শাক্ত পদাবলি রচনায় রামপ্রসাদ সেনের কৃতিত্ব আলোচনা কর।
রামপ্রসাদ সেন
প্রাগাধুনিক বাংলা গীতিসাহিত্যের যে ইতিহাসের সূচনা হয়েছিল চর্যাগীতিকায়, তার পরিণতি রামপ্রসাদ-কমলাকান্তের গীতিসাধনায়। গীতিপ্রধান বাংলা সাহিত্য বৈষ্ণব পদাবলীতে তার সমুন্নতির শিখরদেশ স্পর্শ করেছিল, যার অবক্ষয় শুরু হয় সপ্তদশ শতাব্দীর উপান্তে। বাঙালির সমাজ-ইতিহাসের সেই দিনগুলি গভীরভাবে মসীলিপ্ত হওয়ায় সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রতীকরূপী গীতিসাহিত্যে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতার অবসান ঘটালে রামপ্রসাদ। পাঁচালী- কীর্তনের ক্লান্ত পৌনঃপুনিকতায় সহসা প্রসাদী সুর এক নতুন মাত্রা যোজনা করল। দেবতা ও ভক্তের মধ্যে ব্যবধান ঘুচিয়ে রামপ্রসাদই প্রথম বিশ্ববিধানের নিয়ন্ত্রীশক্তির সঙ্গে লাবণ্যামৃত মাখিয়ে তাকে “মা’’ বলতে শেখালেন, রামপ্রসাদ রচিত পদাবলিতে প্রথম সন্তানের বাৎসল্যে ও স্নেহের কারাগারে জগজ্জননী বন্দি হলেন। এইভাবেই অষ্টাদশ শতকে সেই বিড়ম্বিত সময়ে রুদ্ধবাক সমাজের বেদনার মুহূর্তগুলি রামপ্রসাদের গানে ভাষা পেল।
শাক্ত পদাবলির শ্রেষ্ঠ কবির জন্ম হয়েছিল হালিশহরের কুমারহট্ট গ্রামে। সঠিক সালটি জানা না গেলেও অনুমিত হয় অষ্টাদশ শতাবীর প্রথম দিকে (১৭ ২৩-১৭২৫ খ্রিস্টাব্দ) তাঁর আবির্ভাব। তাঁর জীবন সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। বিদ্যাসুন্দর কাব্য সম্ভবত তার যৌবন সীমান্তের রচনা। কোন স্বাধীন জীবিকা নয়, উচ্চবর্ণের অধীনে চাকরি গ্রহণের মাধ্যমে তার বৃত্তি-জীবনের সূত্রপাত। জীবনীকার চাকুরি গ্রহণের কারণ হিসেবে তার পারিবারিক অবস্থা বিপর্যয়কে দায়ি করেছেন। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক ভাগ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে রামপ্রসাদের চাকুরি গ্রহণের যোগ আছে বলেই মনে হয়। অষ্টাদশ শতকের বাংলাদেশের গ্রামে স্বাধীন বৃত্তি ও কৃষিতন্ত্রের অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। গ্রামীণ জীবনের এই পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যবিত্তকে নগরাভিমুখীন করে তোলে। কিন্তু যে নগরাভিমুখীন মধ্যবিত্ত শ্রেণী পুরনো জীবনের স্মৃতি ভুলতে পারেনি, রামপ্রসাদ সেই শ্রেণীর প্রতিনিধি। স্বভাবতই তাঁর কাব্যে বিষয়ান্তরিত জীবনের ব্যর্থতা প্রকাশ পেয়েছে নিম্নের পংক্তিগুলিতে—
মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব জমিন রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।
রামপ্রসাদের প্রতিভার চরম স্ফূর্তি আগমনী-বিজয়ার গানে না হলেও সাধারণভাবে এ পদগুলির গুণগত উৎকর্ষ এবং কাব্যমূল্য অস্বীকার করা যায় না। আগমনী-বিজয়া গানে পৌরাণিক কাহিনী আশ্রয় করে বাঙালি কবিরা বাৎসল্য রসের যে উৎসার ঘটিয়েছেন তা তুলনাহীন। মাতা-কন্যার মিলন-বিরহের খণ্ড খণ্ড চিত্র রচনায় রামপ্রসাদের কিছু পদ অতুলনীয়। বহুদিন পরে উমার পিতৃগৃহে আগমন, দীর্ঘ অনশনের পর মাতা-কন্যার মিলন মুহূর্তটির বর্ণনায় রামপ্রসাদ অসাধারণ কবিত্বশক্তির পরিচয় দিয়েছেন—
পুনঃ কোলে বসাইয়া, চারুমুখ নিরখিয়া,
চুম্বে অরুণ অধরে।
বলে জনক তোমার গিরি, পতি জনম ভিখারি
তোমা হেন সুকুমারী দিলাম দিগন্বরে।
রামপ্রসাদের আগমনী-বিজয়া সঙ্গীতে আছে মাতৃহাদয়ের বেদনা এবং তৎকালীন সমাজচিত্র। আর এ সব কিছুর প্রকাশ ঘটেছে অত্যস্ত সহজ-সরল ভাষায়।
রামপ্রসাদের শ্রেষ্ঠত্ব অবশ্য সাধনা-আশ্রয়ী পদগুলির জন্যে। এই পদগুলির মধ্যেই রামপ্রসাদের প্রতিভার যথার্থ বিকাশ ঘটেছে। এর কারণ কবিসত্তা ছাড়া রামপ্রসাদ আর একটি সত্তার অধিকারী ছিলেন, সাধকসত্তার। ব্যক্তিজীবনে রামপ্রসাদ ছিলেন তন্ত্রসাধক। তন্ত্র মতে ভোগ না করলে ত্যাগ হয় না। রামপ্রসাদ জন্মান্তরে বিশ্বাসী ছিলেন এবং জন্মজন্মান্তরে দুঃখভোগের কারণস্বরূপ কর্মফলবাদকেই স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য তন্ত্রসাধনার কাব্যরূপায়ণ-ই রামপ্রসাদের উদ্দিষ্ট ছিল না। ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদে দেখা যায় রামপ্রসাদের একমাত্র আকুতি কোন পার্থিব সম্পদ অথবা মুক্তি-আকাঙ্ক্ষা নয়, মায়ের অভয় চরণ-ই তার একমাত্র কাম্য। জীবনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে কাব্য রচনা করায় বাস্তব জীবনের সুখ-দুঃখের বিচিত্র মূর্চ্ছনা তাঁর কাব্যে আধ্যাত্মিক সাধনার সুরে বিচিত্র ঝঙ্কার তুলেছে—
জাঁক-জমকে করলে পূজা, অহঙ্কার হয় মনে মনে।
তুমি লুকিয়ে তারে করবে পূজা, জানবে নারে জগজনে।।
ধাতু পাষাণ মাটির মূর্তি, কাজ কি রে তোর সে গঠনে।
তুমি মনোময় প্রতিমা করি, বসাও হৃদি-পদ্মাসনে।।
এই সহজ ভাবের সাধনার জন্যেই তাঁর সৃষ্টি সহজেই কানের ভিতর দিয়ে মরমে প্রবেশ করে। প্রসাদী-সঙ্গীত তৎকালীন সমাজ-মানসের প্রাণরসে সঞ্জীবিত। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে গোষ্ঠী- জীবনাশ্রিত ধর্মভাবকে অবলম্বন করে ব্যক্তি মানসের মন্ময়তার প্রথম মুক্তির পথ উৎসারিত হয়েছিল রামপ্রসাদের সমাজপ্রিয় কবিব্যক্তিত্বের আত্মলীন উপলব্ধির মধ্যে। ভক্তিই মানব-মনের চঞ্চলতা ঘুচিয়ে তাকে সাধনপথে অগ্রসর হবার প্রেরণা দেয়, ভক্তির পথে অগ্রসর হতে পারলে তবেই জীব কর্মের বন্ধন ছিন্ন করতে পারে। কর্মের বন্ধন ছিন্ন করতে পারলে ভবচক্রের অধীন হয়ে তাকে ক্রমাগত দুঃখ-দুর্দশা বহন করতে হয় না। দেহস্থ ষটচক্রের ভেদ ঘটিয়ে সহস্রারে শিব-শক্তির মিলন ঘটাতে পারলেই মুক্তিলাভ ঘটে, এই তত্ত্বটি রামপ্রসাদের পদে সুন্দরভাবে প্রকাশিত—
