//
//

বাংলা নাটকের ইতিহাসে রামনারায়ণ তর্করত্নের অবদান আলোচনা কর।

রামনারায়ণ তর্করত্ন

মধুসুদনের পূর্বে বাংলা নাটকের প্রস্তুতিপর্বে নাটক রচনায় যাঁর খ্যাতি তিনি হলেন নাটুকে রামনারায়ণ (১৮২২-১৮৮৬)। রামনারায়ণ তর্করত্ন বাস্তব ও সরস নাটক রচনার জন্য ‘নাটুকে রামনারায়ণ’ নামে জনপ্রিয়তা লাভ করেছিলেন। রামনারায়ণ মূলত সামাজিক সমস্যামূলক নাটক রচনা করলেও পৌরাণিক ও প্রহসন রচনায় তাঁর খ্যাতি যথেষ্ট। তাঁর নাটকের প্রধান সম্পদ হল হাস্যরসের উপস্থাপনা। তাঁর ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) প্রথম বাংলা সামাজিক নাটক হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে।

রামনারায়ণ সমাজসচেতন নাট্যকার ছিলেন। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রভাবে আমাদের সমাজে যে সংস্কারবাদ বনাম প্রগতিবাদের সংকট দেখা দেয় সে বিষয়ে যারা সক্রিয় ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামনারায়ণ। তিনি প্রাচীনপন্থী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত সমাজে জন্মগ্রহণ করলেও মানসিকতায় ছিলেন প্রগতিবাদী। কৌলীন্য প্রথা, বিধবা বিবাহ ও সতীদাহ প্রথা প্রভৃতি সম্পর্কে রামনারায়ণের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সমকালীন নবজাগ্রত জীবনচেতনার অনুসারী।

নাট্যকারের রচিত নাটকগুলি হল—(ক) মৌলিক নাটক— কুলীনকুলসর্বস্ব (১৮৫৪), ‘নবনাটক’ (১৮৫৬), ‘স্বপ্নধন’ (১৮৭৩), ‘ধর্মবিজয়’ (১৮৭৫), ‘রুক্মিণী হরণ’ (১৮৭১), ‘কংসবধ’ (১৮৭৫)। (খ) প্রহসন—‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ (১৮৬৫), ‘উভয়সঙ্কট’ (১৮৬৯), ‘চক্ষুদান’ (১৮৬৯)। (গ) নাট্যানুবাদ—‘বেণীসংহার’ (১৮৫৬), ‘রত্নাবলী’ (১৮৫৮), ‘অভিজ্ঞান শকুন্তল’ (১৮৬০), ‘মালতীমাধব’ (১৮৬৭)।

রামনারায়ণের প্রথম নাটক ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’। এই নাটকে নাট্যকার কৌলীন্য প্রথার দোষ ও অসঙ্গতিকে উপস্থাপিত করেছেন। এই নাটকের কাহিনি হল—এক কন্যাদায়গ্রস্ত ভদ্রলোক চার কন্যার যথেষ্ট বয়স হওয়া সত্ত্বেও তাদের বিবাহ দিতে সক্ষম হননি। শেষপর্যন্ত এক কুরূপ বৃদ্ধের সঙ্গে কন্যাদের বিয়ে দিতে বাধ্য হন। নাটকটি ছয় ভাগে বিভক্ত। চরিত্রগুলির নাম বেশ কৌতুকময়—অনৃতাচার্য, অধর্মচি, বিবাহবণিক, উদরপরায়ণ, বিবাহবাতুল, অভব্যচন্দ্র ইত্যাদি। চরিত্রের নামগুলি তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক। রামনারায়ণ এই নাটকে সংস্কৃত নাটকের অনুসরণ করেছেন। কৌলীন্য প্রথার ক্ষতিকারক দিক সম্বন্ধে রামনারায়ণ সচেতন ছিলেন বলেই কুলীনকুলসর্বস্ব’ নাটকের মাধ্যমে সমাজে তা তুলে ধরতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।

