//
//

অসমীয়া সাহিত্যের ইতিহাসে লক্ষীনাথ বেজবড়ুয়ার কৃতিত্ব লেখ।

লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া

ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সংস্পর্শে এসে বাংলা ভাষার মত অসমীয়া ভাষারও নবদিগন্ত ও নবযুগ সূচিত হয়েছিল। প্রাচীন সাহিত্যভাবধারা তার পুরাতন খাত বদল করে সঞ্জীবিত হয়ে ওঠে। এই রূপান্তর অসমীয়া সাহিত্যের content ও form উভয় দিকেই লক্ষিত হয়। তাই ভাব, ভাষা, ছন্দো-নির্মাণ, বাক্‌রীতি সবেতেই নবজাগ্রত জীবনবোধের প্রতিফলন দৃষ্ট হল। এই সময়ের সাহিত্যে আশাবাদ ও আদর্শবোধের সমুন্নতি লক্ষ করা গেল। এই নবযুগের সাহিত্যিকেরা কেবল রাষ্ট্রিক পরাধীনতা থেকে মুক্তি নয়, একই সঙ্গে সামাজিক ও ধর্মীয় অনুশাসনের সংকীর্ণতার বন্ধন থেকেও মুক্তির স্বপ্ন দেখলেন। বাংলা ভাষা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার মতোই অসমীয়া সাহিত্যে ও কাব্যধারাতেও এই নবজীবনবোধের সূচনা লক্ষ করা গেল। এই যুগের কবিদের রচনায় তিনটি সাধারণ লক্ষণ দেখা গেল—
ক. পাশ্চাত্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির দ্বারা অনুপ্রাণিত হওয়া।
খ. সহজাত সৌন্দর্যবোধের প্রেরণা স্বদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতি এদের আকৃষ্ট করেছিল।
গ.স্বদেশের ঐতিহ্যের প্রতি মমত্ববোধ।
কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, ভোলানাথ দাস, লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া ছিলেন এই যুগের প্রতিনিধিস্থানীয় কবি।
লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া (১৮৬৮-১৯৩৮) এই যুগের সাহিত্যিকদের মধ্যে ছিলেন শ্রেষ্ঠতম। তিনি কেবল কবিই ছিলেন না, সাহিত্যের বিবিধ শাখা—উপন্যাস, নাটক ও প্রহসন, জীবনীসাহিত্য, রম্যরচনা, শিশুসাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রেও তাঁর অবাধ বিচরণ ঘটেছিল। তাঁর হাতেই অসমীয়া সাহিত্য যেন নবরূপে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছে।
লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়ার পিতা দীননাথ বেজবড়ুয়া ব্রিটিশ সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। তাঁর মায়ের নাম ছিল ঠানেশ্বরী দেবী। কার্তিকমাসের লক্ষ্মীপূর্ণিমা তিথিতে তাঁর জন্ম হয়েছিল। আসামে থেকে স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি উচ্চশিক্ষার্থে কলকাতায় আসেন ও গ্র্যাজুয়েট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ঠাকুরবাড়ির প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়।
কলকাতায় থাকাকালীন সময়ে তাঁর সাহিত্যজগতে প্রবেশ ঘটে। চন্দ্রকুমার আগরওয়ালা, হেমচন্দ্র গোস্বামী প্রমুখের সঙ্গে তাঁর কলকাতায় থাকাকালীন সময়েই যোগাযোগ হয়। আসামে অসমীয়া ভাষা পুনঃস্থাপনের জন্য তাঁরা তিনজন ও অপরাপর সহপাঠীরা মিলে ‘অসমীয়া ভাষা উন্নতিসাধিনী সভা’ গঠন করেছিলেন। এই সভা ১৮৮৯ সালে ‘জোনাকি’ নামে একটি মুখপত্র প্রকাশ করেছিল। এই মুখপত্রের প্রথমবর্ষ, প্রথমসংখ্যায় লক্ষ্মীনাথের প্রহসন ‘লিতিকাই’ প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯০৯ সালে প্রকাশিত ‘বাহী আলোচনী’র তিনি সম্পাদক ছিলেন। এই পত্রিকার সূত্রেই তাঁর সাহিত্যচর্চা বিকশিত হয়েছিল। এছাড়াও তিনি একাধিক সাহিত্য পত্রিকা সমসাময়িক চেতনা, আলোচনী, অসম সাহিত্য সভা পত্রিকা, দৈনিক বাতরি, অসম বন্তি–প্রভৃতিরও সম্পাদনার কাজও করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যিক ছদ্মনাম ছিল কৃপাবর বড়ুয়া।