প্রসাদ বলে, ব্রহ্মময়ী কর্মডুরি দেনা কেটে
প্রাণ যাবার বেলা এই কর মা, ব্রহ্মরন্ধ যায় যেন ফেটে।
এই সবই সাধনতত্ত্বের কথা। কিন্তু উপমার সার্থক চয়নে (“চিত্রের পদ্মেতে পড়ে ভ্রমর ভুলে রলো”) শব্দের যথাযথ ব্যবহারে রামপ্রসাদের সাধনতত্ত্ব বিষয়ক পদগুলি লোকায়ত জীবনের অঙ্গীভূত হয়ে যথার্থ কাব্য হয়ে উঠেছে। এবং এইখানেই রামপ্রসাদের ‘সাধক কবি’ অভিধা নিঃসন্দেহে সার্থক।
রামপ্রসাদের চিস্তা-চেতনার জগৎ বাংলাদেশের গ্রাম্য পরিবেশ, কৃষিক্ষেত্র, জাল যোগে মাছ ধরা, পাশাখেলার আসর, আর তার সঙ্গে আছে অষ্টাদশ শতকের অত্যাচার অরাজকতা। রামপ্রসাদের কাব্যে জমি, মানবচিত্ত, পেয়াদা, পাইক, কলুর বলদ ইত্যাদি শব্দগুলি সাধনার সঙ্কেত-রূপী শব্দ হিসেবে ব্যবহৃত। কবি হিসেবে রামপ্রসাদের বৈশিষ্ট্য মাতৃ-আরাধনার বিশিষ্ট ধর্মপদ্ধতিকে মাতা ও সন্তানের বাৎসল্য-প্রতিবাৎসল্যের কাঠামোয় স্থাপন করা, মায়ের প্রতি সন্তানের মান-অভিমানের সূত্রটিকে প্রত্যক্ষ করানো। অবশ্য মায়ের প্রতি রামপ্রসাদের অভিযোগগুলি অনেকটাই বাহ্যিক, তার মধ্যে একটা ছদ্ম কোপ থাকলেও মাতৃ-নির্ভরতা কখনই অন্তর্হিত হয়নি। তাই তিনি বলেছেন—
মা, নিম খাওয়ালে চিনি বলে, কথায় করে ছলো।
ও মা, মিঠার লোভে, তিত মুখে সারাদিনটা গেল।।
কিন্ত দিনের শেষে তিনিই বলেন—
রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায় যা হবার তা হলো।
এখন সন্ধ্যাবেলায়, কোলের ছেলে, ঘরে নিয়ে চলো।।
অন্য একটি পদে—
কুপুত্র অনেক হয় মা, কুমাতা নয় কখনতো।
রামপ্রসাদের এই আশা মা, অন্তে থাকি পদানত।
কোনো অবস্থাতেই তিনি জননীর প্রতি আস্থা হারাননি।
অষ্টাদশ শতাব্দীর সর্বাত্মক হতাশায় যখন সবকিছুর মধ্যে সংশয় চিহ দেখা দিতে শুরু করেছে, অবিশ্বাসের প্রবল অভিঘাতে যখন জীবনের মূল্যবোধগুলি ভেঙ্গে পড়ছে তখন মাতৃপ্রসাদের প্রতি আস্থায় রামপ্রসাদ ধ্রুবতাবার মতো নিশ্চল থেকেছেন। এই কারণে রামপ্রসাদের গীতিপ্রতিভা দীর্ঘ দুই শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষের কাছে তার সার্বিক আবেদন পৌঁছে দিতে পেরেছে। রামপ্রসাদের গানকে তাই মৃত্তিকাঘনিষ্ঠ জীবনের সকল প্রকার বৃত্তির মানুষ আপন সংস্কৃতির উত্তরাধিকাররূপে কণ্ঠে গ্রহণ করেছে। চণ্ডীদাস যেমন প্রেমকে বৈষ্ণবীয় বিশ্বাসের গণ্ডী থেকে মুক্ত করে নিখিল মানুষের অন্তরের সামগ্রী করে তুলেছিলেন, রামপ্রসাদও সেইরূপ বাৎসল্যকে সাধনার তপশ্চারণ ও মন্ত্রায়োজন থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে সর্বসাধারণের সামগ্রী করে তুলেছেন। এখানেই তাঁর সবচেয়ে বড়ো কৃতিত্ব।
Leave a Reply