রামনারায়ণের ‘নবনাটক’ বহুবিবাহের বিষময় ফলকে প্রচার করার মানসে রচিত। ঠাকুরবাড়ির রঙ্গমঞ্চে ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারী তা অভিনীত হয়। নাটকটি ঠাকুরবাড়িতেই নয়বার অভিনীত হয়। ‘সোমপ্রকাশ’ পত্রিকায়ও এই অভিনয়ের প্রশংসা করা হয়। নাটকে রামনারায়ণ বৃদ্ধের দ্বিতীয়বার তরুণী ভার্যা বিবাহের কুফল দেখিয়েছেন। স্ত্রৈণ বৃদ্ধ পিতা ও নিষ্ঠুর বিমাতার অত্যাচারে এই নাটকে শোচনীয় অনেকগুলি মৃত্যু ঘটেছে। নাটকে গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি উপহার-পত্রে লেখা হয়েছে—“ইহা বহুবিবাহ প্রভৃতি বিবিধ কুপ্রথা নিবারণের নিমিত্ত সদুপদেশ সূত্রে নিবদ্ধ।’’ নাটকটি সংস্কৃত নাট্যরীতি অনুযায়ী রচিত। কাহিনির বুনুনি অনেকটা শিথিল। নানা টুকরো টুকরো ঘটনা মূল কাহিনিকে আচ্ছন্ন করেছে। অহেতুক বাগাড়ম্বর ও চরিত্রের অপ্রাসঙ্গিকতায় নাট্যরস ক্ষুণ্ন হয়েছে। সংলাপের মধ্যেও রয়েছে আড়ষ্টভাব। তবে হাল্কা কৌতুক রসের পরিবেশনায় নাট্যকারের কৃতিত্ব যথেষ্ট। সমকালীন সমাজজীবনের নানা বাস্তব চিত্রের উপস্থাপনায় নাটকটির গুরুত্ব সমধিক হলেও মূল কাহিনির রস নাটকটিতে দানা বাঁধেনি।

রামনারায়ণ কয়েকটি পৌরাণিক নাটক রচনা করেছিলেন। তার মধ্যে ‘রুক্মিণী হরণ’, ‘কংস বধ’ উল্লেখযোগ্য। রুক্মিণী হরণের কাহিনি রামনারায়ণ পুরাণ থেকে গ্রহণ করেছেন, তবে তা হুবহু অনুবাদমূলক নাটক নয়। নাট্যকার নতুন চরিত্র সৃষ্টি করে পৌরাণিক ঘটনাকে নাট্যরসোত্তীর্ণ করে তুলেছেন। পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে লৌকিক গুণের সমাবেশ করে বাস্তবরসে তাদের উজ্জ্বল করে তুলছেন। তাদের কথাবার্তা, হাবভাব আমাদের সমাজের অতি পরিচিত মানুষের মতোই ধনদাস চরিত্রের লোভ লালসা বেশ জীবন্তরূপে চিত্রিত।

অন্যদিকে ‘কংস বধ’ নাটকটি কংস কর্তৃক অক্রুরকে বৃন্দাবনে পাঠাও থেকেই নাটকের আরম্ভ এবং কংস বধ ও উগ্রসেনের পুনরায় সিংহাসন প্রাপ্তিতে নাটকের সমাপ্তি। সংলাপের ক্লান্তিকরতা ও আধ্যাত্মিক উচ্ছ্বাসের জন্য এই নাটকটি খুব একটা উল্লেখযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি।

সংস্কৃত নাটকের অনুসরণে অনুবাদমূলক নাটক রচনায়ও রামনারায়ণ সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তার মধ্যে ‘রত্নাবলী’, ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ উল্লেখযোগ্য। ‘রত্নাবলী’ নাটকটি চার অঙ্কে বিভক্ত। নাটকটি শ্রীহর্ষের ‘রত্নাবলী’-র অনুবাদ। এটি বেলগাছিয়া নাট্যশালায় ১৮৫৮ সালে অভিনীত হয়েছিল। এই নাটকের অভিনয় দেখেই বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের আবির্ভাব। ‘রত্নাবলী’ নাটকে দৃশ্যের নাম যেমন ‘প্রকরণ’ তেমনি ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলা’ নাটকের দৃশ্যের নাম ‘প্রস্তাব’। এটি সাত অঙ্কে রচিত। ‘রত্নাবলী’ নাটকের থেকে এই নাটকের নাটাগুণ উন্নততর।

‘কুলীনকুলসর্বস্বে’র সাফল্যে রামনারায়ণ কয়েকটি প্রহসন রচনায় ব্রতী হয়েছিলেন। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’, ‘উভয়সঙ্কট’, ‘চক্ষুদান’। এই প্রহসনগুলি রচনার উদ্দেশ্য ছিল সমাজসংস্কার। এজন্য উনিশ শতকের সমাজ সংস্কারের স্রোতে তার এই প্রহসনগুলি বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।

‘যেমন কর্ম তেমনি ফল’ প্রহসনের বিষয় লাম্পট্যের লাঞ্ছনা। এটি দুই অঙ্কে বিভক্ত। এর সঙ্গে দীনবন্ধুর ‘নবীন তপস্বিনী’র কাহিনির মিল রয়েছে। পরস্ত্রীর প্রতি অবৈধ আসক্তি এবং তার হাস্যকর শাস্তি নিয়ে প্রহসনটি রচিত। কৌতুকরস সৃষ্টির ক্ষেত্রে, জলধর চরিত্র নির্মাণে ও নাগর যুগলের করুণ পরিণামের চিত্রণে নাট্যকারের কৃতিত্ব প্রশংসনীয়।

‘উভয়সঙ্কট’ প্রহসনে সপত্নীসমস্যা রূপায়িত হয়েছে। বিষয়বস্তুর উপর পরিহাস মিগ্ধ আলোকপাতের মাধ্যমে কৌতুকরস সৃষ্টির প্রয়াস প্রহসনটির মধ্যে লক্ষ করা যায়। বড় বউ, ছোটট বউ ও গয়লানী চরিত্রসৃষ্টিতে রয়েছে বাস্তবতার নিদর্শন।

‘চক্ষুদান’ প্রহসনে স্ত্রীর কৌশলে স্বামীর লাম্পট্যবিধির চিকিৎসা বর্ণিত হয়েছে। স্বামী নিকুঞ্জবিহারী স্ত্রীর প্রতি অবহেলা করে অন্য নারীতে আসক্ত। স্ত্রী বসুমতী একদিন এক ছলনার আশ্রয় নিয়ে স্বামীর মনে নব চেতনার সঞ্চার করতে পারল। নিকুঞ্জবিহারীর মাধ্যমে সমকালীন সমাজের পুরুষের লাম্পট্যকে নাট্যকার দেখাতে চেয়েছেন।

নাট্যকার রামনারায়ণের কৃতিত্ব

  • সমকালীন সামাজিক নানা ব্যাধিকে কেন্দ্র করে রামনারায়ণ নাটক রচনায় ব্রতী। সছিলেন। এই সামাজিক দায়বদ্ধতা রামনারায়ণকে দিয়েছে মর্যাদা।
  • শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে— “রামনারায়ণ তর্করত্নের কুলীনকুলসর্বস্ব’ (১৮৫৪) প্রথম সার্থক নাটকের গৌরব দাবি করতে পারে। ইহাতে লেখক পুরাণ ও পরাণুকরণ ছাড়িয়া সর্বপ্রথম বাস্তব সামাজিক জীবনে পদক্ষেপ করিয়াছেন।” (বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা-১৯৬৩, পৃঃ-৩৩)।
  • পাইকপাড়ার দুই জমিদার ভাই ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের উদ্যোগে তাদের বাগানবাড়িতে ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ‘রত্নাবলী’ নাটকের যে অভিনয় হয়েছিল তা বাংলা নাটক রচনায় মধুসূদনের আগমনকে প্রসারিত করেছিল। এছাড়া জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির রঙ্গমঞ্চে তাঁর ‘নবনাটক’ অভিনীত হয়েছিল। ফলে বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিকাশে রামনারায়ণের নাটকগুলির বিশেষ গুরুত্ব স্বীকৃত।
  • অনুবাদমূলক নাটক ও প্রহসন রচনা করে বাংলার মানুষের নাট্যপিপাসা চরিতার্থ করবার ক্ষেত্রে প্রাক্-মধুসূদন নাট্যপর্বে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!