তাঁর রচিত সাহিত্যরচনাগুলির তালিকা এইরকম—ক. আত্মজীবনী ও জীবনীমূলক রচনা—মোর জীবন সোঁওরণ, মোর জীবন সোঁওরণ-২য় খণ্ড, ডাঙারীয়া দীননাথ বেজবরুয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনচরিত, শ্ৰী শ্ৰী শংকরদেব, শ্ৰী শ্ৰী শংকরদেব আরু মাধবদেব; খ. প্রবন্ধ—তত্ত্বকথা, শ্রীকৃষ্ণকথা, ভগবকথা; গ. উপন্যাস—পদুমকুয়ারী; ঘ. গল্প—সুরভি, সাধুকথার কুঁকি, জোনবিরি, কেহোঁকলি; ঙ. নাটক ও প্রহসন—লিতিকাই, নোমন, পাচনি, চিকরপতি-মিকরপাত, গদাধর রাজা, বারেমতরা,হযবরল, হেমলেত, মঙলা, চক্ৰধ্বজ সিংহ, জয়মতী কুঁয়রী, বেলিমার; চ. হাস্যরসাত্মক রচনা—কৃপাবর বরুয়ার কাকতর টোপোলা, কৃপাবর বরুয়ার ওভতনি, বরবরুয়ার বুলনি, বরবরুয়ার ভাবর বুরবুরণি (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড), বরবরুয়ার চিন্তার শিলগুটি,বরবরুয়ার সাহিত্যিক রহস্য, কৃপাবর বরুয়ার সামরণি; ছ, শিশুসাহিত্য—বুঢ়ী আইর সাধু; জ. অনুবাদ—ভারতবর্ষর বুরঞ্জী; ঝ. অন্যান্য—বাখর, কামত কৃতিত্ব লভিবর সংকেত, অসমীয়া ভাষা আরু সাহিত্য, পত্রলেখা, কাঁহুদী আরু খারলি, সম্পাদকর চরা। এছাড়াও তিনি ছিলেন অসম সাহিত্যসভার সভাপতি। তাঁর অবিস্মরণীয় সাহিত্যপ্রতিভার প্রতি সম্মাননা জ্ঞাপন করে তাঁকে ‘রসরাজ’ ও ‘সাহিত্যরথী’ উপাধি প্রদান করা হয়ছিল।
লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া রচিত কাব্যগুলিতে তাঁর সমকালীন যুগমানসেরই প্রকাশ ঘটিয়েছিল। লক্ষ্মীনাথের কবিতায় প্রেমভাবনা, নিসর্গভাবনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যায়। তাঁর রোমান্টিক চেতনায় বিশ্বাত্মবোধেরও সমাহার লক্ষ্য করা যায়। তিনি আপন কবিচেতনায় জীবনে সুখ ও দুঃখের অবিচ্ছেদ্য অবস্থান লক্ষ্য যেমন করেছেন, এই দুইয়ের যৌগপত্যেই জীবনকেও উপলব্ধি করেছেন। নিসর্গের বর্ণনায় তিনি প্রকৃতির রূপ, রস,রঙ ওশব্দের সমাহারে যে সুন্দরের আভাস আসে সেকথা বলেছেন। তাঁর স্বদেশী ভাবধারা পুষ্ট কবিতাগুলি স্বদেশীযুগে অসমীয়াদের মনে সাহস ও প্রেরণা জুগিয়েছিল। তাঁর কবিতায় অসমীয়া সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতি তাঁর সুগভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর এই পর্যায়ের কয়েকটি কবিতা হল, আমার জন্মভূমি, মোর দেশ, অসম সংগীত, বীণ–বরাগী প্রভৃতি। তাঁর লেখা গান ‘ও মোর আপন দেশ/ও মোর সুন্দর দেশ’ ১৯২৭ সালে অসম রাজ্যের রাজ্য সঙ্গীত রূপে স্বীকৃত হয়েছে। গানটির কথা হল এই রূপ, অ মোর আপনার দেশ/ অ মোর চিকুণী দেশ/ এনেখন শুরল/ এনেখন সুফলা..’। বহুজাতি ও উপজাতির মিলনভূমি অসমের অন্তরঙ্গ জীবনছবির সন্ধানে তিনি অসমের লোকজীবন থেকেও কাব্যের উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন। তাঁর ‘নিমাতি কন্যা’ একটি কথায় আঁকা চিত্র; ধানবর আরু রতনি’—গ্রাম্য তরুণ-তরুণীর প্রেমকাহিনী; “ কিনো আনিলি মানে ঐ বদন তাই’—যেটি বদন বরফুকনের দেশদ্রোহিতার কথা প্রচার করে। এই বদন বরফুকন আহোম রাজার মন্ত্রী থাকাকালীন ১৮১৬ সালে বর্মীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে আসাম আক্রমণের ব্যবস্থা করেন। আসামের জাতীয় জীবনের এক দুঃখ, বেদনা ও দুরপনেয় কলঙ্কের কাহিনী এই কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে।
লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া তিনটি ঐতিহাসিক নাটক ও চারটি হাস্যরসাত্মক লঘু নাটক লিখেছিলেন। তিনি মূলত তাঁর দেখা অসমীয়া জীবনের অসংগতি, ভুল–ভ্রান্তিকে এই রচনাগুলিতে শিল্পরূপ প্রদান করেছেন। ‘লিতিকাই’ তে তিনি মানুষের পরস্পরকে প্রতারণা, মিথ্যাচার, খলতাকে রসসমৃদ্ধরূপে প্রকাশ করেছেন। ‘পাচনী’তে পাচনীর অতিথি বৎসলতার বাড়াবাড়ি একটি চরম হাস্যকর অবস্থায় পৌঁছেছে। ‘নোমান’ কৌতুক নাটিকা নহর ফুটুকা নামে এক কুঁজো বৃদ্ধের হাস্যকরতার কাহিনী। ‘চিরপতি মিকরপাত’ দুইচোরের চুরির ফন্দিফিকির ও বিচার বিভাগের অপদার্থতার শ্লেষাত্মক কাহিনী। কৌতুকনাটিকা রচনায় লক্ষ্মীনাথের সহজাত দক্ষতার পরিচয় মেলে। চরিত্র, সংলাপ, কৌতুককর পরিস্থিতির নির্মাণে তিনি সত্যিই মুন্সীয়ানার পরিচয় রেখেছিলেন। এছাড়াও তিনি তিনিটি ঐতিহাসিক নাটকও লিখেছিলেন। জয়মতীকুমারী’ নাটকে রানী জয়মতী র স্বামী ও স্বদেশের জন্য আত্মোৎসর্গ বর্ণিত হয়েছে। ‘চক্রধরসিংহ’ নাটকে লাচিত বরফুকন কর্তৃক সরাইঘাটের যুদ্ধে মুঘল সেনাদের প্রতিহত করবার গৌরবোজ্জ্বল কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। ‘বেলিমার’ নাটকটি আহোমরাজাদের ক্রমাবনতির ইতিহাস, বর্মীদর আক্রমণে যার দুঃখদায়ী পরিণতি ঘটে। লক্ষ করার বিষয় এই যে, ঐতিহাসিক নাটক রচনার কালে তিনি ঘটনার ঐতিহাসিকতাকে বিকৃত করেননি। তিনি বরং ইতিহাসকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্যে, ঘটনা ও চরিত্রাবলীকে নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন। নাটকের মধ্যে তিনি বীরত্ব, স্বদেশপ্রেমকে নাটকীয় রূপেই দেখানোর চেষ্টা করেছেন। আসামের জাতীয়তাবোধের বিকাশে নাটকগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও উল্লেখ্য যে, তাঁর বেশ কিছু চরিত্রের নির্মাণে তিনি শেক্সপীয়রের প্রভাবকে স্বীকার করেছেন, যেমন, ‘চক্ৰধ্বজ’ নাটকের গজপুরিয়া ও প্রিয়রাম চরিত্রে শেক্সপীয়রের ‘চতুর্থ হেনরী’ নাটকের ফলস্টাফ ও প্রিন্স হলের ছায়াপাত ঘটেছে; ‘বেলিমার’ নাটকে ভুমুক বহুয়া এবং পিজয়ু চরিত্রে কিং লীয়রের দি ফুল ও অফেলিয়ার প্রভাব দেখা যায়। ‘পদুমকুয়ারী’—ব্যর্থ প্রেমকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা একটি বিয়োগান্তক উপন্যাস। উপন্যাসের মধ্যে প্রেমকাহিনীর আধারে তৎকালীন সামাজিক ও রাজনীতিক অবস্থার নিপুণ ছবি তুলে ধরেছেন লক্ষ্মীনাথ। উপন্যাসের চরিত্রায়ন অত্যন্ত জীবন্ত ও বাস্তবধর্মী হয়েছে।
হাস্যরসাত্মক রচনা গুলির ক্ষেত্রেও লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া আপন দক্ষতার সাক্ষ্য রেখেছেন। তিনি কৃপাবর বরুয়া ছদ্মনামে ও এই চরিত্রের অবলম্বনে এই লেখাগুলি লিখেছিলেন। রচনাগুলির মধ্যে অসমীয়া জীবনের রীতিনীতি, মিথ্যা ভুলের গ্লানি, দোষত্রুটিকে তুলে ধরেছেন। তবে লক্ষ্যণীয়, এই সমস্ত রচনার ক্ষেত্রে তিনি রসিকতার সূত্র ধরে কখনো শালীনতার সীমা অতিক্রম করে যাননি। লেখাগুলিতে সমকালীন সমাজ ও জীবনবোধের প্রকাশও ঘটেছিল। নিছক রঙ্গরসেই রচনাগুলি নিঃশেষিত হয় না, তা পাঠকের রসবোধ ও লোকচরিত্র জ্ঞানের বিকাশেও তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। এইসব কারণে উক্ত রচনাগুলির জনপ্রিয়তা আজও অক্ষুণ্ন আছে। সামগ্রিক বিচারে বলা যায়, আধুনিক অসমীয়া সাহিত্যের বিকাশে লক্ষ্মীনাথ বেজবড়ুয়া এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তিনি তাঁর ভিন্ন ভিন্ন স্বাদধর্মী রচনার দ্বারা আপন সৃষ্টিপ্রতিভার বহুমুখীনতাকেই প্রতিষ্ঠা করেননি, অসমীয়া সাহিত্যের প্রকাশক্ষমতাকেও বর্ধিত করে দিয়েছিলেন। আধুনিক অসমীয়া সাহিত্যের তিনিই ছিলেন প্রাণপুরুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!