লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল সম্পর্কে আলোচনা কর।
লোচনদাসের চৈতন্যমঙ্গল
চৈতন্যজীবনী কাব্য হিসাবে লাোচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের শাখা বিশেষের (‘গৌরনাগর’) তত্ত্ব, আদর্শ ও সাধনপ্রণালী এই কাব্যে বর্ণিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, সাধারণ বৈষ্ণব ভক্তদের কাছে এই গ্রন্থ আকর্ষণীয়। তৃতীয়ত, গ্রন্থটি সাধারণ মানুষের কাছে আকর্ষণীয় হওয়ার কারণ এই গ্রন্থ পাঁচালি, প্রবন্ধ ও মঙ্গলকাব্যের ধারা অনুসরণে গীত হত।
লোচনদাস বৃন্দাবনদাসের সমসাময়িক। তিনি তাঁর কাব্যে আত্মপরিচয় বিস্তৃতভাবে দিয়েছেন। তা থেকে জানা যায় বর্ধমান জেলার ‘কোগ্রামে’র বৈদ্যবংশে তার জন্ম। তার পিতার নাম কমলাকর এবং মাতা সদানন্দী। কবি পিতৃ ও মাতৃকুলের একমাত্র সন্তান—‘মাতৃকুলে পিতৃকুলে আমি মাত্র পুত্র।/সহোদর নাহি নাহি মাতামহের সূত্র।’ তিনি নরহরির শিষ্য ছিলেন।
কাব্যের রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্ক আছে। সতীশচন্দ্র রায়, দীনেশচন্দ্র সেন, মৃণালকান্তি ঘোষ, বিমানবিহারী মজুমদার প্রভৃতি বিশেষজ্ঞদের আলোচনা অনুসারে বলা যেতে পারে ১৫৫০ থেকে ১৫৬৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গ্রন্থটি রচিত হয়েছিল।
চৈতন্যমঙ্গল চারটি খণ্ডে বিভক্ত—সূত্র খণ্ড, আদি খণ্ড, মধ্য খণ্ড, শেষ খণ্ড। প্রায় এগার হাজার ছত্রে এই কাব্য রচিত। সূত্রখণ্ড—মঙ্গলকাব্যের বন্দনা ও দেখণ্ডের মতো। বিভিন্ন দেবদেবীর বন্দনা এবং চৈতন্য অবতারের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করা হয়েছে। আদি খণ্ডে চৈতন্যের জন্ম থেকে বয়ঃপ্রাপ্তি, গয়া গমন ও গয়া থেকে প্রত্যাবর্তন বর্ণিত হয়েছে। মধ্য খণ্ডে চৈতন্যের নবদ্বীপলীলা ও উৎকল লীলা স্থান পেয়েছে। শেষ খণ্ডে মহাপ্রভুর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণ, রায় রামানন্দের সঙ্গে মিলন, সেতুবন্ধ পর্যন্ত ভ্রমণ এবং পুরীতে প্রত্যাবর্তন, নীলাচলে অবস্থান ও চৈতন্যের অলৌকিক তিরোধান বর্ণিত হয়েছে।
মুরারি গুপ্তের কড়চার আদর্শে লোচন কাহিনি বিন্যস্ত করেছেন। লোকমুখে শোনা গল্প কাহিনিই তাঁর রচনার অন্যতম উপাদান। ‘শ্রীচৈতন্যভাগবত’ ও ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতম’-এ গৌরাঙ্গ ও বিষ্ণুপ্রিয়ার সম্পর্ক উপেক্ষিত হয়েছে। কিন্তু লোচনদাস সেই সম্পর্কের বর্ণনা দিয়েছেন। চৈতন্যাবতার গ্রহণের উদ্দেশ্য সম্বন্ধে লোচনদাস দুটি কারণের কথা। বলেছেন—
(এক) পাপময় কলিযুগে না দেখি নিস্তার লোকে
দয়া উপজিল প্রভূচিতে।
পালিব ভকতজন আর ধর্ম সংস্থাপন
জন্ম লভিব পৃথিবীতে।
(দুই) রাধাভাব অন্তরে রাধাবর্ণ বাহিরে।
অন্তর্বাহ্য রাধাময় হব।
সঙ্গে সখাসখীবৃন্দ আর ভক্ত অনন্ত
ব্রজভাবে অখিল মাতাব।।
চৈতন্যদেবের তিরোধান সম্পর্কে লোচনদাস নতুন তথ্য দিয়েছেন। তাঁর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, আষাঢ় মাসের সপ্তমী তিথিতে রবিবারে বেলা তৃতীয় প্রহরে মহাপ্রভু জগন্নাথ কলেবরে লীন হয়ে গিয়েছিলেন—
তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।
জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে।।
লোচনদাসের কবিত্ব শক্তি উন্নত মানের। গ্রন্থটির সহজ, সরল ভাব সাধারণ মানুষের বোধগম্য এবং ছন্দ মাধুর্যের জন্য স্বল্প শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কাব্যরস আস্বাদনের উপযোগী হয়েছে।
Leave a Reply