংশ ‘রাধাবিরহ এই অংশটি নিয়ে একটি প্রশ্ন উঠে আসে তা হল ‘রাধাবিরহ’ কি প্রক্ষিপ্ত? সমগ্র কাব্যের প্রতিটি অংশে বা অধ্যায়ে ‘খণ্ড’ শব্দটি যুক্ত কিন্তু রাধাবিরহে এসে ‘খণ্ড’ শব্দটি বিযুক্ত। তাই এত প্রশ্ন চিহ্ন। এছাড়াও আরো কয়েকটি দিক নিয়েও প্রশ্ন আছে যা আলোচনা করা হবে এই অংশে। শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘রাধাবিরহ’ প্রক্ষিপ্ত কিনা সে বিষয়ে নানা মুনির নানা মত। সমালোচকগণ মনে করেন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের ‘রাধাবিরহ ছাড়া বাকি ১২টি অধ্যায়ে ‘খণ্ড’ শব্দটি যুক্ত। রাধাবিরহের ক্ষেত্রে ‘খণ্ড’ শব্দটি যুক্ত হয়নি তাই এটি স্বতন্ত্রকাব্য। এ প্রসঙ্গে বিমানবিহারী মজুমদার বলেছেন—“যে বড়াই প্রথম হইতে রাধা কৃষ্ণের মিলনে দূতীগিরি করিতে ছিলেন, এ বড়াই যেন সে বড়াই নয়। এ বড়াই কৃষ্ণ ‘কিবা রূপ ধরে’,তা জানেন না। স্বভাব-চরিত্রেরও দেখি এ বড়াই রাধার প্রতি অত্যন্ত স্নেহশালিনী। পূর্বখণ্ডে তিনি কৃষ্ণের কুট্টিনী মাত্র।’’

রাধা কৃষ্ণের মিলন সম্পর্কে বলা হয়েছে— ‘রাধাবিরহে’র পূর্বে একাধিকবার রাধা-কৃষ্ণের মিলন ঘটেছে কিন্তু ‘রাধাবিরহে’র বিরহ চিত্র দেখলে তা মনে হয় না।

ভাষার ক্ষেত্রে অনেকে মনে করেন পূর্বখণ্ডগুলি থেকে বিরহের ভাষা আধুনিক! বিমান বিহারী বাবু দেখিয়েছেন— “ইহাতে ‘রাধিকা কাহ্নঞির সঙ্গে আছে’র মতন আধুনিক ভাষাও পাওয়া যায়।’

‘নবলক্ষকড়ী’ ও শতপল ‘সোনা’ নিয়েও বিতর্ক বর্তমান। এছাড়া ভণিতা অংশ নিয়েও বিতর্কের ঝড় উঠেছে। ভণিতাগুলি—

গাইল বড়ু চন্ডীদাস বাসলী বরেল।

বাসালী শিরে বন্দী চন্ডীদাস গাএ।

গাইল চন্ডীদাসে।

গাইল বড়ু চন্ডীদাস বন্দিআঁ বাসলী চরণে।

এ সকল ক্ষেত্রে কোন অবান্তর বিষয় চোখে পড়ে না। বানান, শব্দ লিপিকরদের হাতে পরিবর্তিত বা ছেড়ে যেতে পারে তার কারণে প্রক্ষিপ্ত বলা সঙ্গত নয়।

শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের পুথিতে ‘কালীয়দমনখণ্ডে’র পরবর্তী খণ্ডটির নাম ছেড়ে গেছে। বসন্তরঞ্জন রায় এই খণ্ডের নামকরণ করলেন—যমুনাখন্ড’। রাধাবিরহের ক্ষেত্রে পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি বা লিপিকরদের হাতে ছাড়ে যেতে পারে। ‘রাধাবিরহের’ পূর্বে ত্রয়ী চরিত্রের কথোপকথন শুনে মনে হয় যে তাদের (রাধা-কৃষ্ণের) মিলন ঘটেছে। রাধাবিরহের অনেকস্থানে তার প্রসঙ্গ রয়েছে। স্বপ্নস্মৃতিমেদুর পথে তার এক আলেখ্য—

দেখিলোঁ প্রথম নিশী সপন সুন তোঁ বসী।

সব কথা কহি আরোঁ তোষারে হে।।

এছাড়া প্রতিটি খণ্ডের শুরুতে পূর্ববর্তী খণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষাসূচক প্রসঙ্গ দেখা যায়। কিন্তু রাধাবিরহে দেখা যায়—

বসিআঁ কদম্বতলে সে কৃষ্ণ করিল কোলে

চম্বিল বদন আন্ধারে হে।

এছাড়া অন্যান্য খণ্ডেরও পূর্বকর্মের ঘটনা থেকে বোঝা যায় একটা পরম্পরা যুক্ত এই ‘রাধাবিরহ অংশটি।

রাধাবিরহের ভাষা অন্যান্য খণ্ডগুলির মতোই। এই খণ্ডটির ভাষা আধুনিক— এই কথা সঠিক নয়। ভণিতার ক্ষেত্রে যে আটটি উল্লেখ আছে তার মধ্যে পাঁচটি উল্লেখ অন্যান্য খণ্ডে দেখা যায়। তাই বলা যায় ‘রাধাবিরহ’ শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। চরিত্র, ভণিতা, ভাব, ভাষা, রাগ-রাগিণী সংস্কৃত শ্লোক, ছন্দ ধ্রুবপদ’ সব কিছু বিচার করে ‘রাধাবিরহ’কে প্রক্ষিপ্ত বলে পৃথক করা অসম্ভব।

তথ্যসূত্র: