//
//

রামায়ণে প্রতিফলিত তৎকালীন সমাজ-জীবনের পরিচয় দাও।

রামায়ণের সমাজ ও চরিত্র

সমালোচক শশিভূষণ দাশগুপ্ত রামায়ণের সমাজের প্রকৃতি সম্বন্ধে বলেছেন—“বাল্মীকির যুগ আরণ্য কৃষি সভ্যতার যুগ। তখন পর্যন্তও মানুষ বন কাটিয়া চারিদিকে নগর পত্তন করে নাই,—বনের সহিত জনপদের মিলন নিবিড় ছিল। এই জনপদজীবন ও আরণ্য জীবনের মিলনেই গড়িয়া উঠিয়াছিল ভারতের সভ্যতা ও সংস্কৃতি। এই মিলন ও মিলনজাত বৃহত্তর সমাজজীবনের পরিবর্তনের ইতিহাসই রহিয়াছে বাল্মীকির কাব্যে।” বলাবাহুল্য রামায়ণের সমাজ মূলত কৃষিভিত্তিক।

শুধু কৃষিভিত্তিক সমাজ নয় রামায়ণে তিনটি বৃহৎ সমাজের কথা পাওয়া যায়? (১) অযোধ্যার রঘুবংশ, (২) কিষ্কিন্ধ্যার বানর বংশ এবং (৩) লঙ্কার রাক্ষসবংশ। এই তিনটি বংশ আর্য, অনার্য এবং এর উভয়ের মধ্যবর্তী সমাজচিত্ৰই রামায়ণে চিত্রিত। প্রত্যেকটি সমাজে মনু প্রবর্তিত শাস্ত্র ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অমোঘ প্রভাব বিস্তৃত। যে রাবণ রক্ষোবংশের প্রধান নায়ক তিনি বেদান্ত শাস্ত্রে সুপণ্ডিত এবং অগ্নিহোত্রাদি কাজে নিষ্ঠাবান। বানরবংশে বালি ছিলেন পরম নীতিজ্ঞ, হনুমান সংস্কৃতজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ।

নরসমাজে রামচন্দ্র পিতৃভক্ত, ভ্রাতৃবৎসল, পত্মীপ্রেমিক, আশ্রিতপালক, প্রজানুরঞ্জক। রামচন্দ্রের ‘প্রাণ ইবাপরঃ’ লক্ষ্মণ পুরুষকারের জীবন্ত প্রতিমূর্তি, আদর্শভ্রাতা, আদর্শ দেবর, ভরত ভ্ৰাতৃভক্তির পলান্ন, ত্যাগের একাদর্শ, আর সীতা পাতিব্রত্যের পরাকাষ্ঠা, তাঁর পবিত্রতা অগ্নিশুদ্ধা।

রামায়ণের বানরসমাজ মানুষের মতো গোষ্ঠীবদ্ধ। মানুষের মতোই তাদের শিক্ষাদীক্ষা, পারিবারিক বন্ধন ও অনুভূতি। এই সমাজেই আছেন নলের মতো শিল্পী। সে সমাজের নেতা ছিলেন বীরবিক্রম বালি। তার পুত্র ধীমান অঙ্গদ, তার স্নেহের সহোদর সুগ্রীব। এই সুগ্রীবের সঙ্গে তার বিরোধ। বালি পুত্রবৎসল, পত্নীপ্রেমিক, পুত্রের নাম করতে করতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। হনুমান সর্বশাস্ত্রজ্ঞ ও প্রভুভক্তির আদর্শ। হনুমানের দাস্য ও সেবা রামায়ণে অমর হয়ে আছে।

রাক্ষসবংশের চিত্রও রামায়ণে চিত্রিত। এই রাক্ষস নরখাদক নয়। আদি রক্ষোবংশ ব্রহ্মর তামসসৃষ্টি। প্রাণিপুঞ্জের রক্ষার জন্য তিনি একদল প্রজা সৃষ্টি করলেন। ক্ষুধার কামনায় অস্থির হয়ে তারা ব্রহ্মাকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে ব্রহ্মা বললেন, রক্ষা কর। তারা বলেছিল ‘রক্ষামঃ’, তাই তারা রাক্ষস (উত্তরখণ্ড)। এই বংশের সন্তান মাল্যবান, মালী, সুমালী। এরা বিষ্ণু কর্তৃক পরাজিত হয়ে পাতাল আশ্রয় করেছিল। সুমালীর কন্যা কৈকসী পুলস্ত্যপুত্র মুনি বিশ্রবাকে পতিত্বে বরণ করেন। বিশ্ববা-কৈকসী থেকে রাবণের জন্ম। রাবণ বৈশ্রবণ রাক্ষস। এই বংশে অনার্যরক্তে আর্যরক্তের মিশ্রণ। রাবণ, ইন্দ্রজিৎ, বিভীষণ, মন্দোদরী, সরমা—সকলেই অনুভূতিসম্পন্ন ব্যক্তি। তাদের মধ্যে কেউ ধার্মিক, কেউ বা অধার্মিক— কেউ সংযত, শাস্ত্ৰপরায়ণ, আবার কেউ বা মদোদ্ধত, পরশ্রীকাতর ও পারলোভী।

রাক্ষস সমাজে আর্য ও অনার্য জাতির মিশ্রণ সুস্পষ্ট। রাক্ষস সমাজের প্রধান প্রতিনিধি রাবণ। রাবণের প্রধান ত্রুটি—বলদর্প, জিগীষা ও কামোন্মত্ততা। মেঘনাদ যুদ্ধবিদ্যায় নিপুণ, পিতৃভক্ত ও পরাক্রমশালী। বিভীষণ ধর্মশীল, জিতেন্দ্রিয়, স্বাধ্যায়সম্পন্ন ও বৃহস্পতিতুল্য জ্ঞানবান। মন্দোদরীর পতিপ্রাণতা অসাধারণ। অন্যদিকে অসাধারণ নারীচরিত্র সরমা। সরমা যখন মানস সরোবরতীরে জন্মগ্রহণ করেন, তখন বর্ষা হেতু সরোবরের জল বর্ধিত হওয়ায় জননী বলেছিলেন—‘সরো মা বর্ধত’— সরোবর আর বর্ধিত হয়ো না, তাই তার নাম সরমা।

সভ্যতার কোন মাহেন্দ্রক্ষণে— ভারতবর্ষের জীবন ও চৈতন্যকে এক নিবিড় অনুরক্তিতে—ছন্দের ললিত অবয়বে রূপদান করেছিলেন-আদি কবি বাল্মীকি। কালের বিস্তীর্ণ প্রান্তর অতিক্রম করে সে গভীর সুষমা-যুগে যুগে, রূপ হতে রূপে, প্রাণ হতে প্রাণে এসে দোলা দিয়েছে—একালের বুকে ও এক অমোঘ প্রত্যয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!